-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: বারোতম পর্ব
আবার ধর্মীয় শাস্ত্র অনুবাদে শব্দের শাব্দিক অর্থ নাকি ভাবার্থকে গুরুত্ব দেয়া হবে সেটা অনেক সময় নির্ভর করে কে অনুবাদ করছে বা কাদের জন্য অনুবাদ করছে। ইসলামে অনুবাদের চারটি ধাপ দেখা যায়- শরিয়ত, হকিকত, তরিকত ও মারফত।
তবে শরিয়ত অর্থ সরাসরি যা বলা হয়ে তাই বলা আর মারফত অর্থাৎ শব্দের অন্তনির্হিত অর্থের অনুবাদই বেশি প্রচারিত। একে জাহেরি অর্থাৎ প্রকাশ্য আর বাতেনি অর্থাৎ গুপ্ত শব্দেও চিহ্নিত করা হয়।
তবে এই বিধান কেবল ইসলামেই নয় সকল মতাদর্শের মাঝেও লক্ষ করা যায়। সাধারণে শব্দের প্রকাশ্য অর্থকেই মেনে নেয়। এরাই জগতে সংখ্যাগুরু। আর যারা গুপ্ত অর্থের পেছনে ছোটে তারা সমাজে সংখ্যালঘু। শব্দের অন্তনির্হিত অর্থের পেছনে যারা মন দেয় তাদের সহ্য করতে হয় নানা নির্যাতন-নিপীড়ন।
তবে ধর্ম-দর্শন-মতাদর্শকে বুঝতে তার মূলভাষা। মূলভাষার শব্দ জেনে-বুঝে যারা পড়তে পারে তাদের পক্ষে এর মূলভাব বোঝা অনেক সহজ হয় বলে বেশিভাগ মানুষ বিশ্বাস করে। যথার্থ অনুবাদের অবশ্য তার তৃষ্ণা অনেকটাই মেটে। তারপরও মূল শব্দ একটা গুরুত্ব বহন করেই চলে।
কারণ তাতে ব্যবহৃত প্রতিটা শব্দের সাথে মিশে থাকে সেই সমাজের সামাজিক, রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় সহ সকল অবস্থার উপর। তার সাথে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি তো আছে। তাই সাধককুল বলেন, শব্দের মূল ভাবটা না ধরতে পারলে সাধন পথে কেবল হাপুর হুপুর ডুব পারাই সারা। প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হয় না।
সাধন পথে শব্দের মায়াজালের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার হলো- ‘গুরুবাক্য’। গুরুবাক্য কয়েক ভাবে হয়ে থাকে। নবীন ভক্তকে দীক্ষা বা বায়াত করার সময় ভক্তকে নির্দিষ্ট কিছু শব্দ বলে দীক্ষিত হয়। এই শব্দ গুরুবাদী মতাদর্শে ভেদে ভিন্ন হলেও অর্থ অনেকাংশেই এক।
আবার শিষ্য-ভক্ত-মুরিদ-অনুসারীদের দেয়া গুরুর আদেশও গুরুবাক্য বলে স্বীকৃত। এই গুরুবাক্য ভক্তকে অমোঘ বাণীরূপে পালন করতে হয়। এর অন্যথা হলে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক নিয়ে টানাটানি পর্যন্ত পরে যায়।
শুধু গুরু-শিষ্য কেনো প্রায় সকল চুক্তি-শপথও তো কিছুর শব্দেরই সমষ্টি। শিশুর জন্ম হলে কেউ দেয় আজান, কেউ দেয় উলুধ্বনি, কেউ বাজায় বাদ্য, কেউ বা শঙ্খ ধ্বনি। বিবাহেও শব্দ করে সম্মতি জানাতে হয় স্বাক্ষীর উপস্থিতিতে। মৃত্যুতেও পাঠ করা হয় প্রত্যেক মত-পথের নির্দিষ্ট কিছু শব্দ।
মৃত শুনতে পাবে না এমন বিশ্বাসীরাও মৃতের পাশে পাঠ করেন বা পাঠ করার ব্যবস্থা করেন পবিত্র গ্রন্থের। শবদেহ বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময়ও শব্দ করে পাঠ করা হয় পবিত্র সব বাণী। এভাবে আসলে শব্দ আমাদের জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে চলতেই থাকে।
