ভবঘুরেকথা
মা মনোমোহিনী'র কথা

মা মনোমোহিনী’র কথা

মানুষ কি করে বড় হয় বাবা? সাত আট বছরের ছোট্ট মেয়ে মনুর যত সব অবান্তর প্রশ্নে রোজ উতক্ত হয়ে ওঠেন রামেন্দ্রনারায়ণ। তবু এই সরলপ্রাণা শিশুটির কৌতূহল নিবৃত্ত না করে পারেন না তিনি। তাই যথাসম্ভব উত্তর দিয়ে যেতে হয় তাঁর সব কথার। রামেন্দ্রনারায়ণ বলেন, যারা ভগবানে বিশ্বাস ও ভক্তি করে চলে এবং গরীব দুঃখীদের সেবা করে, তারাই বড় হয়।

লোকে তাদের বড় বলে। ভগবান তাদের ভালোবাসেন। মনু সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে,  আমি তাই করব। আমিও বড় হব।

সঙ্গে সঙ্গে আর এক প্রশ্ন করে বসে, ভগবান কে বাবা? সহসা রামেন্দ্রনারায়ণের মুখ থেকে আপনা হতে বেরিয়ে এল, যেমন মনে কর, আমাদের রাধামদনমোহন। তুমি এঁকে ভগবান বলে ভক্তি করে যাবে। এঁরই মধ্যে ভগবানকে পাবে।

উত্তরটা সময়মত মুখে জুগিয়ে যাওয়ার স্বস্তি অনুভব করলেন রামেন্দ্রনারায়ণ। কারণ মনুর প্রশ্ন শুনে ভয় হয়েছিল তাঁর কী উত্তর তিনি দেবেন। বালিকা হলেও তাঁর সরলপ্রাণের আকুতিকে কোন কথার ছলনা দিয়ে অবদমিত করতে তিনি কখনো চান না। তিনি চান মেয়ে তাঁর ছোট থেকেই বিভিন্ন সদ্ গুণে অভ্যস্ত হয়ে উঠুক। ধর্মভাব জেগে উঠুক তার নির্মল অন্তরের শুচিশুভ্র পটে।

কিন্তু মনুকে কথাটা বলার পর থেকে নতুন সমস্যা দেখা দিল রামেন্দ্রনারায়ণের দৈনন্দিন জীবনে। যখনি তিনি বাড়ির বাস্তুবিগ্রহ রাধামদনমোহনের পূজা অর্চনা করতে যান তখনি মনু এসে বলে, আমি নিজের হাতে পূজা করব বাবা। রাধামদনমোহনের বিগ্রহের মধ্যেই ভগবান আছেন, বাবার মুখে একথা শোনার পর থেকে বিগ্রহের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা দ্বিগুণ বেড়ে গেছে তাঁর।

ঈশ্বরলাভের এক অত্যুগ্ৰ আকাঙ্খা জেগেছে তাঁর শিশু মনে। রামেন্দ্রনারায়ণ কোনোমতে মনুকে শান্ত ও বিরত করবার জন্য বললেন, মনু, লক্ষ্মী মা আমার, মন্ত্র না শিখলে ঠাকুর পূজো করা যায় না। মনু তখন বলল, আমাকে মন্ত্র শিখিয়ে দাও।

রামেন্দ্রনারায়ণ বললেন, আজ থেকে ঠাকুর ঘরে বসে ঠাকুরের কাছে মনেপ্রাণে প্রার্থনা কর, ঠাকুরই তোমাকে তাঁর পূজোর মন্ত্র বলে দেবেন। সেইদিন থেকে শুরু হল মনুর আকুল প্রার্থনা। ধর্ম সাধনার প্রথম বীজ উপ্ত হল তাঁর সাত্ত্বিক সংস্করসিক্ত উর্বর প্রাণে। বাবার ঠাকুর পূজো শেষ হয়ে গেলেই নির্জনে প্রার্থনা করতেন, ঠাকুর, বাবাকে তুমি মন্ত্র বলে দিয়েছ। আমাকেও মন্ত্র বলে দাও ঠাকুর।

ডাকনাম মনু। ভাল নাম মনোমোহিনী। বাংলা ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১২৭৭ সালে পাবনা জেলার অন্তর্গত নিমাইতপুর গাঁয়ের বিখ্যাত চৌধুরীবংশে মনোমোহিনী দেবীর জন্ম হয়। রাজশাহী বিভাগের সদর জেলাশহরটি ইছামতী নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত। এই শহরের পশ্চিমদিকে পদ্মার উত্তর তীরে নিমাইতপুর গাঁ। এই নিমাইতপুর গাঁ অত্যন্ত প্রাচীন এবং এই গাঁয়ের উৎপত্তি সুদূর মোগলযুগে।

অনেকের মতে, আকবরের সেনাপতি মানসিংহ বাংলাদেশের বারভুঁইঞাদের বিদ্রোহ দমন করতে এসে এই গাঁয়ে ছাউনি ফেলেছিলেন। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই ঠাকুরভক্তি জাগতে থাকে মনোমোহিনীর অন্তরে।

