-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: চতুর্থ পর্ব
মহাদেব পাবর্তীকে বলেছেন ‘গুরুগীতা’য়। সান্ত কবীর তার কথা শব্দের মায়াজালে বলে গেছেন তার দোহায়। ফকির লালন সাঁইজি তার কথা বলে গেছেন তাঁর পদে। এভাবেই সকল সাধুগুরু তাদের প্রাপ্ত ব্রহ্মাণ্ডের সত্য জ্ঞান মানবজাতির জন্য ব্যক্ত করে গেছেন নিজস্ব ভাষা, শব্দ ও সুরে।
কিন্তু শব্দ এতোটাই বিভ্রান্তকর এক ইন্দ্রিয় যার নিজস্বতাই হলো ব্যক্তে; কিন্তু বুঝতে গেলে হতে হয় অব্যক্ত। অর্থাৎ শব্দ মানেই প্রকাশ; কিন্তু এর অর্থ বুঝতে গেলে হতে হয় নিরব-শূন্য। বড়ই জটিল এর সমীকরণ।
বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস তার সাধনা লব্ধ জ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে ‘ইউরেকা’ ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করতে করতে ছুটে গিয়েছিলেন শহরের পথে। তার গায়ে বস্ত্র আছে কি নেই তাও তার স্মরণে ছিল না। আর বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম চরিত্র শালর্ক হোমস সমাধান পেলেই বলে উঠতেন- ‘এলিমেন্টারি ওয়াটসন’।
লালন সাধকরা বলেন, ফকির লালন সাঁইজি নাকি বলতেন, ‘ওরে, আমার পোনা মাছের ঝাঁক আইসেছে’।
আসলে ‘জ্ঞান’ যখন ‘প্রজ্ঞা’য় পরিণত হয় তখন সাধক তর্কে যায় না। সে তার নিজের উপলব্ধির কথা বলে চলে আপন শব্দে। ফকির লালন সাঁইজি একথা সহজ শব্দে বলেছেন-
ঐ রূপ যখন স্মরণ হয়
থাকে না লোকলজ্জার ভয়,
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে।।
যতক্ষণ মানুষ নিজের সঞ্চিত তথ্যকে জ্ঞান ভাবে ততক্ষণ তর্কে জড়ায়। লিপ্ত হয় বাক বিতণ্ডায়। তবে সাধন পথে তার্কিকদের জ্ঞানী বলে গণ্য করা হয় না সে অর্থে। তারা মূর্খের খাতায় সংখ্যা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অনেকের মনেই প্রশ্ন আসবে তাহলে বড় বড় গুরুরা কেনো তবে এক কালে তর্কযুদ্ধে অংশ নিতো?
প্রকৃত সাধকরা তর্কে জয়ী হওয়া বা অন্যকে পরাজিত করার জন্য তর্কে অংশ নেয় না। মূলত তারা তর্কে অংশগ্রহণই করে না। তারপরও যদি করতেই হয় তাহলে তারা নিজের বক্তব্য তুলে ধরতে চায় মাত্র। অপরকে আঘাত করতে বা অপরের বিশ্বাসকে আঘাত হানতে তর্কে জড়ায় না। শুদ্ধতার চর্চায় এর বিধান নেই।
আবার অনেক সমাজের বিধানই এমন যে সেখানে নিজ বক্তব্য তুলে ধরবার রীতিই হলো তর্ক মজলিশে অংশ নেয়া। সেক্ষেত্রে অবশ্য পণ্ডিতেরাই সে সকল সভার মধ্যমণি হতো। সাধকদের সেখানে সেরূপ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না।
যে সকল সাধুগুরু সম্পর্কে বলা হয়ে থাকে যে, তারা তর্কের মজলিশে অংশে নিতেন। ঘটনা বিশ্লেষণে বেশিভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাবে সেটা তাদের অল্প বয়সকালে ঘটেছে বা যখন তারা সাধনকালে ছিলেন সে সময়ের ঘটনা। যতক্ষণ তাদের মনে প্রশ্ন ছিল। ততক্ষণ তারা তর্কে অংশে নিয়েছেন।