বিশ্বাসীদের মাঝে ‘অন্তিম শব্দ’ বিষয়টিও বেশ গুরুত্ব বহন করে। মৃত্যুর সময় শেষ কোন শব্দ উচ্চারণ করতে করতে দেহত্যাগ করবে সেটার জন্য মানুষের থাকে বিশেষ ভাবনা। বিশ্বাসীরা বলেন, অন্তিমকালে যার নাম স্মরণে আসবে সেই তাকে সঙ্গী করে নিয়ে যাবে।
অর্থাৎ অন্তিম শব্দের উপর ভিত্তিকেই পরবর্তী জন্মের ঠিকানা নির্দিষ্ট হয়। তাই অন্তিমকালে সকলেই চায় নিজ নিজ ইষ্ট দেবতার নাম স্মরণে রাখতে। মুসলমানরা চায় শেষ শব্দ হোক প্রথম কলেমা। হিন্দুরা চায় কৃষ্ণা বা রাম নাম করতে। গুরুবাদীরা চায় নিজ নিজ গুরুর নাম স্মরণ করতে।
এভাবেই সাধারণ মানুষও চায় এমন কোনো শব্দ দিয়ে জীবনের শেষ হোক যাতে পরবর্তী জীবন সুখময় হয়।
আবার শিশুর মুখের প্রথম বুলি নিয়েও পরিবার-পরিজনের থাকে ভীষণ উত্তেজনা। কোন শব্দ উচ্চারণ করে শিশু তার কথা বলা শুরু করবে সেটাও অনেক মতাদর্শের লোক বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। অনেকে জন্মের পর থেকেই এমন সব শব্দ শিশুর সামনে বারবার বলে থাকে, যাতে সে সেই শব্দ দিয়েই তার কথা বলার যাত্রা শুরু করে।
সাধারণ ভাবে মা যেমন চায় শিশু প্রথমে বলুক ‘মা’। বাবা চায় শিশু প্রথমে বলুক ‘বাবা’। তেমনি করে আশপাশের সকলেই চায় তাদের নাম বলে শুরু হোক শব্দ উচ্চারণ। তবে অনেকে চায় শিশু প্রথম বলুক স্রষ্টার নাম বা তাঁর অবতার-পগম্বরের নাম। অনেকে চান তাদের গুরুদেবের নাম বলুক।
অনেকে চান পিতৃপুরুষের নাম উচ্চারিত হোক সবার আগে। অনেক আবার চান পবিত্র কোনো শব্দ বলাতে। এইভাবে সকলে সকলের মতো চেষ্টা চালায়। সবাইকে অবাক করে দিয়ে শিশুও তার প্রথম শব্দ উচ্চারণ করে ঢুকে পড়ে শব্দের জগতে।
এভাবে শব্দ মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। নাকি শব্দকে ব্যবহার করে মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে- সেটা একটা গোলমেলে ব্যাপার। তবে ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ‘শব্দ’ যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইন্দ্রিয় তা মানতেই হয়। শব্দের শক্তি ও গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই।
তারপরও প্রশ্ন থেকেই যায় মানুষ শব্দ থেকে নি:শব্দে প্রবেশ করে নাকি নি:শব্দ থেকে শব্দে প্রবেশ করে। এটা অনেকটা ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’র মতো হয়ে যায় কোথাও কোথাও। ফকির লালন সাঁইজি বলছেন-
দেখ না রে, ভাব না রে ভাবের কীর্তি।
জলের ভিতরে রে জ্বলছে বাতি।।
ভাবের মানুষ ভাবের খেলা
ভাসে বসে দেখ নিরালা
নীরে-ক্ষীরোতে ভেলা রয় যুতি।।
জ্যোতিতে রতি উদয়
সামান্যে কি তাই জানা যায়
তাতে কত রূপ দেখা যায় লাল মোতি।।
যখন নিঃশব্দে শব্দেরে খাবে
তখন ভবের খেলা ভেঙ্গে যাবে
লালন কয়, দেখবি কিরে কি গতি।।
মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরনে সর্বপ্রথম অবতীর্ণ শব্দটি হলো- ‘ইকরা’ অর্থাৎ ‘পড়ো’। কোরানে আল্লাহ বলেছেন, ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন, জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ো…।’ (আলাক ১-৩)
