ভবঘুরেকথা
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব সৃষ্টিতত্ত্ব

পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো

-মূর্শেদূল মেরাজ

পঞ্চভূতের মনুষ্যরূপ –

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু, শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, শ্রী অদ্বৈত্ব আচার্য, শ্রীবাস পণ্ডিত এবং গদাধর পণ্ডিত এই পাঁচজনের বিগ্রহের সমষ্ঠিই পঞ্চতত্ত্ব নামে পরিচিত।

পঞ্চতত্ত্বের পরিচয়- ধ্যান ও মন্ত্র।

পঞ্চতত্ত্বাত্মকং কৃষ্ণং ভক্তরূপস্বরূপকম্।
ভক্তিবতারং ভক্তাখ্যং নমামি ভক্তশক্তিকম্।।

গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে, পঞ্চদশ শতকে পৃথিবীতে ভগবান স্বয়ং (কৃষ্ণ) পাঁচটি অবতারে প্রকাশ হয়েছিলেন তাই ‘পঞ্চতত্ত্ব’। এরা হলেন- চৈতন্য মহাপ্রভু (ভক্তরূপে), নিত্যানন্দ (ভক্তস্বরূপ), অদ্বৈত আচার্য (ভক্তাবতার), গদাধর পণ্ডিত (ভক্তশক্তি) ও শ্রীনিবাস ঠাকুর (ভক্তাখ্য বা শুদ্ধভক্ত)।

শ্রীগৌরাঙ্গ প্রথম তত্ত্ব বুঝিতেই হয়।
নিত্যানন্দ তাঁর পরে সদা মনে রয়।।

তৃতীয়তে শ্রীঅদ্বৈত তত্ত্ব বুঝ সবে।
গদাধর পণ্ডিতেরে চতুর্থ ধরিবে।।
শ্রীবাস পঞ্চতত্ত্ব নাহি কেহ আর।
কেশবের পঞ্চতত্ত্ব ইহা জেন সার।।

গৌরতত্ত্ব (ভক্তরূপে)

বলা হয়ে থাকে, রাধা-কৃষ্ণের যুগল ভাব নিয়ে চৈতন্য মহাপ্রভুর রূপে জন্ম নিয়েছিলেন ভগবান তার তিনটি সাধ পূরণের জন্য-

১. রাধার প্রণয় মহিমা কিরূপ?
২. রাধার প্রেমের মাধুর্য ও মহত্ত্ব কিরূপ?
৩. আমাকে অনুভব করে রাধার যে সুখ হয় তাই বা কিরূপ?

প্রকৃতপক্ষে রাধা ও কৃষ্ণ একক সত্ত্বা। লীলার জন্য তারা পৃথক রূপে আবির্ভূত হইয়াছিলেন। আর শ্রী চৈতন্যের মধ্যে একক রূপে প্রকট হয়েছিলেন। রাধার নান্দিনতকা আর কৃষ্ণের প্রেম একীভূত হয়ে সমুদ্র থেকে চাঁদের মতো শচীনন্দন (শ্রীচৈতন্য-জননী) হয়ে শ্রীচৈতন্য উদিত হন।

দাস্যরতির সেবা, সখ্যরতির প্রীতি, বাৎসল্য রতির স্নেহ, শান্তিরতির ঈশ্বরানুরাগ এবং মধুর রতির শ্রেষ্ঠত্ব বিরাজিত রাধার মহাভাবকে নিজ রূপ ধারণ করতেই চৈতন্যরূপে শ্রীকৃষ্ণের এই আবির্ভাব।

নিত্যানন্দ তত্ত্ব (ভক্তস্বরূপ)

চৈতন্যের প্রসিদ্ধ সহচর নিমাইয়ের সঙ্গি নিতাই। বৈষ্ণবের মধ্যে তিনি অবদূত নামে পরিচিত। ত্রেতা যুগের শ্রীরামের লন আর দ্বাপরে কৃষ্ণের বলরামই কলিতে তিনি হয়ে এলেন গৌরের নিতাই। চৈতন্যের আর্বিভাবের প্রায় এক যুগ আগে মাঘি শুক্লা ত্রয়োদশীতে বীরভূম জেলার একচক্র গ্রামে ব্রাহ্মণ কূলে তার জন্ম।

