-মূর্শেদূল মেরাজ
জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: সপ্তম পর্ব
আসলে আপনার শব্দের চয়ন ও তার ব্যবহার ও প্রয়োগ অর্থাৎ আপনার নিজস্ব শব্দের মায়াজাল থেকেই আপনার উপর মানুষ তার সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা তৈরি করে নেয়। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে প্রত্যেক জাতি-সমাজ-গোত্র-ধর্ম-মত-পথের নিজস্ব এক ধরণের স্বাগত শব্দ আছে।
আপনি সেই শব্দ বা শব্দগুলো যতদ্রুত সহজভাবে বলতে শিখে নিবেন ততদ্রুত আপনি তাদের সাথে মিশে যেতে পারবেন। ভারতবর্ষের গুরুবাদীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্ভাষণের জন্য সবচেয়ে অধিক ব্যবহার করতে দেখা যায় ‘জয়গুরু’ শব্দটি। যদিও এর পাশাপাশি আরো অনেক সম্ভাষণের শব্দ বা ভাষার প্রচলন দেখা যায়।
সালাম, ইয়া মুর্শিদ, আদাব, নমস্কার, হঁরিওম, ওঁমশান্তি, গুরুকৃপা, জপনাম, হরেকৃষ্ণ, জয়রাম, জয় জিনেন্দ্র, হ্যালো, হায় যেমন ব্যবহৃত হয় তেমনি লালন ঘরে অধিক ব্যবহৃত হয় ‘আলেকসাঁই’ শব্দটি। অতলে তলিয়ে দেখলে সম্ভাষণের সকল শব্দের বা ভাষার অর্থ শেষে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
তারপরও আপনি যদি সঠিক জায়গায় সঠিক শব্দটির ব্যবহার না করতে পারেন। তাহলে সকলেই আপনার দিকে সরু চোখে তাকাবে। আপনি নিজেকে কক্ষচ্যুত নক্ষত্র রূপে দেখতে পাবেন। কিন্তু জায়গা মতো সঠিক শব্দের প্রয়োগে আপনি মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে পারবেন।
শব্দের পাশাপাশি পোশাক-আচরণ বিষয়গুলোও আছে। সে সব না হয় অন্যান্য ইন্দ্রিয় নিয়ে আলোচনার সময় অন্য কোনো লেখায় বলা যাবে। এ যাত্রায় শব্দেই থাকি। প্রতিটি শব্দের গায়ে যে সমাজ-সভ্যতা একটা লেবেল এঁটে দেয় সে বিষয়ে এখানে কিছু বলা যাক-
যেমন ‘মজদুর’ শব্দের গায়ে যেমন কমিউনিসট কমিউনিসট গন্ধ পাওয়া যায়। তেমনি- কালী, শিব, কৃষ্ণ, ভগবান, আত্মা, বেদ, গীতা, পুজা, মন্দির, দেবতা, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ ইত্যাদি ইত্যাদি শুনলেই মনে হয় হিন্দুত্ব। আবার আল্লাহ, হজরত, মক্কা, কাবা, সুরা, দোয়া, সোয়াব, সালাত, রোজা, ঈদ, হিজরত, মাওলা ইত্যাদি শব্দে মুসলমানিত্ব।
ভিক্ষু, শ্রমণ, চীবর, ভিক্ষু, বুদ্ধ, প্যাগোডা, গুম্ফা, ত্রিপিটক, ধর্ম্মপদ ইত্যাদি বৌদ্ধ। আর প্রভু, ঈশ্বর, যীশু, গড, ফাদার, পোপ, ক্রুশ, স্টার সানডে, ক্রিসমাস ইত্যাদিতে খ্রিস্টানিটির গন্ধ। পীর, রওজা, বায়াত, ওরস, জিয়ারত ইত্যাদিতে সুফিবাদ। অধিবাস, সেবা, ভক্তি, দীক্ষা, বায়াত, খিলকা, খেলাফত, গুরু, শিষ্য শুনলে গুরুবাদ। ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা কোনো কিছু বুঝবার আগেই… ভাববার আগেই শব্দের গায়ে লাগিয়ে দেয়া লেবেল বা নিজে লাগিয়ে নেয়া লেবেলের ভিত্তিতে তুলনামূলক বিচার করে থাকি। এতে আমাদের সহজ মানুষ হওয়া আর হয়ে উঠে না। আমরা সাধারণই থেকে যাই।
এই লেবেল আঁটা শব্দগুলো আমাদের চিন্তা-চেতনাকে বিকাশ হতে দেয় না। এই শব্দের গায়ে লেপ্টে থাকা লেবেলগুলো চিনতে না পারলে চিন্তার সার্বজনীনতায় প্রবেশ করা সহজ নয়। পরে থাকতে হয় বিভাজনের রাজনৈতিক ঘেরাটোপের ভেতরেই।
আমাদের অল্প শিক্ষা, স্বল্প জ্ঞান শব্দ-ভাষাকে সার্বজনীন হতে দেয় না। আমরা আরবি-ফারসিতে মুসলমান, ইংরেজিতে খ্রিস্টান, সংস্কৃতি-হিন্দি-মারাঠী-তামিলে হিন্দু, পালীতে বৌদ্ধ ইত্যাদির গন্ধে মাতাল হয়ে রই। অন্য কিছু ভাববার সময় কোথায়! মনে সংশয়-সন্দেহ-ঘৃণা থাকলে কি আর প্রেমের ভাব জাগে?
