ভবঘুরেকথা
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব সৃষ্টিতত্ত্ব

-মূর্শেদূল মেরাজ

শ্রীগদাধরতত্ত্ব (ভক্তশক্তি)

শ্রী গদাধর পণ্ডিত গোস্বামী হইলেন পঞ্চতত্ত্বের শক্তিতত্ত্ব। ব্রজলীলায় ছিলেন শ্যামসুন্দরবল্লভা বৃন্দাবনলক্ষ্মী (শ্রীরাধিকা), ললিতাও তাঁহাতে সন্নিবিষ্টা। গদাধরে রুক্মিণীদেবীরও প্রভাব পরিলক্ষিত। গদাধর আদি প্রভুর শক্তি অবতার। অন্তরঙ্গ ভক্ত করি গমণ যাঁহার।। যাঁহা সভা লৈয়া প্রভুর নিত্য বিহার। যাহা সভা লৈয়া প্রভুর কীর্তন প্রচার।। যাঁহা সভা লৈয়া করেন প্রেম আস্বাদন। যাঁহা সভা লৈয়া দান করেন প্রমধন।।

চট্টগ্রামের বেলেটিগ্রামে আবির্ভাব। পিতা- শ্রী মাধব মিশ্র; মাতা- রত্নাবতী।

শ্রীবাস পণ্ডিত তত্ত্ব (ভক্তাখ্য বা শুদ্ধভক্ত)

পূর্বের পরম ভাগবত নারদ। বৈষ্ণবীয় বিখ্যাত ছয় চক্রবর্তীর অন্যতম। অপর পাঁচ চক্রবর্তী যথা- শ্রীদাস, শ্যামদাস, গোকুলানন্দ, গোবিন্দ ও রামচরণ। “শ্রীবাসাদি” যত কোটি কোটি ভক্তগণ। শুদ্ধ-ভক্ত-তত্ত্ব মধ্যে সবার গণন।।

শ্রীহট্টে ব্রাহ্মণকূলে আবির্ভাব। ইহারা ছিলেন চারি ভ্রাতা- শ্রীবাস, শ্রীরাম, শ্রীপতি, শ্রীনিধি। “চৈতন্যের অবশেষ পাত্র” নারায়নী দেবী ছিলেন শ্রীবাসের ভ্রাতুস্পুত্রী। শ্রীবাসের স্ত্রী মলিনা দেবী ছিলেন ব্রজের স্তন্যদাত্রী ধাত্রী অম্বিকা।

পঞ্চতত্ত্ব মন্ত্রের তাৎপর্য

“ভজ শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ
শ্রীঅদ্বৈত গদাধর শ্রীবাসাদি গৌর ভক্তবৃন্দ!!”

অর্থ- শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে সর্বদাই বিরাজ করেন সচ্চিদানন্দ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর অংশ প্রকাশ শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু, তাঁর অবতার শ্রীঅদ্বৈত প্রভু, তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি শ্রীগদাধর প্রভু এবং তাঁর তটস্থা শক্তি শ্রীবাস্তব প্রভু। সেই মহাপ্রভু এবং প্রভুগণের ভজনা করি।

সুকুমার রায় তার ‘বুঝিয়ে বলা’য় লিখেছেন-

“বলছিলাম কি, বস্তুপিণ্ড সূক্ষ্ম হতে স্থূলেতে,
অর্থাৎ কিনা লাগ্‌ছে ঠেলা পঞ্চভূতের মূলেতে-
গোড়ায় তবে দেখতে হবে কোত্থেকে আর কি ক’রে,
রস জমে এই প্রপঞ্চময় বিশ্বতরুর শিকড়ে।”

ফকির লালন সাঁইজি বলেছেন-

রূপের ঘরে অটল রূপ বিহারে
চেয়ে দেখ না তোরা,
ফণি মনি জিনি রূপের বাখানি
দুই রূপে আছে সেই রূপ করা।।

যেজন অনুরাগী হয় রাগের দেশে যায়
রাগের তালা খুলে সে রূপ দেখতে পায়,
রাগেরি করণ বিধি বিস্মরণ
নিত্যলীলার অপার রাগ নিহারা।।

ও সে অটল রূপ সাঁই ভেবে দেখ তাই
সে রূপের কভু নিত্যলীলা নাই,
যেজন পঞ্চতত্ত্ব যজে, লীলারূপে মজে
সে কি জানে অটলরূপ কি ধারা।।

আছে রূপের দরজায় শ্রীরূপ মহাশয়
রূপের তালা ছোড়ান তাঁর হাতে সদায়,
যেজন শ্রীরূপে গত হবে তালা ছোড়ান পাবে
অধীন লালন বলে অধর ধরবে তারা।।

পঞ্চভূতে পাঞ্জাতন –

সংখ্যার বিচারে বেশ কিছু সংখ্যাকে তাৎপর্যপূর্ণ ও পবিত্র মানা হয়। তার মধ্যে ‘পাঁচ’ সংখ্যাটি বেশ উল্লেখযোগ্য। জগৎ সৃষ্টতে যেমন পাঁচভূতের অবদান। তেমনি সকল কিছুর মূলেই আছে পাঁচের গুরুত্ব। অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামেও এই পাঁচের গুরুত্ব অপরিসীম।

