ভবঘুরেকথা
জগন্নাথদেব নারায়ণ হিন্দু দেবতা

হিন্দুধর্ম

-ভগিনী নিবেদিতা

স্বামীজী সর্বদাই হিন্দুধর্মকে এক অখণ্ডরূপে চিন্তা করায় মগ্ন থাকিতেন, এবং বৈষ্ণবধর্ম প্রসঙ্গেই এ বিষয়টির বার বার অভিব্যক্তিদেখা যাইত। সন্ন্যাসী হিসাবে সম্ভবতঃ শৈবধর্মের ভাবসমূহের দ্বারা তাহার কল্পনা সমধিক প্রভাবিত ছিল, কিন্তু বৈষ্ণবধর্ম ও উহার বিশ্লেষণেও তাঁহার অনুরাগ ছিল চিরকাল।

অবশ্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসহায়ে যে বিষয়টি তাহার অধিগত ছিল, তাহা হইল অদ্বৈতবাদের সত্যতা। যে দুটি প্রতীকের মাধ্যমে তিনি এই অদ্বৈতবাদ প্রচার করিতে চাহিতেন- তাহার একটি সন্ন্যাসের আদর্শ, অপরটি ভীষণের পূজা। এই উভয় সত্যই কিন্তু কেবল বীর বা যোদ্ধাপ্রকৃতির ব্যক্তির জন্য।

উহাদের দ্বারা একদল সৈন্য সংগঠন করা যাইতে পারে। জগতের অধিকাংশ মানব চিরদিন ঈশ্বরকে দয়ালু, রক্ষাকর্তা এবং পালনকর্তা বলিয়া চিন্তা করিবে। প্রকৃত প্রশ্ন হইল, সর্বোচ্চ অদ্বৈতদর্শন এবং এই প্রকারের বিশ্বাসের মধ্যে যে সংযোগ আছে, সেই সম্পর্কে সাধারণ লোকের জ্ঞান কিরূপে অধিকতর দৃঢ় করা যায়।

বস্তুতঃ পাশ্চাত্যের কথা বলিতে গেলে এই সংযোগসেতু নির্মাণ করিবার প্রয়োজন ছিল। সেখানে অদ্বৈতবাদ ব্যাখ্যা ও প্রচার আবশ্যক। কিন্তু ভারতবর্ষে বহুপূর্বেই এ কার্য সম্পন্ন হইয়াছে। ভারতে এই বিষয়গুলি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত ও গৃহীত।

এখন কেবল প্রয়োজন ঐ উপলব্ধির পুনরুজ্জীবন, হিন্দুধর্মের বিভিন্ন অংশগুলি যে পরস্পর সম্বদ্ধ তাহা ভারতবাসীকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া এবং প্রয়োজন ঐ বিষয়টির বারংবার আলোচনা, যাহাতে যে তর্কযুক্তি সহায়ে বৈষ্ণবধর্ম ও সর্বোচ্চ দর্শন অদ্বৈতবাদ অবিসংবাদিতরূপে অনন্যান্যসাপেক্ষ বলিয়া প্রমাণিত, তাহার মধ্যে কোন ছিদ্র না থাকে।

এইরূপে, তিনি হিন্দুধর্মের ঐতিহাসিক আত্মপ্রকাশের সৌন্দর্যের দিকটি বর্ণনা করিতে ভালবাসিতেন। সর্বদাই তিনি অন্বেষণ করিতেন, কোন একটি ঘটনার ক্রমবিকাশের পশ্চাতে কোন মহাশক্তির প্রেরণা বিদ্যমান। কোন ধর্মসংস্থাপকের পিছনে সেই চিন্তাশীল মনীষী কোথায়?

আবার সেই চিন্তারাশি পূর্ণতালাভ করিল কোন্ মহাপ্রাণের চেষ্টায়! বুদ্ধ তাহার রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান এই পঞ্চতত্ত্বে গঠিত দর্শন মহর্ষি কপিলের নিকট প্রাপ্ত হন। কিন্তু যে প্রেম ঐ দর্শনে প্রাণ সঞ্চার করে, তাহা বুদ্ধের নিজস্ব।

কপিল বলিয়াছিলেন, এই পঞ্চতত্ত্বের কোনটির সম্পর্কেই নির্দিষ্ট করিয়া কিছু বলা যায় না, কারণ কোনটিরই অস্তিত্ব নাই। উহা অতীতে ছিল, কিন্তু বর্তমানে আর নাই। “প্রত্যেকেই জলরাশির উপর বুদ্বুদমাত্র। হে মানব, জেনে রাখো, তুমি সেই জলধিস্বরূপ।”

আবার সর্বসাধারণের বোধ্য যে হিন্দুধর্ম তাহার প্রচারক ও স্রষ্টা হিসাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি স্বামীজীর এমন আবেগপূর্ণ মনোভাব ছিল, যাহা ভগবান বুদ্ধের প্রতি ব্যক্তিগত প্রগাঢ় অনুরাগ অপেক্ষা কোনক্রমেই কম বলা চলে না। শ্রীকৃষ্ণের বহুমুখী ভাবের তুলনায় বুদ্ধের সন্ন্যাস আদর্শ প্রায় দুর্বলতাই বলা যায়। গীতা কি বিস্ময়কর গ্রন্থ!

“সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ তথা মানাপমানয়োঃ।
শীতোষ্ণসুখদুঃখেষু সমঃ সঙ্গবিবর্জিতঃ।।”গীতা, ১২।১৮

বাল্যকালে গীতা পড়িবার সময় তিনি প্রায়ই ঐ ধরনের কোন গভীর অর্থপূর্ণ বাক্য দেখিলে থামিয়া যাইতেন, তারপর বহুদিন ধরিয়া ঐ কথাগুলি তাহার মস্তিষ্কে আলোড়ন তুলিত। আর সেই যুদ্ধের বর্ণনা- সেই প্রচণ্ড তেজঃপূর্ণ যুদ্ধ- শ্রীকৃষ্ণের ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে’ (গীতা, ২।৩) বাক্যে যাহার আরম্ভ!

কি শক্তিপূর্ণ! ইহা ব্যতীত সত্যই গীতা অপূর্ব সৌন্দর্যের খনি! বৌদ্ধগ্রন্থগুলির পর গীতা যেন সকলের নিকট স্বস্তি বহন করিয়া আনিল। বুদ্ধ সর্বদা বলিতেন, “আমি সাধারণ লোকদের জন্য এসেছি।” অমনি বৌদ্ধগণ তাহার নামে ললিতকলা ও বিদ্যাচর্চার সমস্ত গৌরব পদদলিত করিয়া চূর্ণ করিল। প্রাচীনকে ধ্বংস করিয়া ফেলাই বৌদ্ধধর্মের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক ভুল।

“কারণ বৌদ্ধগ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করা একপ্রকার যন্ত্রণাবিশেষ। অজ্ঞ জনসাধারণের জন্য ঐ গ্রন্থগুলি লিখিত হওয়ার ফলে এক একখানি বিশাল গ্রন্থে মাত্র দু-একটি উচ্চভাব দেখতে পাওয়া যায়।[১] এই অভাব পূরণ করবার জন্যই পুরাণের উদ্ভব। ভারতে মাত্র একজন মনীষী পূর্ব থেকেই এই অভাব হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন তিনি শ্রীকৃষ্ণ। বোধ হয় তার মতো মহাপুরুষ আর জন্মগ্রহণ করেননি।

সাধারণ লোকের অভাব, এবং পূর্বেই জাতির মধ্যে যা কিছু সঞ্চিত হয়েছে, তা সংরক্ষণের আকাঙ্ক্ষা তিনিই সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করেছিলেন। শুধু গোপী-ভাগবত ও গীতার (গীতায় পুনঃ পুনঃ স্ত্রী ও শূদ্রগণের প্রসঙ্গ আছে) সাহায্যেই তিনি সাধারণ লোকদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করেননি। কারণ, সমগ্র মহাভারত তাঁরই, তার ভক্তগণ কর্তৃক রচিত এবং গোড়া থেকেই ঘোষণা করছে যে, গ্রন্থখানি সাধারণ লোকদের জন্য।

“এইভাবে একটি ধর্মের সৃষ্টি হলো, যার পরিণতি বিষ্ণুপূজায় এবং তার মূল কথা হলো জীবনের গতি অব্যাহত রেখে, ভোগের মধ্যে থেকেও ঈশ্বরলাভের চেষ্টা। আমাদের দেশের শেষ ধর্ম-আন্দোলন শ্রীচৈতন্য প্রচারিত ধর্ম ভোগবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত, তা বোধ হয় তোমার জানা আছে।[২] আবার দেখ, জৈনধর্ম প্রচার করছে ঠিক তার বিপরীত ভাব-আত্মপীড়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে শরীরপাত।

“এখন আমাদের ভারতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে তার নিজের ভাবেই সাহায্য করতে হবে। যে সব আন্দোলন কোন ব্যক্তি বা কাজকে তাদের নিজস্বভাব বজায় রেখে সাহায্য করতে চেষ্টা না করে, আন্দোলন হিসাবে তার সার্থকতা থাকে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, ইউরোপে আমি বিবাহ ও ব্রহ্মচর্যকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করি।

সুতরাং দেখছ, বৌদ্ধধর্ম হলো জৈনধর্মের সংশোধিত আকার এবং বুদ্ধ কর্তৃক সেই পাচজন কঠোর তপস্বীর সঙ্গত্যাগের এই হলো প্রকৃত অর্থ। ভারতবর্ষে প্রত্যেক যুগে এমন কতকগুলি ক্রমবিন্যস্ত সম্প্রদায় থাকে, যাদের মধ্যে চরম শারীরিক-নিগ্রহ থেকে আবম্ভ করে চূড়ান্ত ভোগবাদ পর্যন্ত সকল প্রকার বাহ্য সাধনার নিদর্শন পাওয়া যায়।

