ভবঘুরেকথা

২৭৬
উপদেশ হচ্ছে পলায়নরত শিকারের মতো। একজন তা হারালেও অন্য কেউ তা ধরতে সক্ষম হতে পারে।

২৭৭
হে আদম সন্তানেরা! যেদিন এখনো আসে নি সেদিনের জন্য আজকের দিনে উদ্বীগ্ন হয়ে না। কারণ সে দিনটি যদি তোমার জীবনে আসে। তবে আল্লাহ সেদিনের জীবিকাও তোমার জন্য দান করবেন।

২৭৮
বন্ধুকে একটা সীমা অবধি ভালোবেসো। কারণ সে যেকোন সময় শত্রু হয়ে যেতে পারে। আবার শত্রুকে একটা সীমা অবধি ঘৃণা করো, কারণ যে কোন সময় সে তোমার বন্ধু হয়ে যেতে পারে।

২৭৯
এ পৃথিবীতে দুই প্রকারের কর্মী আছে। এক প্রকার হলো- তারা যারা শুধু দুনিয়ার জন্য কাজ করে আখেরাতের কথা বেমালুম ভুলে থাকে। সে যাদেরকে ফেলে যাবে তাদের দুঃখ-কষ্টের বিষয়ে সে সর্বদা ভীত থাকে। সুতরাং সে অন্যের সুখ শান্তির কাজে নিজের জীবন কাটায়।

আরেক প্রকার হলো তারা যারা এ পৃথিবীতে পরকালের জন্য কাজ করে যায়। এসব লোক দুনিয়াতে বিনা প্রচেষ্টায় তাদের হিস্যা পেয়ে থাকে। ফলে তারা ইহকাল ও পরকাল উভয়টার সুবিধা ভোগ করতে পারে এবং উভয় ঘরের মালিক হয়ে পড়ে। এসব লোক আল্লাহর দরবারে সম্মানের অধিকারী হয়। যদি সে আল্লাহর কাছে কিছু চায় তবে বিফল মনোরথ হয় না।

২৮০
ওমরের খেলাফতকালে কাবার উদৃত অলঙ্কারের বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছিল এবং কেউ কেউ প্রস্তাব করেছিল, ‘এসব অলঙ্কার দিয়ে কাবার কী হবে? তার চাইতে সেগুলো দিয়ে একটা মুসলিম বাহিনী গঠন করলে ভালো হতো।’ এ যুক্তি ওমরের পছন্দ হলো। তবুও তিনি বিষয়টি সম্পর্কে আলীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন-

‘যখন কোরান নাজেল হয়েছিল তখন চার প্রকারের সম্পদ ছিল। এক- মুসলিম ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি যা সে নির্দিষ্ট হারে উত্তরাধিকারীদেরকে বন্টন করে দিতো। দুই- কর যারা প্রাপ্য ছিল তাদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হতো।

তিন- এক-পঞ্চমাংশ খাজনা যা বণ্টনের পথ আল্লাহ নিজেই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। চার, দান-খয়রাত যার বণ্টন আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এ আদেশাবলী নাজেলের সময় কাবার অলঙ্কারগুলো সেখানে ছিল এবং আল্লাহ সেগুলোকে সেভাবেই রেখেছেন।

আল্লাহ ভুল বশত বা অজানার কারণে সেগুলোকে সেখানে রাখেন নি। সুতরাং আল্লাহ ও তার রাসূল সেগুলোকে যেখানে রেখেছেন তুমিও তা সেখানে থাকতে দাও।’

আলীর কথা শুনে ওমর বললেন, ‘আপনি না থাকলে নিশ্চয়ই আমরা অপমানিত হতাম।’

তিনি অলঙ্কারগুলো যেভাবে ছিল সেভাবে রেখে দিলেন।

২৮১
সরকারি সম্পদ চুরি অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে আলীর কাছে আনা হয়। তাদের একজন সরকারি অর্থে ক্রীতদাস এবং অপরজন কোন এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত অর্থে ক্রীতদাস।

আলী বললেন, ‘সরকারি অর্থে যে ক্রীতদাস তার জন্য কোন শাস্তি নেই; কারণ, আল্লাহর এক সম্পদ আরেক সম্পদ নিয়েছে। কিন্তু অপরজনকে বিধি অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে।’

ফলে ব্যক্তিগত ক্রীতদাসটির হাত কেটে ফেলা হয়েছিল।

২৮২
এ পিচ্ছিল পথে যদি আমি দৃঢ় পদে দাঁড়াতে পারি। তবে আমাকে অনেক কিছু পরিবর্তন করতে হবে।

