পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
-মূর্শেদূল মেরাজ
রূপ হলো দরশন। রূপ দেখলেই কামনা জাগে। মোহ-মায়া জন্মায়। আকর্ষণ বাড়তে থাকে। তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সর্বনাশ করেই ছাড়ে। যেমন আগুণকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না রাখতে পারলে যে সবকিছু পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয়।
আবার আগুন হলো আলো; আর আলোতেই সকলকিছু দৃশ্যমান হয় চর্মচক্ষুতে। ব্রহ্মাণ্ডে যখন অগ্নিতত্ত্বের বিকাশ হয় তখন থেকেই সৃষ্টি বিকাশ পেতে শুরু করে।
তাই স্বভাবে ক্রোধিকে বলা হয়- ‘অগ্নি মূর্তি’। অগ্নি স্বভাব একাধারে যেমন সাহস, উদ্যম বৃদ্ধি করে। তেমনি আবার করে তোলে সহিংস, ক্রোধি, নিয়ন্ত্রণহীন ইত্যাদি।
মাওলানা রুমি বলেছেন, “দিপ্তীমান মোমবাতির মত হওয়া মোটেও সহজ নয়! অন্যকে আলোকিত করতে চাইলে সর্বপ্রথম নিজেকে আগুনে পুড়ে শুদ্ধ হতে হয়।”
অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেছেন, “যেখানে আগুন আছে সেখানেই আলো জ্বলিবার সম্ভাবনা। আগুন তাই অর্হনীয়।”
অগ্নি তত্ত্ব ব্যাপক ব্যাপার। আদতে ব্রহ্মাণ্ডের সকল তাপ, আলো সকল কিছু মিলেই অগ্নিতত্ত্ব। কেবল গনেগনে আগুনে তা সীমাবদ্ধ নয়। তারপরও আগুনের দৃশ্যমান রূপ হলো এই লেলিহান আগুন। তবে সকল আগুনেও কিন্তু তার তাপ সমান থাকে না।
মোমবাতির আগুন অনেকটাই নরম, কাঠের আগুন থেকে। আবার গ্যাসের আগুন, লোহার আগুন সহ নানা প্রেট্রোলিয়ামের আগুনের উত্তাপে আছে পার্থক্য। কিন্তু শেষ বিচারে সব আগুনই কম হোক বেশি হোক পোড়ায় বা তাপ দিয়েই যায়।
আবার আরেক প্রকার আগুন হলো দেহের আগুন। তা অনেক সময় হয় কামনা-বাসনার আগুন। অনেক সময় উদ্যাম-উদ্দিপনার আগুন। ক্রোধের-ধ্বংসের আগুন। জল তত্ত্ব দিয়ে আগুনকে শান্ত করা যায়। তা হোক মনে-দেহে বা ব্রহ্মাণ্ডে।
পৌরাণিক কাহিনীতে বিভিন্ন পর্যায়ে আগুন আবির্ভূত হয়েছেন নানা রূপে- অঙ্গিরার সন্তানরূপে, মানিশের রাজারূপে, মারুত রূপে, সন্ধিলার পৌত্ররূপে, তমসার শাসনকালে বিরাজমান সাতজন মুনির এক বা চতুর্থ মনুরূপে, অন্যতম তারকারূপে এবং বৈদিক স্তোত্রগীতের রচনায় উৎসাহ প্রদানকারীরূপে।
আগুন আবার সকল কিছুই শুদ্ধ করে। তাই বৈদিক মতে, আগুনকেই সাক্ষি মানা হয়েছে। আগুনেই আহুতি দেয়ার কথা বলা হয়েছে সকল কিছুকে। ভাবা হয়েছে আগুনের মাধ্যমেই পরমের কাছে বার্তা পৌঁছানো সম্ভব। কারণ এ তত্ত্ব মধ্যবর্তী তত্ত্ব। এই তত্ত্ব না সূক্ষ্ম না স্থূল।
তাই আগুনকে ধরা হয়ে মিডিয়া হিসেবে। তাতেই দেয়া হয় সকল অর্ঘ্য।
আগুন মানব সভ্যতার এক অপরিহার্য উপাদান। আগুন আবিষ্কারের পরেই সভ্যতার রূপ পাল্টে যেতে থাকে। পরিবর্তন হতে থাকে জীবন ও জীবিকার ইতিহাস। অন্যদিকে অগ্নি-উপাসকদের কাছে আগুন দেবতা হিসেবে গণ্য।
ভারতীয় পুরাণে আগুনকে জীব ও দেবতাদের মধ্যে সংযোগস্থাপনকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আগুনকে বলা হয় দেবতাদের মুখ বা দূত। তার মাঝে আহুতি দেয়ার মাধ্যমেই অন্য দেবতারা তা পেয়ে থাকেন এমনটাই বিশ্বাস।