আবার ঐ কালেই ঐভাবে ক্রমবিন্যস্ত কতকগুলি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়ে থাকে, যাদের সাধন প্রণালীর মধ্যে দেখা যায়, ইন্দ্রিয়গুলিকে সাধনের অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করা থেকে তাদের বিলোপ-সাধন পর্যন্ত সবরকম প্রচেষ্টার মাধ্যমে ঈশ্বরোপলব্ধির চেষ্টা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, হিন্দুধর্ম চিরকালই দুটি spiral বা পেঁচের দ্বারা গঠিত তাদের বেড়গুলি বিপরীতমুখী; একই অক্ষ বা মেরুদণ্ড আশ্রয় করে আছে, এবং একটি অপরটির পরিপূরক।

“বৈষ্ণবধর্ম বলে, ‘পিতা, মাতা, ভ্রাতা, স্বামী বা সন্তানের জন্য এই যে প্রচণ্ড ভালবাসা, এসব ঠিক!, এসবই ঠিক, যদি কেবল তুমি ভাবতে পার যে, কৃষ্ণই তোমার ঐ সন্তান, এবং তাকে আহার করাবার সময় মনে করতে হবে, কৃষ্ণকেই আহার করাচ্ছ। ইন্দ্রিয়গুলোকে নিগ্রহ কর, ওদের দমন কর’- বেদান্তের এই নির্দেশের পরিবর্তে শ্রীচৈতন্যের উপদেশ ছিল- ”ইন্দ্রিয়গুলির সহায়তা নিয়ে পূজা কর!

“বর্তমান কালে আমরা জাতীয় ধর্মের তিনটি বিভিন্ন রূপ দেখতে পাইপ্রাচীনপন্থী ধর্ম, আর্যসমাজ ও ব্রাহ্মসমাজ। প্রাচীনপন্থী ধর্ম মহাভারত যুগে বৈদিক হিন্দুগণ কর্তৃক গৃহীত পথ অবলম্বন করেছে। জৈনধর্মের স্থান অধিকার করেছে আর্যসমাজ, এবং ব্রাহ্মসমাজ বৌদ্ধধর্মের স্থান গ্রহণ করেছে।

“আমি দেখতে পাচ্ছি, ভারত নবীন ও প্রাণবন্ত। ইউরোপও তরুণ এবং সজীব। এদের মধ্যে কেউ এখনো পর্যন্ত বিকাশের এমন স্তরে উপনীত হয়নি, যাতে তাদের সব অনুষ্ঠান নিরাপদে সমালোচনা করা চলে। উভয়েই বিরাট পরীক্ষা-নিরীক্ষায় রত, কোনটি এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণতা লাভ করেনি।

ভারতে আমাদের সর্বস্তরে যে সাম্যবাদ (Social Communism) তা সমাজের অধীনে, অদ্বৈতজ্ঞানের আলো তার ওপর এবং আশে পাশে বিকীর্ণ হচ্ছে, তাকে বলা যায় আধ্যাত্মিক ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র (Spiritual Individualism)। ইউরোপে তোমরা সামাজিক ব্যাপারে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রতার (Social Individualism) পক্ষপাতী, কিন্তু চিন্তাধারায় তোমরা দ্বৈতবাদী; অর্থাৎ আধ্যাত্মিক ব্যাপারে তোমরা নিজ নিজ মতে না চলে কোন একটা সাধারণ মত (Spiritual Communism) অনুসরণ কর।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, একের (অর্থাৎ ভারতের) দৈনন্দিন জীবনের সব অনুষ্ঠান সমাজতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; কিন্তু ব্যক্তিগত চিন্তা স্বাধীনতা দ্বারা সীমাবদ্ধ; আর অপরের অনুষ্ঠানগুলি ব্যক্তিতান্ত্রিক, কিন্তু এক সাধারণ চিন্তাপ্রভাবে নিয়ন্ত্রিত।

“এখন আমাদের ভারতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে তার নিজের ভাবেই সাহায্য করতে হবে। যে সব আন্দোলন কোন ব্যক্তি বা কাজকে তাদের নিজস্বভাব বজায় রেখে সাহায্য করতে চেষ্টা না করে, আন্দোলন হিসাবে তার সার্থকতা থাকে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলতে পারি, ইউরোপে আমি বিবাহ ও ব্রহ্মচর্যকে সমানভাবে শ্রদ্ধা করি।

ঐহিক জ্ঞানবৃদ্ধি আমাদের বালকের সেই দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু অবশেষে উচ্চতর জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা পুনরায় ঐ অবস্থায় উপনীত হই। ছোট ছেলেরা গাছপালা, ইট, কাঠ, পাথর, সব জিনিসের মধ্যে একটা জীবন্ত শক্তি দেখতে পায়। আর সত্যি কি এদের পিছনে কোন জ্বলন্ত শক্তির অস্তিত্ব নেই? এটা প্রতীকোপাসনা, জড়োপাসনা নয়। দেখতে পাচ্ছ না?”

