ভবঘুরেকথা

-কাজী দীন মুহম্মদ

মারুফ প্রথম তাসাউওফের সংজ্ঞা এভাবে নির্ণয় করেন: ‘আততসাউওফু আল আখজু বিল হাকায়িকে ওয়াল আসু মিম্মা ফীল আযাদিল খালাকে।’ তাসাউওফ হচ্ছে সত্য বাস্তুসমূহের উপলব্ধি, আর সৃষ্ট জীবগণের হাতে যা রয়েছে তা ত্যাগেই উপলব্ধির সূচনা।

এক কথায়, বিষয়-নিস্পৃহতার উপরই তত্ত্বজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত। আবু সোলায়মান ইরাকী১০ সুফি চিন্তায় মারিফাতের বা অতীন্দ্রিয় জ্ঞানকে, শাস্ত্রাতীত অনুভূতিজাত আধ্যাত্মিক বোধকে একটি প্রধান স্থান দিলেন।

এই মারিফত জ্ঞান গ্রীকদের genosis-এর কল্পনা থেকে গৃহীত হযেছে বলে অনেকে মনে করেন; কিন্তু ইরানী মারিফতের জ্ঞানে গ্রীক প্রভাব থাকলেও ইসলাম তা পরিশোধন করে এক শুদ্ধ তত্ত্বজ্ঞানের বিকাশের মাধ্যমে এর স্ফূর্তির ধারা বাহিকতার উল্লেখ করেছে। এরপর এলেন মিশর দেশের অধিবাসী আবুল ফয়েজ সাওবান বিন ইবরাহিম জুন্নূন আল-মিসরী।১১

ইনি মারিফাতবাদকে মেনে নিয়ে আল্লহর সত্তায় বিলীন হয়ে মানুষ যে আনন্দ রসের১২ অনুভূতিতে অবগাহন করে, তা-ই জীবনে একমাত্র কাম্য বলে প্রচার করেন।

‘আনাল হক’ মন্ত্রের অন্যতম প্রধান হুসায়ন বিন মনসুর আল-হাল্লাজ ‘আনাল হক’ তসবিহ প্রকাশ্যে ঘোষণা করার জন্য শরিয়তপন্থীদের কাজী ও মোল্লারা সহ্র করতে পারলেন না বটে, কিন্তু অনুভূতিপ্রবণ ভাবুক তাকে জীবনমুক্ত মহাপুরুষের সম্মান দিল। হাল্রাজ ইসলাম জগতে এক শ্রেষ্ঠ শহীদের আসনে আসীন হলেন। তিনি অসাধারণ পণ্ডিত ছিলেন। তার ব্যক্তিত্ব ও সাধনার অতুলনীয় প্রভাব পরবর্তী সুফিজগতে সর্বজন-স্বীকৃত সত্য বলে গণ্য হলো।

আল্লাহর ভাবে তিনি কতখানি বিভোর হয়েছিলেন তা তার পুত্র ও মুরিদগণ লিখে গেছেন। তাকে চাবুক মারা হয়েছে। দুই হাত ও দুই পা কেটে ফেলা হয়েছে। একরাত্রি এ অবস্থায় কারাগার থেকে হত্যার জন্য আনা হযেছে। তিনি শিষ্যদের সাথে হেসে কথা বলছেন, উপদেশ দিচ্ছেন।

এ অবস্থা দেখে একজন শিষ্য জিজ্ঞাসা করলেন: প্রভু! তোমার এ অবস্থা কেন? তিনি উত্তরে বললেন: তার রূপের আপর এরূপই, যে তার সঙ্গে মিলন চায়, তাকে এভাবেই তিনি টেনে নেন। তারপর এ শ্লোকটি রচনা করে আবৃত্তি করলেন-

‘নাদিমী গায়র মানসুবিন ইলা শায়য়িন মিনাল হয়কি।
সাকানী মিছলা মা আশরিবু কাফি লিজ্জায়বি বিজ্জয়ফি।।
ফালাম্মা দারাতিল কাসি দায়া বিন তাইওয়াস সাইফি।
কা যি মান আশরিবুয়াহ মায়াতিন্নিনি ফি সাইফি।।

: আমা রবন্ধু দয়ামায়ার সহিত সম্পর্কের বাইরে। আমায় সে পান করালে যা সে নিজে পান করে, যেমন মেহমানের সঙ্গে মেজবান করে। পান পাত্র ঘুরে আসার পর, সে মাথা কাটার জন্য চামড়ায় ‘নাত’ ও তরবারি আনিয়ে নলি। তার এমনি নিয়ম। সে গ্রীষ্ম কালে মহানাগের সঙ্গে সুরা পান করে।

