পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
-মূর্শেদূল মেরাজ
প্রাচীন ভারতের ঋষি-মুনিদের এক অনন্য খোঁজ ‘পঞ্চভূতের ধারণা’। এই ধারণা মতে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সকল কিছুই পাঁচভূতে দৃশ্যমান। জীবন ও জগৎ হচ্ছে ‘পঞ্চ ভূতাত্ত্বক’। সবই পঞ্চভূতের রচনা। সাধারণ অর্থে সৃষ্টির আদি পাঁচটি মৌলিক পদার্থকে নির্দেশ করা হয় এই পঞ্চ বা পাঁচভূত হিসেবে।
অনেকে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের এই ধারণাকে ভূতবাদ বলেও আখ্যায়িত করেন। ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আগুন), মরুৎ (বায়ু) ও ব্যোম (আকাশ বা শূন্য লোক) এই পাঁচ তত্ত্ব মিলে পঞ্চভূত। তবে এই মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশভূতের তত্ত্বকে অল্পতে বুঝে ফেলা সহজ নয়।
পঞ্চভূতের ধারণা মতে, মাটি তত্ত্ব কেবল পায়ের তলার মেঠোপথের মাটি নয়। সহজ অর্থে পঞ্চতত্ত্বে ‘মাটি’ হলো দৃশ্যমান সকল কঠিন পদার্থের প্রতীক স্বরূপ। তেমনি ‘অপ’ সকল তরল পদার্থ। ‘মরুৎ’ সকল বায়বীয় পদার্থ। ‘তেজ’ সকল তাপ, আলো, শক্তি। ‘ব্যোম’ হল সকল শূন্য স্থানের প্রতীক।
সমস্ত সৃষ্টির মূল উপাদানই হচ্ছে পঞ্চভূত। সৃষ্টি জগতের সকল কিছুই এই পঞ্চভূতের বিভিন্ন মাত্রার সমন্বয় মাত্র। বলা হয়, আত্মা ভিন্ন সকল কিছুই প্রকাশ করে এই পঞ্চতত্ত্ব। আবার এই পঞ্চভূত আত্মাকে ধারণও করে। কারণ পঞ্চভূতকে কেন্দ্র করেই প্রতিক্রিয়া রূপে সৃষ্টি হয় মন, বুদ্ধি ও অহংকার। যা আত্মা বৈশিষ্ট্যরূপ বলা যায়।
আকাশ ভিন্ন বাকি চারটি ভূত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলে এদের ভূতদ্রব্যও বলা হয়। আকাশতত্ত্ব অতীন্দ্রিয় বলে একে সেই তালিকায় রাখা যায় না। এক বলা হয় মূর্তদ্রব্য। অবশ্য পঞ্চভূতের অন্যান্য ভূতকে মূর্তদ্রব্য বলা গেলেও। আকাশ তত্ত্বকে ভূতদ্রব্য বলা যায় না মোটেও।
ভৌতদ্রব্য নিত্য ও অনিত্য এই দু’প্রকার। এই ভৌত দ্রব্যগুলির মৌলিক আদি উপাদান হলো- ক্ষিতি পরমাণু, অপ্ পরমাণু, তেজ পরমাণু ও মরুৎ পরমাণু। এই পরমাণুগুলি নিত্য অর্থাৎ এদের উৎপত্তি ও বিনাশ নেই।
কিন্তু এই পরমাণুগুলোর সংযোগের ফলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে স্থূল মাটি, জল, আগুন, বায়ুর উৎপন্ন হয় তা অনিত্য। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই চারটি যৌগিক দ্রব্য বলে এদের উৎপত্তি ও বিনাশ আছে।
প্রাচীন ভারতীয় দর্শন মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত। একটা আস্তিক দর্শন অন্যটা নাস্তিক দর্শন। তবে এই আস্তিক ও নাস্তিক দর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিশ্বাসের উপর নির্দিষ্ট করা হয়নি। এটি চিহ্নিত করা হয়েছিল পরকাল তত্ত্বের বিশ্বাসের ভিত্তিতে।
আর এই পঞ্চতত্ত্ব থেকেই সৃষ্টি দৃশ্যমান হয়েছে। এই পাঁচতত্ত্বের উপরে যে তত্ত্ব তিনিই পরমপুরুষ। আর পঞ্চভূতের একীকৃত সমষ্টিই চৈতন্য। চৈতন্যই ভগবানের সত্তা। পঞ্চভূতই স্রষ্টার বিভূতি, এর সংযোগেই চৈতন্য, আর বিয়োগেই মৃত্যু।
আস্তিক দর্শন পঞ্চভূতকে মানলেও ভারতীয় দর্শনের বস্তুবাদী ধারা চার্বাক দর্শনে পাঁচের পরিবর্তে চারটি ভূতের কথা জানা যায়। চার্বাক দর্শনে আকাশ তত্ত্বের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না। বস্তুবাদী চার্বাক দর্শন অলীক কোনো কিছু বিশ্বাস করে না। যা দৃশ্যমান নয় অর্থাৎ ইন্দ্রিয়-বহির্ভূত তা এই দর্শন মানে না।
পঞ্চভূতের মধ্যে সবচেয়ে সূক্ষ্ম তত্ত্ব হলো আকাশ তত্ত্ব। যা দেখা বা অনুভব করা যায় না। কেবল মেনে নিতে হয়। তাই চার্বাক দর্শনে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে অন্য চার ভূতের কথা স্পষ্ট পাওয়া যায়।
সৃষ্টিপ্রকরণ আলোচনায় মহাত্মা গুরুনাথ সেনগুপ্ত তার তত্ত্বজ্ঞানের উপাসনা খণ্ডে ১২৫ পাতায় উল্লেখ করেছেন, “ব্যোম থেকে পরমপুরুষ- যোগে বায়ু, ঐ রূপে বায়ু থেকে তেজঃ, তেজ থেকে জল অর্থাৎ তরল পদার্থ, তরল পদার্থ থেকে ভূমি অর্থাৎ কঠিন পদার্থ উৎপন্ন হলো। পরে ব্যোমাদি ভূতপঞ্চক পঞ্চীকৃত হল। এই পঞ্চীকৃত পঞ্চভূত এতেই জড় জগতের সৃষ্টি হয়েছে।”
অর্থাৎ খাদ্যকণা থেকে জীবের সৃষ্টি। এই খাদ্য এসেছে ঔষধি তথা গাছপালা থেকে। আবার গাছপালা জন্মায় ক্ষিতি তথা মাটি বা পৃথিবীতে। এই ক্ষিতি এসেছে অপ অর্থাৎ জল থেকে। এই জল এসেছে তেজ থেকে।
এই তেজ বা আগুন এসেছে মরুৎ অর্থাৎ বায়ু থেকে। আবার মরুৎ এসেছে ব্যোম অর্থাৎ আকাশ বা শূন্য থেকে। এই আকাশ এসেছে নির্গুণ আত্মা বা অব্যক্ত অব্যয় থেকে।
আর এই পঞ্চতত্ত্ব থেকেই সৃষ্টি দৃশ্যমান হয়েছে। এই পাঁচতত্ত্বের উপরে যে তত্ত্ব তিনিই পরমপুরুষ। আর পঞ্চভূতের একীকৃত সমষ্টিই চৈতন্য। চৈতন্যই ভগবানের সত্তা। পঞ্চভূতই স্রষ্টার বিভূতি, এর সংযোগেই চৈতন্য, আর বিয়োগেই মৃত্যু।
অষ্টাবক্র মুনি বলছেন-
ন পৃথ্বী – ন জলং – ন অগ্নিঃ – ন বায়ুঃ – ন দৌঃ বা ভবান্।
এষাং সাক্ষিনম্ আত্মানং চিদ্রূপং(চিৎ -রূপম) বিদ্ধি মুক্তয়ে।
অর্থাৎ- আমি মাটি নই – জল নই – অগ্নি নই – বায়ু নই – আকাশ নই। আমি একজন সাক্ষী, আমার নাম আত্মা, আমি চৈতন্য স্বরূপ।
অষ্টাবক্র মুনি আরো বলছেন-
আত্মা সাক্ষী বিভুঃ পূর্ণ একো মুক্তঃ চিৎ অক্রিয়ঃ
অসঙ্গো নিঃস্পৃহঃ শান্ত ভ্ৰমাৎ সংসারবান ইব।।
(অষ্টবক্র গীতা, শ্লোক-১২)
অর্থাৎ- আত্মা স্বভাবতই সাক্ষী, বিভু, পূর্ণ, মুক্ত চৈতন্য স্বরূপ, অক্রিয়, অসঙ্গ, নিস্পৃহ ও শান্তস্বরূপ। ভ্ষ্ম বশতঃ সংসারবান মনে হয়।
সংক্ষেপে পঞ্চভূত –
- ক্ষিতি (মাটি)
- পদার্থ- কঠিন।
- মাটির গুণ- গন্ধ।
- স্থিতি- নাকে।
- ক্রিয়া- ঘ্রাণ।
- শক্তির স্বরূপ- চৌম্বকশক্তি/মাধ্যকর্ষণ।
- তত্ত্ব- মাটি।
- অপ (জল)
- পদার্থ- তরল পদার্থ।
- জলের গুণ- রস।
- স্থিতি- জিহ্বায়।
- ক্রিয়া- স্বাদ।
- শক্তির স্বরূপ- শব্দ।
- তত্ত্ব- পানি।
- তেজ (অগ্নি)
- পদার্থ- শক্তি।
- অগ্নির গুণ- রূপ।
- স্থিতি- চোখে।
- ক্রিয়া- দৃষ্টি।
- শক্তির স্বরূপ- সূর্য।
- তত্ত্ব- আগুন।
- মরুৎ (বায়ু)
- পদার্থ- বায়বীয়।
- বায়ুর গুণ- স্পর্শ।
- স্থিতি- ত্বকে।
- ক্রিয়া- স্পর্শ।
- শক্তির স্বরূপ- বায়ু।
- তত্ত্ব- বাতাস।
- ব্যোম (আকাশ)
- পদার্থ- ভর ও শক্তির আন্ত-পরিবর্তনের প্রক্রিয়া ও তাদের উৎসস্থল।
- আকাশের গুণ- শব্দ।
- স্থিতি- কানে।
- ক্রিয়া- শব্দ।
- শক্তির স্বরূপ- বর্ষা।
- তত্ত্ব- আকাশ।
(চলবে…)
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দু্ই>>
………………….
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
পুরোহিত দর্পন।
উইকিপিডিয়া।
বাংলাপিডিয়া।
শশাঙ্ক শেখর পিস ফাউন্ডেশন।
পঞ্চভূত – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বাতাসের শেষ কোথায় : ইমরুল ইউসুফ।
ন্যায় পরিচয় -মহামহোপাধ্যায় ফনিভূষণ তর্কবাগীশ।
পঞ্চভূত স্থলম ও পঞ্চভূত লিঙ্গম- দেবাদিদেব শিবঠাকুরের খোঁজে: আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়ের।
…………………………..
আরো পড়ুন-
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এক
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দুই
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তিন
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চার
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পাঁচ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব ছয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব সাত
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব আট
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব নয়
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব দশ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব এগারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব বারো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব তেরো
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব চোদ্দ
পঞ্চভূতের পঞ্চতত্ত্ব : পর্ব পনের