-কাজী দীন মুহম্মদ
এরাই বৈষ্ণব। ভগবতের মতে ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক কর্তা ও কর্মের সম্পর্ক, বিষয়ী (subject) ও বিষয় (object)-এর সম্পর্ক। সৃষ্টিই ভক্ত, স্রষ্টাই ভগবান। ভক্তের কর্তব্য ভগবানের পূজা করে যাওয়া। বর দেওয়া বা না দেওয়া ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা।
কিন্তু ভগবতের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনুধ্যান ও অনুষ্ঠান কেবল কৃষ্ণেই সীমাবদ্ধ রইল না। আরো নানা অবতারবাদ ক্রমে তাদের বিশ্বাস তথা অনুষ্ঠানকেও আচ্ছন্ন করে ফেলল। পরে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শ্রীচৈতন্য দেবের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এ ভাবধারায় যেমন এলো পরিবর্তন, তেমনি এর অনুষ্ঠানেও এলো সংশোধন বিশোধন।
ভক্ত-ভগবানের সম্পর্ক মেনে নিয়ে বৈষ্ণব নিজস্ব চিন্তাধারা অনুয়ায়ী কৃষ্ণকেই ভগবানের অবতার অর্থাৎ সাক্ষাৎ ভগবান মানবরূপে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়েছেন, মনে করে। তাদের মতে ভগবানকে সেবা মানেই কৃষ্ণের সেবা। রাধা ভাবে বিভাবিত বৈষ্ণব সে ভাবেই কৃষ্ণকে ভজনা করেছে।
চৈতন্যদেবের আমলে প্রচারিত পরিবর্তিত ও সংস্কৃত বৈষ্ণব ধারায় এ সংস্কারের সঙ্গে যুক্ত হলো আরো একটি ভাব। ভক্তরা বিশ্বাস করল, শ্রীচৈতন্যের মধ্যে ভগবানের দ্বিভাবে বিহারকল্প শ্রীকৃষ্ণ ও শ্ররাধা একই মূর্তিতে মানবরূপে রূপ পরিগ্রহ করেছে।
তাই প্রেয়সীরূপে কৃষ্ণকে নিজের দরিত জ্ঞানে সেবার মাধ্যমে সর্ব ধর্মকর্মের অভিব্যক্তি জ্ঞান করা হলো। ভগবান পুরুষ ভক্ত পরা বা প্রকৃতি। পুরুষের কামানা-বাসনায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই নিজের যেমনটি অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়, তেমনটি আর কিছুতে নয়। তাই বৈষ্ণবের কাছে ভগবান প্রেমিক দয়িত এবং ভক্ত প্রেয়সী দয়িতা।
এ রাধাকৃষ্ণ যুগল কল্পধ্যানে শ্রীচৈতন্য তৎকালে শ্রীকৃষ্ণের মত পূজিত হতে থাকল। রাধা যেমন প্রেয়সীরূপে কৃষ্ণের অনুরাগে জীবন কাটিয়েছে এবং তার মধ্যেই সত্যিকার ভক্তের স্বরূপ ফুটে উঠেছে, ঠিক তেমনি গৌরাঙ্গরূপে আত্মহুতি দিয়ে পরবর্তীকালে বৈষ্ণব নিজেকে কৃতার্থ মনে করেছে।
ভগবানস্বরূপ চৈতন্য তার ভজনায় নিজেকে বিলীন করে দেওয়াতেই তো ভক্তের সার্থকতা। তাই বৈষ্ণব নিজের ভক্তি, বাৎসল্য, সখ্য, দাস্য, মধুর ইত্যাদি নানারসে সিক্ত করে অভিব্যক্ত করতে চায়। কৃষ্ণ চরম মিলনে সুখ একমাত্র মধুর বা প্রেম রসেই। এতেই জীবের স্ফূর্তি।
তাই প্রেয়সীরূপে কৃষ্ণকে নিজের দরিত জ্ঞানে সেবার মাধ্যমে সর্ব ধর্মকর্মের অভিব্যক্তি জ্ঞান করা হলো। ভগবান পুরুষ ভক্ত পরা বা প্রকৃতি। পুরুষের কামানা-বাসনায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েই নিজের যেমনটি অস্তিত্ব উপলব্ধি করা যায়, তেমনটি আর কিছুতে নয়। তাই বৈষ্ণবের কাছে ভগবান প্রেমিক দয়িত এবং ভক্ত প্রেয়সী দয়িতা। সেজন্য রাধিকার জবানীতে যখন বৈষ্ণব ভক্ত বলেন-
সই কেবা শুনাইল শ্যামনাম।
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিলগো
আকুল করিল মোর প্রাণ।।
তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, এ রাধা, প্রেম-পাগলিনী রাখা। এ প্রেম যখন ঊর্দ্ধে ওঠে, ভাবের তুরীয় মার্গে রাধাকে নিয়ে যায়, তখন দেহ, বস্তু কিছুই স্পষ্ট থাকে না। যা থাকে তা হলো-
রজকিনী প্রেম
নিকষিত হেম
কামগন্ধ নাহি তায়।।
রূপজ মোহ, দেহজ প্রেম বৈষ্ণবের প্রেম নয়। প্রেয়সী বিরহিনী উন্মাদিনী রাখা ভাবে বিভাবিত ভক্তের প্রেমিক দয়িত কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণেই আনন্দ, তা-ই চরম চাওয়া ও পাওয়া। এর বাইরে সে ভাবতে পারে না। পারে না বলেই, সে কেঁদে বলে-
জনম অবধি হাম রূপ নেহারনু
নয়ন না তির পিত ভেল।
লাভ লাভ যুগ হিয়ে রাখনু
হিয় জুড়ন না গেল।।
মুসলিমের চিন্তাধারায় এ ভাব কিরূপ পেয়েছে তার স্বরূপ বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।
বাতি থেকে বাতি জ্বাললে যেমন উভয়ই এক থেকে উদ্ভুত একই সত্তা অথচ একে অপর থেকে পৃথক, আল্লাহর নূর থেকে নূরে মুহম্মদী সৃষ্টি করাও তদ্রূপ। এ নূরে মুহম্মদীই সৃষ্টির মূলীভূত কারণ বা পুরুষ এবং সৃষ্টিই প্রকৃতি বা জড়।
মুসলিম সুফী মতে আল্লাহ নির্গুণ নয়, সগুণ। সব কিছুই আল্লাহ থেকে সৃষ্ট হয়েছে সত্য, কিন্তু সবটাই একটা নিয়মের ভিতর দিয়ে হয়েছে, বিধান অনুসারে হয়েছে। সে নিয়ম কি? সে নিয়ম হলো- হজরত রসুলে করীম (সা) নিজেই বলেছেন, ‘আনা মিন নুরিল্লাহে, ওয়া কুল্লু শায়য়িন মিন নূরী’ : ‘আমি আল্লাহর নূর থেকে সৃষ্ট এবং জগতের তামাম বস্তু আমার নূর থেকে সৃষ্ট।’
আল্লাহ গোপন ছিলেন, প্রকাশ হতে চাইলেন, সৃষ্টি করতে চাইলেন। তাই তিনি স্বীয় অস্তিত্ব থেকে, নিজের নূর থেকে আর এক অস্তিত্বের, আর এক নূরের সৃষ্টি করলেন। তাই নূরে মুহম্মদী। এ নূরে মুহম্মদী তার বিদা বা প্রকার নয়। সে নূর তৈয়ার করতে গিয়ে তিনি দ্বিধাবিভক্ত হলেন না।
বাতি থেকে বাতি জ্বাললে যেমন উভয়ই এক থেকে উদ্ভুত একই সত্তা অথচ একে অপর থেকে পৃথক, আল্লাহর নূর থেকে নূরে মুহম্মদী সৃষ্টি করাও তদ্রূপ। এ নূরে মুহম্মদীই সৃষ্টির মূলীভূত কারণ বা পুরুষ এবং সৃষ্টিই প্রকৃতি বা জড়।
(চলবে…)
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………..
আরো পড়ুন:
সূফীবাদের গোড়ার কথা: এক
সূফীবাদের গোড়ার কথা: দুই
সূফীবাদের গোড়ার কথা: তিন
সূফীবাদের গোড়ার কথা: চার
সূফীবাদের গোড়ার কথা: পাঁচ
সূফীবাদের গোড়ার কথা: ছয়
সূফীবাদের গোড়ার কথা: সাত
সূফীবাদের গোড়ার কথা: আট
সূফীবাদের গোড়ার কথা: নয়
……..
১. Maxmuller, Indian Philosophy, page 895
২. ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহি- আল কোরান।
৩. ওয়া ইজা আরাদা শাইয়ান আঁইয়াকুলা-লাহু কুন ফাইয়াকুন- আল কোরান।
৪. রবীন্দ্রনাথ।
৫. lower self এবং higher self কথাগুলো পাশ্চাত্য দর্শনের। আমাদের বিবেচনায় এ দুটোও প্রমাদপূর্ণ। কারণ self, self-ই। এর lower এবং higher নাই। যা আছে তা aspect এর বিভিন্নতা।
৬. আল-হাদিস
৭. আল কোরান।
৮. আনাল হক: আমিই সত্য; অহং ব্রহ্মাষ্মি : আমিই ব্রহ্ম; সো অহং : সেই আমি, আমিই সে।
৯. যুগে যুগে সম্ভবামি: গীতা।
১০. ইনি ৮৩০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
১১. ইনি ৮৬০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।