কখনও ভুলে যেও না, দোষ ও গুণের সমাবেশেই মানুষ মহৎ হয় ও পূর্ণত্ব লাভ করে। সুতরাং কোন জাতির সবই দোষযুক্ত একথা প্রমাণ করা সম্ভব হলেও, তার উন্নতির জন্য সাহায্য করতে গিয়ে তার জাতীয়ত্ব অপহরণ করবার চেষ্টা করা উচিত নয়।”

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বলিতে তিনি কি বুঝিতেন, সে বিষয়ে তাহার ধারণা অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল। কতবার তিনি আমাকে বলিয়াছেন, “তোমরা এখনো ভারতবর্ষকে বুঝতে পারনি। যাই বলল, ভারতবাসী আমরা মানুষের উপাসনা করি। আমাদের ঈশ্বর দেহধারী মানুষ।”

এ স্থলে তিনি সেই সব আত্মদর্শী মহাপুরুষদের কথা বলিতেছিলেন – যেমন বুদ্ধ, শ্রীকৃষ্ণ, গুরু বা মহাপুরুষ। অন্য এক সময়ে তিনি ‘মানব’ শব্দটি সম্পূর্ণ পৃথক অর্থে ব্যবহার করেন। তিনি বলিয়াছিলেন, “এই মানব-উপাসনার[৩] ভাব সূক্ষ্ম বীজাকারে ভারতবর্ষে বর্তমান, কিন্তু কখনো বিকাশলাভ করেনি। তোমাদের উচিত এর বিকাশসাধন। এই ভাবকে কাব্যে, ললিতকলায় রূপায়িত কর।

তোমাদের মধ্যযুগের ইউরোপের মতো আবার সেই ভিক্ষুকদের পা পূজা করবার প্রথা প্রবর্তন কর। মানুষের পূজা করবে এমন এক উপাসক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি কর।”

আবার, প্রতিমাপূজার উপকারিতা সম্বন্ধেও তার ধারণা সমভাবেই স্পষ্ট ছিল। তিনি বলিতেন, “তোমরা সব সময়ে বলতে পার যে, প্রতিমাই ঈশ্বর। কিন্তু ঈশ্বরকে প্রতিমা ভেবে বসা–এ ভুল করো না।” একবার কয়েকজন তাহাকে ‘হোটেণ্টটদের জড়োপাসনা’র নিন্দা করিবার জন্য অনুরোধ করে। উত্তরে তিনি বলেন, “জড়োপাসনা কাকে বলে আমি জানি না।”

তখন তাড়াতাড়ি তাহার নিকট এক বীভৎস চিত্রসহকারে এ উপাসনা বর্ণনা করা হইল- পূজাৰ্হ বস্তুটিকে তাহারা ক্রমান্বয়ে প্রথমে পূজা, তারপর প্রহার এবং অবশেষে ধন্যবাদজ্ঞাপন করিয়া থাকে। উত্তরে তিনি সবিস্ময়ে বলিলেন, “আমি এর নিন্দা করব!”

পরক্ষণেই সমাজে যাহারা নিম্নশ্রেণী, অসাক্ষাতে তাহাদের প্রতি অন্যায় আচরণে অসন্তুষ্ট হইয়া উত্তেজিতস্বরে বলিলেন,”দেখছ না, এটা জড়োপাসনা নয়? ওঃ, তোমাদের হৃদয় কি কঠিন! দেখতে পাও না যে, ছোট ছেলেরা ঠিকই করে থাকে। তারা সবই চৈতন্যময় দেখে।

ঐহিক জ্ঞানবৃদ্ধি আমাদের বালকের সেই দৃষ্টি থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু অবশেষে উচ্চতর জ্ঞানের মাধ্যমে আমরা পুনরায় ঐ অবস্থায় উপনীত হই। ছোট ছেলেরা গাছপালা, ইট, কাঠ, পাথর, সব জিনিসের মধ্যে একটা জীবন্ত শক্তি দেখতে পায়। আর সত্যি কি এদের পিছনে কোন জ্বলন্ত শক্তির অস্তিত্ব নেই? এটা প্রতীকোপাসনা, জড়োপাসনা নয়। দেখতে পাচ্ছ না?”

সত্য সম্পর্কে এরূপ নির্ভীক মতবাদ ইতিপূর্বে নিশ্চয়ই দেখা যায় নাই। তাহার কথা শুনিতে শুনিতে বুঝিলাম, সমস্ত ব্যাপারটি প্রাচ্য মনের এই অন্তর্নিহিত, স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাসের উপর স্থাপিত যে, ধর্ম উপলব্ধির বস্তু, কোন মতবাদ নহে; স্বামীজী নিজেই যেমন অন্যত্র বলিয়াছেন, উহা ক্রমিক অবস্থান্তর-প্রাপ্তি-ধর্মের প্রভাবে মানুষ উত্তরোত্তর নূতন ও উচ্চতর জীবন লাভ করে।

কিন্তু যদিও প্রত্যেক ব্যক্তির আন্তরিক মনোভাব ছিল তাঁহার নিকট পবিত্র, মুহূর্তের জন্যও তিনি হিন্দুধর্ম-দর্শনের মাহাত্ম বিস্মৃত হইতেন না। আইনবিগণের বোধ্য শুষ্ক যুক্তিতর্ক দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝাইতে গিয়া তিনি তাহাদের উপর অবিরত কবিত্বের অনন্ত উৎস খুলিয়া দিতেন। কী অনুরাগের সহিত মীমাংসা দর্শনের ব্যাখ্যা করিতেন।

