-নূর মোহাম্মদ মিলু
সে বললো- যদি আপনি নবীজীর নিকট যান তাহলে তিনি অবশ্যই আপনার সাথে তাঁর বিয়ে দিবেন।
আলী বলেন- আল্লাহর কসম! সে আমাকে এভাবে আশা-ভরসা দিতে থাকে। অবশেষে আমি একদিন নবীজীর নিকট গেলাম। তাঁর সামনে বসার পর আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। তাঁর মহত্ত্ব ও তাঁর মধ্যে বিরাজমান গাম্ভীর্য ও ভীতির ভাবের কারণে আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না।
এক সময় তিনিই আমাকে প্রশ্ন করলেন- কি জন্য এসেছ? কোন প্রয়োজন আছে কি? আলী বলেন- আমি চুপ করে থাকলাম। নবীজী বললেন- নিশ্চয় ফাতেমাকে বিয়ে প্রস্তাব দিতে এসেছ?
আমি বললাম- হ্যাঁ। তিনি বললেন- তোমার কাছে এমন কিছু আছে কি যা দ্বারা তুমি তাকে হালাল করবে? বললাম- আল্লাহর কসম, ইয়া রাসূলুল্লাহ! নেই।
তিনি বললেন- যে বর্মটি আমি তোমাকে দিয়েছিলাম সেটা কি করেছ?
বললাম- সেটা আমার কাছে আছে। আলীর জীবন যে সত্তার হাতে তার কসম, সেটা তো একটি ‘হুতামী’ বর্ম। তার দাম চার দিরহামও হবে না।
নবীজী বললেন- আমি তারই বিনিময়ে ফাতেমাকে তোমার সাথে বিয়ে দিলাম। সেটা তার কাছে পাঠিয়ে দাও এবং তা দ্বারাই তাকে হালাল করে নাও। আলী বলেন- এই ছিল ফাতেমার মাহর। (দালায়িল আন-নুবুওয়াহ্-৩/১৬০; উসুদুল গাবা-৫/২৫০; আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া-৩/৩৪৬; তাবাকাত-৮/১২)
আলী দ্রুত বাড়ি গিয়ে বর্মটি নিয়ে আসেন। কনেকে সাজগোজের জিনিসপত্র কেনার জন্য নবীজী সেটি বিক্রি করতে বলেন। (সহীহ আল-বুখারী, কিতাব আল-বুয়ূ; সুনানে নাসাঈ, কিতাব আন-নিকাহ; মুসনাদে আহমাদ-১/৯৩, ১০৪, ১০৮)
বর্মটি উছমান ইবন আফফান (রা) চারশ সত্তর (৪৭০) দিরহামে কেনেন। এই অর্থ নবীজীর হাতে দেয়া হয়। তিনি তা বিলালের (রা) হাতে কিছু আতর-সুগন্ধি কিনতে বলেন, আর বাকী যা থাকে উম্মু সালামার (রা) হাতে দিতে বলেন। যাতে তিনি তা দিয়ে কনের সাজগোজের জিনিস কিনতে পারেন।
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে নবীজী সাহাবীদের ডেকে পাঠান। তাঁরা উপস্থিত হলে তিনি ঘোষণা দেন যে, তিনি তাঁর মেয়ে ফাতেমাকে চাশ মিছকাল রূপোর বিনিময়ে আলীর সাথে বিয়ে দিয়েছেন। তারপর আরবের প্রথা অনুযায়ী কনের পক্ষ থেকে নবীজী ও বর আলী নিজে সংক্ষিপ্ত খুতবা দান করেন।
তারপর উপস্থিত অতিথি সাহাবায়ে কিরামের মধ্যে খোরমা ভর্তি একটা পাত্র উপস্থাপন করা হয়। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬০৭)
ফাতেমা ও আলীর বিয়েতে প্রদত্ত নবীজীর খুতবা। (জামহারাতু খতাব আল-আরাব-৩/৩৪৪)
‘সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর দান ও অনুগ্রহের কারণে প্রশংসিত, শক্তি ও ক্ষমতার জোরে উপাস্য, শাস্তির কারণে ভীতিপ্রদ এবং তাঁর কাছে যা কিছু আছে তার জন্য প্রত্যাশিত। আসমান ও জমিনে তিনি স্বীয় হুকুম বাস্তবায়নকারী।
তিনি তাঁর শক্তি ও ক্ষমতা দ্বারা এই সৃষ্টিজগত সৃষ্টি করেছেন, তারপর বিধি নিষেধ দ্বারা তাদেরকে পার্থক্য করেছেন, দীনের দ্বারা তাদেরকে শক্তিশালী করেছেন এবং তাঁর নবীজীর দ্বারা তাদেরকে সম্মানিত করেছেন। অতঃপর আল্লাহ বিবাহ ব্যবস্থাকে পরবর্তী বংশ রক্ষার উপায় এবং একটি অবশ্যকরণীয় কাজ করে দিয়েছেন।
এর দ্বারা রক্ত সম্পর্ককে একটির সাথে আরেকটি সংযুক্ত করে দিয়েছেন। এ ব্যবস্থা সৃষ্টি জগতের জন্য অবধারিত করেছেন।
যাঁর নাম অতি বরকতময় এবং যাঁর স্মরণ সুমহান, তিনি বলেছেন- ‘তিনিই পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন মানুষকে, অতঃপর তাকে রক্তগত বংশ ও বৈবাহিক সম্পর্কশীল করেছেন। তোমার রব সবকিছু করতে সক্ষম।’
সুতরাং আল্লাহর নির্দেশ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে ধাবিত হয়। প্রত্যেকটি চূড়ান্ত পরিণতির একটি নির্ধারিত সময় আছে। আর প্রত্যেকটি নির্ধারিত সময়ের একটি শেষ আছে। আল্লাহ যা ইচ্ছা বিলীন করেন এবং বহাল রাখেন। আর মূল গ্রন্থ তাঁর কাছেই রয়েছে।’
অতঃপর, আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন, আমি যেন, আলীর সাথে ফাতেমার বিয়ে দিই। আর আমি তাঁকে চার শো ‘মিছকাল’ রূপোর বিনিময়ে তার সাথে বিয়ে দিয়েছি- যদি এতে আলী রাজী থাকে।’
নবীজীর কুতবার পর তৎকালীন আরবের প্রথা-অনুযায়ী বর আলী ছোট্ট একটি খুতবা দেন। প্রথমে আল্লাহর হামদ ও ছানা এবং রাসূলের প্রতি দরূদ ও সালাম পেশ করেন। তারপর বলেন-
‘আমাদের এই সমাবেশ, আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন এবং তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন। আর বিয়ে হলো আল্লাহ যার আদেশ করেছেন এবং যে ব্যাপারে অনুমতি দান করেছেন। এই যে নবীজী আমাকে তাঁর কন্যা ফাতেমার সাথে চারশ আশি দিরহাম মাহরের বিনিময়ে বিয়ে দিয়েছেন। আমি তাতে রাজি হয়েছি। অতএব আপনারা তাঁকে জিজ্ঞেস করুন সাক্ষী হিসেবে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (প্রাগুক্ত-৩/৩৪৫)
এভাবে অতি সাধারণ ও সাদাসিধে ভাবে আলীর সাথে নবী দুহিতা ফাতেমার বিয়ে সম্পন্ন হয়। অন্য কথায় ইসলামের দীর্ঘ ইতিহাসের সবচেয়ে মহান গৌরবময় বৈবাহিক সম্পর্কটি স্থাপিত হয়।
সংসার জীবন
মদীনায় আসার পর রজব মাসে এ বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। আর হিজরি দ্বিতীয় সনে বদর যুদ্ধের পর আলী তাঁর স্ত্রীকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য একটি ঘর ভাড়া করতে সক্ষম হন। সে ঘরে বিত্ত-বৈভবের কোন স্পর্শ ছিল না। সে ঘর ছিল অতি সাধারণ মানের। সেখানে কোন মূল্যবান আসবাব পত্র, খাট-পালঙ্ক, জাজিম, গতি কোন কিছুই ছিল না।
আলীর ছিল কেবল একটি ভেড়ার চামড়া, সেটি বিছিয়ে তিনি রাতে ঘুমাতেন এবং দিনে সেটি মশকের কাজে ব্যবহার হতো। কোন চাকর-বাকর ছিল না। (আ‘লাম আন-নিসা -৪/১০৯; তাবাকাত-৮/১৩; সাহাবিয়াত-১৪৮)
আসমা বিনত উমাইস (রা) যিনি আলী-ফাকিসার (রা) বিয়ে ও তাঁদের বাসর ঘরের সাজ-সজ্জা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, তিনি বলেছেন, খেজুর গাছের ছাল ভর্তি বালিশ-বিছানা ছাড়া তাদের আর কিছু ছিল না। আর বলা হয়ে থাকে আলীর ওলীমার চেয়ে ভালো কোন ওলীমা সে সময় আর হয়নি।
সেই ওলীমা কেমন হতে পারে তা অনুমান করা যায় এই বর্ণনা দ্বারা- আলী তাঁর একটি বর্ম এক ইহুদীর নিকট বন্ধক রেখে কিছু যব আনেন। (তাবাকাত-৮/২৩) তাঁদের বাসর রাতের খাবার কেমন ছিল তা এ বর্ণনা দ্বারা অনুমান করতে মোটেই কষ্ট হয় না।
তবে বানূ আবদিল মুত্তালিব এই বিয়ে উপলক্ষে জাঁকজমকপূর্ণ এমন একটা ভোজ অনুষ্ঠান করেছিল যে, তেমন অনুষ্ঠান নাকি এর আগে তারা আর করে নি। সাহীহাইন ও আল-ইসাবার বর্ণনা মতে তাহলো, হামযা (রা) যিনি নবীজীর ও আলী উভয়ের চাচা, দুটো বুড়ো উট যবেহ করে আত্মীয়-কুটুম্বদের খাইয়েছিলেন। (তারাজিমু বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬০৭)
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে আগত আত্মীয়-মেহমানরা নব দম্পতির কল্যাণ কামনা করে একে একে বিদায় নিল। নবীজী উম্মু সালামাকে (রা) ডাকলেন এবং তাঁকে কনের সাথে আলীর বাড়িতে যাওয়ার জন্য বললেন। তাঁদেরকে একথাও বলে দিলেন, তাঁরা যেন সেখানে তাঁর (রাসূল) যাওয়ার অপেক্ষা করেন।
বিলাল এশার নামাজের আজান দিলেন। নবীজী মসজিদে জামাতের ইমাম হয়ে নামাজ আদায় করলেন। তারপর আলীর বাড়ি গেলেন। একটু পানি আনতে বললেন। পানি আনা হলে কোরানের কয়েকটি আয়াত তেলাওয়াত করে তাতে ফুঁ দিলেন।
সেই পানির কিছু বর-কনেকে পান করাতে বললেন। অবশিষ্ট পানি দিয়ে নবীজী নীচে ধরে রাখা একটি পাত্রের মধ্যে ওযু করলেন। সেই পানি তাঁদের দু‘জনের মাথায় ছিটিয়ে দিলেন। তারপর এই দোয়া করতে করতে যাওয়ার জন্য উঠলেন-
‘হে আল্লাহ! তুমি তাদের দু‘জনের মধ্যে বরকত দান কর। তুমি তাদের দু‘জনকে কল্যাণ দান কর। তাদের বংশধারায় সমৃদ্ধি দান কর।’ (আ‘লাম আন-নিসা’-৪/১০৯)
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, যাবার সময় তিনি মেয়েকে লক্ষ্য করে বলেন- ফাতেমা! আমার পরিবারের সবচেয়ে ভালো সদস্যের সাথে তোমার বিয়ে দেয়ার ব্যাপারে কোন ত্রুটি করিনি। (তাবাকাত-৮/১৫, ২৮)
ফাতেমা চোখের পানি সম্বরণ করতে পারেন নি। পিতা কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তারপর পরিবেশকে হালকা করার জন্য অত্যন্ত আবেগের সাথে মেয়েকে বলেন- আমি তোমাকে সবচেয়ে শক্ত ঈমানের অধিকারী, সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সবচেয়ে ভালো নৈতিকতা ও উন্নত মন-মানসের অধিকারী ব্যক্তির নিকট গচ্ছিত রেখে যাচ্ছি। (তারাজিমু সায়্যিদাতি বায়ত আন-নুবুওয়াহ্-৬০৮)
(চলবে…)
…………………………………
আরো পড়ুন:
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২