সহসা ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে এক অত্যুজ্জ্বল জ্যোতি দেখতে পেলেন মনোমোহিনী। সমস্ত ঘরখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সে জ্যোতিতে। তাঁর মনে হল, এক জ্যোতির্ময় বিরাট পুরুষ এসে বিগ্রহ মূর্তির স্থানে আশ্চর্যভাবে বিরাজ করছেন আর তাঁর পায়ের কাছে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘রাধাস্বামী।’

রামেন্দ্রনারায়ণ যেদিন তাঁকে ঠাকুর পূজোর মন্ত্র শিখিয়ে দেওয়ার জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে যেতে বলেন, সেদিন থেকে রোজ দুপুরে ঠাকুরের ভোগ আরতির পর ভাই লোহাকে নিয়ে ঠাকুরঘরে গিয়ে মন্ত্রের জন্য কাতর-মিনতি জানান ঠাকুরের কাছে। হঠাৎ একদিন খেয়াল হল মনোমোহিনীর, ঠাকুর শুয়ে আছে বলেই হয়ত বা তাঁদের প্রার্থনা ঠাকুরের কাছে যাচ্ছে না।

ভোগ আরতির পর বিগ্রহ মূর্তিকে শয়ন অবস্থায় রাখা হয়। মনোমোহিনী তাই ভাবলেন, ঠাকুর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় তাঁদের কথা শুনতে পাওয়া সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। তাই একদিন ভাইবোন দুজনে ঠাকুরের মূর্তিটিকে ধরে উঠিয়ে দেন।

তারপর থেকে রোজই ভোগের পর ঠাকুরঘরে গিয়ে বিগ্রহমূর্তিকে ধরে উঠিয়ে দেন মনোমোহিনী। একদিন প্রার্থনার আকুলতা ও নিবিড়তা দুইই খুব বেড়ে যায়। সহসা ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে এক অত্যুজ্জ্বল জ্যোতি দেখতে পেলেন মনোমোহিনী।

সমস্ত ঘরখানা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে সে জ্যোতিতে। তাঁর মনে হল, এক জ্যোতির্ময় বিরাট পুরুষ এসে বিগ্রহ মূর্তির স্থানে আশ্চর্যভাবে বিরাজ করছেন আর তাঁর পায়ের কাছে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা রয়েছে, ‘রাধাস্বামী।’

ক্রমে মনে হল, এই জ্যোতির্ময় পুরুষের এক দিব্যজ্যোতির এক অংশ তাঁর মাথার মধ্যে এসে ঢুকে গেল। বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেললেন মনোমোহিনী। বাড়ির লোক দেখতে পেয়ে অনেক চেষ্টায় জ্ঞান ফিরিয়ে আনল মনোমোহিনীর। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে সব কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে গেল সবাই।

আর পাঁচজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে কথাটা বলতে তাঁরা বললেন, সরল শিশু প্রাণের ব্যাকুল আবেদনে স্থির থাকতে না পেরে ঠাকুর তাঁকে দেখা দিয়ে ইষ্টবীজ বলে দিয়ে গেছেন। বহু তপস্যা ও সাধন ভজনের দ্বারা যা লাভ করতে পারা যায় না, ইষ্টদর্শনরূপে সেই দুর্লভ বস্তু লাভ করেছেন মনোমোহিনী।

ইষ্টদেবতা মদনমোহন এক জ্যোতির্ময় মানুষী মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন; রাধাস্বামী তাঁরই ইষ্টবীজ। তাই দেখে এক দিব্য আবেশে বাহ্যজ্ঞানহারা হয়ে পড়েছিলেন মনোমোহিনী।

রামেন্দ্রনারায়ণ মনোমোহিনীকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, ঐ মন্ত্রই তুমি নিষ্ঠার সঙ্গে মন প্রাণ দিয়ে জপ কর মা। ঐ হবে তোমার ইষ্টমন্ত্র। গীতায় ভক্তিযোগ সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-

যে ত্বক্ষরমনির্দেশ্যমব্যক্তং পর্যুপাসতে।
সর্বত্রমচিন্ত্যঞ্চ কূটস্থমচলং ধ্রুবম্।।
সংনিম্যেন্দ্রিয়গ্ৰামং  সর্বত্র এ সমবুদ্ধয়ঃ।
তে প্রাপ্নুবন্তিমামেব  সর্বভূতহিতে রতাঃ।।

শ্রীমা তাঁকে নিজে আশ্রমের প্রতিটি কর্মকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে সৎসঙ্গের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপ্রণালী সব কিছু সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেন। মহাত্মাজীও সৎসঙ্গের উন্নত আদর্শ ও বিচিত্র কর্মধারা দেখে মুগ্ধ হন।