এ কারণে এ অঞ্চলের প্রায় সকল আচার-অনুষ্ঠানে আগুনকে সাক্ষী মানা হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পরবর্তী সকল কর্মেই আগুনের কর্ম থাকে। বৈদিক যুগের তিন প্রধান দেবতার একজন অগ্নি; তিনি মর্ত্যের দেবতা।
পৌরাণিক কাহিনীতে বিভিন্ন পর্যায়ে আগুন আবির্ভূত হয়েছেন নানা রূপে- অঙ্গিরার সন্তানরূপে, মানিশের রাজারূপে, মারুত রূপে, সন্ধিলার পৌত্ররূপে, তমসার শাসনকালে বিরাজমান সাতজন মুনির এক বা চতুর্থ মনুরূপে, অন্যতম তারকারূপে এবং বৈদিক স্তোত্রগীতের রচনায় উৎসাহ প্রদানকারীরূপে।
আগুনের আকৃতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, সাধারণভাবে অগ্নি দু মুখ, তিন পা ও সাত বাহুবিশিষ্ট, যা লোহিত অথবা শিখাবর্ণের। তার সামনে দ্বিধাবিভক্ত লেজাকৃতির একটি ধ্বজা রয়েছে যার উপর একটি ভেড়াও দেখা যায়।
আর সাধকের কাছে সেই মাত্রার সমন্বয় হতে হয় সুষম বা সাত্মিক। আর এই সাত্মিক ধারা বজায় রাখতে সাধককে দেহে এমনভাবে আগুনকে রাখতে হয়। যা ক্রোধ-কামনা-বাসনায় না পুড়িয়ে অফুরন্ত প্রাণ শক্তিতে উজ্জীবিত করে।
ইসলাম ধর্মে দুইটি জাতির কথা বলা হয়। একটা মানুষ অন্যটা জিন জাতি। মানুষ মাটির আর জিন জাতি আগুনের তৈরি। আর আগুনের কথা উল্লেখ পাওয়া যায় শেষ বিচারের পর পাপীদের যে স্থানে রাখা হবে অর্থাৎ দোজখের বর্ণনায়।
বলা হয়েছে দোজখে ভয়াবহ আগুনে পুড়বে পাপীরা। যে আগুন দুনিয়ার আগুনের বহু বহু গুণবেশি তেজ ধারণ করে। অনেকে রূপক হিসেবে মন-দেহের আগুণকেও দোজখের আগুন বলে উল্লেখ করে। বলে পাপ বেশি হলে দুনিয়াতেই পুড়তে হয়।
দেহের অগ্নি বেড়ে গেলে যেমন বিপদ তেমনি কমে গেলেও মহাবিপদ। দেহে আগুন আছে বলেই দেহের বিস্তার। দেহ পায় কর্ম করার উৎসাহ-উদ্দিপনা। আগুন নিভে গেলেই শেষ। আগুন নিভু নিভু করলেও অচল। তাই প্রতিটি তত্ত্বই দেহ অনুযায়ী যে মাত্রায় বা সমন্বয়ে থাকবার কথা; তাকে টিকিয়ে রাখাই সুস্থ্যতা।
আর সাধকের কাছে সেই মাত্রার সমন্বয় হতে হয় সুষম বা সাত্মিক। আর এই সাত্মিক ধারা বজায় রাখতে সাধককে দেহে এমনভাবে আগুনকে রাখতে হয়। যা ক্রোধ-কামনা-বাসনায় না পুড়িয়ে অফুরন্ত প্রাণ শক্তিতে উজ্জীবিত করে।
প্রাত্যহিক জীবনে আগুন-তাপ-আলোর বহুবিধ ব্যবহার থাকলেও সাধনায় অন্ধকারের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে এই অন্ধকারের মাঝেও উপস্থিত থাকে আলো বা আগুন। সাধকরা অন্ধকারের মাঝ থেকে আলো আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে নিজেকে চেনার সাধন করে।
গুরু-মুর্শিদের সমাধী-রওজা-দরবারে আলো জ্বালানোর বিশেষ রীতি আছে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যা বাতি দেয়ার রীতি তো ঘরে ঘরে প্রচলিত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পঞ্চভূত’ প্রবন্ধে রূপকের ছলে তেজ বা আগুনের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, “শ্রীমতী তেজ (ইঁহাকে দীপ্তি নাম দেওয়া গেল) একেবারে নিষ্কাষিত অসিলতার মতো ঝিক্মিক্ করিয়া উঠেন এবং শাণিত সুন্দর সুরে ক্ষিতিকে বলেন- ইস! তোমরা মনে কর পৃথিবীতে কাজ তোমরা কেবল একলাই কর।
