-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: এগারোতম পর্ব
এর জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ভাষাভাষি বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাসীদের মাঝে নানাবিধ মন্ত্র প্রচলিত আছে। এসব শব্দকে অনেকে কেবলই কিছু বাক্য বা শব্দ বলে মানে। কেউ বলে এই শব্দের ভেতর দিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের শব্দকে ধরার কৌশল লুকায়িত আছে।
কেউ বলেন এই শব্দের মায়াজালের শব্দমালাই আল্লাহ-ভগবান-প্রভু-ঈশ্বর তথা স্রষ্টার সাথে যোগাযোগের মাধ্যম। নানাবিধ নিয়ম-ক্ষণ-কাল-লগ্ন মেনে এ সকল মন্ত্র ইষ্ট দেবতা ভেদে পাঠ করার বিধান দেখতে পাওয়া যায় প্রচলিত ধর্মমতে।
তবে মন্ত্র যে কেবল বিশাল বিশাল বাক্যমালার সমষ্টি তাই নয়। মন্ত্র হতে পারে নিছক এক দুই বা তিন শব্দের সমাহার। সেই মন্ত্র বারবার উচ্চারণ করে সাধক লীন হতে চায় অনন্তে। সনাতন মত অধিক প্রচলিত গায়ত্রী মন্ত্রের শুরুটা এমন-
‘ভূর্ভুবঃ স্বঃ’ বা ‘ভূঃ, ভূবঃ ও স্বঃ’।
শব্দের সাথে ধর্মীয় ভাবধারায় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হচ্ছে ‘নামজপ’। গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু বলেছেন, কলিকালে আর কোনো ভগবান ধরাধামে আসবেন না। তাই শেষে যিনি এসেছেন তার নাম করে যাও। তিনিই পার করে নিয়ে যাবেন। অর্থাৎ কৃষ্ণ নাম করে যাও।
তবে এই নাম জপ কেবল কৃষ্ণ নামে সীমাবদ্ধ থেকে যায় নি। নামজপে বিভিন্ন বিশ্বাসী, সম্প্রদায়, গোষ্ঠি নিজ নিজ ইষ্ট দেবতা বা গুরুর নামও স্মরণ করে থাকেন। এরমধ্যে কৃষ্ণনাম, হরিনাম, রামনাম বেশি শুনতে পাওয়া যায়। হিন্দুধর্মের গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে ‘হরে কৃষ্ণ’ মন্ত্র না নামজপটি সবচেয়ে জনপ্রিয়-
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ
কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম
রাম রাম হরে হরে।।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, ‘নামই এ যুগের সাধন। ভগবান ও তাঁর নাম অভিন্ন। যদি আকুল হয়ে একমনে শুধু তাঁর নামই জপ করা যায়, তবে তাতেই মুক্তিলাভ হয়। নামের অসীম শক্তি। নামের আগুন জ্বলে উঠলে ভেতরকার সমস্ত জঞ্জাল পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। জপের সময় না পেলেও স্মরণ-মনন ছাড়বে না। সারাদিনের মধ্যে দু’ঘণ্টা সময় অন্তত দেওয়া চাই।’
সুফিধারায় শব্দের এরূপ একটি উল্লেখযোগ্য ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। তা হলো ‘জিকির’। সাধারণ অর্থে জিকির অর্থ হলো স্রষ্টাকে স্মরণ। স্রষ্টার নামকে স্মরণ। একটা নির্দিষ্ট তালে মহান কোনো শব্দকে ক্রমাগত উচ্চরণ করতে করতে সাধকগণ মাতোয়ারা হয়ে যান ইসকে।
