ভবঘুরেকথা
ধ্যান চক্র যোগ আসন

অন্তস্রাবী গ্রন্থি : পর্ব পাঁচ

-দ্বীনো দাস

অন্তস্রাবী গ্রন্থি- অভন্তরীণ, দৃশ্যমান বায়বীয় শরীর বাহ্যিক অদৃশ্যমান লতিফা – ষট্চক্র।

মুলাধার অবধি পঞ্চচক্রভেদী
লালন বলে আজ্ঞাচক্রে রয় নিরবধি,
হেরিলে সে নিধি যাবে ভবব্যাধি
ভাসবি আনন্দসাগরে।।
-সাঁইজি ফকির লালন

এই সমস্ত চক্রগুলো শান্ত অবস্থাতেই থাকে এবং নিজ নিজ ভারসাম্য বজায় রেখে চলে (অন্তস্রাবী গ্রন্থি)। মানুষের শরীর, মন ও ভাবের উপর এগুলোর অত্যন্ত গভীর প্রভাব পড়ে। চক্রের ভারসাম্য নষ্ট হলে সাথে সাথে ভেতরের গ্রন্থির পরে হরমন ও শরীরের রক্ত, অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ব্যাঘাত ঘটে।

বাহ্যিক চক্র বা বায়বীয় সূক্ষ্ম শরীরের কাজ বায়ুমণ্ডলে ব্যাপ্ত জীবপ্রাণ শক্তিকে ধরে কায়া শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গে প্রবেশ করানো। এই চক্রগুলোতে জ্যোতির্ময় আভা ঔজ্জ্বল্য থাকে। উপরের ৩টি চক্র- সহস্রার, আজ্ঞা ও বিশুদ্ধ। নিচের ৩টি চক্র- মুলাধার, সাধিষ্ঠান, মনিপুর। মাঝামাঝি হৃদয় চক্র- অনাহত চক্রের অবস্থান। উপর নিচ ৩টি ৩টি র সঙ্গমস্থল হল এই প্রেমের ধারক চক্র হৃদ বা অনাহত চক্র।

চক্রের সামান্য পিছনে ভৌত কায়া শরীরের দিকে (Energy web) শক্তির জাল বা ছাঁকনি। Filter থাকে যার ব্যাস মোটামুটি ১ ইঞ্চি। এটি সমস্ত ধরনের বাহ্য নকারত্মক Negative প্রভাব থেকে সুরক্ষা প্রদান করে। গুরুতর নকারত্মক Negative প্রভাব পড়লে এই ছাকনিতে ফাটল ধরে বা ছিদ্র হয়ে যায়।

তখন ঐ ছিদ্র দিয়ে মানুষের উর্জা শক্তি বাহিরে বেরিয়ে যায়। মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। মানুষ যখন অত্যন্ত রেগে যায় তখন তার মনিপুর, আজ্ঞা ও সহস্রার চক্রের সুরক্ষিত ছাকনি, Protective Web ফেটে ছিন্ন হয়ে যায়। ক্রোধিত ব্যক্তি অস্থায়ীভাবে প্রায় উম্মাদের মত অবস্থায় পৌঁছে যায় সমস্ত চক্র তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে।

সে এমন সব কাজ বা আচরণ শুরু করে যা কিনা সে স্বাভাবিক অবস্থায় কখনোই করে না।

সাধক যোগীদের লতিফা, চক্রভেদ, কোষভেদ, গ্রন্থিভেদ করে বিভিন্ন লোক পাড়ি দিতে হয়।

মায়া মহাশক্তি ধরে বসে আছে চৈতন্যকে সাথে করে। জীবের একরকম উর্দ্ধগতি রুদ্ধ, অবশ, অজ্ঞানাচ্ছন্ন, অচৈতন্য হয়ে জীব পড়ে আছে। চৈতন্য হতে মায়াকে আলাদা করতে পারলে গ্রন্থিভেদ হয়। আর গ্রন্থিভেদ, চক্রভেদ হলেই মানুষের তখন অহং জ্ঞান আমার আমার ভাবনাটা চলে যায়।

কে বলেরে আমি আমি
সেই আমি কি আমি আমি,
লালন বলে তবে কে আমি
আমারে চিনিনে আমি।।
-সাঁইজি ফকির লালন

মায়াযুক্ত হয়ে চৈতন্য জৈব ভাব প্রাপ্ত হয়। সে ভুলে যায় তার সত্ত্বা, সে যে ব্রহ্ম। চৈতন্য আর মায়া যখন ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে, তখন সে বুঝতে পারবে সে মূলে নিজে কে?

স্বরূপের সত্য রূপ তখন সে জানতে পারবে।

এই হল গ্রন্থিভেদ আর যার গ্রন্থিভেদ হয় তার সর্ব সংশয় শেষ হয়ে যায়। ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ হলে তখন ব্রহ্ম ও জীব আলাদা হয়ে যায়।

নির্বিকল্প সমাধি হলে এটা সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু মানুষ মরে গেলে এটা হয় না, তার কারণ জৈব-ভাব সহ ঐ চৈতন্য সম্পূর্ণ বের হয়ে যায়। এটা পৃথক পৃথক্ভাবে বের হয় না।

রুদ্রগ্রন্থি (ভ্রূদেশে) ভেদ হলে তখন কারণ অবস্থা প্রাপ্ত হয়। গ্রন্থিগুলো যখন যে অবস্থান বা চক্রভেদ হবে তখন সে লোকের ভাব, বৃত্তিগুলিই অবসান হবে-

১. ব্রহ্ম গ্রন্থি- নাভিমূলে।
২. বিষ্ণু গ্রন্থি- হৃদয়ে।
৩. রুদ্র গ্রন্থি- ভ্রূদেশে।

আর পঞ্চকোষের কোষগুলি ছিন্ন করতে পারলে একেবারে ব্রহ্মে পৌঁছে যাবে এতে কোন ধন্দ থাকবে না। যখন আহার নিদ্রা সাধনা দ্বারা সংযত হবে। তখন অন্নময় কোষকে ছাড়িয়ে যাবে। যখন প্রাণময় কোষের প্রাণবায়ুকে নিরোধ করে ইচ্ছামত নিতে বা ছাড়া যাবে তখন প্রাণময়কোষকে ছাড়িয়ে যাবে। এ রূপে একটা একটা করে কোষ ছাড়ালে কতকগুলি বৃত্তি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

১. অন্নময় কোষ- লয়প্রাপ্ত হয় আসন, মুদ্রা, তপস্যা এসব সাধনা দ্বারা
১. প্রাণময় কোষ- লয়প্রাপ্ত হয় প্রাণায়ম, প্রত্যাহার দ্বারা
৩. মনোময় কোষ- লয়প্রাপ্ত হয় ধ্যান, ধারনা দ্বারা।

আর বিজ্ঞানময় সূক্ষ্ম অনুভূতিময় কোষ সমাধি দ্বারা ছাড়িয়ে যেতে হয়। তরপর আনান্দঘনময় স্থানে স্থিতি।

সূক্ষ্মদেহের গতানগতি বিভিন্নলোক। সাধরণ মানুষের সূক্ষ্মদেহ স্বলোক পর্যন্ত থাকে, মহলোকে এসে সকলের দেহ নষ্ট হয়ে যায়, ধুম্র মাত্র থাকে। ঐ ধুম্র বায়ুময় দেহ অবলম্বন করে উর্দ্ধগতি হওয়া যায়। এই মহলোকে দেহ পতনের সময় যাদের সামান্যতম ইচ্ছা বা বাসনা থাকে, তাদের সেখান হতে নিন্মগতিতে ভোগের পতন হয়। ভোগায়তন দেহ তাই স্থূলদেহ পায় না বলে সোজা ভুলোকে এসে দেহ ধারণ করে।

মহলোক কেন্দ্রলোক এই লোক নিচের তিন লোককে আর্কষণ করে। আবার উপরের তিন লোককেও আর্কষণ করে। এখান থেকে নিচের দিকে পতনও হতে পারে আবার উপরের দিকে গতিও হতে পারে।

এইলোক আত্মঘন অবস্থাময়। যাদের মহলোকেও ভোগের কোন কারণ থাকে না তারা ক্রমশ উজালা মুক্তির পথে এগিয়ে যায় এবং ক্রমশই সূক্ষ্মদৃষ্টি খুলতে থাকে।

কৃতারম্ভ ভোগ- (পূর্বজন্মার্জিত কর্মফল যাহার ভোগ শুরু হইয়াছে, ভোগদ্বারা কৃতারম্ভের ক্ষয় হবে)

কৃতারম্ভ ভোগ হয় দেহের। আত্মবোধ যতক্ষণ থাকে এ শরীরে ততক্ষণ ভোগ হয়। আত্মা যখন স্থূল, সূক্ষ্ম, কারণ ছাড়িয়ে নির্বিকল্প অবস্থান প্রাপ্ত হয় তখন কৃতারম্ভ ভোগ থাকে না। নির্বিকল্প সমাধি হলে মানুষ মরে না জৈব ভাব যায় না, ইন্দ্রিয়গুলোর কার্য বন্ধ থাকে মাত্র।

যখন আবার নির্বিকল্প থেকে ফিরে এসে পূর্বের দেহ প্রাপ্ত হয় তখন ঐ জৈব-ভাব কৃতারম্ভ পূর্বে যাহা ছিল, তাই ভোগ করেন তখন।

সাধকের নির্বিকল্প হবার পর সে ইচ্ছা করলে এই ভোগ রুখে দিতে পারে বা গতি রোধ করতে পারে কিন্তু দেয় না। এই স্থূলের জন্য আর এটা কে করে।

পূর্বের যে কর্ম করা হয়েছে তাতো ভোগ ভিন্ন নষ্ট হবে না। ভোগ না করলে সেটা বঞ্চিত থেকে যায়। যখন স্থূলদেহ ধারণ করে তখন সে কৃতারম্ভ জোর করে এসে ভোগ হয়ে যায়।

(চলবে…)

চক্র : পর্ব ছয়>>

…………….
আরো পড়ুন:
ধ্যানযোগ : পর্ব এক
সপ্তচক্র লতিফা : পর্ব দুই

প্রবৃত্তি : পর্ব তিন
ধ্যান : পর্ব চার
অন্তস্রাবী গ্রন্থি : পর্ব পাঁচ
চক্র : পর্ব ছয়
সাধিষ্ঠান চক্র : পর্ব সাত
মনিপুর চক্র : পর্ব আট  
অনাহত চক্র : পর্ব নয়
বিশুদ্ধ চক্র : পর্ব দশচক্র
আজ্ঞা চক্র : পর্ব এগারো
সহস্রার চক্র : পর্ব বারো

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

…………….
আরো পড়ুন:
অবশ জ্ঞান চৈতন্য বা লোকাল অ্যানেস্থেসিয়া
ঈশ্বর প্রেমিক ও ধৈর্যশীল ভিখারী
সুখ দুঃখের ভব সংসার
কর্ম, কর্মফল তার ভোগ ও মায়া
প্রলয়-পূনঃউত্থান-দ্বীনের বিচার

ভক্তি-সংসার-কর্ম

………..
বি.দ্র.
আমার এই লেখা কিছু ইতিহাস থেকে নেওয়া কিছু সংগৃহীত, কিছু সৎসঙ্গ করে সাধুগুরুদের কাছ থেকে নেওয়া ও আমার মুর্শিদ কেবলা ফকির দুর্লভ সাঁইজি হতে জ্ঞান প্রাপ্ত। কিছু নিজের ছোট ছোট ভাব থেকে লেখা। লেখায় অনেক ভুল ত্রুটি থাকতে পারে তাই ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।। আলেক সাঁই। জয়গুরু।।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!