পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
-মূর্শেদূল মেরাজ
আকাশতত্ত্ব
সূক্ষ্মতার বিচারে পঞ্চভূতের সর্বোচ্চ সূক্ষ্ম হলো আকাশতত্ত্ব। মাটির বিপরীত হলো আকাশ। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম আকাশতত্ত্ব সর্বত্র বিরাজিত। এই তত্ত্ব সর্বত্র ও সবকিছুর মাঝেই উপস্থিত। এর বিস্তার এতো বেশি যে একে দেখাই যায় না। আকাশের উৎপত্তি ও বিনাশ কিছুই নেই। তাই আকাশ এক এবং নিত্য।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে আকাশতত্ত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছন- “শব্দগুণকম্ আকাশম্। তৎ চ একং বিভু নিত্যং চ।”
অর্থাৎ- ‘শব্দ গুণ যার সেই দ্রব্য আকাশ। আকাশ এক, নিত্য ও বিভূ।’ অন্যান্য ভূতের মতো আকাশ অনিত্য নয়। আকাশ বিভূ। কারণ আকাশ সর্বসূক্ষ্ম, সর্বব্যাপী ও অতীন্দ্রিয়। তাই সকল ভূতের মাঝেই আকাশের সম্পর্ক আছে। অর্থাৎ সকল শূন্যতার মাঝেই আকাশের উপস্থিতি। তাই আকাশ বিভূ অর্থাৎ সম্পর্কযুক্ত।
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুই আকাশতত্ত্বের মাঝে বহমান। সৃষ্টির আদিতে যখন সর্বত্র শূন্যতায় বিরাজিত ছিল। সেই শূন্যতার মাঝেই মহাবিস্ফোরণের মধ্যে প্রকাশ্যে দৃশ্যমান যে জগতের রচনা হয় তাই পঞ্চভূত। আর এই পঞ্চভূতের মধ্যে সর্বোচ্চ সূক্ষ্মতত্ত্ব হলো আকাশতত্ত্ব।
পঞ্চভূতের বাতাসতত্ত্ব পর্যন্ত লোকে বিশ্বাস করলেও আকাশ তত্ত্বকে অনেকেই মানতে নারাজ। তারপরও মাথার উপর অসীম শূন্যতাকে আকাশ বলেই চিহ্নিত করা হয়। যদিও আকাশ তত্ত্ব কেবল মাথার উপর নয় ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই বিরাজ করে। এমনকি দেহের মাঝেও এই তত্ত্বের অবস্থান আছে।
লালন ফকির এখানে প্রশ্ন রেখে বলছেন-
কেন জিজ্ঞাসিলে খোদার কথা
দেখায় আসমানে,
আছে কোথায় স্বর্গপুরে
কেউ নাহি তার ভেদ জানে।।
পৃথিবী গোলাকার শুনি
অহর্নিশি ঘোরে আপনি,
তাইতে হয় দিন রজনী
জ্ঞানীগুণী তাই মানে।।
একদিকে নিশি হলে
অন্যদিকে দিবা বলে,
আকাশ তো দেখে সকলে
খোদা দেখে কয়জনে।।
আপন ঘরে কে কথা কয়
না জেনে আসমানে তাকায়,
ফকির লালন বলে কেবা কোথায়
বুঝোরে দিব্যজ্ঞানে।।
আসলে শূন্যতা না থাকলে পূর্ণতা হতে পারে না। শূন্যতা আছে বলেই সকল কিছু সচল। শূন্যতা না থাকলে সকল কিছু স্থির হয়ে যেত। কোনো কিছুই আপন গতি পেতে পারতো না। আকাশের আশ্রয়ে আছে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ।
আকাশের প্রধান ও একমাত্র গুণ হলো- ‘শব্দ’। আকাশকে না দেখা যায়, না অনুভব করা যায়। অকাশ হলো সেই অসীম শূন্যতা যা এতোটাই সূক্ষ্ম যে তার কোনো স্থান-কাল নেই।
আকাশভূত এমনই এক তত্ত্ব যাকে সাধারণ জ্ঞানে বোঝা প্রায় অসম্ভব। কারণ শব্দ ভিন্ন এর আর কোনো গুণ নেই। এর আকার-আকৃতি, রূপ-রস-গন্ধ কিছুই নেই। একে ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুধাবন করা যায় না। বুদ্ধিতে বোঝার সাধ্য নেই। মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, “আকাশ কেবল হৃদয় দিয়েই ছোঁয়া যায়।”
বিশ্বাসীরা বলে, এই পঞ্চভূতের পরের যে তত্ত্ব তাই পরম ত্ত্ত্ব। যা আকাশতত্ত্ব থেকেও সূক্ষ্ম। তাই আকাশতত্ত্বকে বোঝা গেলে তবেই পরমকে বোঝার সম্ভাবনা দেখা দেয়। আবার অনেকে বলেন, আকাশ তত্ত্বই মূলত পরম। তাই আকাশ নিয়ে জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই।
ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ কোরানে আকাশের সপ্ত স্তরের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়। মুশাক্বাতুল ক্বুলুব গ্রন্থে উল্লেখিত এই সপ্ত আকাশের নাম-
- প্রথম আসমান- রকীয়াহ্।
- দ্বিতীয় আসমান- ফায়দূম।
- তৃতীয় আসমান- মালাকুত বা হারিয়ূন।