অর্থাৎ, যে সকল যোগী সর্বদা সকলের কল্যাণ করেন, সকলকে সমান চোখে দেখেন, ইন্দ্রিয়গুলি সংযত করে যাঁরা ইন্দ্রিয়ের অব্যাক্ত সর্বব্যাপী, চিন্তার অতীত, স্থির, নিত্য ব্রহ্মকে আরাধনা করেন, তাঁরা আপনাকেই পান। মনোমোহিনী দেবীও ইষ্টের প্রতি অচল ভক্তি রেখে জনকল্যাণকর কাজ করে যেতেন অক্লান্তভাবে।

সময়-অসময়ের সীমা নেই, আপনপরের ভেদ নেই। স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে প্রতিটি ক্ষুধার্ত, রোগার্ত ও দুঃস্থ মানুষের সেবা করে চলাই তাঁর জীবনের পরম মন্ত্র। তিনি তাঁর ইষ্ট দেবতাকে মন্দিরের মধ্যে সংকীর্ণভাবে আবদ্ধ করে রাখেননি কোনদিন, তিনি তাঁকে বহু ও বিচিত্ররূপে খুঁজে পেয়েছিলেন অজস্র মানুষের আত্মার মধ্যে।

একবার মহাত্মা গান্ধী পাবনা সৎসঙ্গ আশ্রম দেখতে আসেন। শ্রীমা তাঁকে নিজে আশ্রমের প্রতিটি কর্মকেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে সৎসঙ্গের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপ্রণালী সব কিছু সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেন। মহাত্মাজীও সৎসঙ্গের উন্নত আদর্শ ও বিচিত্র কর্মধারা দেখে মুগ্ধ হন।

বিদায়ের সময় মহাত্মাজীকে সন্তানদের মত আদর করে জড়িয়ে ধরে শ্রীমা স্নেহশীল কণ্ঠে বলেন, তুমি দেশের একজন যত বড়ই নেতা হও না কেন, তুমি আমার সন্তান। গান্ধীজীও বিশেষ শ্রদ্ধার সাথে বলেন, হ্যাঁ মা, আমি সত্যিই আপনার সন্তান। পরে গান্ধীজী শ্রীমা সমন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, ‘I have never seen a masterly women of such wonderful personality in my life.’

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশও শ্রীমার সেবাধর্মে মুগ্ধ হয়ে তাঁর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। ছোট থেকে কাব্য ও সঙ্গীতের প্রতি মনোমহিনী দেবীর শুধু অনুরাগই ছিল না,এ বিষয়ে তাঁর নিজের সৃষ্টিশক্তিও ছিল। তিনি ভজন কীর্তনগান ভালোবাসতেন, তেমনি নিজে অনেক ভক্তি-বিষয়ক পদও রচনা করেন। তাঁর রচিত অজস্র কীর্তন গানের মধ্যে একটি ঊষা কীর্তন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পদটির প্রথম কয়েকটি পংক্তি হলো,

প্রভাত যামিনী            উদিত দিনমণি
      ঊষারানী হাসি মুখে চায় রে।
জাগি বিহঙ্গ সব           তুলি নানা কলরব
      রাধা রাধা রাধাস্বামী গায় রে।।

………………….
পুনপ্রচারে বিনীত: প্রণয় সেন

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

……………………..
আরো পড়ুন:
মা সারদা দেবী
প্রজ্ঞাপারমিতা শ্রীশ্রীমা সারদা
বহুরূপিনী বিশ্বজননী সারদামণি
মা মনোমোহিনী
শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে সপ্তসাধিকা
মাতৃময়ী তিনরূপ
মা আনন্দময়ী
আনন্দময়ী মায়ের কথা
ভারত উপাসিকা নিবেদিতা
রাসমণি
নিরাহারা যোগিনী মায়ের সন্ধানে
পূণ্যশীলা মাতা কাশীমণি দেবীর সাক্ষাৎকার
আনন্দময়ী মা
মা মারিয়াম :: পর্ব-১
মা মারিয়াম :: পর্ব-২
মা মারিয়াম :: পর্ব-৩
মা মারিয়াম :: পর্ব-৪
মীরার কথা
অলৌকিক চরিত্র মাদার তেরেসা
মা আনন্দময়ীর কথা
বৈষ্ণব সাধিকা যশোদা মাঈ
আম্মার সঙ্গলাভ
শ্রীশ্রী সাধিকা মাতা
জগৎ জননী ফাতেমা-১
জগৎ জননী ফাতেমা-২
জগৎ জননী ফাতেমা-৩
জগৎ জননী ফাতেমা-৪
জগৎ জননী ফাতেমা-৫
জগৎ জননী ফাতেমা-৬
জগৎ জননী ফাতেমা-৭
জগৎ জননী ফাতেমা-৮
জগৎ জননী ফাতেমা-৯
জগৎ জননী ফাতেমা-১০
জগৎ জননী ফাতেমা-১১
জগৎ জননী ফাতেমা-১২

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!