-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: দ্বিতীয় পর্ব
শব্দের ভেতর দিয়ে… ভাষার মধ্য দিয়ে… শব্দের মায়াজালে… জগতের কতই না মহৎ শিল্প-সাহিত্য-কাব্য-গান-গীতি রচিত হয়েছে। শব্দের ভেতর দিয়ে… ভাষার মধ্য দিয়ে… আমরা নিজেকে কতশত জ্ঞানকে ধরে রাখবার… বয়ে নিয়ে যাওয়ার… চলমান রাখার প্রকৃয়া করে চলেছি।
তাই শব্দ যেমন অপব্যবহারে ভয়ঙ্কর, তেমনি সু-ব্যবহারে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। মহানবী হজরত মোহাম্মদ বলেছেন, ‘যার কথা ও আচরণে অন্য মুমিন কখনো আহত হয় না, সে-ই প্রকৃত ঈমানদার।’ (মুসলিম, হাদিস-৪০)
বাক্য সংযমী হওয়া উত্তম, সেটা সকলেই কম বেশি জানে। কিন্তু তা মেনে চলা যে সহজ নয়, তাও তো মিথ্যা নয়। কারণ শব্দ হীন অর্থাৎ নিরব থাকা সাধারণের কর্ম নয়। ভেতরে যতক্ষণ প্রশ্নের উদ্রেক হয়, ততক্ষণ তা শব্দ হয়ে প্রকাশ হতে চাইবেই। জোর করে তাকে আটকে রাখতে চাইলে তাতে বিপদ আরো বাড়ে।
দমিয়ে রাখলে অল্প সংখ্যক শব্দ মনের ভেতরে অব্যক্ত আরো অগনতি শব্দের জন্ম হয়। আর এসব অব্যক্ত শব্দমালা প্রকাশ হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে। মানুষ অস্থির হয়ে উঠে। তাই নিরব হওয়ার জন্যও চাই যথাযথ শিক্ষা। সঠিক দিকনির্দেশনা। অর্থাৎ সঠিক ও শুদ্ধ সাধনা।
প্রকৃত নিরব সাধক, তখনই হতে পারে যখন মনের মাঝে সর্বক্ষণ প্রশ্নের উদ্রেক হওয়ার পরিবর্তে সমাধান সৃষ্টি হতে শুরু হয়। যতক্ষণ প্রশ্ন থাকে… জিজ্ঞাসা থাকে… ততক্ষণ সম্পূর্ণ নিরব হওয়া দুষ্কর। তাই বলা হয়, শব্দই চূড়ান্ত সাধনার প্রধান অন্তরায়।
তবে প্রাথমিক সাধনায় শব্দের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। সে কথায় পরে আসছি। তবে শব্দ কি করে জটিলতা তৈরি করে সে সম্পর্কে বাস্তবিক কিছু কথা আলোচনা করে নেয়া যাক এই অবসরে-
শব্দ বা ভাষা কেবল উচ্চারণেই সীমাবদ্ধ থাকে না। এরসাথে জড়িয়ে থাকে উচ্চারণের গতি-প্রকৃতি-গভীরতা, গলার স্বর, উচ্চারণের সময় মানুষিক স্থিতি, প্রকাশ ভঙ্গি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা প্রভৃতি।
এছাড়াও কে বলছেন, কাকে বলছেন, কোন সময়ে বলছেন, কোন পরিবেশে বলছেন, কোন স্থিতিতে বলছেন, কোন সমাজে বলছেন, কোন বিশ্বাস থেকে বলছেন, কোন বিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়ার জন্য বলছেন এই বিষয়গুলোও জড়িয়ে থাকে প্রতিটা শব্দের প্রকাশের পেছনে।
একই শব্দ ভিন্নভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতিতে যেমন তার অর্থ পাল্টে নেয়। তেমনি উচ্চারণের ভঙ্গিতেও ভিন্ন হয়ে যায় অর্থ। আবার কিছু কিছু শব্দ তেমনি তার ভেতরে লুকিয়ে রাখে অনন্ত অন্তনির্হিত অর্থ বা তাৎপর্য। ছোটগল্প সম্পর্কে যেমন বলা হয়- ‘শেষ হইয়াও হইলো না শেষ’।
তেমনি শব্দও তার নিজের মাঝে অব্যক্ত অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখে। যা প্রকাশের পরও সকলের কাছে ব্যক্ত হয় না; বা বলা যায় ধারা দেয় না। এই রহস্য ঘেরা শব্দ নিয়েও সুযোগ হলে দু-এক কথা বলবো পরে। সাধারণ শব্দের কথায় ফিরে আসি।
লক্ষ্য করলে দেয়া যায়, প্রত্যেক সমাজব্যবস্থায় নির্দিষ্ট কিছু শব্দের ব্যবহারে থাকে নিষেধাজ্ঞা। আবার কিছু শব্দের ব্যবহার করা হয় বাধ্যতামূলক। কিছু শব্দের ব্যবহার থাকে অপরিহার্য। কিছু কিছু শব্দ ব্যবহারে বৈধতা থাকলেও তা সকলের জন্য উন্মুক্ত থাকে না। আবার কিছু কিছু শব্দ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষে ব্যবহার করা যায়। অর্থাৎ থাকে সীমাবদ্ধতা।