বলা হয়ে থাকে, অতীশ দীপঙ্কর মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে একজন প্রখ্যাত নৈয়ায়িক ব্রাহ্মণকে তর্কযুদ্ধে পরাজিত করলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে। তখন আচার্য শীলরক্ষিত তাকে ‘শ্রীজ্ঞান’ উপাধি প্রদান করেন এবং তাঁর নতুন নাম হয় ‘দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান’।
আবার যারা সাধনায় সিদ্ধ হয়েও তর্কের মজলিশে উপস্থিত হয়ে ছিলেন। তাদের ক্ষেত্রেও দেখা যাবে বেশিভাগ ক্ষেত্রেই তাদেরকে সমাজ বাধ্য করেছে সে অবস্থায় যেতে। আর অংশ নিলেও তারা সেখানে তর্ক নয়, সমাধান বাণীই দিয়েছেন। সেখানে তর্কাতর্কি করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেন নি।
বেশিভাগ ক্ষেত্রেই এসব তর্কে সাধুগুরুদের কাছে অন্যপক্ষ বশ্যতা স্বীকার করে নত হয়েছে। আর যেখানে হয়নি সেখানের ইতিহাস ঘাটলে খুঁজে পাওয়া যাবে সেসব তর্ক মজলিস প্রকৃত পক্ষে ছিল উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে সাধুগুরুকে আক্রমণ করা। তাকে শাস্তির আওতায় আবার কূটকৌশল মাত্র।
অন্যদিকে আর যে সকল সাধকদের তর্কযুদ্ধে ব্যাপকভাবে অংশ নিতে দেখা যায়। তাদের বেশিভাগই দরবারী সাধক বলে বিবেচিত। শাসকের নির্দেশে তারা বিভিন্ন পণ্ডিতের সাথে তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতো। মূলত তারা জ্ঞান আহরোনই করতো তর্কে জয়ী হওয়ার জন্য। তার জন্য তারা পেতো বিশেষ সম্মান ও সম্মানী।
যাক সে সব কথা। আবার ফিরি শব্দের জটে। মানুষ একে অন্যের সাথে পরিচয়ের প্রাথমিক পর্বেই একে অন্যের প্রতি ধারণা করতে চায় তার প্রাথমিক কিছু তথ্য সংগ্রহ করে। সাধারণভাবে মানুষ একে অন্যের নাম, নিবাস, বংশ, শিক্ষা, গুরুকুল ইত্যাদি দেখে ধারণা করে নেয়।
তারপর পোশাক, ব্যবহার, আচরণ, শব্দের চয়ন থেকে ধারণা করে, কে কেমন। এসব যে সকল সময় সঠিক হয় তা নয়। কিন্তু কারো সম্পর্কে ধারণা করার এগুলোই সহজ ধাপ। কিন্তু কেউ যদি নিরব থাকে তার সম্পর্কে ধারণা করা জটিল হয়ে পরে।
তাই পারস্পরিক ধারণার জন্য শব্দ একটা বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে। যখনি কেউ বলতে শুরু করে তখনি তার সম্পর্কে পূর্বের সকল অনুমান পাল্টে নতুন ধারণার জন্ম নিতে শুরু করে।
এ প্রসঙ্গে মাওলা আলী বলেছেন, ‘মানুষ তার জিহ্বার নীচে লুকিয়ে থাকে।’ অর্থাৎ মানুষ কথা বলতে শুরু করলেই তার সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ধারণা পাওয়া যায়।