ইসলাম ধর্মের মূল স্তম্ভও পাঁচটি। যথা- কলেমা, নামাজ, রোজা, যাকাত ও হজ্ব। আবার প্রতি দিনকার নামাজও পাঁচ ওয়াক্ত অনুষ্ঠিত হয়। যথা- ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব ও এশা। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ হলো পাক পাঞ্জাতন। এই পাক পাঞ্জাতন হলো-

সাধারণ অর্থে এই পাক পাঞ্জাতনের বাংলা অনুবাদ হল, পাঁচ পবিত্র সত্ত্বা। মুসলমানদের পেয়ারা নবী হজরত মোহাম্মদ, সাহাবী হজরত আলী, নবী কন্যা মা ফাতিমা, নবী পৌত্র ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেন -এই পাঁচজনকে মিলিয়ে পাক পাঞ্জাতন বলা হয়।

এটি শিয়াদের একটি বিশেষ আকীদা। পেয়ারা নবী এবং আহ্‌লে বাইতের চারজন সদস্য নিয়ে এই পাঁচজন পবিত্র সত্ত্বাকে একত্রে বলা হয় পাক-পাঞ্জাতন। বলা হয় এই পাঁচসত্ত্বাই সৃষ্টির মূল, মধ্য ও শেষ। তারাই পরমের বিভূতি। পরমকে বুঝতে গেলে তাই তাদের বোঝা আবশ্যক।

এই বিশ্বাস মতে, দেহের পঞ্চভূতের আসন নির্দিষ্ট। আর প্রতি আসনের এক এক জন গুরু। আর এই পঞ্চগুরুই দেহের পাঞ্জাতন। যা সূক্ষ্ম, স্থূল ও কারণ দেহে কার্য পরিচালনা করে। দেহের এদের সম্মেলনেই চেতন হয় আর বিয়োগে অচেতন।

হাতের পাঁচ আঙ্গুলের নাম ও পাক পাঞ্জাতন-

  • সাব্বাবা/বৃদ্ধাঙ্গুলি- মোহাম্মদ (সা)।
    • আল্লাহর ইচ্ছা পূরনের প্রতীক।
  • সাব্বাহুম/তর্জনী- হযরত আলী (আ)।
    • আল্লাহর শক্তি ও বিচারের প্রতীক।
  • সাব্বা/মধ্যমা- মা ফাতেমা (রা)।
    • আল্লাহর সংযম ও সৌন্দর্যের প্রতীক।
  • পেনসির/অনামিকা- ইমাম হাসান (আ)।
    • আল্লাহর শান্তির প্রতীক।
  • খেনসির/কনিষ্ঠা- ইমাম হোসেন (আ)।
    • আল্লাহর সত্য ও ত্যাগের প্রতীক।

ক্বারী আমীর উদ্দিন লিখেছেন-

আগের সব মুরব্বিয়ান।
শাবানের চাঁন্দেরে ডাকতা বাত্তির চাঁন
পাঞ্জাতনে বিশ্বাস করতা, এক আত্মা এক দেহ প্রাণ।।

আল্লার নুরে নবী পয়দা, ঈমান থাকলে মিলব ফায়দা
যার খাতিরে নিজে খোদায়, বানাইলা জমিন আছমান,
বলছেন নবীর পাক জবানে, আহলে বায়েত যারা মানে
উদ্ধার পাইবা ঘোর নিদানে, নূহের তরণীর সমান।।

আলী নাম প্রায় সকল গ্রামে, বেশীর্ভাগ মানুষের নামে
জারি গাইতা মহররমে, কাইন্দা হইতা পেরেশান,
পোলাও ক্ষীর হালুয়া রুটি, শিন্নি দিতা বাটি বাটি
তাঁরাই ছিলেন ভক্ত খাঁটি, বুঝতা তাঁরা মানির মান।।

এক তারিখে জন্ম যাহার, বিবি জয়নব নামটি তাঁহার
বেটি হজরত মাই ফাতেমার, যার আদর্শ অফুরান,
৩ তারিখ হুছাইন মউলার, ৪ তারিখ আব্বাস আলমদার
জয়নাল আবদীন শাহাজাদার, জন্ম ৫ তারিখ শাবান।।

শাবানের সাত তারিখেতে, হজরত কাশেম জন্ম তাতে
শহীদ হইলেন কারবালাতে, কাঁনতেছে সখিনার প্রাণ,
আলীআকবর এই মাসেতে, জন্ম এগারই শাবানেতে
এজিদের বাহিনীর হাতে, কারবালাতে দিলেন জান।।

মাহাদী আইলেন ধরণীতে, ১৫ তারিখ শাবানেতে
জাহির হইবা বায়তুল্লাতে, আমির উদ্দিনের ঈমান,
আকাশ হইতে ঈছা আইবা, ইমাম মাহাদীর সঙ্গী হইবা
সত্য প্রতিষ্ঠা করিবা, আল্লাহ পাকের সংবিধান।।

(চলবে…)

<<পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো ।। পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো>>

………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।

…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!