অন্যদিকে শব্দের প্রচলিত ব্যবহারে আরেকটা উল্লেখযোগ্য ব্যবহার হলো- ‘স্লোগান’। সাধারণ কিছু শব্দও যখন স্লোগানে রূপ নেয় তা এতোটাই শক্তিশালী হয়ে উঠে যে, তা আটপৌরে মানুষকেও প্রতিবাদী করে তুলতে সক্ষম হয়। সেই শব্দগুলো একধরনের প্রতীকে পরিণত হয়।
মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি বলেছেন, ‘শব্দ দিয়ে প্রতিবাদ করো, কণ্ঠ উঁচু করে নয়। মনে রাখবে ফুল ফোটে যত্নে, বজ্রপাতে নয়।’
সাধারণভাবে স্লোগান শব্দটা শুনলেই তা প্রতিবাদের ভাষা মনে হলেও, একে যুগে যুগে বহু বার বহু ভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অনেক সময় প্রাণের স্লোগানের শব্দ যুগ পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিণত হয়েছে নেহাত ‘বাণিজ্যিক স্লোগান’-এ।
আবার এর উল্টো চিত্রও দেখা যায়। হাজার হাজার বছর পরও আদি কোনো শব্দ মানুষকে আজও জাগিয়ে তোলে। সম্মিলিত করে। সেই স্লোগানের শব্দ কখনো আবেদন হারায় না।
স্লোগানের শব্দ চয়ণে তাই দেয়া হয় অধিক গুরুত্ব। কারণ যথাযথ শব্দ প্রয়োগে একটা স্লোগান এতো মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে যে, এক স্লোগানের ডাকে অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতাধারও আসন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অগনতি স্লোগান পাওয়া যায়। যা দেশ-কাল-সীমানা পেরিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের ভাষা হয়ে উঠেছে।
কোনো কোনো স্লোগানের শব্দ এতটাই ক্ষমতাধর হয়ে উঠে যে তা উচ্চারণ করার উপরও নানাবিধ বিধিনিষেধ আরোপ করতে হয় বিভিন্ন ব্যাবস্থাপনাকে। ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে ভারতবর্ষের রক্ত গরম করা স্লোগান ছিল, ‘বন্দে মাতারাম’। স্বাধীনতা আন্দোলনে পাকিস্তানের স্লোগান ছিল- ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
আর মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর স্লোগান হয়ে উঠে- ‘জয় বাংলা’। যে স্লোগানের ডাকে সাড়ে সাত কোটি জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরেছিল। আজও স্বাধীনতার পক্ষের বাঙালী এই স্লোগানে শোনা মাত্রই উজ্জীবিত হয়ে উঠে। এ স্লোগান হলো বাঙালীর প্রাণের স্লোগান।
শব্দের আরেকটা লিখিত উল্লেখযোগ্য রূপ হলো ‘শিরোনাম’। অর্থাৎ পত্র-পত্রিকার বিভিন্ন খরবের শিরোনাম। অনেকে খরবের গুরুত্ব বাড়াতে এমন সব শব্দের ব্যবহার করে যা মানুষকে এমন আকর্ষণ করে যে, যাদের পড়বার কোনো রুচি নেই তারাও নগদে পত্রিকা কিনে পড়তে বাধ্য হয়।
অনেকে একে স্রেফ ব্যবসায়িক স্বার্থে বা পত্রিকার কাটতি বাড়াতে ব্যবহার করলেও। অনেক সময় কিছু শিরোনাম সর্বকালের সেরা হয়ে টিকে থাকে ইতিহাসের পাতায়।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