কী গর্বের সহিত তিনি শ্রোতাকে স্মরণ করাইয়া দিতেন যে, হিন্দু পণ্ডিতগণের মতে সমগ্র জগৎ শুধু পদার্থময় (পদের অর্থ)! আগে শব্দ বা পদ, পরে বস্তু। সুতরাং অর্থ বা ভাবই সব! বস্তুতঃ ঐ বিষয়ে তিনি যখন ব্যাখ্যা করিতেছিলেন, তখন মীমাংসকদিগের অতি সাহসপূর্ণ যুক্তিপ্রণালী, নির্ভীকতার সহিত কতকগুলি বিষয়ের স্বীকৃতি এবং অনুমানের দৃঢ়তা আমাদের নিকট হিন্দুধর্মের বিশেষ গৌরবস্থল বলিয়া প্রতীত হইয়াছিল।

যে জাতি এরূপ বলিতে পারেন যে, ‘প্রতিমা পূজা করিলেও প্রতিমা প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্যবস্তু সম্বন্ধে চিন্তার অবলম্বন ব্যতীত তার কিছু নহে’; প্রার্থনার একাগ্রতার উপরেই উহার শক্তিবৃদ্ধি নির্ভর করে; দেবদেবীর অস্তিত্ব শুধু মনে, কিন্তু সে কারণেই জোর করিয়া বলা যায়, তাহারা সত্যই আছেন- তাঁহাদের সম্বন্ধে আর এ-কথা বলা যায় না যে, তর্কের যে-কোন মীমাংসা তাঁহারা কৌশলে পরিহার করিতে চাহেন।

সমগ্র চিন্তাধারা যেন মূর্তিবিদ্বেষী কালাপাহাড়ের সর্ববিধ্বংসী আক্রমণ বলিয়া মনে হইয়াছিল অথচ উহাই প্রযুক্ত হইয়াছিল একটি মত ব্যাখ্যার অনুকূলে।

একদিন তিনি সত্যভামার ব্রত অনুষ্ঠানের গল্প বলেন। একটি তুলসীপত্রে শ্রীকৃষ্ণের নাম লিখিয়া তুলাদণ্ডের একদিকের পাল্লায় রাখা হইল; অপরদিকে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং উপবিষ্ট থাকিলেও তাহার নামযুক্ত পাল্লা অধিক ভারী হইল।

স্বামীজী বলিতে লাগিলেন, “প্রাচীনপন্থী হিন্দুধর্ম ‘শ্রুতি’ বা শব্দকেই সব বলে থাকেন। বস্তু’ হলো পূর্ব থেকে বর্তমান শাশ্বত ভাবের একটা ক্ষীণ প্রতিচ্ছায়া মাত্র। সুতরাং ঈশ্বরের ‘নাম’ই সব; ভগবান নিজেই বিরাট মনে অবস্থিত সেই ভাবের বাহ্য অভিব্যক্তি মাত্র। তোমার নিজের নামও, তুমি যে ব্যক্তি বা সান্ত, তার অপেক্ষা অনন্তগুণে পূর্ণতর। ঈশ্বর অপেক্ষা নামের মাহাত্ম্য অধিক। অতএব বাক্যপ্রয়োগ সম্পর্কে সাবধান হবে।”

সত্য সম্পর্কে এরূপ নির্ভীক মতবাদ ইতিপূর্বে নিশ্চয়ই দেখা যায় নাই। তাহার কথা শুনিতে শুনিতে বুঝিলাম, সমস্ত ব্যাপারটি প্রাচ্য মনের এই অন্তর্নিহিত, স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাসের উপর স্থাপিত যে, ধর্ম উপলব্ধির বস্তু, কোন মতবাদ নহে; স্বামীজী নিজেই যেমন অন্যত্র বলিয়াছেন, উহা ক্রমিক অবস্থান্তর-প্রাপ্তি-ধর্মের প্রভাবে মানুষ উত্তরোত্তর নূতন ও উচ্চতর জীবন লাভ করে।

বৌদ্ধদের মতে রূপ অন্য চারিটি তত্ত্বের ফলস্বরূপ, নিজে কিছুই নহে। সুতরাং বৌদ্ধধর্মের মতে লক্ষ্যবস্তু বিজ্ঞানের পারে অবস্থিত বা পঞ্চতত্ত্বের বহির্ভূত। ইহাদের সঙ্গে আবার তিনি বেদান্তের (এবং ক্যান্টেরও) কাল, দেশ, নিমিত্ত- এই তিনটি প্রতিভাসিক বস্তুর উল্লেখ করিতেন- উহারাই নামরূপাকারে প্রকাশ পায়।

যদি একথা সত্য হয় যে, এই উপায়ে মানবকে বহুত্বের ধারণা হইতে ক্রমে নিশ্চিতরূপে সেই ‘একমেবাদ্বিতীয় তত্ত্বে উপনীত করে, তাহা হইলে ইহাও নিশ্চিত সত্য যে, আমরা যাহা কিছু দেখি, শুনি সবই মনে; বাহ্য জগৎ মনের কল্পনারই স্থূল রূপমাত্র।