২৮৩
দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে জেনে রাখো, অদৃষ্টলিপিতে যা লেখা আছে তার অধিক জীবিকা আল্লাহ নির্ধারণ করেন না। যতই উপায় অবলম্বন করা হোক, যতই কঠোর প্রচেষ্টা করা হোক। আর যতই কসরত করা হোক না কেন নির্ধারিত জীবিকার বেশি পাবে না।

কোন লোকের দুর্বল অবস্থা বা উপায়-উপকরণের অভাব নির্ধারিত জীবিকার পথে অন্তরায় হতে পারে না। যারা এটা অনুধাবন করে এবং সে মতে আমল করে তারাই সব চাইতে আরাম-আয়েশে থাকে। আর যারা এতে সন্দেহ পোষণ করে এবং এর প্রতি অবহেলা করে তারা সকলের চেয়ে বেশি অসুবিধা ভোগ করে।

আনুকূল্য প্রাপ্ত ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে আনুকূল্যের মাধ্যমে শান্তির দিকে তাড়িত করা হচ্ছে এবং শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তিকে শাস্তির মাধ্যমে কল্যাণ করা হচ্ছে। সুতরাং হে শ্রোতামণ্ডলী, তোমাদের কৃতজ্ঞতা বর্ধিত কর, লোভ-লালসা কমিয়ে ফেল এবং তোমাদের জীবিকার সীমার মধ্যে তৃপ্ত থাক।

২৮৪
তোমাদের জ্ঞানকে অজ্ঞতায় এবং দৃঢ় প্রত্যয়কে সংশয়ে পরিণত করো না। জ্ঞান, লাভ করলে তদনুযায়ী আমল কর এবং দৃঢ় প্রত্যয় অর্জিত হলে তার ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হও।

২৮৫
লোভ মানুষকে জলাশয়ের কাছে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু পানি পান করানো ছাড়াই আবার টেনে ফেরত নিয়ে আসে। লোভ দায়িত্ব গ্রহণ করে কিন্তু তা পরিপূর্ণ করে না। লোভাতুর ব্যক্তি তৃষ্ণা মেটার আগেই অনেক সময় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

কোন কিছু পাবার আকুল আকাঙ্খা যত বেশি হবে তা না পেলে দুঃখও তত বেশি হবে। লোভ-লালসা বোধগম্যতার চক্ষু অন্ধ করে দেয়। যা ভাগ্যে নির্ধারিত আছে তা না চাইলেও পৌঁছে যাবে।

২৮৬
হে আমার আল্লাহ, আমি তোমার কাছে সেই অবস্থা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি, যে অবস্থায় মানুষ বাহ্যিকভাবে আমাকে ভালো বলে দেখবে অথচ আমার বাতেন তোমার দরবারে পাপপূর্ণ থাকবে। আমি সেই অবস্থা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করি, যে অবস্থায় একজন রিয়াকার হিসাবে লোক দেখানোর জন্য পাপ থেকে নিজকে মুক্ত রাখার কাজ করি।

অথচ আমার বাতেন সম্পর্কে তুমিই ভালো জান। সেই অবস্থা থেকে আশ্রয় চাই যাতে মানুষের কাছে ভালো সেজে থাকি আর তোমার কাছে সব পাপ প্রকাশ পায় এবং এতে করে তোমার বান্দাদের নৈকট্য লাভ করি। অথচ তোমার সন্তুষ্টি থেকে দূরে সরে থাকি।

২৮৭
আমি তার শপথ করে বলছি, যিনি আমাদেরকে রাতের অন্ধকারের পর দিনের আলোতে অতিক্রম করতে দেন, যে অমুক অমুক বিষয় ঘটেনি।

২৮৮
নিয়মিত পালিত ক্ষুদ্র আমল বিরাগপূর্ণ দীর্ঘ আমল থেকে অনেক ভালো ও উপকারী।

২৮৯
যখন ঐচ্ছিক বিষয়াদি অবশ্যকরণীয় বিষয়ের বাধা হয়ে দাঁড়ায় তখন তা পরিত্যাগ করো।

২৯০
যে কেউ ভ্রমণের দূরত্ব সম্পর্কে সজাগ হয় সে প্রস্তুত থাকে।

২৯১
চোখের প্রত্যক্ষণ প্রকৃত পর্যবেক্ষণ নয় কারণ চোখ অনেক সময় ধোকা দেয়; কিন্তু জ্ঞান যাকে পরামর্শ দেয় তাকে প্রতারণা করে না।

২৯২
সদোপদেশ আর তোমাদের মাঝখানে একটা প্রবঞ্চনার পর্দা রয়েছে।

২৯৩
তোমাদের মধ্যকার অজ্ঞরা অনেক বেশি পায় আবার শিক্ষিতরাও বঞ্চিত হয়।

২৯৪
যারা ওজর দেখায় জ্ঞান তাদের ওজরকে দূরীভূত করে।

২৯৫
কারো মৃত্যুবৎ অবস্থা হলে সে কেবল সময় চায়, কিন্তু মৃত্যু সরে গেলে ভালো কাজ স্থগিত রাখার নানা ওজর দেখায়।

২৯৬
মানুষ যত কিছুতে বলে, ‘কতই না ভালো’ তার সব কিছুতেই মন্দ নিহিত আছে।

২৯৭
অদৃষ্ট সম্পর্কে আলী বলেন, ‘এটা অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ, এদিকে পা বাড়িয়ো না; এটা গভীর সমুদ্র-এতে ডুব দিয়ো না; এটা আল্লাহর বিষয়-এটা জানতে অযথা চেষ্টা করো না।’

২৯৮
আল্লাহ যখন কাউকে অপমানিত করতে চান তখন তার কাছ থেকে জ্ঞান তুলে নিয়ে যান।

২৯৯
আমার একজন ইমানি ভাই ছিলেন। আমার দৃষ্টিতে তিনি সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন, কারণ তার কাছে দুনিয়া ছিল খুব হীন। তার পেটের তাড়না তাকে নিয়ন্ত্রণ করেনি। সে যা পায়নি তার জন্য কোন লালসা করেনি,। সে যা পেত তার অধিক যাচনা করেনি।

বেশির ভাগ সময় সে নিশ্চুপ থাকতো, যদি সে কথা বলতো তবে অন্যদের নিশ্চুপ করে দিত, সে প্রশ্নকারীদের তৃষ্ণা মিটিয়ে দিত, সে দুর্বল ও কৃশকায় ছিল। কিন্তু জেহাদে সে সিংহের মত ছিল, সিদ্ধান্তমূলক ছাড়া সে কোন যুক্তি দেখাতো না।

ক্ষমাযোগ্য কোন বিষয়ে ওজর না শুনে সে কখনো কাউকে গালি দিত না, বিপদ চলে যাবার পূর্ব পর্যন্ত কাউকে কোন বিপদের কথা বলতো না, সে যা করতে পারতো তাই বলতো। যা করতে পারতো না তা বলতো না। এমনকি কথার চেয়ে বেশি সে নিশ্চুপ থাকতো।

কথার চেয়ে নীরবতা রক্ষা করাতে তার বেশি আগ্রহ ছিল। দুটি জিনিস তার কাছে এলে সে পরখ করে দেখতো কোনটির প্রতি তার হৃদয়ে লালসা বেশি-তখনই সে তা পরিত্যাগ করতো।

এসব গুণাবলী অর্জন করা তোমাদের দরকার। সুতরাং তোমরা এগুলোতে একে অপরকে অতিক্রম করার চেষ্টা করবে। এমনকি এগুলোর সব ক’টি অর্জন করতে না পারলেও আংশিক অর্জন সম্পূর্ণটুকু পরিত্যাগ অপেক্ষা অনেক ভালো।

৩০০
আল্লাহ যদি শাস্তির জন্য সতর্ক নাও করতেন তবুও তার নেয়ামতের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও তাঁর অনুগত হওয়া অবশ্য কর্তব্য হতো।

(চলবে…)

…………………………….
সূত্র: নাহজ আল-বালাঘা

…………………………….
আরো পড়ুন:
মাওলা আলীর বাণী: ১
মাওলা আলীর বাণী: ২

মাওলা আলীর বাণী: ৩
মাওলা আলীর বাণী: ৪
মাওলা আলীর বাণী: ৫
মাওলা আলীর বাণী: ৬
মাওলা আলীর বাণী: ৭
মাওলা আলীর বাণী: ৮
মাওলা আলীর বাণী: ৯
মাওলা আলীর বাণী: ১০
মাওলা আলীর বাণী: ১১

মাওলা আলীর বাণী: ১২
মাওলা আলীর বাণী: ১৩
মাওলা আলীর বাণী: ১৪
মাওলা আলীর বাণী: ১৫

মাওলা আলীর বাণী: ১৬
মাওলা আলীর বাণী: ১৭
মাওলা আলীর বাণী: ১৮
মাওলা আলীর বাণী: ১৯
মাওলা আলীর বাণী: ২০

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!