জিকিরের সার্বজনীন নির্দিষ্ট কিছু শব্দ থাকলেও। নিজ নিজ ঘারানার শিষ্যরা গুরুকর্তৃক জিকিরের উচ্চারণ ও শব্দ প্রাপ্ত হওয়ার রেওয়াজ দেখা যায় প্রচলিত তরিকাগুলোতে। তারা তাই জপে জান।
তবে এই জিকিরেও অনেক প্রকার ভেদ আছে। প্রকাশিত জিকির, অপ্রকাশিত জিকির, উচ্চস্বরে জিকির, নিরবে জিকির সহ আরো অনেক অনেক জিকিরের প্রচলিত আছে বিভিন্ন তরিকায়।
এই জিকির করতে করতে সাধক কখনো কখনো এতোটাই মাতোয়ারা হয়ে যান যে, তার আর হিতাহিত জ্ঞান পর্যন্ত থাকে না। সে কেবল স্রষ্টা-পয়গম্বর-গুরুর নামেই লীন থাকে।
বুখারি শরীফে বলা হয়েছে, ‘এ জিকির হলো ওই সব শব্দ, যা বললে সাওয়াব পাওয়া যায়। জিকিরের মধ্যে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা হাওলা ওয়ালা কুয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহ, বিসমিল্লাহ, হাসবুনাল্লাহ, আসতাগফিরুল্লাহসহ দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ কামনায় যে কোনো দোয়া করাই জিকিরের শামিল।’
ক্বারী আমির উদ্দিন তার গানে রাসূলের নাম জপার কথা বলেছেন-
নাম জপরে নাম জপরে, জপরে পাক নাম
লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদ রাছুউলুল্লা।।
একা ছিলেন যখন, আপে সাঁই নিরঞ্জন
কেউ ছিল না তাহার সঙ্গিলা,
আপনার নিজো নুরে, পয়দা করিয়া মোহাম্মদরে
দুস্ত বলে আল্লায় ডাকিলা।।
আউয়ালে আহাদ, দুওমে আহাম্মদ
মোহাম্মদ নাম ছিওমে রাখিলা,
চাহারমে ছিতারায় নিয়া, পঞ্চমে ময়ূর সাজাইয়া
ষষ্টমে রূহুগণ সৃজন করিলা।।
সপ্তমে আরশে নিয়া, ফানুসেতে সাজাইয়া
অষ্টমে ভাগ্য গুণে, পাইলেন আব্দুলা,
নবমে আমেনার ঘরে, জন্মিয়া মক্ষার শহরে
মানবলীলা প্রকাশ করিলা।।
দশমে নুরের জামাল, ফরমাইয়া ইন্তেকাল
এ নিখিল ভুবনেরে কাঁদাইয়া গেলা,
বলে আমির উদ্দিনে, ত্বরাইও শেষ নিদানে
ওগো শাফায়াত করনেওয়ালা।।
ব্রহ্মাণ্ডের মূলভাব শব্দহীন হলেও এর প্রকাশিত প্রথম শব্দকে অনেকে চিহ্নিত করেছেন ‘ওঁম’ ধ্বনিকে। অনেকে এর উচ্চারণকে ভেঙে বলেছেন ‘আয়াম’। অর্থাৎ অ য়া ম। তবে বেশিভাগ মানুষ একে ও ই ম হিসেবে ভেঙে উচ্চারণ করেন সাধন পথে।
বলা হয়ে থাকে, এই তিনটি মৌলিক শব্দই কেবল মানুষ করতে পারে। আর বাদবাকি শব্দগুলো হলো এরই সংমিশ্রণে সৃষ্ট। জিহ্বা-ঠোট-দাঁত ব্যবহার না করলে এই তিনটি শব্দের বাইরে আর কোনো উচ্চারণ করাই মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
এই তিনটি শব্দকে কেন্দ্র করেই জিহ্বার ব্যবহারে অন্যান্য শব্দগুলো মানুষ করে থাকে। এই তিনটি শব্দই মূলত প্রথমিক শব্দ এই ব্রহ্মাণ্ডের। এই তিনটি পৃথক শব্দ মিলে হয়েছে ওঁম বা ওঙ্কার শব্দটি। এই তিনটি শব্দ যেমন ব্রহ্মাণ্ডের শব্দ। তেমনি দেহেরও শব্দ।
বিশ্বাসীরা বলেন, এই তিন শব্দ মিলে যে ওঁম শব্দ হয় তা দিয়ে যেমন ব্রহ্মাণ্ডকে জাগ্রত করা সম্ভব তেমনি দেহের সমস্ত শিরা-উপশিরা-ধমনীকে জাগ্রহ করা সম্ভব। ‘ওঁম’ ধ্বনিই হচ্ছে সকল শব্দের মূল রূপ।
অন্যদিকে আধুনিক বিজ্ঞান বলে ব্রহ্মাণ্ডে সকল কিছুর পেছনেই আছে একটা কম্পন; অর্থাৎ কম্পন শক্তি। আর যেখানে কম্পন শক্তি যেখানে বাঁধা প্রাপ্ত হয় সেখানেই শব্দের জন্ম হয়।
ওঁম ধ্বনি কেবল হিন্দু ধর্মমেত বিশ্বাসীরাই সাধনায় ব্যবহার করেন তা শুধু নয়। অন্যান্য ধর্ম দর্শন এমনকি যোগ-আধুনিক ইয়োগা, ধ্যানেও এর ব্যাপক প্রচলন আছে। অন্যদিকে সুফিরাও এরূপ নানা শব্দকে জিকিরে ব্যবহার করেন।
ভারতবর্ষের মানুষের উচ্চারণে যেমন ব্রহ্মাণ্ডের আদি শব্দ হিসেবে ওঁম কে চিহ্নিত করা হয়েছে। তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এর গঠন প্রকৃতি পাল্টে ভিন্ন ভিন্ন উচ্চারণ হয়ে থাকতে পারে বলেও অনেকে মনে করে। অনেকে ওঁম বা ওঙ্কার শব্দের সাথে মিলিয়ে অনেক শব্দের কথাও উল্লেখ করেন।
শব্দের আরেকটা বহুল প্রচলিত ব্যবহার দেখা যায় ধর্মীয়গ্রন্থে। যেখানে শব্দকে মহিমান্বিত করে রাখা হয়েছে। অবর্ণনীয় এক ছন্দময়তার মাঝে ধর্মীয় গ্রন্থে শব্দকে ব্যবহার করা হয়েছে। যা হাজারের বছর পরও একাধারে যেমন রহস্যময় তেমনই আকর্ষণীয়।
সেই সকল শব্দের শাব্দিক অর্থ যেমন বেশিভাগ মানুষ মেনে চলে স্রষ্টার বিধান বলে। অনেকে আবার সে সকল শব্দে অন্তর্নিহিত অর্থে খুঁজে পেতে চান স্রষ্টাকে। হাজার হাজার বছর ধরে সেই শব্দমালা এক স্তরের মানুষ কণ্ঠস্থ করে চলে। এক স্তরের মানুষ তা ব্যাখ্যা দিয়ে যায়। আর এক শ্রেণীর মানুষ শুনে যায়।
তা যে ভাষাতেই আদিতে শাস্ত্র লেখা হোক না কেনো বর্তমানে তা প্রচলিত না থাকলেও ভক্তকুল সেই শব্দকে ধারণ করে শ্রদ্ধা-ভক্তিতে। তার প্রতিটা শব্দকে দেয়া হয় চূড়ান্ত ভক্তি। মানা হয় বিধির বিধান বলে। সকলের বুঝবার সুবিধার জন্য ধর্মগ্রন্থগুলো অগনতি ভাষা বা শব্দে অনুবাদ করা হয়েছে আগামীতেও হবে।
যেমন বেদের বৈদিক বা সংস্কৃতি ভাষা, ত্রিপিটকের পালী ভাষার প্রচলন এখন না থাকলেও বর্তমানে প্রচলিত সকল ভাষাতেই সেসবের অনুবাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এই অনুবাদ যদি যথাযথ না হয় তাহলে সর্বনাশের মাথায় বারি।
কারণ একই শব্দের বহুবিধ অর্থ হতে পারে। কোনটা আদৌতে বোঝাতে চেয়েছে তার যথার্থ ব্যবহার না হলে মূল ভাব হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