সুতরাং প্লেটো-প্রচারিত গ্রীকদর্শন প্রকৃতপক্ষে হিন্দু মীমাংসা দর্শনের অন্তর্ভুক্ত, এবং ইউরোপীয়গণ যাহাকে শুধু ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞান’ বলিয়া অভিহিত করেন, ভারতীয় দর্শনে তাহার যুক্তিমূলক কারণ দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপেই আর একদিন, কোন স্বতঃসিদ্ধ সত্য সম্পর্কে যেমন কেহ বলিয়া থাকে, সেইভাবে তিনি বলেন,

“আমি গ্রীক দেবতাদেরও পূজা করব না, কারণ স্বরূপতঃ তারা মানুষ থেকে পৃথক ছিলেন। কেবল তাদেরই পূজা করা উচিত, যারা আমাদেরই মতো, কিন্তু আমাদের অপেক্ষা মহত্তর। দেবতা ও আমার মধ্যে যে প্রভেদ, তা শুধু প্রকাশের তারতম্য- আমি ক্ষুদ্র, তারা বৃহৎ এইমাত্র।”

কিন্তু দর্শন সম্পর্কে তাঁহার আলোচনা কোনক্রমেই সব সময় এইরূপ সৌখীন মতবাদ বা একটু আধটু সুস্বাদু চাটনীর মতো ছিল না। সাধারণতঃ তাহার দাবি ছিল, সকলেই পূর্ণমাত্রায় বিচারশক্তির প্রয়োগ করুক- এ বিষয়ে তিনি ছিলেন নির্দয়।

প্রাচীন মতবাদ ব্যাখ্যা করিতে গিয়া কখন কখনও তিনি দুই ঘণ্টাকাল পর্যন্ত কাটাইয়া দিতেন; শ্রোতৃবর্গ যে পণ্ডিত নহেন, এবং তাঁহারা বিরক্তি বা কষ্ট বোধ করিতে পারেন- এ বিষয়ে তাহার কোন সন্দেহ হইত না। ঐ সকল সময়ে ইহাও স্পষ্ট বোঝা যাইত যে, বিচারটি তিনি মনে মনে অপর এক ভাষায় অনুধাবন করিতেন, কারণ দেখা যাইত, পারিভাষিক শব্দগুলি অনুবাদ করিতে গিয়া মধ্যে মধ্যে তিনি ভিন্ন ভিন্ন শব্দ প্রয়োগ করিতেন।

এইরূপে তিনি বৈশেষিক মতে যে ছয়টি পদার্থের বিচারের দ্বারা জগতের উৎপত্তি নির্ণয় করিতে পারা যায়, তাহাদের উল্লেখ করিতেন। উহাদের নাম- দ্রব্য(৪), গুণ, কর্ম, সামান্য, সমবায় এবং বিশেষ। ইহাদের সহিত তিনি বৌদ্ধদের পঞ্চতত্ত্বের তুলনা করিতেন- রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান।

বৌদ্ধদের মতে রূপ অন্য চারিটি তত্ত্বের ফলস্বরূপ, নিজে কিছুই নহে। সুতরাং বৌদ্ধধর্মের মতে লক্ষ্যবস্তু বিজ্ঞানের পারে অবস্থিত বা পঞ্চতত্ত্বের বহির্ভূত। ইহাদের সঙ্গে আবার তিনি বেদান্তের (এবং ক্যান্টেরও) কাল, দেশ, নিমিত্ত- এই তিনটি প্রতিভাসিক বস্তুর উল্লেখ করিতেন- উহারাই নামরূপাকারে প্রকাশ পায়।

আবার অনুমানের প্রণালী পাচপ্রকার সাধ দ্বারা, বৈধ দ্বারা, সাধ ও বৈধ উভয় দ্বারা, আংশিক সাধ দ্বারা এবং আংশিক বৈধৰ্ম দ্বারা। শেষোক্ত দুইটি কখন কখনও একত্র ‘পারিশেষ্য’ নামে অভিহিত হয়। ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, কেবল তৃতীয় প্রণালী অবলম্বনেই ক্রটিশূন্য বা নির্ভুল অনুমান করা চলে, অর্থাৎ “অন্বয় ও ব্যতিরেক এই উভয় ভাবে প্রমাণ করিলে তবেই প্রমাণ যথার্থ হয়।”

এইনামরূপই মায়া- অর্থাৎ উহা সৎ নহে, আবার অসৎও নহে। অতএব স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, দৃশ্যমান এই জগতের কোন স্থায়ী সত্তা নাই বরং উহা এক নিত্য পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া। সৎ বস্তু এক, কিন্তু প্রক্রিয়াবশতঃ ঐ সৎ বস্তু নানারূপে প্রতিভাত হয়। ক্রমবিকাশ ও ক্রমসঙ্কোচ- উভয়ই মায়ার অন্তর্গত। সৎ বস্তুর বা প্রকৃত সত্তাব অভিব্যক্তি অথবা সঙ্কোচ কিছুই হয় না, উহা নিত্য একরূপে অবস্থিত।

যে পথ অনুসরণ করিয়া হিন্দুজাতি বর্তমান অবস্থায় উপনীত, তাহার পুনঃপ্রতিষ্ঠারূপ মহৎ ব্যাপার-প্রসঙ্গে স্বামীজী পাশ্চাত্য চিন্তার ফলাফল বিস্মৃত হন নাই। কারণ তাহার মন এরূপ উপাদানে গঠিত ছিল, যাহা কেবল লক্ষ্য করিত মানবের অনুসন্ধিৎসা কোন্ পথ অনুসরণ করিয়া অগ্রসর হইতেছে; সেখানে প্রাচীন ও আধুনিকের মধ্যে কোন কৃত্রিম প্রভেদ করিত না।

পাশ্চাত্য দর্শনে যাহাকে সিলোজিসম (Syllogism) বলে, তাহার বিশ্লেষণ করিয়া তিনি উহার সহিত প্রাচীন ভারতীয় ‘পঞ্চাবয়ব[৫] ন্যায়ের অদ্ভুত সাদৃশ্য দেখাইতেন। তারপরেই ন্যায়শাস্ত্রের চতুর্বিধ প্রমাণের আলোচনায় আসিতেন, উহারা হইল- প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং শব্দ। এই ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে আধুনিক অবরোহী প্রথা[৬] (Induction) ও আরোহী প্রথা[৭] (Deduction) স্বীকৃত হইত না।

এই মতে অনুমান মাত্রেই দুই প্রকার- অধিক পরিজ্ঞাত বস্তু হইতে অল্প পরিজ্ঞাত বস্তুর এবং অল্প পরিজ্ঞাত বস্তু হইতে অধিক পরিজ্ঞাত বস্তুর আবিষ্কার। প্রত্যক্ষ জ্ঞান হইতে যে অনুমান, তাহা ত্রিবিধ- প্রথম, যাহাতে কারণদৃষ্টে কার্য অনুমিত হয় (ন্যায়ের ভাষায় যাহাকে বলা হয় পূর্ববৎ’); দ্বিতীয়, যাহাতে কার্যদৃষ্টে কারণ অনুমিত হয় (শেষবৎ’);এবং তৃতীয়, যাহাতে আনুষঙ্গিক অন্যান্য অবস্থা পর্যালোচনার দ্বারা অনুমান করা হয় (সামান্যতোদৃষ্ট’)।

আবার অনুমানের প্রণালী পাচপ্রকার সাধ দ্বারা, বৈধ দ্বারা, সাধ ও বৈধ উভয় দ্বারা, আংশিক সাধ দ্বারা এবং আংশিক বৈধৰ্ম দ্বারা। শেষোক্ত দুইটি কখন কখনও একত্র ‘পারিশেষ্য’ নামে অভিহিত হয়। ইহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, কেবল তৃতীয় প্রণালী অবলম্বনেই ক্রটিশূন্য বা নির্ভুল অনুমান করা চলে, অর্থাৎ “অন্বয় ও ব্যতিরেক এই উভয় ভাবে প্রমাণ করিলে তবেই প্রমাণ যথার্থ হয়।”

নৈয়ায়িকেরা অনুমান-প্রমাণবলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ করিয়াছেন; বৈদান্তিকেরা কিন্তু শ্রুতি বা শব্দ-প্রমাণকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সাধনের মূল প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করিয়াছেন। তাঁহাদের মতে অনুমান সহকারী প্রমাণ মাত্র।

“দেখছ, একদল লোক বাহ্যবিকাশকে প্রাধান্য দেয়, আর একদল অন্তরের ভাব বা ধারণাকে। কোনটি আগে? পাখি আগে, তারপর ডিম-না ডিম আগে, তারপর পাখি পাত্রার তৈল, অথবা তৈলাধার পাত্র? এ সমস্যার মীমাংসা নেই, এ-সব বিচার ছেড়ে দাও। মায়ার হাত থেকে নিষ্কৃতিলাভ কর।”

“আবার ব্যাপ্তি বলে একটা ব্যাপার আছে। একখানা পাথর পড়ে গেল এবং তাতে একটা কীট মারা গেল। এর দ্বারা আমরা অনুমান করি, সকল পাথরই পড়লে কীট বিনাশ করে। একটি প্রত্যক্ষ ঘটনাকে আমরা বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে অন্যস্থলে প্রয়োগ করি কেন? কেউকেউ বলেন, ওটা অভিজ্ঞতারই ফল।

কিন্তু মনে কর, ওটা প্রথমবারই ঘটল। একটি শিশুকে শূন্যে ছুঁড়ে দাও, সে কাঁদবে। অতীত জন্মের অভিজ্ঞতা বলছ? কিন্তু ভবিষ্যতে কেন প্রযুক্ত হয়? তার কারণ, কতকগুলি বস্তুর মধ্যে একটি প্রকৃত সম্পর্ক আছে- ব্যাপ্তি সম্বন্ধ। আমাদের শুধু এইটুকু লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কোনভাবে ওতে অতিব্যাপ্তি অথবা অব্যাপ্তি দোষ না ঘটে। এই বিচারের ওপরেই মানবের সমস্ত জ্ঞান নির্ভর করছে।

“হেত্বাভাস অথবা ভ্রান্তযুক্তি সম্বন্ধে স্মবণ রাখতে হবে যে, প্রত্যক্ষ অনুভব তখনই প্রমাণস্বরূপ গণ্য হতে পারে, যখন ঐ অনুভবের ইন্দ্রিয়, অর্থাৎ যে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে অনুভব হবে) যে উপায় মাধ্যমে অনুভব হবে তা এবং ঐ অনুভবের অবিচ্ছিন্ন স্থিতি- সমস্তই হবে নির্দোষ। পীড়া বা ভাবাবেগ থাকলে লক্ষ্যের বিচ্যুতি ঘটবে।

