উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : চার
-শংকর
তৎক্ষণাৎ আমরা তিনজন গৃহী ভক্ত এবং উক্ত নন্দলাল ব্রহ্মচারীজি স্বামীজির দেহখানি বহন করিয়া ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া আসিয়া নীচের দালানে পুষ্পসজ্জিত পালঙ্কের উপরে স্থাপন করিলাম। সেই সময়ে গোটাকতক বেদানা, আপেল, ন্যাসপাতি, আঙুর, স্বামীজির বক্ষের উপরে সাজাইয়া দেওয়া হইল।
তখন বুড়ো গোপাল দাদা (স্বামী অদ্বৈতানন্দ) ব্রহ্মচারীজিকে বলিলেন- “ওরে নন্দলাল! আমাদের সকলের চেয়ে স্বামীজি তোকেই বেশি ভালোবাসিতেন। আজ তাঁর শেষ পূজা তোর হাতেই হোক।”
এই প্রস্তাব শ্রীমৎ রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) প্রমুখ সাধুবৃন্দ অনুমোদন করাতে, নন্দলাল স্বামীজিকে পুষ্পমাল্যাদি দানে এবং নানাবিধ ফল ও মিষ্টান্ন প্রভৃতি নিবেদনের পর আরতি করিয়া স্তোত্রপাঠ করিলেন।
এই সময়ে স্বামীজির শেষ ফটো (আলোকচিত্র) তুলিবার প্রস্তাব করা হইলে, শ্রীরাখাল মহারাজ নিষেধ করিয়া বলিলেন- “স্বামীজির কতো রকমের ভাল ফটো রয়েছে, এই বিষাদ মাখা ছবি সকলের হৃদয়কে বিদীর্ণ করবে।”
তাহার পরে শ্রীরাখাল মহারাজ প্রমুখ সন্ন্যাসীবৃন্দ ও ব্রহ্মচারিগণ স্বামীজির চরণে পুস্পাঞ্জলি দিলেন। অবশেষে স্বামীজির সহাধ্যায়ী বন্ধু হরমোহন মিত্র প্রভৃতি গৃহীভক্তবৃন্দ অঞ্জলি দিলেন। পরে স্বামীজির চরণতল অলক্তকে (আস্তায়) রঞ্জিত করিয়া তাহার পায়ের ছাপ লওয়া লইল।
ভগিনী নিবেদিতাও একখানি নূতন রুমালে স্বামীজির চরণের ছাপ তুলিয়া লইলেন। একটি বড় বিকাশোন্মুখ ‘মার্শাল নীল’ জাতীয় গোলাপ ফুল চন্দনে চর্চিত করিয়া স্বামীজির চরণতলে বুলাইয়া আমি সেই স্মৃতিচিহ্নটি বুকপকেটে রাখিয়া দিলাম।
ইহা শুনিয়া ভগিনী নিবেদিতা শোকোচ্ছ্বাস চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না। তিনি জ্বলন্ত চিতার সন্নিকটে চারিপার্শ্বে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। পাছে তাহার গাউনে (পরিচ্ছদে) আগুন ধরিয়া যায় এই আশঙ্কায় মহারাজজী (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) কানাই মহারাজকে বলাতে, তিনি ভগিনীর হাত ধরিয়া তফাতে গঙ্গার ধারে লইয়া গিয়া বসাইলেন এবং কোনমতে। তাঁহাকে প্রবোধ দিতে লাগিলেন।
স্বামীজির পূজাদি কার্য সমাধানের পর শ্রীশরৎ মহারাজ ঐ পালঙ্কখানি বহন করিয়া যে স্থানে স্বামীজির দেহে অগ্নিসংস্কার করা হইবে সেখানে লইয়া যাইবার জন্য আমাদেরই চারিজনকে পুনরায় অনুমতি দিলেন। তাহার পরে উঁহারা সকলে শবানুগমন করিতে লাগিলেন।
সেইদিন পূর্বাহ্নে বৃষ্টিপাত হওয়াতে মঠের পিচ্ছিল চোরপুলি কাঁটায় পূর্ণ বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ ধীরে ধীরে সন্তর্পণে পার হইয়া আমরা পালঙ্কখানি চন্দনকাষ্ঠের চিতার উপরে স্থাপন করিলাম। সেই সময়ে কলিকাতা সিমলা পল্লী হইতে একখানিগাড়িকরিয়াস্বামীজিরকাকীমা এবং জ্ঞাতিভ্রাতাহাবুদত্তসপরিবারে আসিয়া কিছুক্ষণ উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন ও বিলাপ করিতে লাগিলেন।
তাহার পরে শ্রীশরত্মহারাজ উপস্থিত সকলকে বলিলেন:”তোমরা এক এক বাণ্ডিল পাকাটি আগুনে ধরিয়ে নিয়ে এই বেদীকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে শেষে খাটেরনীচে স্বামীজির পায়ের তলায় জ্বলন্ত আগুন রেখে প্রণাম কর।”
তাঁহার আদেশমত স্বামীজির শরীরকে চন্দন কাষ্ঠে প্রজ্বলিত অগ্নিতে আহুতি প্রদানের পর শোকসন্তপ্ত ভক্তগণ প্রজ্বলিত চিতাকে বেষ্টন করিয়া প্রস্তর মূর্তির ন্যায় বসিলেন। চিতাবহ্নি ক্রমে ক্রমে লেলিহ্যমান্ ঊর্ধ্বমুখী বহু জিহ্বা বিস্তার করিয়া ধূ ধূ করিয়া জ্বলিতে লাগিল।
সেই সময়ে মহাকবি গিরিশচন্দ্র, বসুমতী’র উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সাহিত্যিক জলধর সেন, মাষ্টার মহাশয় (শ্রীম), অক্ষয়কুমার সেন (শাঁখচুন্নী মাষ্টার) প্রভৃতি গৃহীভক্তগণ বেলতলার সন্নিকটে রকের উপর বসিয়া এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখিতে লাগিলেন।
গিরিশবাবু ভগ্নহৃদয়ে আক্ষেপ করিয়া বলিলেন- “নরেন! কোথায় তুমি বেঁচে থেকে আমার কথা লোকের কাছে বলে ঠাকুরের মহিমা প্রচার করবে, কিন্তু সে সাধে পোড়া বিধি হোল বাদী, আমি বুড়ো বেঁচে রইলুম তোমার এই দৃশ্য দেখবার জন্যে? তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে, বল দেখি এখানে আমাদের কি দশায় ফেলে অকালে চলে গেলে? নিশ্চয়ই আমাদের কপাল ভেঙেছে।”
ইহা শুনিয়া ভগিনী নিবেদিতা শোকোচ্ছ্বাস চাপিয়া রাখিতে পারিলেন না। তিনি জ্বলন্ত চিতার সন্নিকটে চারিপার্শ্বে পরিক্রমণ করিতে লাগিলেন। পাছে তাহার গাউনে (পরিচ্ছদে) আগুন ধরিয়া যায় এই আশঙ্কায় মহারাজজী (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) কানাই মহারাজকে বলাতে, তিনি ভগিনীর হাত ধরিয়া তফাতে গঙ্গার ধারে লইয়া গিয়া বসাইলেন এবং কোনমতে। তাঁহাকে প্রবোধ দিতে লাগিলেন।
স্বামীজির নারায়ণী তনুখানির নিম্ন অর্ধাংশ অনুকূল বায়ুর হিল্লোলে সেই হোমাগ্নি মধ্যে অল্পক্ষণেই ভস্মে পরিণত হইল। কিন্তু আশ্চর্য, তাহার বুকে, মুখে এবং মস্তকের কেশে অগ্নিস্পর্শ না করাতে সেই মুখভঙ্গী, আয়ত নেত্রের দৃষ্টি কী সুন্দর দেখাইতে লাগিল!