পিতার নাম হাড়াই পণ্ডিত (মতান্তরে, হাড়াই উঝা)। মায়ের নাম পদ্মাবতী দেবী। অল্প বয়সে মাধবেন্দ্র পূরীর সাথে তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে অবশেষে বোম্বাই প্রদেশার্ন্তগত পাণ্ডার পুর তীর্থে লপিতি নামে একসাধু পুরুষের কাছে মন্ত্র গ্রহণ করেন।

সর্ব অবতারী কৃষ্ণ- স্বয়ং ভগবান্।
তাহার দ্বিতীয় দেহ- শ্রী বলরাম।।
একই স্বরূপ দোঁহে ভিন্ন মাত্রা কায়।
আদ্য কায়ব্যৃহ- কৃষ্ণলীলা সহায়।।

সেই কৃষ্ণ নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যচন্দ্র।
সেই বলরাম সঙ্গে নিত্যানন্দ।।
শ্রী বলরাম গোঁসাইঞ্চি মূল সঙ্কর্ষণ।
পঞ্চরূপ ধরি করেন কৃষ্ণের সেবন।।

আপনে করেন কৃষ্ণ লীলার সহায়।
সৃষ্টিলীলা কার্য্য করে ধরি চার কায়।।
সর্ব্বরূপে আস্বাদয়ে কৃষ্ণ-সেবানন্দ।
সেই রাম শ্রীচৈতন্য সঙ্গে নিত্যানন্দ।।

কৃষ্ণ বিগ্রহ যৈছে বিভূতাদি গুণবান।
সেই পরমব্রহ্মে নারায়ণের চারিপাশে।
দ্বারকা চতুর্বূহ দ্বিতীয় প্রকাশে।।
বাসুদেব সংকর্ষণ প্রদ্যুম্ন অনিরুদ্ধ।

দ্বিতীয় চতুব্যুহের এই তুরীয় বিশুদ্ধ।।
তাহা যে রামের রুপ মহাসঙ্কর্ষণ।
চিচ্ছক্তিআশ্রয় তিহোঁ কারণের কারণ।।
চিচ্ছক্তি বিলাসএক শুদ্ধ সত্ত্ব নাম।

শুদ্ধ সত্ত্বময় যত বৈকুন্ঠাদি ধাম।।
ষড়বিধ ঐশ্বর্য তাহা- সকল চিন্ময়।
সঙ্কর্ষণের বিভূতি সব জানিহ নিশ্চয়।।
জীব নাম তটস্হাখ এক শক্তি হয়।

মহাসঙ্কর্ষণ সর্ব জীবের আশ্রয়।।
যাহা হইতে রাষ্টবিশ্বোৎপতি যাহাতে প্রলয়।
সেই পুরুষের সসঙ্কর্ষণ সমাশ্রয়।।
সর্ব্বাশ্র সর্ব্বোদ্ভূত ঐশ্বর্য অপার।

অনন্ত কহিতে নারে মহিমা যাহার।।
তুরীয় বিশুদ্ধ সত্ত্ব সংকর্ষণ নাম।
তিহোঁ যার অংশ সেই নিত্যানন্দ রাম।।

শ্রীঅদ্বৈততত্ত্ব (ভক্তাবতার)

শ্রীঅদ্বৈত প্রভু (১৪৩৪-১৫৫৯) বাংলাদেশের সিলেটের লাউড় গ্রামে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় তার পারিবারিক নাম ছিলো কমলাক্ষ। তার পিতা কুবের পণ্ডিত আর মা নাভাদেবী।

বঙ্গদেশে শ্রীহট্ট নিকট নবগ্রাম।
‘কুবের পণ্ডিত’ তথা নৃসিংহসন্তান
কুবের পণ্ডিত ভক্তিপথে মহাধন্য।
কৃষ্ণপাদপদ্ম বিনা না জানয়ে অন্য
তৈছে তাঁর পত্নী ‘নাভাদেবী’ পতিব্রতা।
জগতের পূজ্যা, যেঁহো অদ্বৈতের মাতা
(ভক্তিরত্নাকর ৫/২০৪১-৪৩)

