ভবঘুরেকথা
ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান

-মূর্শেদূল মেরাজ

ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান : দুই

থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেলো হেডম্যানের ঘরে। সে জানালো, আমরা সবাই এখন খুবই ব্যস্ত। তোমরা তোমাদের মতো থাকো। আমরা শিকারে গিয়ে আটকা পরে গিয়েছিলাম। ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। তাই জোগারযন্ত্র তেমন কিছু হয় নি উৎসবের।

যা আছে তা দিয়েই তড়িঘড়ি করে সব করতে হচ্ছে। তোমরা বিশ্রাম নাও। আমরা গ্রাম সাজাতে গেলাম। আমরা অতি উৎসাহী হয়ে বললাম। আমরাও তোমাদের সাহায্য করবো। আমরা বসে থাকবো কেনো? আমরাও হাত লাগাবো।

উপস্থিত সকলে খুশি হয়ে গেলো। সকলে একমত হলো আমরা বুড়োর বাড়ি সাজাতে সাহায্য করবো। আমরা মহা উৎসাহে তাদের পিছু পিছু বুড়োর বাড়ি গেলাম। প্রায় নব্বই বছরের এক বুড়ো-বুড়ি দম্পতির হাতে সমর্পণ করে তারা সকলে চলে গেলো।

তার পর বাকিটা ইতিহাস। বিশেষ ধরণের এক চুন জাতীয় রং দিয়ে সাজাতে হবে। বিভিন্ন শুকনা পাতা লাগাতে হবে। আরো কত কি। আমরা নিজেদের মতো আলোচনা করে কাজ শুরু করে দিতে যাব। তখন বুড়ো মাঁচা থেকে নেমে বিশাল এক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে বললো, সে যেমন যেমন বলবে তেমন তেমন করতে হবে।

আমরাও রাজি। তারপর থেকে সকাল পর্যন্ত বুড়োবুড়ি আমাদের এক দণ্ড বসতে দেয় নাই। অনবরত কাজ করিয়ে নিয়েছে। আবার সেই কাজ তাদের মন মতো না হলেই বিশাল লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে মারবে বলে। পান থেকে চুন খসার উপায় নাই। এমনিতেই কুপি-মশালের আলোকে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই।

এক এক করে দর্শক-শ্রোতারা জড়ো হতে লাগলো। স্থানীয় মানুষের মাঝে চেনা-জানা অনেক মুখও দেখা দিতে লাগলো। স্বল্প পরিসরের আলোচনা শেষে নরসিংদীর শিল্পী সুমন ক্বারী ভাই দৈন্য দিয়ে শুরু করলেন মূল আয়োজন।

আমরা মাইনকারচিপায় পরে গেছি যখন বুঝতে পারলাম। তখন আরো একটা জিনিস বুঝতে পারলাম। সকলে কেনো আমাদের এই বাড়ি সাজানোর জন্য পাঠানোর সময় মুচকি মুচকি হাসছিল। ভেবেছিলাম সারাদিনের ক্লান্তির পর এই পাড়ায় এসে আরামে একটু ঘুম দিবো।

কিন্তু কপালের নাম তো গোপালচন্দ্র; কি আর করা। সেই খিটখিটে বুড়োবুড়ির লাঠির বাড়ি খাওয়া থেকে বাঁচতে ভয়ে ভয়ে কাজ করে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি? আর হিংস্র কুকুরগুলোও বুড়োবুড়ির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বুড়োবুড়ি হুংকার দিলে তারা আরো জোড়ে পাহাড় কাপিয়ে চিৎকার করে উঠে।

মুখের সামনে এসে এত্তো বড় মুখ করে হা করে দাঁত দেখিয়ে যায়। কানে কানে এসে তানভীর বলেছিল, এইবার বেঁচে ফিরতে পারলে আর জীবনে পাহাড়ে আসমু না। সকলে সেই মতের সাথে একমত হলেও। পরদিন সকালেই সেই প্রতিজ্ঞা ভুলে গিয়েছিলাম।

উৎসবের দিন সকালে বুড়োবুড়ি আমাদের যে পরিমাণ আদর-আপ্যায়ণ করেছিল। ফেরার সময় জড়িয়ে ধরে যখন কাঁদছিল তখন মনে হয়েছিল, এরাই আমাদের আপন দাদা-দাদী। আর কখনোই সেই পাড়ায় যাওয়া হয়নি। কিন্তু সেই স্মৃতি আজও মনে করিয়ে দেয়।

ভালোবাসার মানুষ সর্বত্রই অপেক্ষায় থাকে। সেটা আদায় করে নিতে হয়। প্রত্যেকের ভালোবাসার ধরনই আলাদা। সেই ভালবাসার ছকে পরে গেলেই ভাব জাগ্রত হয়। নইলে ভালোবাসাও ঘুমিয়ে থাকে উপরের খোলসের আড়ালে।

যাক শেষ পর্যন্ত সকলের সহযোগীতায় সাজিয়ে ফেলা হলো “ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান”-এর মঞ্চ। অনুষ্ঠান শুরুর কয়েক মিনিট আগে শেষ হলো আমাদের কর্মযজ্ঞ।

এক এক করে দর্শক-শ্রোতারা জড়ো হতে লাগলো। স্থানীয় মানুষের মাঝে চেনা-জানা অনেক মুখও দেখা দিতে লাগলো। স্বল্প পরিসরের আলোচনা শেষে নরসিংদীর শিল্পী সুমন ক্বারী ভাই দৈন্য দিয়ে শুরু করলেন মূল আয়োজন।

এক এক করে সুধাম সাধু, সুমন দাস বাউল, নরসিংদীর বাউল কন্যা খ্যাত শান্তা সহ অনেকেই মঞ্চ আলোকিত করে সাঁইজির বাণী পরিবেশন করতে লাগলেন।

সকলের মাঝেই যেন একটা ভাব ক্রিয়া করছে। গানে মাতোয়ারা শিল্পীরা যেমন হচ্ছে; তেমনি হয়েছে দর্শককুল। তবে প্রায় সকল দর্শকের হাতই মোবাইল দিয়ে ভিডিও আর লাইভ করতে ব্যস্ত থাকায় তালির শব্দ সেই হারে শোনা গেলো না।

এই সব ভাবতে ভাবতে আমি না পারছি গানে ডুবে যেতে। না পারছি আপন ভাবনায় সঙ্গকে নিয়ে ভাবতে। না পারছি সাধুগুরুর সংস্পর্শে আসতে। সর্বোপরি আমি সাধুসঙ্গে এসেছি বটে। কিন্তু সাধুসঙ্গের কোথাও আমি নেই। এই কথাটা যখনই মাথায় প্রবেশ করলো।

এখন এই এক মহা-সমস্যা দেখা দিয়েছে। কেউ কিছু দেখতে চায় না। সবাই ব্যস্ত তা মোবাইলে বন্দি করে রাখতে। বিষয়টা যে মন্দ তা বলছি না। এই সব চলমান চিত্র ধারণ করা হয় বলে। অনেক সময় আমরা অনেক জায়গায় উপস্থিত না থেকেও অনেক কিছুর সাথে যুক্ত হতে পারি।

অনেক কিছু দেখবার সুযোগ পাই। অনেক কিছু জানবার সুযোগ পাই। কিন্তু সর্বক্ষণ মোবাইলের স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে দেখবার অভ্যাসটা হয়ে গেলে। জগতকে তার আপন রূপে আর দেখা সহজ হয় না। আমিও যে এসব থেকে যোজন যোজন দূরে বসবাস করি তা তো নয়।

একটা সময় আমিও অনেক কিছু ধারণ করার চেষ্টা করেছি। এখনো মাঝে মধ্যে করি। এখন তখনই করি, যখন দেখি অন্য কেউ তা ধারণ করছে না। যখন ভীড় করে অনেকে কিছু ধারণ করতে থাকে। তখন মনে হয় ধারণ তো হচ্ছেই। আমি না হয় অনুভবই করি।

এই অনুভবের কথাটা জেগেছিল এক সাধুসঙ্গে। সেই সঙ্গে টানা সাঁইজির পদ চলছে। কোনো বিরাম নেই। আমিও লেগে আছি সে সব ধারণ করতে। ধারণ করতে করতে আর শরীর নিতে পারছিল না। আর গানও এতো সুন্দর হচ্ছিল যে। ধারণ না করেও পারছিলাম না।

তখন প্রায় ভোর ভোর হয়ে এসেছে। হঠাৎ চোখে পরলো দূরে এক পরিচিত সাধু বসে কয়েকজনের সাথে কথা বলছেন। শেষ রাতের আধো আলোতে সেই দৃশ্য আমাকে নতুন করে ভাবাতে শেখালো। আরে! আমি করছি কি? কি ধারণ করছি??

এই সব ধারণ করতে গিয়ে মূল হারিয়ে ফেলছি না?? আমার তো এখন সেই সাধুর সাথে বসে তার কথা শুনবার কথা ছিল। কেনো এতো টেনশন নিয়ে ধারণ করে যাচ্ছি? ব্যাটারিতে চার্জ কতখানি আছে, কার্ডে স্পেস কতখানি আছে। কোন পাশ থেকে ধারণ করলে বাইরের শব্দ কম আসবে। ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই সব ভাবতে ভাবতে আমি না পারছি গানে ডুবে যেতে। না পারছি আপন ভাবনায় সঙ্গকে নিয়ে ভাবতে। না পারছি সাধুগুরুর সংস্পর্শে আসতে। সর্বোপরি আমি সাধুসঙ্গে এসেছি বটে। কিন্তু সাধুসঙ্গের কোথাও আমি নেই। এই কথাটা যখনই মাথায় প্রবেশ করলো।

তবে ফর্সা হাজীতে যতই সময় যাচ্ছিল ততই আমার কাছে স্পষ্ট হতে থাকলো এর উত্তর। আমরা যে কয়দিন ছিলাম ফর্সা হাজীতে, সেই সময়ে এক প্রহরও এমন যায় নি; যে সময়টাতে ফর্সা হাজীকে কেন্দ্র করে গান গাওয়া হয়নি। সর্বসময়ই কেউ না কেউ গাইছিল। কেউ না কেউ শুনছিল।

ঠিক তক্ষুনি ডিভাইস অফ করে উঠে পরলাম। পাশে থাকা অন্যেরা পেছন থেকে জানতে চাইছিল, কি দাদা চলে যাচ্ছেন যে। আমাদের গুলো রেকর্ড করবেন না?

আমি ঘুরে এক ঝলক হেসে রওনা দিয়েছিলাম সেই সাধুর দিকে। সেই রওনা তো এই রওনা। তারপর থেকে আর সেইভাবে ধারণ করার দিকে মনোযোগী হতে চাইনি। দেখবার-বুঝবার চেষ্টা করি। ধারণ করি না বলে যে অনেক কিছু জেনে-বুঝে ফেলেছি তা হয়তো নয়।

তবে অনেক ঘটনার সাক্ষী হতে পেরেছি। অনেক ভাবনার তরীতে উঠে বসতে পেরেছি ভেবেই প্রশান্তিতে মন ভরে উঠে। আসলে নিজের মতো করে, নিজের জন্য দেখাতেই আনন্দ। আর সেটা করা গেলে অন্যের সাথে সেই আনন্দটা বিনিময়ও করা যায়।

চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা শীতের তাড়নায় মাঝরাতের পর দর্শক কমতে থাকলেও যখন নরসিংদীর ওস্তাদ হুমায়ুন সাধু ‘আমি কৃষ্ণহারা হলেম জগতে’ সাঁইজির পদটা ধরলেন; তখন সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল। ফর্সা হাজী শ্রীরামপুরে সাঁইজিকে নিয়েই আসলেন। জয় হোক লালন ফকিরের। জয় হোক ফর্সা হাজীর।

“ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান” অনুষ্ঠানের বার্তাটা ফেসবুকে একটা গ্রুপে পোস্ট করার পর সেন্টু গাজী প্রশ্ন করেছিল ফর্সা হাজী কি গান শুনতেন? বিস্তারিত জানাবেন?? তার প্রশ্নটা শুনে প্রথমে ধাক্কা খেয়েছিলাম। তার কাছে এমন প্রশ্ন আশা করিনি।

আবার ভাবলাম আসলেই তো ফর্সা হাজী সম্পর্কে আমিই বা কতটুকু জানি। আসলেই কি তিনি গান শুনতে পছন্দ করতেন? প্রশ্নটা আমার মাঝেও ক্রিয়া করতে শুরু করলো। না জেনে উত্তর কি দিবো ভেবে আর তার উত্তরে কিছুই লেখা হলো না। তারপর অনুষ্ঠানের টুকিটাকি কাজ করতে গিয়ে চলছিল ব্যস্ত সময়।

তবে ফর্সা হাজীতে যতই সময় যাচ্ছিল ততই আমার কাছে স্পষ্ট হতে থাকলো এর উত্তর। আমরা যে কয়দিন ছিলাম ফর্সা হাজীতে, সেই সময়ে এক প্রহরও এমন যায় নি; যে সময়টাতে ফর্সা হাজীকে কেন্দ্র করে গান গাওয়া হয়নি। সর্বসময়ই কেউ না কেউ গাইছিল। কেউ না কেউ শুনছিল।

তবে তখন মনে এই ভাব ছিল না। দেখবার জন্য দেখতে আসা আর কি। গত কয়েক বছর ধরে যে কি হইছে জানি না। এইখানে আইসা শান্তি পাই। প্রতিদিন দুইবেলা আসতেই হয়। আমিও এখন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। বাতি জ্বালাই। গিলাপ পাল্টাই।

এক মধ্যরাতে নিজেই নিজে হেসে উঠেছিলাম এসব ভাবতে ভাবতে। আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি। যদিও অনুষ্ঠানে সেন্টু গাজীর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। আড্ডা হয়েছে। সঙ্গ হয়েছে। কিন্তু এ কথা বলা হয়নি। হয়তো তিনিও জেনে গেছেন সেই উত্তর।

কিন্তু যখন স্পষ্ট হলো ফর্সা হাজী গান এতোটাই ভালোবাসেন যে তিনি সুদূর কুষ্টিয়া-খুলনা থেকে শিল্পী এনে তিন-চারদিন সমানে লালন সাঁইজির পদ শুনে নিলেন। তারপর আর বলবার কি অবশিষ্ট থাকে?

ফর্সা হাজীর জীবনীটা অনেকটা ডাকু রত্নাকরের মতোই। বর্তমান খাদেম আবদুস সালাম কাকা বলেন, বাবা আমি তো এতো কিছু জানি না। আমি তারে দেখছি। উনি যখন এই এলাকায় আসছিলেন তখন আমিও অন্য সকলের মতো দেখতে আসছি তারে।

তবে তখন মনে এই ভাব ছিল না। দেখবার জন্য দেখতে আসা আর কি। গত কয়েক বছর ধরে যে কি হইছে জানি না। এইখানে আইসা শান্তি পাই। প্রতিদিন দুইবেলা আসতেই হয়। আমিও এখন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি। বাতি জ্বালাই। গিলাপ পাল্টাই।

উনার এক নাতি আছে। উনারা আসনে। বিশেষ করে ওরশের সময় আসেন। ময়মনসিংহের মঠবাড়িয়ায় এখনো উনাদের বেশ প্রভাব আছে। আমি গেছিলাম সেখানে। ঘুইরা আসছি।

যতদূর শুনছি দয়াল এককালে ছিল মস্ত ডাকাইত। তবে তার একটা প্রতিজ্ঞা ছিল। যদি তিনি কোনোদিন পুলিশের হাতে ধরা পরে। তাইলে সেইদিন হইবো তার ডাকাতির শেষ দিন।

ফর্সা হাজীর কাহিনীটা আরেকদিন বলবো। সে এক বিশাল ঘটনা। রত্নাকর থেকে বাল্মিকী হয়ে উঠার কাহিনীটা অল্পকথায় শেষ করে দিলে হবে কেনো?

(চলবে…)

<<ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান-এক ।। মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি>>

………………………..
আরো পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব নয়
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এগারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব তেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব চোদ্দ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব পনেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব ষোল
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব সতেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব আঠারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব উনিশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বিশ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!