রাত্রি ৩টার পরে শ্রীশরৎ মহারাজ নীচেকার ঘরে আসিয়া আমাদের তিনজনকে জাগাইয়া তুলিয়া উপরের..ঘরে যাইতে বলিলেন। সেখানে যাইলে মহারাজজী… আমাকে… আচমন করিয়া জপ করিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরে মহারাজজীর আজ্ঞায় সকলে নীচের তলায় আসিয়া পশ্চিম দিকের দালানের সম্মুখস্থিত প্রাঙ্গণে বৃহৎ হোমকুণ্ডের চারিধারে বসিয়া জপ করিতে লাগিলেন।
এমন সময়ে জানি না কোন্ প্রেরণায় পরমহংসদেবের কোনো এক বিশিষ্ট গৃহীভক্তের মুখ হইতে অত্যন্ত মর্মান্তিক একটি মন্তব্য বাহির হইল। ইহা নিতান্তকঠোর ও পরিতাপের বিষয় বলিয়া লিপিবদ্ধ করা হইলনা। তাহা শ্রবণে সকলেই মর্মাহত হইলেন এবং স্বামীজির সন্ন্যাসী শিষ্য শ্রীনিশ্চয়ানন্দ উত্তেজিত হইয়া বলিলেন-
“যো কোই স্বামীজিকা শির’পর লাঠি মারেঙ্গে, উকো শির লাঠিসে হাম্ তোড়েঙ্গে, যেতনা কাঠ লাগে গাছ তোড়কে হাম্ আভি দেঙ্গে।” এই বলিয়া অদূরবর্তী এক প্রাচীন বৃক্ষে আরোহণ পূর্বক তিনি শাখা ছেদন করিয়া প্রচুর কাষ্ঠ সংগ্রহ করিবার পর জ্বলন্ত চিতার উপর তাহা সাজাইয়া স্বামীজির মুখোনি আবৃত করিয়া দিলেন।
এই সময়ে রাখাল মহারাজ আমাকে একটু তফাতে লইয়া গিয়া হাতে দশটাকার একখানি নোট দিয়া বলিলেন- “তুমি নিবারণকে সঙ্গে নিয়ে গিরিশবাবুর নৌকায় ওপারে, বরানগরে গিয়ে বাজার থেকে কিছু সন্দেশ ও খাবার কিনে আনো। কাল রাত্তির থেকে সাধুরা কেউ মুখে জল দেয়নি–আর উপস্থিত ভক্তদেরও অনেকেরই খাওয়া হয়নি।”
মহারাজজীর আদেশমত কার্য করিতে আমাদের উভয়কে যাইতে দেখিয়া বরানগরনিবাসী ভক্ত বিপিন সাহা উহার উপর পাঁচ টাকা দিয়া আমাদের সঙ্গে ওপারে যাইয়া দোকানে গরম লুচি কচুরি সন্দেশ প্রভৃতি। তৈয়ারি করাইয়া ঝুড়ি নিজে বহিয়া আমাদের সঙ্গে পুনরায় মঠে ফিরিলেন। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে আমরা যখন মঠে পঁহুছিলাম, তখন চিতা নির্বাপণের পর স্বামীজির দেহাবশেষ সঞ্চয় করিয়া সন্ন্যাসিবৃন্দ এবং ভক্তগণ স্নানান্তে গঙ্গাসলিলে তৰ্পণ করিতেছিলেন।…
সমস্ত দিনের পর ঠাকুরের এই প্রথম সান্ধ্যজলপানি ভোগওআরতিহইয়া যাইলে নীচের তলার সমবেত সাধু এবং ভক্তমণ্ডলীর মধ্যে চা, সরবৎ এবং প্রসাদ বিতরিত হইল। তাহার পরে গৃহীভক্তেরা একে একে ভগ্নহৃদয়ে বিদায় লইলেন।
স্বামীজির অন্তিম ইচ্ছা পূরণের জন্য ৪ জুলাই-এর (২০ আষাঢ়) পরবর্তী অমাবস্যার রজনীতে বেলুড় মঠে শ্রীশ্রীকালী পূজার অনুষ্ঠান হইয়াছিল। তাহাতে বাহিরের কাহাকেও আমন্ত্রিত করা হয় নাই। কেবল স্বামীজির কনিষ্ঠ সহোদর শ্রীভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয় আসিয়াছিলেন।…
রাত্রি দশটার পর মঠের দোতলায় ঠাকুর-ঘরে শ্রীশ্রীকালীপূজা আরম্ভ হইলে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের পিতৃদেব প্রাচীন তান্ত্রিক সাধক ঈশ্বরচন্দ্র চক্রবর্তী মহাশয় পূজকের আসন গ্রহণ করিলেন। সাধু ও ব্রহ্মচারিগণ ঠাকুর প্রণাম করিয়া স্বামীজির ঘরে যাইয়া…বসিলেন।
তাহার পূর্বে ঠাকুরের সন্ধ্যাকালীন ভোগ হইবার পরে পূজনীয় মহারাজজী স্বামী প্রেমানন্দ মহারাজকে বলিলেন- “ভূপেনকে আর এদের দুজনকে ঠাকুরের প্রসাদ খেতে দাও, আমাদের সকলের আজ উপবাস।”
প্রসাদ পাইবার পরে আমরা তিনজনে নীচেকার পশ্চিমদিকের বড় ঘরে শয়ন করিলাম, রাত্রিতে মধ্যে মধ্যে স্বামীজির বৃদ্ধ শিষ্য নিত্যানন্দ স্বামীর সকরুণ ক্রন্দন-ধ্বনিতে মঠ যেন মুখরিত হইয়া উঠিল।
রাত্রি ৩টার পরে শ্রীশরৎ মহারাজ নীচেকার ঘরে আসিয়া আমাদের তিনজনকে জাগাইয়া তুলিয়া উপরের..ঘরে যাইতে বলিলেন। সেখানে যাইলে মহারাজজী… আমাকে… আচমন করিয়া জপ করিতে বলিলেন। কিছুক্ষণ পরে মহারাজজীর আজ্ঞায় সকলে নীচের তলায় আসিয়া পশ্চিম দিকের দালানের সম্মুখস্থিত প্রাঙ্গণে বৃহৎ হোমকুণ্ডের চারিধারে বসিয়া জপ করিতে লাগিলেন।
দেহটা গিয়েই আমার মুক্তি হোক, অথবা দেহ থাকতে থাকতেই মুক্ত হই, সেই পুরনো ‘বিবেকানন্দ’কিন্তু চলে গেছে, চিরদিনের জন্য চলে গেছে–আর ফিরছেনা! শিক্ষাদাতা, গুরু, নেতা, আচার্য বিবেকানন্দ চলে গেছে পড়ে আছে কেবল সেই বালক, প্রভুর সেই চিরশিষ্য, চিরপদাশ্রিত দাস।”
হোমক্রিয়া সমাপনের পরে যে স্থানে স্বামীজির দেহে অগ্নি-সংস্কার করা হইয়াছিল সেইস্থানে সকলে যাইয়া সাতবার প্রদক্ষিণের পর প্রণত হইলেন এবং কিছুক্ষণ বেলতলায় বসিয়া জপ করিয়া ফিরিয়া আসিয়া ঠাকুর-ঘরে প্রণামের পর নীচে আসিয়া প্রসাদ গ্রহণ করিলেন।”
যে প্রশ্ন মাথায় রেখে স্বামীজিকে নিয়ে এই অনুসন্ধানের সূচনা করেছিলাম এবার সেখানেই ফিরতে হবে।
মহামানবদের জন্মদিন পালনে সনাতন ভারত সতত উৎসাহী, কিন্তু মৃত্যুদিনের স্মৃতিভার বহন তেমন প্রয়োজনীয় নয় কেন? স্বামী বিবেকানন্দর অন্ত্যলীলার অনুসন্ধান করতে গিয়ে তার উত্তর মিলে গিয়েছে। এই পৃথিবীতে অতি সাধারণ মানুষকে “মরিয়া প্রমাণ করিতে হয় সে মরে নাই।”
মরার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যু হয় অন্য সব মানুষের। কিন্তু মহামানবদের প্রকৃত বাঁচা শুরু হয় মৃত্যুদিন থেকে। সেই হিসেবে ৪ জুলাই ২০০২ মৃত্যুঞ্জয়ী বিবেকানন্দর প্রথম শতবর্ষপূর্তি।
ভগিনী নিবেদিতাকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর মধ্যে তফাত কী? নিবেদিতা উত্তর দিয়েছিলেন, অতীত পাঁচ হাজার বছরে ভারতবর্ষ যা কিছু ভেবেছে তারই প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ, আর আগামী দেড় হাজার বছর ভারত যা কিছু ভাববে তারই অগ্রিম প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ।
নিবেদিতার কথা যদি সত্য হয়, তা হলে স্বামী বিবেকানন্দর তিরোধান দিবস পালন সত্যই প্রয়োজনহীন।
মহাসমাধির দু’বছর আগে (এপ্রিল ১৯০০) স্বামীজি তাঁর অনুরাগিণী মার্কিনী বান্ধবী মিস জোসেফিন ম্যাকলাউডকে আশ্চর্য এক চিঠি লিখেছিলেন আলমোড়া থেকে।