শব্দ বড়ই জটিল এক উপাত্য। যা ক্ষণিকে চিত্তকে প্রেমময় করে তুলতে পারে আবার মুর্হূতে করতে পারে অগ্নিশর্মা-বিদ্রোহী। যুদ্ধের যাওয়ার পূর্বে সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে বলা হয় এমন সব শব্দ, যাতে তারা জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে প্রস্তুত হয়ে যায়; সামান্য অস্ত্রপাতি নিয়েও।
অন্যদিকে নেতারা ভাষণ দিয়ে কর্মীদের এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন যে, তারা মুর্হূতে সকল কিছু ভুলে নেতার কথা মতো কাজে ঝাঁপিয়ে পরতে দ্বিধা করে না। আবার প্রচণ্ড উত্তপ্ত পরিবেশে মহান নেতার কিছু কথায় সকল কিছু শান্ত হয়ে যায়। সবাই যে মুর্হূতেই বুঝতে পারে নিজেদের ভুল। হয়ে উঠে অনুতপ্ত।
আবার শব্দ যখন উচ্চারিত না হয়ে লিখিত রূপ হয় তার মাধুর্য পাল্টে যায়। যেমন একটা শব্দ ভিন্ন ভিন্ন বয়সে, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, ভিন্ন ভিন্ন মনস্থিতিতে এক এক রূপে ধরা দেয়। একই কবিতা-গল্প-উপন্যাস বা যে কোনো রচনা ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ-পরিস্থিতি-মনস্থিতিতে ভিন্ন ভিন্ন আবেদন রাখে।
কৈশরে যে প্রেমের কবিতা বিমোহিত করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হয়তো তা আবেদন হারায়। আবার এর উল্টোটাও হতে পারে। শব্দ যে মনের ব্যাকুলতা তৈরিতে যথেষ্ঠ ভূমিকা রাখে সে কথা স্বীকার করতেই হবে।
নানা সংস্কৃতি শব্দকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে। কেউ গুরুত্ব দিয়েছে অধিক শব্দকে। আবার কেউ গুরুত্ব দিয়েছে শব্দহীনতাকে।
তবে মোটা দাগে বাণিজ্যিক সমাজব্যবস্থা সব সময়ই অধিক শব্দকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে। আর আধ্যাত্মিক জীবনাচার গুরুত্ব দিয়েছে শব্দহীনতাকে। তবে এর মাঝেও মোটা দাগে পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভেদ লক্ষণীয়।
পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদেরকে শেখায় যত বেশি প্রশ্ন করবে তত বেশি জানবে। প্রশ্ন করতে করতেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয়। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে যেতে হবে। চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে। তবেই মিলবে সমাধান।
অন্যদিকে প্রাচ্যের শিক্ষা আমাদের বলে, যত বেশি নিরব থাকবে ততবেশি উপলব্ধি করবে। ‘জেনে’ তুমি কোথাও পৌঁছাতে পারবে না। কারণ জানার কোনো শেষ নেই। যদি উপলব্ধি করতে পারো তাবেই তুমি সত্যের সন্ধান পাবে। তার মাঝেই সকল উত্তর লুকায়িত আছে।
তা জানার জন্য আর কারো মুখাপেক্ষী হতে হবে না। কারণ বোধজ্ঞানের আগে তুমি যে সকল প্রশ্ন করো তা কেবল ধারণা পাওয়ার জন্য। অতি প্রশ্ন মানুষকে তার প্রকৃত প্রশ্ন থেকে অনেক দূরে নিয়ে যায়।
সেজন্য সাধককুলের গূঢ়তত্ত্বে বেশিভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিষ্যদের নিরবতা শিক্ষা দিতে। নিরব থাকার অভ্যাস করাতে। বাক্য সংযমী হতে। কটূবাক্য পরিত্যাগ করতে। সত্যবচন গ্রহণ করতে।