একবার শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর মা শ্রীমতী নাভাদেবী স্বপ্নে দেখেন- তার কোলের শিশু সন্তান সর্বমঙ্গলময় স্বয়ং মহাবিষ্ণু। সেই সন্তানের জন্য তুমি সমস্ত তীর্থে নিয়ে গিয়ে স্নান করবে। এমন আদেশ আসে স্বপ্নে। স্বপ্নে ভঙ্গের পর মাকে চিন্তিত দেখে অদ্বৈত বলেন, আমি এখানেই সকল তীর্থকে উপস্থিত করব, তাতে তুমি স্নান করবে।

অদ্বৈত যোগাবলে সকল তীর্থকে আকর্ষণ করলে। সমস্ত তীর্থ উপস্থিত হয়ে তাদের আহ্বানের কারণ জানতে চাইলে। অদ্বৈত বলেন- মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে (মহাবারুণি) তোমরা সকলে এখানে পর্বতোপরি বিহার করবে।

অদ্বৈত মাকে বললো, পর্বতোপরি সমস্ত তীর্থ এসেছে, তুমি সেখানে গিয়ে স্নান করো। অদ্বৈত শঙ্খ-ঘণ্টা বাজিয়ে উচ্চৈঃস্বরে হরিধ্বনি করামাত্রই সমস্ত তীর্থের জল পরতে থাকে। নাভাদেবী সেই জলে স্নান করে স্বপ্নের আদেশ পালন করেন।

চৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের বহু পূর্বে তার আবির্ভাব। বলা হয়ে থাকে, সেই অদ্বৈত প্রভুর প্রেম হুংকারেই ধরাধামে মহাপ্রভুর আবির্ভাব হয়। পুরীর রথযাত্রায় লক্ষ লোকের সমাবেশে তিনি শ্রীচৈতন্যকে অবতার ঘোষণা করেন।

বৈষ্ণব দীক্ষার জগতে তার গুরু ছিলেন ‘মাধবেন্দ্র পুরী’। দীক্ষার পর তিনি অদ্বৈতাচার্য উপাধি লাভ করেন। তার গুরু মাধবেন্দ্রপুরী চৈতন্যদেবেরও পরম গুরু ছিলেন।

অদ্বৈত আচার্য গোঁসাঞি সাক্ষাৎ ঈশ্বর।
যাহার মহিমা নহে জীবের গোচর।।
মহাবিষ্ণু সৃষ্টি করেন জগদাদি কার্য্য।
তাঁর অবতার সাক্ষাৎ অদ্বৈত-আচার্য।।
যে পুরুষ সৃষ্টি স্থিতি করেন মায়ায়।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন লীলায়।।
ইচ্ছায় অনন্তমূর্তি করেন প্রকাশে।
এক এক মূর্ত্তো করেন ব্রহ্মাণ্ড প্রবেশে
চোরের অভেদ হইতে অদ্বৈত পূর্ণ নাম।।
সে পুরুষ অংশ অদ্বৈত নাহি কিছু ভেদ।
দেহ বিশেষ তাঁর নাহিক বিচ্ছেদ।।
আপনে পুরুষ বিশ্বের নিমিত্ত কারণ।
অদ্বৈত রূপে উপাদান হয় নারায়ন।।
মহাবিষ্ণুর অংশ অদ্বৈত গুণধাম।
ঈশ্বরের অভেদ হইতে অদ্বৈত পূর্ণনাম।।
যাঁহার তুলসী জলে যাঁহার হুংকারে।
স্বগণ সহিতে চৈতন্যের অবতারে।।
যাঁর দ্বারা কৈল প্রভু কীর্তন প্রচার।
যাঁর দ্বারি কৈল প্রভু জগত-নিস্তার।।

(চলবে…)

<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ ।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো>>

………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।

…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!