অথচ আমরা ভাষার জন্য জীবন বিসর্জন দেয়া জাতি। আমরাই যদি সকল ভাষাকে সমান সম্মান প্রদর্শন করতে না পারি তাহলে সেটা জাতি হিসেবে খুবই দুঃখজনক। পৃথিবীকে তো আমাদেরই দেখিয়ে দেয়ার কথা ছিল ভাষাকে… শব্দকে… কি করে আপন করে নিতে হয়। কি করে ভালোবাসতে হয়।
অথচ আমরা বিশ্ব রাজনীতির স্বার্থে শব্দকে যে সাম্প্রদায়িক আবরণে মুড়ে রাখা হয়েছে সেই পাতা ফাঁদে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে বসে আছি। বসে আছি বললে ভুল হবে। আমরা তা নিয়ে সদা উল্লাসে মত্ত বলাই মনে হয় ঠিক হবে।
নইলে দেখুন না আমাদের মাঝে কেউ যদি তার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। আমরা তাকে নিয়ে গর্ব করার বদলে হাসি-তামাসায় মত্ত হয়ে উঠি। ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতেও পিছপা হই না। কেউ যদি প্রমিত ভাষায় কথা বলতে না পারে বা তার নিজ আঞ্চলিক ভাষায় বা আঞ্চলিক শব্দ প্রয়োগে করে তাহলে আমরা ভাবি সে সমাজচূত্য ব্রাত্য জন।
যদি কোথাও ভুল বানানে কিছু লেখা দেখি তাকে বিনয়ের সাথে তা স্মরণ করিয়ে না দিয়ে। তার ছবি তুলে রাষ্ট্র করে দেই। যাতে সে তামাসার পাত্র হয়। আর এই তামাসার মজমায় তাকে বানর নাচ নাচিয়ে আমরা চর্তুদিকে ভীড় করে হাত তালি দেই।
এ আমাদের শব্দের গায়ে লাগানো লেবেলের দাসত্বের দ্বীনতা-হিনতা মাত্র। প্রকৃত শিক্ষা কখনো এমন শিক্ষা দেয় না। প্রকৃত শিক্ষা ভালোবাসতে শেখায়-ক্ষমা করতে শেখায়। বিদ্রূপ করতে শেখানো প্রকৃত বা যথাযথ শিক্ষার কর্ম হতে পারে না।
প্রবাদে বলে- ‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’। শব্দের প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রবাদটা একটু পরিবর্তন যোগ্য। এর ভাবিয়া বলিও কথা বিষয়টি শতভাগ মেনে চলাই উচিত। কিন্তু বলিয়া আর ভাবিও না বিষয়টাতে একটু ঝামেলা আছে। ভুল করে কোনো কিছু হঠাৎ উত্তেজনাবশত কিছু বলে ফেললে তার সংশোধনের সুযোগ থেকে যায়।
যদি যথাযথ বিনয় পূর্বক তা করা যায় অনেকক্ষেত্রে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যায়। কিন্তু ‘বলেছি তো বলেছিই’ এমন মনোভাব থাকলে আর কিছু করার থাকে না। মনের গড়িমা অহঙ্কারকে তাতিয়ে দেয়।
এই লীলাখেলা দেখলে বোঝা যায় শব্দের পেছনে যে রাজনীতি তার সাথে জড়িয়ে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। ধারিত্রীর ভূমি-জল-পাহাড়-পর্বত-নদী-নালা-সাগর-মহাসাগর-বন-জঙ্গল সর্বত্রই যেমন মানুষ ক্ষমতার বলে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
তেমনি শব্দও মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে নিজেদের মধ্যে কুক্ষিগত করে রেখেছে। এই শব্দের বিভাজন বড়ই ভয়ঙ্কর মানুষের মনুষ্যত্ব বৃদ্ধিতে। আধ্যাত্মিকতা-ভাবজগৎ অর্থাৎ সর্বোপরি প্রেমজগতকে বুঝতে।
সে কারণে সাধককুল শুরু থেকেই শব্দকে বিভাজনের বদলে শব্দের ভেতরে অন্তর্নিহিত অর্থ লুকায়িত করে রাখার পথে হেঁটেছেন।
সাধুগুরুরা তাদের তত্ত্ব চলমান রাখতে প্রয়োজনে সকল শব্দই ব্যবহার করেছেন। যার তাৎপর্য বেশিভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন হলেও শব্দের ব্যবহারকে সহজ করতে এই প্রচেষ্টা মহৎ সাধুগুরুরা চলমান রেখেছেন। তারা প্রেমের রসে অনেক শব্দকে সহজ করার প্রয়াস নিয়েছেন।
ভেদাভেদ থেকে বের হয়ে শব্দকে সার্বজনীনতা দেয়ার প্রশ্ন তুলেছেন। শব্দের একমুখো চর্চাকে বয়কট করে একই শব্দের ভেতর জুড়ে দিয়েছেন অগনতি চিন্তার ধারা। অগনতি ভাবনার উৎস করে দিয়েছেন প্রতিটি শব্দকে। তারা শব্দের এককত্বকে ভাঙবার প্রয়াস করেছেন।
এই চেষ্টা যে কেবল সাধুগুরুরাই করেছেন তাই নয়। একে ব্যবহার করেছেন যুগে যুগে অনেকেই। অনেক পেশাজীবী, এমনকি বাণিজ্যিক কাজেও এর ব্যবহার হয়। তবে সে সকল ব্যবহারের উদ্দেশ্য সাধুগুরুদের মতো মহতের বদলে, সত্য আড়াল করে সার্থসিদ্ধিতেই বেশি প্রয়োগ হয়ে থাকে।
হয়তো এ কথা সকল ক্ষেত্রে খাটে না, তবে বেশিভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক হওয়ারই সম্ভবনা যে আছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই; এটা সত্য।
আল্লাহ-গড-ভগবান-ঈশ্বর-প্রভু সবই যে এক আরাধ্য স্রষ্টারই ভিন্ন ভিন্ন নাম। সে কথাটা আমরা মানতেই পারিনি আজও। আমরা এখনো মেতে থাকি এই তর্কে যে আমাদের প্রভু তোদের ভগবান থেকে ভালো। এ প্রসঙ্গে বিচ্ছেদ গানের প্রাণ পাগল বিজয় সরকার লিখেছেন-
জানিতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটি কি,
আমরা বহু নামে ধরা ধামে কোত রকমে ডাকি।।
কেহ তোমায় বলে ভগবান
গড বলে কেউ করিয়ে আহবান
কেহ খোদা কেউ যিহুদা কেউ কয় পাথিয়ান;
গাইলাম জনম ভরে মুখস্ত গান
মুখবোলা টিয়াপাখি।।
সকল শাস্ত্রে শুনিয়ে যে পাই,
তোমার না কি পিতামাতা নাই
তোমার নামকরণ কে করিলো বসে ভাবি তাই;
তুমি নাকি কি অনামি সাঁই
আমরা তার বুঝি বা কি।।
কেহ পিতা কেহ পুত্র কয়,
বন্ধু বলে কেউ দেয় পরিচয়
তুমি সকলের সকল আবার কারো কিছু নয়;
দয়াল তোমার আসল যে পরিচয়
কে জানে তা কি না কি।।
পাগল বিজয় বলৈ, মনের কথা কই,
আমি খাঁটি ভাবের পাগল নাই
গোল বেধেছে মানের মাঝে কাজেই পাগল হই;
আমার বুকে যা নাই মুখে তাই কই
কাটাকান চুলে ঢাকি।।
(চলবে…)
……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