ভবঘুরেকথা
শব্দের মায়াজাল

-মূর্শেদূল মেরাজ

জ্ঞানেন্দ্রিয় শব্দ : শব্দের মায়াজাল: নবম পর্ব

এই সূত্রে বলতে হয়, শব্দের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হচ্ছে মানুষের ‘নাম’। নামের পদবী দিয়ে যেমন আমরা মানুষের জাত-কুল-বংশ-বর্ণ বুঝবার চেষ্টা করি। তেমনি নামের শব্দের ভেতর দিয়েও তাকে চিনতে চাই। স্বজনরা নবজাতেকর নাম রাখতে চান এমন যাতে তাকে চিহ্নিত করা যায়।

সেই চিহ্নায়ণ কেবল তাদের সন্তানরূপে নয় তার ভবিষ্যত কর্ম ও স্বভাবকে যেরূপ দেখতে চায় সেরূপ নাম রাখে। কিন্তু বড় হতে হতে বা কর্মগুণে মানুষ যে নাম প্রাপ্ত হয় তা দিয়ে তাকে চিহ্নায়ণ করা বেশ সহজতর হয়। যেমন বাবা-মা সন্তানের নাম রাখে ভগবানের নামে ‘কৃষ্ণ’। যাতে সে সকলের জন্য কল্যাণময় কর্ম করে।

পাড়া প্রতিবেশী কৃষ্ণ নামে ডাকে কারণ তার গায়ের রং কালো। বন্ধু-সখারা তাকে কৃষ্ণ নামে ডাকে কারণ তার সখীর সংখ্যা সীমাহীন। আবার মুরব্বিরা আদর করে কৃষ্ণকে বানিয়ে দিলো হয়তো ‘কালা’।

তাই যে শব্দে একজনকে চিহ্নিত করার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছিল তা টিকে থাকলেও তা এক এক জনের কাছে অর্থ পাল্টে গেছে আচরণের কারণে।

আবার কিছু কিছু নাম নিজেই বদনাম রূপে স্বীকৃত। যেমন বাংলা ভাষাভাষীদের কাউকে ‘মীরজাফর’ বললে সে রেগে যাবে। আবার বাংলাদেশীদের কেউ ‘রাজাকার’ বললে উত্তেজিত হবে-ক্ষোভে ফেটে পরবে। পাল্টা জবাব দেবে।

আবার নাম যথাযথ না হলে শুনতে হয় নানান কথা। এ নিয়ে প্রবাদও প্রচলিত আছে- ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’। যেমন ধরুন ছোটখাটো লিকলিকে কারো নাম যদি হয় ভীম, বা বিশালদেহী কারো নাম যদি হয় ‘লিলিপুট’ কিংবা প্রচণ্ড দুরন্তপনা কারো নাম যদি হয় ‘শান্ত’।

আবার নামের বিকৃতিও একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে মানুষের জীবনে। কারো নাম হয়তো ‘মদন’। তা কালক্রমে হয়ে গেলো ‘মদন্ন্যাই’। আবার ছোটবেলায় শখ করে বাবা-মা হয়তো একটা সুন্দর নাম রেখেছিল। কিন্তু বড় হতে হতে স্বভাব দোষে নামের পাশে বিশেষণ যোগ হয়ে গেলো- চোর, কালা, মোটা, চিকন, ছক্কা ইত্যাদি ইত্যাদি।

কালক্রমে হয়তো মূল নাম পাল্টে শুধু বিশেষণটাই টিকে রইলো। আবার সন্তানের নামে অনেকে পরিচিত হয়ে উঠে হারিয়ে ফেলে নিজের নাম। এখানে মানুষ নানাভাবে নানা রূপে নিজ নাম হারিয়ে পরিচিত হয়ে উঠেন ভিন্ন কোনো নামে।

আমাদের পাড়ায় একসময় ১৭ জনের নাম ছিল বাবু। তাদেরকে নিয়ে ছিল নানা বিভ্রান্তি। তাই এলাকাবাসী কর্ম-গুণ-স্বভাব-চরিত্র-গঠনের ভিত্তিতে তাদের নাম দিয়ে দিলো।

তাদের কেউ হলো লম্বা বাবু, কেউ বেটে বাবু, পিচ্চি বাবু, গুণ্ডা বাবু, সুন্দর বাবু, পাঙ্কু বাবু, বিজলী বাবু, জাপানি বাবু, গোদা বাবু ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে একটা বিষয় আমরা ছোটরা কিছুতেই বুঝতাম না, দেখতে ফর্সা বাবুকে ডাকা হতো কালা বাবু আর কালো বর্ণের বাবুকে কেনো যেনো ডাকা হতো গোড়া বাবু নামে।

এমন উদাহরণে আপনাদের সকলেরই হয়তো হয়েছে। এই লেখা যারা পড়ছেন তাদের নিজেদেরও হয়তো এমন নানারূপ নাম আছে। একবার ষাট বছরের এক পৌর ভদ্রলোক যখন পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিল তার নাম ‘টুল্লু’ বিষয়টা আমার কাছ বেশ অভিনব লেগেছিল। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি এই বয়সের মানুষরা সাধারণত তাদের সম্পূর্ণ নাম বলে থাকে। যাক সে কথা।

আসুন এ পর্যায়ে ব্যাকরণে শব্দকে কিরূপে দেখা হয়েছে সে সম্পর্কে দুই-এক কথা জেনে নেয়া যাক। এরজন্য বংলাকেই বেছে নিচ্ছি। এ পর্যায়ে প্রবেশ করতে গেলে ভাষা সম্পর্কে যৎসামান্য না জানলেই নয়। তাই বাংলা ভাষা নিয়ে গুটিকয়েক কথা বলেই যাচ্ছি শব্দের ব্যাকারণে।

বাংলা ভাষার উৎপত্তি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকে। এর প্রধান দুটি শাখা- শতম ও কেন্তুম। ধারণা করা হয়, শতম থেকে আর্য ভাষার উৎপত্তি ঘটে। আর্যদের ধর্মগ্রন্থ বেদের ভাষা বলে এটি বৈদিক ভাষা নামে পরিচিত। সপ্তম শতকে পানিনি এই ভাষাতে কিছুটা সংস্কার করলে সংস্কারকৃত এই রূপ পরিচিতি পায় সংস্কৃত ভাষা নামে।

উচ্চারণে সুবিধার জন্য সংস্কৃত অর্থাৎ তৎসম শব্দে কিছুটা পরিবর্তন আনা হলে এটি রূপ লাভ করে পালি ভাষায়। পালির সাথে অনার্যদের ভাষার মিশ্রণে সৃষ্টি হয় প্রাকৃত ভাষা। এই প্রাকৃত ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে নানরূপ উপভাষা সৃষ্টি হয়। যেমন-

পূর্ব ভারতে প্রচলিত মাগধী প্রাকৃত ভাষা থেকে পূর্বী অপভ্রংশ উদ্ভুত হয় এবং সেই অপভ্রংশ থেকে মগহী, মৈথিলী ও ভোজপুরী এই তিনটি বিহারী ভাষা এবং বাংলা, অসমীয়া ও ওড়িয়া এই তিনটি ভাষাকে বাংলা ভাষায় জমজ বোন বলা হয়। অন্যদিকে, পশ্চিমের শৌরসেনী অপভ্রংশ থেকে হিন্দি ও অন্যান্য ইন্দো-আর্য ভাষার উদ্ভব হয়।

তবে গৌড়ীর প্রাকৃত থেকে বাংলা ভাষার উদ্ভব ঘটেছে কিনা তা নিয়ে মতভেদ আছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ মনে করেন বাংলা ভাষা বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছিল ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। তবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে এর সঠিক সময় কাল হবে খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে।

পরবর্তীতে নিজস্ব শব্দের মায়াজালের শব্দভাণ্ডারের সাথে পৃথিবীর নানা অঞ্চলের বহু শব্দ প্রবেশ করে বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে। তবে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সময়ের সাথে সবকিছুই পরিবর্তিত হয়। শব্দ ও ভাষাও তেমনি। এতেও পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে। লাগাটাই স্বাভাবিক।

তবে বিবর্তন আর বিকৃতি দুটির মধ্যে পার্থক্য দৃশ্যমান। শব্দ… ভাষা… এগিয়ে যেতে যেতে কিছু পরিবর্তন হয়ে বিবর্তিত হয়। এটাকে মেনে নিতেই হয়।

কিন্তু বিকৃতি বড়ই সর্বনাশা। শব্দের বিকৃতি ঘটলে মূলভাব হারিয়ে যায়। মূলভাব হারিয়ে গেলে শব্দের অর্থে বিভ্রান্তি প্রকট হয়। এতে শব্দের মাঝে লুকায়িত অন্তর্নিহিত ভাব আরো দুর্বোদ্ধ হয়ে ওঠে এবং আদি গ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যা প্রচলিত বা প্রচারিত হয়।

অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টির নাম শব্দ। তবে ধ্বনির সমষ্টি হলেই তা শব্দ হবে না, তাকে একটি অর্থ প্রকাশ করতে হবে। অর্থাৎ অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টিকে শব্দ বলে। যেমন: হাত, চাবি, দরজা ইত্যাদি।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) বলেছেন, ‘অর্থযুক্ত ধ্বনিকে বলে শব্দ। কোনো বিশেষ সমাজের নর-নারীর কাছে যে ধ্বনির স্পষ্ট অর্থ আছে, সেই অর্থযুক্ত ধ্বনি হচ্ছে সেই সমাজের নর-নারীর ভাষার শব্দ।’

