ভবঘুরেকথা
ফকির লালন

-নূর মোহাম্মদ মিলু

বাংলা ভাষাভাষিদের স্রষ্টা প্রেরিত পথপ্রদর্শক ঐশী বার্তাবাহক মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির ১২৯তম তিরোধান দিবস হোক বিশ্ব লালন দিবস। লালনপন্থী বা লালনকে যারা ধারণ করে এই দাবী কেবল তাদেরই নয়; লালনকে যারা ভালোবাসেন, লালনের গান যারা ভালোবাসেন সকলেই প্রীত হবেন এমন স্বীকৃতিতে।

তবে লালন এইসবের ধার ধারেন না। জাতি-ধর্ম-গোত্র-কুল এসকে ফকির লালন কখনো গুরুত্ব দেননি। যতটা দিয়েছেন মানুষ হয়ে উঠবার জন্য। মানুষ হয়ে উঠার মন্ত্রণাই ফকির লালন সাঁইজি দিয়েছেন তাঁর গানে গানে। নিজে মানুষ হয়ে উঠে, মানুষকে ভজনা করে, মানুষের সাধনাই লালনের মত-পথ।

ফকির লালন সাঁইজির দেহত্যাগের শত বছর পর আজও মরা কালীগঙ্গার পাড়ে মানুষের মিলনমেলা জমে। ফকির, সাধকদের একতারায় সমবেত আওয়াজ ওঠে। ভক্তদের পদধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে ছেঁউড়িয়া। সাধুগুরুদের কণ্ঠে ছড়িয়ে পরে মহাত্মা লালন ফকিরের মানবতার বাণী। দূরদূরান্ত থেকে ফকির সাধকরা তাদের শিষ্য অনুরাগীদের নিয়ে মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির আখড়া বাড়িতে হাজির হন।

একতারার সঙ্গে সুর তোলে, “ভবে মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার, সর্ব সাধন সিদ্ধ হয় তার।” কারিগরের তাঁতের শব্দ আর ফকির সাধকদের গাওয়া সুরের সাথে কুষ্টিয়াবাসীর সখ্য অনেকদিনের। সেই কবে মলম শাহ্ কালীগঙ্গার পাড় হতে পরিচয়হীন এক অচিন মানুষকে খুঁজে পায়। তুলে দেয় সহধর্মিণী মতিজানের হাতে। সেই থেকে তাঁদের বাৎসল্যে বেড়ে ওঠে অচিন মানুষটি। লালিত পুত্রের নাম হয় “লালন”।

দীর্ঘ ১১৬ বছরের জাগতিক জীবনে তিনি অজস্র শিষ্য প্রশিষ্য নিয়ে যে সত্য সুপথের অসাম্প্রদায়িক মানবতার পরিবার গড়ে তোলেন। এইদিন ভোর পাঁচটায় তিনি শিষ্যসেবকদের নিকট থেকে চিরদিনের জন্যে জাগতিকভাবে পর্দা করেন।

কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া হয়ে ওঠে এই লালনের প্রধান আশ্রয়। লালন হয়ে ওঠেন ফকির। সমগ্র বিশ্বের সাঁইজি। গড়ে তোলেন স্রষ্টার সৃষ্টির একমাত্র অসাম্প্রদায়িক মানবতার তীর্থভূমি।

১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর অর্থাৎ ১২৯৭ বঙ্গাব্দের ১লা কার্তিক; ছেঁউড়িয়াবাসীসহ সমগ্র বিশ্বের সত্য সুপথের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদীগনের নিকট স্মরণীয় দিন। এই দিনেই পরম প্রিয় বাংলা ভাষাভাষীদের পথপ্রদর্শক বার্তাবাহক মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি দেহ রাখেন জাগতিক সংসার থেকে।

দীর্ঘ ১১৬ বছরের জাগতিক জীবনে তিনি অজস্র শিষ্য প্রশিষ্য নিয়ে যে সত্য সুপথের অসাম্প্রদায়িক মানবতার পরিবার গড়ে তোলেন। এইদিন ভোর পাঁচটায় তিনি শিষ্যসেবকদের নিকট থেকে চিরদিনের জন্যে জাগতিকভাবে পর্দা করেন।

১২৯৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংক্রান্তির দিনে সাঁইজি তাঁর আখড়ায় সাধুসঙ্গের আয়োজন করেন। কথিত আছে যে, সাঁইজির ইচ্ছানুযায়ী এই দিনে সাধুদের ইলিশ মাছ দিয়ে সেবা দেওয়া হয়। সাঁইজির ঘরের সামনে লেপা মোছা করে বসে সাঁইজি ঐশীবাণীর আসর। চলে নিগূঢ় তত্ত্ব কথার ব্যাখ্যা। শিষ্য সাধুরা সাঁইজির নিকট থেকে গুঢ়তত্ত্বের ব্যাখ্যা জেনে নিতে থাকেন।

সাঁইজির অন্তিমকালে সমবেত শিষ্যসেবক মিলিত হয়েছেন। সবাই নিঃশব্দ। কারো কোনো ভাবান্তর নেই। রুদ্ধকণ্ঠে নতমস্তকে সবাই আখড়া বাড়িতে বসে আছেন। কেবল এক একজন একতারা আর বায়াটিতে মৃদু আঘাত করে ধীরলয়ে সাঁইজির বাণী গেয়ে চলেছেন। পুরো রাত তাদের নিদ্রাহীনভাবে কেটেছে। এখন রাত্রি প্রায় শেষ। পূর্ব আকাশে ঊষার আবির্ভাব ঘটেছে।

এই সময় সাঁইজির কণ্ঠে শেষ ঐশীবাণী ধরলেন-

ক্ষম হে অপরাধ আমার।
এ ভব কারাগারে
পার কর হে দয়ালচাঁদ আমারে।।

…………………………………..
চিত্র:
ফকির লালন সাঁইজির প্রকৃত কোনো ছবি নেই। লেখাতে ব্যবহৃত ছবিটি লালন ফকিরের কাল্পনিক একটি ছবি মাত্র। বহুল ব্যবহৃত হলেও এই ছবির সাথে লালন সাঁইজির আদৌ কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া যায় না।

………………………..
আরো পড়ুন:
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: এক
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: দুই
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজি: তিন

লালন ফকিরের নববিধান: এক
লালন ফকিরের নববিধান: দুই
লালন ফকিরের নববিধান: তিন

লালন সাঁইজির খোঁজে: এক
লালন সাঁইজির খোঁজে: দুই

লালন সাধনায় গুরু : এক
লালন সাধনায় গুরু : দুই
লালন সাধনায় গুরু : তিন

লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: এক
লালন-গীতির দর্শন ও আধ্যাত্মিকতা: দুই

ফকির লালন সাঁই
ফকির লালনের ফকিরি
ফকির লালন সাঁইজি
চাতক বাঁচে কেমনে
কে বলে রে আমি আমি
বিশ্ববাঙালি লালন শাহ্ফকির লালন সাঁইজির শ্রীরূপ
গুরুপূর্ণিমা ও ফকির লালন
বিকৃত হচ্ছে লালনের বাণী?
লালন ফকিরের আজব কারখানা
মহাত্মা লালন সাঁইজির দোলপূর্ণিমা
লালন ফকির ও একটি আক্ষেপের আখ্যান
লালন আখড়ায় মেলা নয় হোক সাধুসঙ্গ
লালন অক্ষ কিংবা দ্রাঘিমা বিচ্ছিন্ন এক নক্ষত্র!
লালনের গান কেন শুনতে হবে? কেন শোনাতে হবে?
লালন গানের ‘বাজার বেড়েছে গুরুবাদ গুরুত্ব পায়নি’
‘গুরু দোহাই তোমার মনকে আমার লওগো সুপথে’
মহাত্মা ফকির লালন সাঁইজির স্মরণে বিশ্ব লালন দিবস

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!