তোমাদের কাজে যাহা আবশ্যক নয় বলিয়া ছাঁটিয়া ফেলিতে চাও, আমাদের কাজে তাহা আবশ্যক হইতে পারে। তোমাদের আচার-ব্যবহার, কথাবার্তা, বিশ্বাস, শিক্ষা এবং শরীর হইতে অলংকারমাত্রই তোমরা ফেলিয়া দিতে চাও, কেননা, সভ্যতার ঠেলাঠেলিতে স্থান এবং সময়ের বড়ো অনটন হইয়াছে।
কিন্তু আমাদের যাহা চিরন্তন কাজ, ঐ অলংকারগুলো ফেলিয়া দিলে তাহা একপ্রকার বন্ধ হইয়া যায়। আমাদের কত টুকিটাকি, কত ইটি-উটি, কত মিষ্টতা, কত শিষ্টতা, কত কথা, কত কাহিনী, কত ভাব, কত ভঙ্গি, কত অবসর সঞ্চয় করিয়া তবে এই পৃথিবীর গৃহকার্য চালাইতে হয়।
আমরা মিষ্ট করিয়া হাসি, বিনয় করিয়া বলি, লজ্জা করিয়া কাজ করি, দীর্ঘকাল যত্ন করিয়া যেখানে যেটি পরিলে শোভা পায় সেটি পরি; এইজন্যই তোমাদের মাতার কাজ, তোমাদের স্ত্রীর কাজ এত সহজে করিতে পারি।
যদি সত্যই সভ্যতার তাড়ায় অত্যাবশ্যক জ্ঞান-বিজ্ঞান ছাড়া আর-সমস্তই দূর হইয়া যায়, তবে একবার দেখিবার ইচ্ছা আছে অনাথ শিশুসন্তানের এবং পুরুষের মতো এতবড়ো অসহায় এবং নির্বোধ জাতির কী দশাটা হয়!”
বায়ুতত্ত্ব
সূক্ষ্মতার বিচারে পঞ্চভূতের অগ্নিতত্ত্ব অবস্থান করে দ্বিতীয় স্থানে। এটি না পুরোপুরি সূক্ষ্ম না হলেও অনেকটাই সূক্ষ্ম। বাতাসের গুণ ‘শব্দ’ ও ‘স্পর্শ’। এতে রূপ, গন্ধ ও রস অনুপস্থিত।
পঞ্চভূতের ভূতগুলো যত সূক্ষ্মতার দিকে যায় তার বিস্তার ততই বেশি। আর যত স্থূল ততই তা নির্দিষ্ট। যেমন মাটি বা কঠিন বস্তু বা পদার্থ দৃশ্যমান। অনেকটাই স্থায়ীভাবে জায়গা দখল করে রাখে।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বায়ুতত্ত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছন- “রূপরহিতস্পর্শবান্ বায়ু। স দ্বিবিধ: নিত্য: অনিত্যশ্চ। নিত্য: পরমাণুরূপ:। অনিত্য কার্যরূপ:।”
অর্থাৎ- ‘বায়ু হলো সেই দ্রব্য যাতে স্পর্শ আছে কিন্তু রূপ নেই। বায়ু দুই প্রকার নিত্য ও অনিত্য। পরমাণুরূপ বায়ু নিত্য, কার্যরূপ বায়ু অনিত্য।’
জল মাটি থেকে সূক্ষ্ম হলেও এটি দৃশ্যমান, স্পর্শযোগ্য এবং জায়গা দখল করে রাখে। তাই এটিও অনেকাংশে নির্দিষ্ট অংশ জুড়ে থাকে। এরপরের তত্ত্ব হলো অগ্নি। এটি আরো সূক্ষ্ম। এর আকার-আকৃতি নেই। নির্দিষ্ট জায়গা দখল করে থাকে না। তবে প্রয়োজন অনুসারে সে তার বিস্তার ঘটিয়ে জায়গা করে নেয়।
তারপর হলো এই বায়ুত্ত্ত্ব। যার অনুভব থাকলেও দৃশ্যমানতা নেই। তাই একে নির্দিষ্ট গণ্ডিতে যেমন রাখা যায় না। তেমন এর বিস্তারও নির্দিষ্ট নয়। এর ব্যাপ্তি ক্রমানুসারে মাটি, জল, আগুন থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি। তাই নিজ সুবিধা মতো জায়গায় সমস্ত পরিমণ্ডলেই বায়ু বিরাজ করে।
অগ্নি ও জলতত্ত্বের সমন্বয় হলো বায়ুতত্ত্ব। বায়ুতত্ত্বের মাঝে অগ্নিতত্ত্বের তাপ আর জলের আর্দ্রতা বিরাজ করে। বায়ু হলো গতি, চঞ্চলমতি। বায়ুই জীবের প্রাণ। বায়ুই দেহ পরিচালনা করে। প্রাণ বায়ু থাকলেই জীব জীবিত থাকে। আর প্রাণবায়ু চলে গেলেই জীব জীবন হারায়।
(চলবে…)
<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ ।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত>>
………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের