ভবঘুরেকথা
মীরাবাঈ

মীরার কথা

১৪৯৮ সালে ভারতের রাজস্থান রাজ্যের নাগৌর জেলার অন্তঃপাতী মেরতার নিকটবর্তী কুদকি (কুরকি) নামে একটি ছোট গ্রামে মীরাবাঈ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মীরাবাঈ-এর পিতা রাঠোর বংশীয় রাজপুত জমিদার যোধা রতন সিং রাঠোর। মাতা বীরকুমারী ছিলেন ভক্তিময়ী নারী।

১৫০৫ সালে রাজস্থানের পালির পাথুরে রাস্তা দিয়ে বাদ্য বাজিয়ে চলেছে বিয়ের শোভাযাত্রা। প্রাসাদের জানালা দিয়ে তা দেখে আর চোখের পলক পড়ে না ছোট্ট মীরার। এক দৌঁড়ে মায়ের কাছে গিয়ে বালিকার আব্দার, আমার বর কই মা?

সাত বছরের মেয়ের কথা শুনে কী উত্তর দেবেন ভেবে পেলেন না রানি বীরকুমারী। হাত ধরে নিয়ে গেলেন গৃহদেবতা গিরিধারীর মূর্তির সামনে। বললেন, এই তো তোমার বর।

এরপর থেকে কী যে হল। শ্রীকৃষ্ণের হাজারো রূপের মধ্যে‚ এক আঙুলে গোবর্ধন পাহাড়কে ধরে রাখা ‘গিরিধারী’ রূপকেই মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছিলেন মীরা। সাত বছরের রাজকুমারী মীরা, গিরিধারী ছাড়া কিছুই বোঝে না। তার জগৎ জুড়ে শুধুই শ্রীকৃষ্ণ। ক্ষত্রিয় রাজপুতকন্যার এই আচরণে বিস্মিত প্রাসাদের সবাই।

কারণ মীরা যে সে পরিবারের মেয়ে নয়। স্বয়ং রতন সিং তারা বাবা। রাঠোড় বংশের মেরটা-শাসক রাও দুদার ছোট ছেলে রতন সিং। রাও দুদা আবার রাও যোধার ছেলে। এই রাও যোধা প্রতিষ্ঠা করেন যোধপুর শহরের। সেই রাও যোধার প্রপৌত্রী হয়ে মীরা কি না ভেসে গেলেন ভক্তিসাগরে। কৃষ্ণপ্রেমে ! ক্ষত্রিয় বংশের মেয়ে হয়ে যেটা বেশ বেমানান।

মায়ের কাছে কৃষ্ণপ্রেমের সঙ্গে পরিচয় হলেও মীরা বেশিদিন মাতৃস্নেহ পাননি। তাঁর বালিকা বয়সেই সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান বীরদেবী। বাবা রতন সিং মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা যান।

বাবা-মাকে হারিয়ে রাজকুমারী মীরা বড় হন ঠাকুরদা রাও দুদা এবং জেঠু রাও ভীরাম দেবের অভিভাবকত্বে। রাও দুদা ছিলেন বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী। তিনি মীরাকে ধর্ম, রাজনীতির ব্যাপারে পাঠদান করেন। পাশাপাশি গান এবং শিল্পকলায়ও পারদর্শী হয়ে ওঠেন মীরা।

১৫১৬ সালে, ১৮ বছর বয়সে অপরূপা সুন্দরী মীরার বিয়ে হয় মেবারের রাজা রাণা সঙ্ঘের ছেলে ভোজরাজের সঙ্গে। গিরিধারীর মূর্তি সঙ্গে নিয়ে মীরা মেরটা থেকে পা রাখেন চিতোরের কেল্লায়। সঙ্গে ছিলেন বাল্যবন্ধু মিথুলা। তিনি শেষ দিন পর্যন্ত মীরার ছায়াসঙ্গী ছিলেন।

মীরার বিবাহিত জীবন সুখের হয়নি। তিনি হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণের আসনে কাউকে বসাতে পারেননি। বিয়ের মাত্র পাঁচ বছর পরে মীরার স্বামী নিহত হন মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধে। এরপর আরও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে তাঁর জীবন। রানাসঙ্ঘ যতদিন বেঁচেছিলেন প্রাসাদে থাকতে পেরেছিলেন তাঁর পুত্রবধূ। কিন্তু এরপর সেটাও আর সম্ভব হল না।

মীরার খ্যাতি এবং আধ্যাত্মিকতা লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে মোঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। সম্রাট আকবর ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তানসেনকে সাথে নিয়ে হাজির হন মীরার কাছে। আকবর তার প্রাণবন্ত সঙ্গীত এবং ভক্তিমূলক গানে এতটাই আসক্ত হয়েছিলেন যে, ফিরে যাওয়ার সময় মীরার চরণে তার পরিহিত মূল্যবান গলার মালা উৎসর্গ করে যান।

কৃষ্ণ-উপাসনা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় বাড়তে থাকে মীরার উপর অত্যাচার। এই মানসিক নিগ্রহের মূল হোতা ছিলেন মীরার দেওর, চিতোরের নতুন শাসক বিক্রমাদিত্য।

শেষে হাজারো অপবাদ আর গিরিধারীর মূর্তি নিয়ে মীরা চলে আসেন মেরটায়। কিন্তু সেখানেও মন বসেনি। এরপর মীরা চলে যান তাঁর আরাধ্যের লীলাভূমি বৃন্দাবনে।

জীবনের এই পর্বে মীরা আর রাজকুমারী নন। পুরোপুরি সাধিকা। এই সময় বৃন্দাবনে ছিলেন চৈতন্যের শিষ্য রূপগোস্বামী। মীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। কিন্তু একজন মহিলার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হননি রূপ-সনাতনের রূপ গোস্বামী।

এই প্রত্যাখানে ভেঙে পড়েননি মীরা। বৃন্দাবন থেকে শুরু হয় তাঁর ভক্তি আন্দোলন। পায়ে হেঁটে তিনি চষে ফেলেন উত্তর ভারতের প্রতিটি কোণা। কাশীতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় কবীরের।

দেশ জুড়ে তীব্র হয় ভক্তি আন্দোলন। কবীরের দোঁহার মতো ছড়িয়ে পড়ে মীরার ভজন। রাজস্থানি-ব্রজবুলি আর হিন্দিতে মেশানো এই ভজন একইসঙ্গে ভক্তি, প্রেম আর বিরহের কথা বলে। সরল ছন্দে বাঁধা এই ভজন পদ, মধ্যযুগে ভারতের ভক্তি আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র হয়ে ওঠে।

মীরার খ্যাতি এবং আধ্যাত্মিকতা লোকমুখে প্রচারিত হতে হতে মোঘল সম্রাট আকবরের কানে পৌঁছায়। সম্রাট আকবর ভিক্ষুকের ছদ্মবেশে তানসেনকে সাথে নিয়ে হাজির হন মীরার কাছে। আকবর তার প্রাণবন্ত সঙ্গীত এবং ভক্তিমূলক গানে এতটাই আসক্ত হয়েছিলেন যে, ফিরে যাওয়ার সময় মীরার চরণে তার পরিহিত মূল্যবান গলার মালা উৎসর্গ করে যান।

জীবনের শেষ দিনগুলো গুজরাটের দ্বারকায় কাটিয়েছিলেন মীরা। মন্দিরে গিরিধারীর মূর্তিতে বিলীন হয়ে যান তিনি।

তাঁকে হত্যার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন দেওর বিক্রমাদিত্য। তার মধ্যে সবথেকে বেশি চর্চিত হল চরণামৃত বলে দেওয়া বিষ যখন মীরা পান করেছিলেন, কৃষ্ণের কৃপায় তা বদলে গিয়েছিল চরণামৃততে। সাজিতে লুকিয়ে রাখা সাপ পাল্টে গিয়েছিল ফুলের মালায়।

এই রাজপুত নারী শিখিয়ে গেছেন বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। কৃষ্ণপ্রেমে বিলীন হতে প্রাসাদের বিলাসিতা ত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি তিনি। কলঙ্কের ভাগী হয়ে ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলেন। শুধু নিজের প্রেমকে বিসর্জন দেবেন না বলে।

জয় গোবিন্দ হরি জয় নন্দলাল
কৃষ্ণ কানাই জয় জয় ব্রজের গোপাল।
ত্রিভূবনে হাসি দেখি তোমার দয়ায়
বিরূপ শুধু প্রভু তুমি আমার বেলায়।

কেউতো বোঝেনা, কিসের ব্যথায়?
কেঁদে কেঁদে মীরার দিন কেটে যায়।
ও কেউতো বোঝেনা কিসের ব্যথায়?
কেঁদে কেঁদে মীরার দিন কেটে যায়।

পরতে গেলাম আমি মায়ার কাজল,
কাজল হয়ে গেল নয়নের জল।
চাইতে গেলাম সুধা, পেলাম গরল,
রইল আমার মালায় কাঁটাই কেবল।

কেউতো বোঝেনা, কিসের ব্যথায়?
কেঁদে কেঁদে মীরার দিন কেটে যায়।
ত্রিভূবনে হাসি দেখি তোমার দয়ায়,
বিরূপ শুধু প্রভু তুমি আমার বেলায়।

আমার ভালবাসার একি পরিনাম?
আধাঁরে যাকিছু আলো, সবই হারালাম।
আমায় একা ফেলে রইলে কোথায়?
জানিনা তো কবে দেখা দেবে আমায়?

কেউতো বোঝেনা, কিসের ব্যথায়?
কেঁদে কেঁদে মীরার দিন কেটে যায়।
জয় গোবিন্দ হরি জয় নন্দলাল,
কৃষ্ণ কানাই জয় জয় ব্রজের গোপাল।

………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………..
আরো পড়ুন:
মা সারদা দেবী
প্রজ্ঞাপারমিতা শ্রীশ্রীমা সারদা
বহুরূপিনী বিশ্বজননী সারদামণি
মা মনোমোহিনী
শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে সপ্তসাধিকা
মাতৃময়ী তিনরূপ
মা আনন্দময়ী
আনন্দময়ী মায়ের কথা
ভারত উপাসিকা নিবেদিতা
রাসমণি
নিরাহারা যোগিনী মায়ের সন্ধানে
পূণ্যশীলা মাতা কাশীমণি দেবীর সাক্ষাৎকার
আনন্দময়ী মা
মা মারিয়াম :: পর্ব-১
মা মারিয়াম :: পর্ব-২
মা মারিয়াম :: পর্ব-৩
মা মারিয়াম :: পর্ব-৪
মীরার কথা
অলৌকিক চরিত্র মাদার তেরেসা
মা আনন্দময়ীর কথা
বৈষ্ণব সাধিকা যশোদা মাঈ
আম্মার সঙ্গলাভ
শ্রীশ্রী সাধিকা মাতা
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!