আসন্ন বিদায়ের কথা মনে না থাকলে এমন চিঠি লেখা যায় কি না তা বিবেচনার ভার পাঠকের ওপরেই ছেড়ে দিতে চাই। কতবার যে স্বামীজির লেখা এই কটা লাইন পড়েছি তার হিসেব নেই, কিন্তু প্রতিবারেই বাণীটা নতুন মনে হয়। মনে হয় সমকালের ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ অনন্তকালের সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন।
স্বামীজি লিখছেন- “আমি যে জন্মেছিলাম–তাতে খুশি; এতে যে কষ্ট পেয়েছি তাতেও খুশি; জীবনে যে বড় বড় ভুল করেছি–তাতেও খুশি। আবার এখন যে নির্বাণের শান্তি-সমুদ্রে ডুব দিতে যাচ্ছি–তাতেও খুশি। আমার জন্যে সংসারে ফিরতে হবে, এমন বন্ধনে আমি কাউকে ফেলে যাচ্ছি না; অথবা এমন বন্ধন আমি কারও থেকে নিয়ে যাচ্ছি না।
দেহটা গিয়েই আমার মুক্তি হোক, অথবা দেহ থাকতে থাকতেই মুক্ত হই, সেই পুরনো ‘বিবেকানন্দ’কিন্তু চলে গেছে, চিরদিনের জন্য চলে গেছে–আর ফিরছেনা! শিক্ষাদাতা, গুরু, নেতা, আচার্য বিবেকানন্দ চলে গেছে পড়ে আছে কেবল সেই বালক, প্রভুর সেই চিরশিষ্য, চিরপদাশ্রিত দাস।”
এই বিবেকানন্দই বোধহয় মানুষের হৃদয়মন্দিরে অনন্তকাল ধরে পূজিত হবেন।
……………………………
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
অচেনা অজানা বিবেকানন্দকে খুঁজতে গিয়ে একাল ও সেকালের জীবিত ও মৃত, চেনা-অচেনা কত ভক্ত এবং কত গবেষকদের দিকে ভিক্ষাপাত্র এগিয়ে দিয়েছি এই মুহূর্তে তার পুরো হিসেব দেওয়া সম্ভব নয়। অনুসন্ধানের কাজটা প্রাথমিকভাবে সম্পন্ন করে মনে হচ্ছে, এও একধরনের মাধুকরী। কারণ কোনো নতুন তথ্য আমি আবিষ্কার করতে সক্ষম হইনি। যা চেষ্টা করেছি তা হলো, জীবননাটকের রঙ্গমঞ্চে একটু নতুনভাবে আলোকসম্পাত।
প্রথমেই বলি, অনুপ্রেরণার উৎসমূলে রয়েছেন বহু গ্রন্থের লেখক সন্ন্যাসীগবেষক স্বামী প্রভানন্দ এবং ভক্তগবেষক আমার সাহিত্যগুরু শঙ্করীপ্রসাদ বসু! বসুমহাশয়ের মহাভারত ‘বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ’, ‘লোকমাতা নিবেদিতা’ ও ‘লেটারস্ অফ নিবেদিতা’ এই ভিক্ষাজীবীকে বহুবার উপাদানের অনশন থেকে রক্ষা করেছে।
এর পরেই রয়েছে বহুখণ্ডে বিভক্ত বাংলা ও ইংরিজি স্বামী বিবেকানন্দর বাণী, রচনা ও পত্রাবলী। বাংলা সংস্করণে পত্রাবলীর অংশটি এখনও অসম্পূর্ণ। ইংরিজি সংস্করণের পত্রাবলীতেও যে অপরিপূর্ণতা আছে তার কিছুটা পূরণ হয়েছে বেণীশঙ্কর শর্মার গবেষণায় এবং মেরি লুইস বার্ক সম্পাদিত ৬ খণ্ডে সম্পূর্ণ স্বামী বিবেকানন্দ ইন দ্য ওয়েস্ট নামক দিকদর্শন গ্রন্থমালায়।
আরও আছে এক স্বর্ণভাণ্ডার। স্বামী বিবেকানন্দর মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তর অর্ধশতাধিক গ্রন্থ। এই সুযোগে তাঁর রচনার মধ্য দিয়ে মহেন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলাম এবং বুঝলাম কেন তাকে ‘পুণ্যদর্শন’ বলা হতো। আর এক মহামূল্যবান লেখক স্বামীজির কনিষ্ঠ ভ্রাতা ডঃ ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তার একটি বই ছাড়া (আমার আমেরিকার অভিজ্ঞতা) প্রায় সব বই পড়েছি। ভূপেন্দ্ররচনাও একালের বাঙালির অবশ্যপাঠ্য।
আর আছে ইংরিজি ও বাংলায় বেশ কিছু আকর গ্রন্থস্বামী সারদানন্দের শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ভগিনী নিবেদিতা গ্রন্থাবলী, রোমাঁ রোলাঁর বিবেকানন্দর জীবন, স্বামী গম্ভীরানন্দের যুগনায়ক বিবেকানন্দ, প্রমথনাথ বসুর বিবেকানন্দ এবং দ্য লাইফ অফ স্বামী বিবেকানন্দ, ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্যর বর্ণাঢ্য রচনাবলী, এস এন ধরের এ কমপ্রিহেনসিভ বায়োগ্রাফি অফ বিবেকানন্দ ইত্যাদি বেশ কয়েক ডজন গ্রন্থ।
আরও রয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন সন্ন্যাসীর ও সংসারীর অমূল্য স্মৃতিকথা ও দিনলিপি কিছু ইংরিজিতে, কিছু বাংলায়। আদালতী ব্যাপারে সাহায্য পেয়েছি চিত্রগুপ্ত বিরচিত ছোট্ট বাংলা বই থেকে। স্বামী প্রভানন্দের ধৈর্যপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থগুলি সামনে না থাকলে আমার মতন ভিক্ষাজীবী লেখকের মনে সাহস জুটতো না।
আর এক মহামূল্যবান খবরাখবরের খনি ব্রহ্মবাদিন পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলি। সেই সঙ্গে প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলি। এবং অবশ্যই উদ্বোধন পত্রিকা এবং শ্রীসারদা মঠ প্রকাশিত অপেক্ষাকৃত কম বয়সের নিবোধত পত্রিকা।
আরও বেশ কিছু কৃতজ্ঞতা-স্বীকারের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে মিস। জোসেফিন ম্যাকলাউড ও মিসেস ওলি বুলের সাম্প্রতিক জীবনীকার প্রব্রাজিকা প্রবুদ্ধপ্রাণা। এই বিদেশিনী সন্ন্যাসিনী আমার পরিচিত না হলেও তাকে দূর থেকে প্রণাম জানাই। সেই সঙ্গে বাংলাভাষায় শঙ্করাচার্য ও শ্রীচৈতন্যের জীবনী লেখকদের। আরও আছেন মার্কিন মুলুকের প্রাণবন্ত লেখক স্বামী চেতনানন্দ।
কিছুটা নেশার ঘোরেই শ’ দুয়েক বইয়ের অরণ্য থেকে অচেনা বিবেকানন্দ সম্বন্ধে সামান্য যা খুঁজে পেলাম তা এই বইতে একত্রে সংগ্রহ করে রাখা গেল, এই আশায় এবং এই বিশ্বাসে যে নানা দিক থেকে নানাভাবে খোঁজ খবর না করলে কোনো মহামানবকেই পুরো জানা যায় না।
ব্যক্তিগতভাবে উপদেশ দিয়ে এবং তথ্যসন্ধানে সাহায্য করেছেন রামকৃষ্ণ মিশনের পূজ্যপাদ স্বামী রমানন্দ, স্বামী বিশোকানন্দ, স্বামী সর্বগানন্দ, অদ্বৈত আশ্রমের স্বামী বোধসারানন্দ, স্বামী সত্যময়ানন্দ, গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার গ্রন্থাগারের গোপা বসুমল্লিক, ডাক্তার সুব্রত সেন, ডাক্তার তাপস বসু, বিশিষ্ট গবেষক সুনীলবিহারী ঘোষ, শ্রীহর্ষ দত্ত, শ্রীদিলীপ দে, শ্রীসুবীর মিত্র, শ্রীবাদল বসু, শ্রীরাকেশ দাস, শ্রীবঙ্কিম কোনার, নীরব অনুসন্ধানী শ্রীশিবশঙ্কর ঘোষ, শ্রীবিশ্বরূপ মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। এঁদের সকলকে কৃতজ্ঞতা জানাই।