এরপর হাল্লাজ যথারীতি সালাত আদায় করে সঙ্গীদের উপদেশ ও উৎসাহ দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হলেন। চাবুক মারার কালেও তিনি ‘আহাদ’ আহাদ’ ‘এক’ ‘এক’ বলে চিৎকার করেছেন।

মনসুরকে সুফি সাধকমালার মধ্যমণি বলা চলে। তার তিরোধানের পর সুফি মতবাদ, দশন ও চিন্তা বিশিষ্ট রূপ পরিগ্রহ করতে থাকে।

মনসুর তার পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক সত্যদ্রষ্টাদের অনুভূতির আধারে, পরবর্তী mystic বা মরমিয়া কবি ও দার্শনিকগণ ইরাকে, আরবে, সিরিয়া, মিশরে, স্পেনে, তুর্কীস্থানে, ইরানে, মধ্য-এশিয়ায় ও পাক ভারতে আরবী ফারসি ও অন্যান্য ভাষায় কাব্য-কবিতা ও বিচারপূর্ণ গ্রন্থ লিখে বিরাট এক সুফি সাহিত্যের সৃষ্টি করেন।

ফলে তাসাউওফের কোমলতা ও ভাবপ্রবণতা ভিম্বামানবের দৃষ্টিতে সুন্দরতর ও শোভনতর করে তুলে ধরল। আল-গাজ্জালীর মতো দার্শনিকও তসাউওফের সৌন্দর্যও বিরোধকে মিটিয়ে দিয়ে ইসলামী বিচার ও যক্তিতর্কের অবতারণা করে বিশ্ব মানবের হিতার্থে প্রয়োগের পক্ষে যক্তি দেন।

ইবনুল ফরীদ, ইবনুল আরাবী, হাকীম সানাই, মৌলানা জালালুদ্দিন রুমি, শামসুদ্দিীন হাফিজ, নুরুদ্দীন জামিী- এরা সকলেই মানুষকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছেন। মানুষের মনের ও আত্মার সমস্ত দ্বার খুলে দিয়ে তাতে জান্নাত বা ফিরদৌসের হাওয়া বইযেছেন।

সমগ্র মানবজাতির জন্য এরা ভাবুকতার, সৌন্দর্যের ও আধ্যাত্মিক আনন্দে অক্ষয় ভাণ্ডার খুলে দিয়েছেন। সুফি পণ্ডিতেরা দার্শনিক খুঁটিনাটির সঙ্গে সঙ্গে সুফি অনুভূতি ও উপলব্ধি কল্পনা ও কাব্যের প্রসারণ, বিচার-বিশ্লেষণ ও বর্গীকরণ করে ধারণাটিকে সাধারণ মানুষের পক্ষে হয়তো একটু জটিল করে তুলেছেন। কিন্তু তাতে ক্ষতি হয়নি।

অন্যতম সুফি সাধিকা রাবেয়ার একটি প্রার্থনা এরূপ : প্রভু! যদি বেহেস্তের লোভে তোমার সেবা করে থাকি তা হলে তা আমার জন্য হারাম করো, যদি দোজখের ভয়ে তোমার সাধনা করে থাকি, তা হলে সে দোজখে পুড়িয়ে মারো। আর যদি শুধু তোমার জন্য, তোমারই সন্তুষ্টির জন্য তোমার আরাধনা করে থাকি, তবে তোমার দর্শন থেকে বঞ্চিত করো না।

সাধারণ মানুষ মনসুর হাল্লাজের বাণী ও সাধনা, উবনুল ফরীদ, ইবনুল আরাবী, ফরীদুদ্দীন আত্তার, মৌলানা রুমি, হাফেজ ও যামীর ফারসি ও আরবী কবিতা থেকে রস আহরণ করে ভাবে নিমগ্ন হতে পারে আধ্যাত্মিক চিন্তা ও অনুভূতির ক্ষেত্রে আরব পারস্য ও পৃথিবীর মুসলমানদের এ এক শ্রেষ্ঠ দান।

বাংলাদেশ, পাক-ভারত সিরিয়া ইরাক আরব ও পারস্যের এ ভাবধারায় উজ্জীবিত হয়ে আধ্যাত্মিক ভাবধারা ও সাহিত্যের পরিপুষ্টি সাধনে সমর্থ হয়েছে।

ইরানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফি কবি নুরুদ্দীন জামিী রচিত সুফিমত সার-সংগ্রহ স্বরূপ ‘ল বাইহ’ বা ‘রশ্মিরাজি’ নামক গ্রন্থ থেকে একটি মোনাজাতের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। কবিতাটির আরম্ভ আরবীতে, উপসংহার ফারসিতে। মোনাজাতটি গদ্যে এরূপ দাঁড়ায়-

‘হে আল্লাহ, প্রতিপালক, ক্ষুদ্র বিষয় বাসনা থেকে আমাদের মুক্ত করো। সমস্ত বস্তুর সত্য স্বরূপকে আমাদের দেখাও। আমাদের বিচার চক্ষুর উপরে যে গাফিলতির পর্দা পড়েছে, তা সরিয়ে দাও। প্রত্যেক বস্তু যেমনটি আছে তেমনটি দেখাও।

বাতিল বা অসত্যকে আমাদের কাছে সত্যরূপে প্রকাশ করো না। সত্যের সৌন্দর্যের উপর অসথ্যের পর্দা ঢেকে দিও না। পরিদৃশ্যমান রূপসমূহকে তোমায় সৌন্দর্যের ঔজ্জ্বল্যের প্রতিচ্ছায়া করো। এগুলোকে আবরণেরও দূরত্বের কারণ করো না।

এ সকল মায়াময় কাল্পনিক চিত্রকে আমাদের জ্ঞান ও সত্য দর্শনের আয়ত্তে এনে দাও। এগুলোকে অজ্ঞান অন্ধত্বের আয়ত্তও করো না। আমাদের অভাব ও প্রবাস আমাদের দোষেই ঘটে, আমাদের মধ্যে আমাদের ফেলে রেখো না। বরং আমাদের থেকেই আমারেদ মুক্তি দাও। আমদিগকে তোমায জানতে দাও।’

অন্যতম সুফি সাধিকা রাবেয়ার একটি প্রার্থনা এরূপ : প্রভু! যদি বেহেস্তের লোভে তোমার সেবা করে থাকি তা হলে তা আমার জন্য হারাম করো, যদি দোজখের ভয়ে তোমার সাধনা করে থাকি, তা হলে সে দোজখে পুড়িয়ে মারো। আর যদি শুধু তোমার জন্য, তোমারই সন্তুষ্টির জন্য তোমার আরাধনা করে থাকি, তবে তোমার দর্শন থেকে বঞ্চিত করো না।

সুফি সাধনা, ভাবধারা ও দর্শন যুগে যুগে আমাদের চিন্তাধারা জীবন পদ্ধতি ও সংস্কৃতি তথা কাব্য-সাহিথ্যের প্রেরণা যোগাবে এ সন্বেন্ধে সন্দেহ নাই।

(চলবে…)

………………………..
আরো পড়ুন:
সূফীবাদের গোড়ার কথা: এক
সূফীবাদের গোড়ার কথা: দুই
সূফীবাদের গোড়ার কথা: তিন
সূফীবাদের গোড়ার কথা: চার
সূফীবাদের গোড়ার কথা: পাঁচ
সূফীবাদের গোড়ার কথা: ছয়
সূফীবাদের গোড়ার কথা: সাত
সূফীবাদের গোড়ার কথা: আট

সূফীবাদের গোড়ার কথা: নয়

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…….
১. Maxmuller, Indian Philosophy, page 895
২. ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহি- আল কোরান।
৩. ওয়া ইজা আরাদা শাইয়ান আঁইয়াকুলা-লাহু কুন ফাইয়াকুন- আল কোরান।
৪. রবীন্দ্রনাথ।
৫. lower self এবং higher self কথাগুলো পাশ্চাত্য দর্শনের। আমাদের বিবেচনায় এ দুটোও প্রমাদপূর্ণ। কারণ self, self-ই। এর lower এবং higher নাই। যা আছে তা aspect এর বিভিন্নতা।
৬. আল-হাদিস
৭. আল কোরান।
৮. আনাল হক: আমিই সত্য; অহং ব্রহ্মাষ্মি : আমিই ব্রহ্ম; সো অহং : সেই আমি, আমিই সে।
৯. যুগে যুগে সম্ভবামি: গীতা।
১০. ইনি ৮৩০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।
১১. ইনি ৮৬০ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!