ব্যাকরণের ভাষায় উৎপত্তি অনুসারে বাংলা শব্দকে পাচ ভাগে ভাগ করা হয়- ১. তৎসম শব্দ, ২. অর্ধতৎসম শব্দ, ৩. তদ্ভব শব্দ, ৪. দেশি শব্দ ও ৫. বিদেশি শব্দ।

তৎসম শব্দ: সংস্কৃত ভাষা থেকে অপরিবর্তিত অবস্থায় যে সকল শব্দ বাংলা ভাষায় এসেছে, সেই শব্দগুলোকে তৎসম শব্দ বলে। যেমন-চন্দ্র, সূর্য, বৃক্ষ, পুষ্প, নক্ষত্র, ধর্ম, কর্ম, চর্ম, পাত্র, ছাত্র ইত্যাদি।

অর্ধতৎসম শব্দ: যে সকল শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে কিছুটা বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষায় এসেছে, তাদেরকে অর্ধতৎসম শব্দ বলে। যেমন – চন্দ্র > চন্দ, গাত্র > গতর, গৃহিণী > গিন্নি, জন্ম > জনম, জ্যোৎস্না > জোছনা, প্রাণ > পরাণ, কুৎসিত > কুচ্ছিত ইত্যাদি।

তদ্ভব শব্দ: যেসকল শব্দ সংস্কৃত ভাষা থেকে পরিবর্তিত হয়ে প্রাকৃত ভাষার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় এসেছে সেসব শব্দকে তদ্ভব শব্দ বলে। চর্মকার > চম্ময়ার > চামার, হস্ত > হন্থ > হাত, চন্দ্র > চন্দ > চাঁদ ইত্যাদি।

দেশি শব্দ: যেসব শব্দ আদিকাল থেকেই বাংলা ভাষার নিজস্ব শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সে সকল শব্দকে দেশি বা খাঁটি বাংলা শব্দ বলে। যেমন- কুলা, মই, ডাব, ডিঙ্গি, চোঙ্গা, ঠোঙ্গা, ঢেঁকি, ঝাঁটা, টোপর ইত্যাদি।

বিদেশি শব্দ: সংস্কৃত ছাড়া অন্যান্য বিদেশি ভাষা থেকে যেসব শব্দ বাংলা ভাষায় স্থান করে নিয়েছে সেসব শব্দকে বিদেশি শব্দ বলে। যেমন- চেয়ার, টেবিল, স্কুল, কলেজ, নামাজ, রোজা, ইমান, হারাম, হালাল, রিকশা, হারিকেন, চা, চিনি, এলাচি, চাকর, আলমারি ইত্যাদি।

আবার গঠন অনুসারে শব্দ দুই প্রকার- মৌলিক শব্দ ও সাধিত শব্দ।

মৌলিক শব্দ: যে সকল শব্দকে বিশ্লেষণ করলে আর কোন শব্দ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। অর্থাৎ যে সব শব্দকে ভাঙলে আর কোন অর্থ সঙ্গতিপূর্ণ শব্দ পাওয়া যায় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন- দেশ, সিংহ, গোলাপ, নাক, লাল, মাছ ইত্যাদি।

যদিও বা এ সব শব্দকে ভেঙে নতুন শব্দ পাওয়া যায়, তাতেও তার সঙ্গে শব্দটির কোন অর্থসঙ্গতি পাওয়া যায় না। যেমন গোলাপ শব্দটি ভাঙলে গোল শব্দটি পাওয়া যায়। কিন্তু গোলাপ শব্দটি গোল শব্দ থেকে গঠিত হয়নি। এই দুটি শব্দের মাঝে কোন অর্থসঙ্গতিও নেই।

সাধিত শব্দ: যে সব শব্দকে বিশ্লেষণ করলে অর্থসঙ্গতিপূর্ণ ভিন্ন একটি শব্দ পাওয়া যায়, তাদেরকে সাধিত শব্দ বলে। মূলত, মৌলিক শব্দ থেকেই বিভিন্ন ব্যাকরণসিদ্ধ প্রক্রিয়ায় সাধিত শব্দ গঠিত হয়।

মৌলিক শব্দের সাথে সমাসবদ্ধ, প্রত্যয় বা উপসর্গ, দ্বিরুক্তি ও পদান্তরসহ নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ ধরনের শব্দ গঠন করা হয়।। যেমন- হাতল (হাত+ল), চাঁদমুখ (চাঁদ+মুখ) পায়েল (পা+এল), দেশান্তর (দেশ+অন্তর), সিংহাসন (সিংহ+আসন) ইত্যাদি।

আবার অর্থগতভাবে শব্দকে চার ভাগে ভাগ করা যায়- যৌগিক শব্দ, রূঢ় বা রূঢ়ি শব্দ ও যোগরূঢ় শব্দ।

(চলবে…)

পরবর্তী পর্ব >>

……………………
আরো পড়ুন:
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৫
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৬
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৭
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৮
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-৯
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১০
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১১
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১২
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৩
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৪
শব্দের মায়াজাল: পর্ব-১৫

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!