সুতরাং প্রত্যক্ষ অনুভবও এক রকমের অনুমান। অতএব, সর্বপ্রকার মানবীয় জ্ঞান অনিশ্চিত এবং ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ হতে পারে। প্রকৃত দ্রষ্টা কে? তিনিই প্রকৃত দ্রষ্টা, যার নিকট আলোচ্য বিষয়টি প্রত্যক্ষ অনুভূত। সুতরাং বেদই সত্য, কারণ বেদ আপ্তপুরুষের সাক্ষ্য।

কিন্তু এই দর্শন বা অনুভবশক্তি কি কারও বিশেষ সম্পত্তি? না। ঋষিমাত্রেরই- আর্য বা ম্লেচ্ছ যেই হোন- এই ক্ষমতা আছে।

“আধুনিক বাঙালীরা বলেন, আপ্তবাক্য প্রত্যক্ষ অনুভবের এক বিশেষ অবস্থামাত্র, এবং উপমান ও সাদৃশ্যমূলক বিচার অপকৃষ্ট অনুমানমাত্র, সুতরাং প্রকৃত প্রমাণ মাত্র দুটি- প্রত্যক্ষ ও অনুমান।

“দেখছ, একদল লোক বাহ্যবিকাশকে প্রাধান্য দেয়, আর একদল অন্তরের ভাব বা ধারণাকে। কোনটি আগে? পাখি আগে, তারপর ডিম-না ডিম আগে, তারপর পাখি পাত্রার তৈল, অথবা তৈলাধার পাত্র? এ সমস্যার মীমাংসা নেই, এ-সব বিচার ছেড়ে দাও। মায়ার হাত থেকে নিষ্কৃতিলাভ কর।”

ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী>>

………………..
১. কেই যেন মনে না করেন, স্বামীজী এখানে ‘ধম্মপদ’কে উদ্দেশ করিতেছেন। ‘ধম্মপদ’কে তিনি গীতার সঙ্গে সমান স্থান দিতেন। সম্ভবতঃ স্বামীজী এখানে জাতকশ্রেণীব পুস্তকগুলি কথাই বলিতেছেন। Trubner’s Oriental Series-এ উক্ত গল্পগুলি দুইখণ্ডে প্রকাশিত হইয়াছে।
২. স্বামীজী এখানে কেবল ধর্মমতের লক্ষণ নির্দেশ করিতেছেন, শ্রীচৈতন্যের কঠোর সন্ন্যাসব্রতের কথা বলিতেছেন না। সেরূপ কঠোরতা সম্ভবতঃ জগতে অতুলনীয়।
৩. অর্থাৎ মানবমাত্রেই উপাসনা-মানবত্বের উপাসনা, ব্যক্তিবিশেষকে তাহার উন্নত মন বা চরিত্রের জন্য পূজা না করিয়া সকল মানুষকে গুণনির্বিশেষে পূজা করা।
৪. বৈশেষিক মতে দ্রব্য নয়টি- পঞ্চভূত, কাল, দিক,আত্মা ও মন।- অনুঃ
৫. পঞ্চাবব–প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহবণ, উপনয় ও নিগমন। যথা ১. প্রতিজ্ঞা-”এই পর্বত বহ্নিযুক্ত”; ২. হে?–”যেহেতু ইহাতে ধূম রহিয়াছে”, ৩. উদাহরণ–”যে যে স্থলে ধূম থাকে, সেই সেই স্থলে অগ্নিও থাকে; যেমন রন্ধনশালা”; ৪. উপনয়- ”এই পর্বতও সেইরূপ অর্থাৎ ধূমবান”; ৫. নিগমন –”যেহেতু এই পর্বত ধূমবিশিষ্ট, সেই হেতু উহা অবশ্যই বহ্নিবিশিষ্ট।”–অনুঃ
৬. বিশেষেব জ্ঞান হইতে সাধাবণ নিয়মের জ্ঞান।- অনুঃ
৭. উহার বিপরীত অর্থাৎ সাধারণ নিয়ম হইতে বিশেষের জ্ঞান।–ঐ

…………………..
অশেষ কৃতজ্ঞতা
স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি – ভগিনী নিবেদিতা। অনুবাদক-স্বামী মাধবানন্দ

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………………..
আরও পড়ুন-
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : এক
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : দুই
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : তিন
উনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন : চার

……………….
আরও পড়ুন-
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি এক
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি দুই
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি তিন
সন্ন্যাসীর শরীর : কিস্তি চার

…………………
আরও পড়ুন-
স্বামীজী-প্রচারিত মতসমূহের সমষ্টিভাবে আলোচনা : এক
স্বামীজী-প্রচারিত মতসমূহের সমষ্টিভাবে আলোচনা : দুই
মহাপুরুষদর্শন-প্রসঙ্গে
ঐতিহাসিক খ্রীস্টধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজী
হিন্দুধর্ম
মহাপুরুষদর্শন-প্রসঙ্গে

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!