কোনো কোনো সাধনার ধারায় প্রাথমিক পর্যায়ে শিষ্যদের গুরুর নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কথা বলাও বন্ধ করে দেয়া হয়। তা এক দিনের জন্যও হতে পারে আবার সমগ্র জীবনের জন্যও হতে পারে। গুরু যখন বুঝতে পারে শিষ্য স্থির হয়েছে তখন বলবার অনুমতি প্রদান করে।
প্রশ্ন করে করে জানা ভালো? নাকি নিরবতায় জেনে নেয়ার প্রকৃত পথ খুঁজে নেয়া ভালো? সেটা ভিন্ন আলোচনা। দুই পক্ষেরই নিজস্ব যুক্তি-তর্ক থাকবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেই পথে না যাই। তারচেয়ে বরঞ্চ শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে আরো কিছু জানি।
শব্দের সাথে জড়িয়ে থাকে ছন্দ, সুর, তাল, ধ্বনি ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণ শব্দের সাথে ছন্দ মিলনে শব্দকে তালের মধ্যে ফেলে দেয়। যা মনকে অধিক বিগলিত করে। আর তার সাথে যদি সুমধুর সুর বা প্রকৃতির সময়োপযোগী রাগ মিশে তাহলে তো কথাই নেই। এতে সাধারণ শব্দগুলোই হয়ে উঠে অনেক চিত্তাকর্ষক-হৃদয়গ্রাহী।
সাধককুল শব্দকে কোমল করতে ছন্দ, সুর, তাল, রাগ-রাগীনির আশ্রয় নিয়েছেন সকল কালেই। এতে তাদের বক্তব্য যেমন মানুষের কাছে অধিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তেমনি হয়েছে হৃদয়গ্রাহী-স্মরণীয়। হয়েছে কালজ্বয়ী-অমর। শব্দকে ছন্দে-সুরে বা বলতে গেলে সংগীতে রূপ দিয়ে তাকে করা হয়েছে অনেক বেশি কোমল ও শ্রুতিমধুর।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, বেশিভাগ সাধকই তাদের কথা বা শব্দমালাকে সুরের মাঝে বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন। আবার যারা সুর-সংগীতে যান নি, তারাও তাদের ব্যক্ত করা কথার ভাষায় এমন সব চিত্তাকর্ষক পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন যা শতাব্দীর পর শতাব্দী পার হয়ে গেলেও তার আবেদন হারায় না।
সুর-ছন্দ-সঙ্গীত বা শব্দ চয়নের এ সকল ভাব রীতিতে সাধককুল অনেক গভীর ও গূঢ়তত্ত্ব ব্যক্ত করলেও সাধারণ চিন্তার লোকজন চট করে তার বিরুদ্ধাচরণ করতে পরে না। গূঢ়জ্ঞানের অভাবে তারা সেই সকল শব্দের অন্তর্নিহিত জগতে প্রবেশ করতে না পেরে সুরের মুর্ছনায় ডুবে যায়।
কারণ শব্দ উত্তেজিত করলেও সুরের তরঙ্গ অন্য এক আবেশে ডুবিয়ে দেয়। এজন্য সাধনার সংগীত আর বিদ্রোহের বা বিপ্লবের সংগীতরে সুরে থাকে ভিন্নতা। একটা মানুষকে ডুবায় নম্রতার গভীরে আরেকটা মানুষকে উত্তেজিত করে ক্রোধে।
আবার সংগীতের আরেক ধারায় শব্দের সাথে এমন সব সুর জুড়ে দেয় হয় যাতে মানুষ না গভীরতায় ডুবতে পারে, না পারে বিপ্লবের আগুনে জ্বলতে। সে উত্তেজিত হয়ে উঠে কামনা-বাসনায়। এই ধারাই সংগীতের সবচেয়ে জনপ্রিয় হলেও; শুদ্ধ সংগীতের আবেদন সকল সময়ই আশেককুলের হৃদয়ে বাস করে।
ইসলামে ইবাদতের জন্য সুরের মাধুরীতে ‘আজান’ দিয়ে আগমনী বার্তা দেয়া হয়। বিশ্বাসীরা এই আগমনী বার্তা পেয়ে ইবাদতের জন্য মনস্থির করে। মনস্থির হলে নিয়ত করে স্রষ্টার নামে নামাজে দাঁড়ায়। ইবাদতে ডুবে যায়।
অন্যদিকে মন্দিরে প্রবেশের পরই ভক্তকুল পুজা-প্রার্থনার পূর্বে ঘণ্টা বাজায়ে আগমনী বার্তা দেয়। এই ঘণ্টার ধ্বনি ভক্তের কানে প্রবেশ মাত্রই তার সমস্ত চিন্তা-চেতনা একীভূত হয়ে যায়। প্রস্তুত হয় ভগবানের চরণে নিজেকে নিবেদিত করার।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