কৃতজ্ঞতা জানাই বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ডক্টর মানস রায়, আনন্দবাজার পত্রিকার দিল্লি সংবাদদাতা জয়ন্ত ঘোষাল, সুখী গৃহকোণ পত্রিকার সুযোগ্যা সম্পাদিকা শুভা দত্ত এবং সংবাদ প্রতিদিন-এর সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এঁরা সারাক্ষণ উৎসাহ না দিলে এই বইয়ের শেষপ্রান্তে পৌঁছনো বেশ কঠিন হতো। আর একজন সর্বদা লুকিয়ে থাকতে চান–তার উল্লেখ উৎসর্গপত্রে করেছি।
সবার শেষে শতসহস্র ধন্যবাদ এই বইয়ের প্রকাশক শ্রীনির্মলকুমার সাহা ও তার সুযোগ্য পুত্র বিবেকানন্দ-অনুরাগী শ্রীপ্রদীপ সাহাকে। একই সঙ্গে ধন্যবাদ উৎসাহী কর্মী শ্রীসুখেন সাহাকে।
আরও একজন পাঠকের কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম আমার প্রথম প্রকাশক নিউ এজ পাবলিশার্সের তরুণ কর্ণধার শ্রীশিলাদিত্য সিংহরায় সম্পাদনার কাজে নানাভাবে সাহায্য করেছেন।
এবার আসা যাক ছবির প্রসঙ্গে। অদ্বৈত আশ্রম বেশ কিছুদিন ধরে অশেষ ধৈর্য ও বিপুল নিষ্ঠার সঙ্গে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সংক্রান্ত অনেক ছবি ডিজিটাল পদ্ধতিতে উদ্ধার করে চলেছেন। তাদের কাছে আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা। সেই সঙ্গে দুই প্রবীন ও নবীন দিকপাল চিত্রসাংবাদিক মোনা চৌধুরি ও অশোক মজুমদার। এঁরা নানাভাবে উপকার করেছেন। এঁদের জয় হোক।
শংকর
পু: শেষ মুহূর্তে দু’জন নিষ্ঠাবান পাঠকের কাছে গভীর ঋণে আবদ্ধ হলাম। এঁদের নাম শ্রীঅরুণকুমার দে ও শ্রীসোমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। যতদিন এঁদের মতন সাবধানী পাঠকরা আছে ততদিন বাংলাভাষার লেখকদের কোন চিন্তা নেই।
…………………….
অচেনা অজানা বিবেকানন্দ- শংকর।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………..
আরও পড়ুন-
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : এক
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : দুই
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : তিন
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : চার
……………….
আরও পড়ুন-
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি এক
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি দুই
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি তিন
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি চার
…………………
আরও পড়ুন-
স্বামীজী-প্রচারিত মতসমূহের সমষ্টিভাবে আলোচনা : এক
স্বামীজী-প্রচারিত মতসমূহের সমষ্টিভাবে আলোচনা : দুই
মহাপুরুষদর্শন-প্রসঙ্গে
ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী
হিন্দুধর্ম
মহাপুরুষদর্শন-প্রসঙ্গে