বলবার ভঙ্গি, শব্দের চয়নের উপর ভিত্তি করেই মানুষের জ্ঞানের বহর ও মানসিক স্থিতি বোঝার কৌশলটা হলো ধারণার দ্বিতীয় ধাপ। তবে এটিও সাধারণ বিচার। গবেষণা বলেন, মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে উচ্চারিত শব্দের ভূমিকা মাত্র ৭ শতাংশ।
শব্দের চয়ন ও বলবার ভঙ্গি থেকে শিক্ষিত জনরা মানুষকে বুঝবার চেষ্টা করে। ভাষার ব্যবহার থেকে বুঝে নিতে চায় কে ডানপন্থী, বামপন্থী, ডেমোক্রেট, রিপাবলিক, সাধু, গুরুবাদী, মৌলবাদী, কট্টরপন্থী, মার্কসবাদী, লেনিনবাদী, মাওবাদী ইত্যাদি ইত্যাদি।
গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘আমরা যখন কথা বলি, তখন সেই সময় আমাদের শব্দগুলোকে ভালোভাবে নির্বাচন করা উচিত। কারণ এর ফলে শ্রোতার উপর ভালো কিংবা খারাপ প্রভাব পরতে পারে।’
খেয়াল করলে দেখবেন জুতার কারবারিরা নিজেদের মধ্যে কিছু কোড বা সাংকেতিক শব্দের ব্যবহার করে। সেই শব্দগুলো সাধারণত তারা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ব্যবসায়ীক মত বিনিময়ের জন্য ব্যবহার করে থাকে। বিষয়টা খুব জটিল কিছু নয়।
আপনি যদি তাদের সেই শব্দগুলো জেনে নেন। এবং তাদের সাথে কথা বলার সময় সেই শব্দগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারেন। তবে দেখবেন অল্পতেই আপনি তাদের সাথে মিশে যেতে পারবেন। বিষয়টা হলো আপনার সামনে যে জন, সে কি ভাষায় আপনার ভাব বুঝবে, তা যদি আপনি বুঝতে পারেন তাহলে মিশে যাওয়া সবচেয়ে সহজ।
যেমন সহজ নিরবতার ভাষা বুঝলে পরমের সাথে মিশে যাওয়া। ফকির লালন সাঁইজি এ প্রসঙ্গে বলেছেন-
এই বেলা তোর ঘরের খবর
জেনে নে রে মন,
কেবা জাগে কেবা ঘুমায়
কে কারে দেখায় স্বপন।।
শব্দের ঘরে কে বারাম দেয়
নিঃশব্দে কে আছে সদাই,
যেদিন হবে মহাপ্রলয়
কে কার করে দমন।।
দেহের গুরু আছে কেবা
শিষ্য হয়ে কে দেয় সেবা,
যেদিনে তাই জানতে পাবা
কোলের ঘোর যাবে তখন।।
যে ঘরামি ঘর বেঁধেছে
কোনখানে সে বসে আছে,
সিরাজ সাঁই কয় তাই না খুঁজে
দিন তো বয়ে যায় লালন।।
যদি আপনি বাংলা ভাষাভাষী হয়েও কথা বলার সময় প্রচুর বিদেশী শব্দ ব্যবহার করেন। তাহলে আপনি যে ভাষার শব্দ বেশি ব্যবহার করছেন তার সাথে আপনার একটা যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই। ধরা যাক, আপনি বাংলা ভাষার সাথে প্রচুর ইংরেজি শব্দ বা বাংলার পরিবর্তে আপনি ইংরেজিতেই কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। তাহলে আপনার সম্পর্কে এক ধরণের ধারনার জন্ম দেয়।
যদি বিষয়টা আপনি বিনয়ের সাথে করেন তাহলে আপনার সম্পর্কে এক ধরণের ধারণা হবে। আবার যদি অহংকার বা গড়িমার সঙ্গে বলেন তাহলে বিষয়টা অন্যরকম হবে। আবার যদি আপনি বিষয়টা মূর্খতার সাথে করেন তাহলে বিষয়টার তাৎপর্যই পাল্টে যাবে।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