- চতুর্থ আসমান- যাহিরাহ।
- পঞ্চম আসমান- মুযাইনা।
- ষষ্ঠ আসমান- খালিসাহ।
- সপ্তম আসমান- লাবিয়্যাহ বা দামিয়াহ্।
বিভিন্ন হাদিসে এর নানারূপ বর্ণনাও পাওয়া যায়। যায় ভিন্ন ভিন্ন স্তরের আকাশের রঙের বিবরণও। নবী করিম যখন স্রষ্টা সাথে সাক্ষাতে মেরাজ করেন তখন তিনি সপ্ত আসমান পারি দেন বলে হাদিসে পাওয়া যায়।
শ্রীশ্রী চরণ দাস তার ‘তত্ত্বরসামৃত জ্ঞানমঞ্জরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, “পঞ্চভূতের মধ্যে আকাশে একটি মাত্র গুণ। ইহা কাহারও আশ্রয়ীভূত নহে। আকাশে (সূক্ষ্ম আকাশ ব্যোম) না থাকিলে মাটি, জল, আলো ও হাওয়া তিষ্ঠিতে পারিত না, তাহাদের অস্তিত্ব বজায় থাকিত না।
এই চারি ভূতের লীলার জন্যেই ব্যোমের বিশেষ আবশ্যক। এক ব্যোমের অভাবেই সমস্ত সৃষ্টি জগত অচল হইত। তাই ব্যোমের শ্রেষ্ঠত্ব, ব্যোম সর্ব্বোপরি সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় প্রত্যেক পলে বিপলে ঘটিতেছে। সৃষ্টি ও স্তিতিতে (জন্ম ও রক্ষা কার্য্যে) পঞ্চভূতের সংযোগ এবং প্রলয়ে তার বিয়োগ আবহমানকাল চলিয়া আসিতেছে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘পঞ্চভূত’ প্রবন্ধে রূপকের ছলে ব্যোম বা আকাশের পরিচয় দিতে গিয়ে লিখেছেন, “শ্রীযুক্ত ব্যোম কিয়ৎকাল চক্ষু মুদিয়া, বলিলেন- ঠিক মানুষের কথা যদি বল, যাহা অনাবশ্যক তাহাই তাহার পক্ষে সর্বাপেক্ষা আবশ্যক।
যে কোনো-কিছুতে সুবিধা হয়, কাজ চলে, পেট ভরে, মানুষ তাহাকে প্রতিদিন ঘৃণা করে। এইজন্য ভারতের ঋষিরা ক্ষুধাতৃষ্ণা শীতগ্রীষ্ম একেবারেই উড়াইয়া দিয়া মনুষ্যত্বের স্বাধীনতা প্রচার করিয়াছিলেন। বাহিরের কোনো-কিছুরই যে অবশ্যপ্রয়োজনীয়তা আছে ইহাই জীবাত্মার পক্ষে অপমানজনক।
সেই অত্যাবশ্যকটাকেই যদি মানব-সভ্যতার সিংহাসনে রাজা করিয়া বসানো হয় এবং তাহার উপরে যদি আর-কোনো সম্রাট্কে স্বীকার না করা যায়, তবে সে সভ্যতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ সভ্যতা বলা যায় না।
জড়ের নিকট হইতে পলায়নপূর্বক তপোবনে মনুষ্যত্বের মুক্তিসাধন না করিয়া জড়কেই ক্রীতদাস করিয়া ভৃত্যশালায় পুষিয়া রাখিলে এবং মনুষ্যকেই এই প্রকৃতির প্রাসাদে রাজারূপে অভিষিক্ত করিলে আর তো মানুষের অবমাননা থাকে না।
ব্যোম যাহা বলে তাহা কেহ মনোযোগ দিয়া শোনে না। পাছে তাহার মনে আঘাত লাগে এই আশঙ্কায় স্রোতস্বিনী যদিও তাহার কথা প্রণিধানের ভাবে শোনে, তবু মনে মনে তাহাকে ‘বেচারা পাগল’ বলিয়া বিশেষ দয়া করিয়া থাকে। কিন্তু দীপ্তি তাহাকে সহিতে পারে না।
অধীর হইয়া উঠিয়া মাঝখানে অন্য কথা পাড়িতে চায়। তাহার কথা ভালো বুঝিতে পারে না বলিয়া তাহার উপর দীপ্তির যেন একটা আন্তরিক বিদ্বেষ আছে।
কিন্তু ব্যোমের কথা আমি কখনো একেবারে উড়াইয়া দিই না। আমি তাহাকে বলিলাম- ঋষিরা কঠোর সাধনায় যাহা নিজের নিজের জন্য করিয়াছিলেন, বিজ্ঞান তাহাই সর্বসাধারণের জন্য করিয়া দিতে চায়। ক্ষুধাতৃষ্ণা শীতগ্রীষ্ম এবং মানুষের প্রতি জড়ের যে শতসহস্র অত্যাচার আছে, বিজ্ঞান তাহাই দূর করিতে চায়।
জড়ের নিকট হইতে পলায়নপূর্বক তপোবনে মনুষ্যত্বের মুক্তিসাধন না করিয়া জড়কেই ক্রীতদাস করিয়া ভৃত্যশালায় পুষিয়া রাখিলে এবং মনুষ্যকেই এই প্রকৃতির প্রাসাদে রাজারূপে অভিষিক্ত করিলে আর তো মানুষের অবমাননা থাকে না।
অতএব স্থায়ীরূপে জড়ের বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া স্বাধীন আধ্যাত্মিক সভ্যতায় উপনীত হইতে গেলে মাঝখানে একটা দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক সাধনা অতিবাহন করা নিতান্ত আবশ্যক।”
(চলবে…)
<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত ।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের