পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
-মূর্শেদূল মেরাজ
পঞ্চভূতের বিস্তার-
আকাশ:
পঞ্চভূতের সবচেয়ে সূক্ষ্ম ভূত হলো আকাশ বা মহাশূন্য। একে না দেখা যায়, না স্পর্শ করা যায়, না এর স্বাদ নেওয়া যায়, না অনুভব করা যায়। এই মহা অদৃশ্য তত্ত্বই হলো ব্যোম বা আকাশ। পঞ্চতত্ত্বের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম বলে এই তত্ত্ব সর্বব্যাপী বিরাজ করে।
সকল তত্ত্বের মাঝেই এর অবস্থান। আমরা আকাশ বলতে কেবল মাথার উপরে অনন্ত-সীমাহীন শূন্যতাকে বুঝি। তাই আকাশ বললেই মাথার উপর তাকিয়ে মেঘের শেষ সীমা দেখবার চেষ্টা করি। যদিও এই মহাকালের অনন্ত শূন্যতার সবটুকই আদতে আকাশ।
এই আকাশ ভূতের মাঝেই অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে সর্বদা ঘূর্ণয়মান অবস্থায় পৃথিবী নামক গ্রহ বিরাজ করছে। এই মহাশূন্যের মাঝে বিরাজ করা সকল কিছুই পারস্পরিক আকর্ষণ-বিকর্ষণের মাধ্যমে একে অন্যের মধ্যে নানা প্রভাব বিস্তার করে আছে।
আর এর ফেলে যে নানাবিদ শক্তি কার্যকর রয়েছে তার প্রভাব জীব-জড় সকলের মধ্যেও প্রভাব সৃষ্টি করে। আকাশের গুণ হলো ‘শব্দ’। আকাশ বা শূন্যতা; শূন্যতা থেকে ধ্বনি; ধ্বনি থেকে শব্দ।
আকাশের গুণ হলো- ‘শব্দ’। শব্দ কারো আশ্রয়ীভূত নন। তাকে আশ্রয় করে সবাই থাকে। আকাশ থেকেই কাম, ক্রোধ, লোভ, লজ্জা, মোহ প্রভৃতির সৃষ্টি ও অবস্থান। আকাশের স্থিতি জীব কান দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে।
শব্দের আবার দুটি ভাগ। একটি শ্রুতি বা শোনা। আর অন্যটি হলো বাক্ বা বাক্য অর্থাৎ বলা। আর এই শব্দের দুই ভাগে দুটি গুণের ভিন্ন রূপ। একটি সত্ত্বগুণ আর অপরটি রজগুণ রূপ-
- সত্ত্বগুণ রূপ-
- সত্ত্বগুণী আকাশের যে ভাগ তা শ্রুতি বা শোনা।
- শ্রবণ যে ইন্দ্রিয় তা আকাশেরই সত্ত্বগুণ।
- রজগুণ রূপ-
- রজগুণী আকাশের যে ভাগ, তা বাক্ বা বাক্য অর্থাৎ বলা।
- জিহ্বা যে ইন্দ্রিয় তা আকাশেরই রজগুণ রূপ।
[শ্রুতি আর বাক্যের মাঝে মিত্রতাও আছে। তাই দেখা যায় জন্মগতভাবে যে বধিত সে কানে শুনতে পায় না। আবার যে কানে শুনতে পায় না সে বধির। বলা এবং শোনা অর্থাৎ জিহ্বা ও কান পরস্পর সম্পর্কযুক্ত।]
বাতাস:
আকাশ তত্ত্ব থেকে আরেকটু কম সূক্ষ্ম ভূত হলো মরুৎ বা বাতাস। বাতাসকে চর্মচক্ষুতে প্রত্যক্ষ করা না গেলেও, তাকে অনুভব করা যায়। নির্ণয় করা যায় বায়ুর উপস্থিতি। আর এই বায়ু ধারণ করেই অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের মধ্য দিয়েই জীব বেঁচে থাকে। সম্পর্ক তৈরি করে প্রকৃতির সাথে। বায়ুহীন অবস্থায় জীব জীবন ধারণ করতে পারে না।
এই বায়ু মূলত বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়। এ যাবৎকাল অনুসন্ধানে পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে পৃথিবীর জীবের উপযোগী বায়ুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এই পৃথিবীর বায়ুতে আছে অক্সিজেন- ২১%, নাইট্রোজেন- ৭৮%, আর অন্যান্য গ্যাসের মধ্যে আছে- নিয়ন, হিলিয়াম, আর্গন, কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি।
বাতাসের প্রধান গুণ ‘স্পর্শ’; তবে এর মাঝে শব্দের গুণও বিদ্যমান। ধারণ, চালন ও সঙ্কোচ, প্রসারণ, ক্ষেপন এগুলো বাতাসের সৃষ্টি। বাতাসের এই গুণদ্বয় জীব ত্বক বা চামড়া দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে।
বায়ুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্পর্শ এবং শব্দ। বায়ু দোষ প্রাণায়ামে সমাধান হয়। বায়ুর গুণও দুই রূপে দৃষ্ট হয়। একটি সত্ত্বগুণ আর অপরটি রজগুণ।
- সত্ত্বগুণ ভাগ-
- বায়ুর সত্ত্বগুণ ভাগের ইন্দ্রিয় হলো ত্বক।
- জ্ঞানেন্দ্রিয় ত্বক ইন্দ্রিয়ের স্পর্শ গ্রহণ করে।
- বায়ুর প্রসারণ হয় আকাশ তত্ত্বে। তাই বায়ু আকাশের মাধ্যমে যে চলাচল করে তার সত্ত্বগুণ ভাগ হলো ত্বক।
- রজগুণ ভাগ-
- বায়ুর রজগুণ ভাগের ইন্দ্রিয় হলো হস্ত বা হাত।
- ইন্দ্রিয় নির্বাহ করে।
- কর্মেন্দ্রিয় হাতের যে নড়াচড়া তা বায়ু তত্ত্ব।
- ধমনী বা শিরার কোনো সমস্যা হলে হাত চালনা বন্ধ হয়ে যায়।
- বায়ুর প্রসারণ হয় আকাশ তত্ত্বে তাই বায়ু আকাশের মাধ্যমে যে চলাচল করে তার সত্ত্বগুণ ভাগ হলো ত্বক। আর রজগুণ ভাগ হলো হাত।
[ত্বক আর হাতের মাঝে মিত্রতাও আছে। ত্বকে স্পর্শের অনুভূতি হলে হাত নড়াচড়া করে।]
আগুন:
পঞ্চভূতের মধ্যবর্তী তত্ত্ব হলো তেজ বা আগুন। পঞ্চভূতের তত্ত্বগুলোর ক্রম ধারাবাহিকতা কেবল বলবার সুবিধার জন্যই নয়। এই ক্রম ধারাবাহিকতা হলো এর সূক্ষ্মতার ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ মধ্যবর্তী হওয়ায় আগুন হলো এমনই এক তত্ত্ব যা না পুরোপুরি সূক্ষ্ম – না পুরোপুরি স্থূল।
আকাশ আর বাতাসকে দেখা না গেলেও আগুনকে দেখা যায়। সূক্ষ্মতার দিক দিয়ে ভূতের মধ্যে আগুনই প্রথম যার রূপ দর্শন হয়। তাই আগুনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো রূপ। একই সাথে বর্ণনাকৃত পূর্ববর্তী অন্য দুই ভূতের গুণ বা বৈশিষ্ট্যগুলোও বিদ্যমান। অর্থাৎ আগুনে রূপের পাশাপাশি আছে স্পর্শ ও শব্দের গুণ।
আগুন হলো সমস্ত শক্তির উৎস। যাবতীয় যত শক্তি বিদ্যমান তার মাঝে আছে তেজ বা আগুন। আর এই আগুনের প্রধান উৎস হলো সূর্য। আগুন থেকেই সৃষ্টি হয় তাপ এবং আলো। তাপ আর আলো আছে বলেই জীবন চলমান।
আগুনের গুণ তিনটি। যথা- রূপ, শব্দ ও স্পর্শ। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, নিদ্রা, আলস্য এগুলো এর সৃষ্টি। আকাশ ও বাতাসের রূপ গুণ নেই কিন্তু আগুনের তা রয়েছে। তাই আগুণের গুণ জীব চোখ দ্বারা উপলব্ধি করতে পারে। আগুন সমস্যা আসনে সমাধান হয়।
আগুনের গুণ রূপ। আর রূপের দুটি ভাগ। একটি দৃষ্টি বা দেখা। আর অন্যটি হলো চলা বা পা। আর এই রূপের দুই ভাগে দুটি গুণের ভিন্ন রূপ। একটি সত্ত্বগুণ আর অপরটি রজগুণ রূপ-
- সত্ত্বগুণ ভাগ-
- আগুনের সত্ত্বগুণ ভাগ হলো দেখা বা চোখ।
- জ্ঞানেন্দ্রিয় চোখ রূপ গ্রহণ করে।
- রজগুণ ভাগ-
- কর্মেন্দ্রিয় পা চলাচল করে চোখ যা দেখে সেই মতে।
- পা ইন্দ্রিয় গমণ করে।
[চোখ আর পায়ের মাঝে মিত্রতাও আছে। চোখে দিয়ে দেখি আর পা দিয়ে সেদিকে যাই। চোখে জ্যোতি থাকলে দেখা যায় কিন্তু তার জন্য আলোর প্রয়োজন। চোখের জ্যোতি কাজ করার জন্য বাইরে আলো আবশ্যক। সূর্যের প্রকাশে অর্থাৎ আগুন তত্ত্ব আর চোখের জ্যোতি সাত্ত্বগুণ। তাই বৃদ্ধবস্থায় নজর কমজোরি হলে বলা হয় তার অগ্নি কমে গেছে।]
জল
পঞ্চভূতের চতুর্থ তত্ত্ব হলো অপ বা জল। জলের প্রধান গুণ হলো রস। আর অন্যন্য বৈশিষ্ট হলো- শব্দ, স্পর্শ ও রূপ। সৃষ্টি পঞ্চভূতাত্মক। প্রকৃতির সর্বত্র যেমন পঞ্চভূতের উপস্থিতি। তেমনি দেহেও পঞ্চভূত বিরাজিত। আবার দেহকে সুস্থ রাখতেও পঞ্চভূতের সমন্বয় জরুরী।
এই পঞ্চভূতের সমন্বয় করতে। দেহের মধ্যে অবস্থিত পঞ্চভূতকে যেমন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। তেমনি বাইরে থেকে পঞ্চভূতকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে দেহে প্রবেশ করাতে হয়। এবং বের করে দিতে হয়ে। যেমন নি:শ্বাসের সাথে বায়ু তত্ত্বকে গ্রহণ করতে হয়।
তেমনি প্রশ্বাসের সাথে ক্ষতিকর বা অতিরিক্ত বায়ু বের করে দিতে হয়। তেমনি দেহে লাগতে হয় তেজ বা আলো। আবার তেজদ্বায়ক খাবার গ্রহণ করতে হয়। আবার যে আহার নিলে দেহে তাপ তার মাত্রা ঠিক রাখে সেই পরিমাণে আহার নিতে হয়।
তেমনি জীবন ধারণের জন্য জলের সমন্বয় করতে হয়; দেহের বাইরে ও অভ্যন্তরে। জীবের জীবন ধারণের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান উপাদন হলো জল। পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে আছে জল। আবার মানবদেহেও দুই তৃতীয়াংশ হলো জল।
এই জল তত্ত্ব কেবল নদী-খাল-বিলে-পুকুরের ‘জল’ নয়। ব্রহ্মাণ্ডের সকল তরল পদার্থই হলো জল তত্ত্ব বা জল ভূত। জল সকল তরলের প্রতিনিধিত্বকারী।
জলের উপরের তিন ভূতের তিনগুণ অর্থাৎ শব্দ, স্পর্শ ও রূপের পাশাপাশি আছে রস গুণ। শুক্র, শোণিত, মল, মূত্র, মজ্জা, প্রভৃতি জলের সৃষ্টি। জল বা রস জীব জিহ্বা উপলব্ধি করতে পারে।
জলের গুণ রস। আর রসের দুটি ভাগ। একটি রস গ্রহণ। আর অন্যটি রস ত্যাগ। আর এই রসের দুই ভাগে দুটি গুণের ভিন্ন রূপ। একটি সত্ত্বগুণ আর অপরটি রজগুণ রূপ-
- সত্ত্বগুণ ভাগ-
- জিহ্বা কর্মেন্দ্রিয় রস গ্রহণ করে।
- স্বাদ নেয়।
- জিহ্বায় পৌঁছালে এমনিতেই স্বাদ নেয়া হয়ে যায় এটা ইন্দ্রিয়জাত।
- রজগুণ ভাগ-
- কর্মেন্দ্রিয় উপাস্থ ইন্দ্রিয় রস ত্যাগ করে।
- উপাস্থ দিয়ে জল ত্যাগ করতে হয়। এটা কর্ম। এমনিতেই হয় না। করতে হয়।
[জিহ্বা আর উপাস্থের মাঝে মিত্রতাও আছে। একজন গ্রহণ করে আরেক জন ত্যাগ করে।]
(চলবে…)
<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার>>
………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের