ভবঘুরেকথা
মনোমোহনের পথে

-মূর্শেদূল মেরাজ

মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি

নিজেদের মাঝে কথা বলছিলাম। ছোট ছোট দলে ভাগ ভাগ হয়ে আমরা ঘুরছি মঞ্চের আশপাশে। এখানকার মঞ্চটা অন্যান্য মঞ্চের মতো না। এখানে শিল্পীদের ঘিরে যন্ত্রীরা এমনভাবে বসেছে যে বোঝাই যাচ্ছে না শিল্পীরা সকলের জন্য গাইছে নাকি মঞ্চের মানুষের জন্য গাইছে।

কবিগানে এমন মঞ্চ হয় বটে কিন্তু সেখানেও ভিউটা এমন হয় যে শিল্পীদের দৃষ্টি দর্শকের দিকে থাকে। এখানে এমনটা নয়। আবার এমনো হতে পারে, মঞ্চে বিশিষ্ট অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন বলে শিল্পীরা তাদেরই গুরুত্ব দিয়ে গান পরিবেশন করছিল। আবার মঞ্চটা একটু বেশি উঁচু বলেও বিষয়টা এমন মনে হতে পারে।

যাক এক সময় সাগর দেওয়ান বেহালা হাতে গান ধরলেন। তার ধ্রুপদী ঢঙ্গের মনোমোহনের গান আমাদেরকে আবিষ্ট করে ফেললো। মঞ্চের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমরা একের পর এক গান শুনতে লাগলাম। এরই ফাঁকে একটা ক্ষিদে ক্ষিদে ভাবও অনুভূত হতে লাগলো।

অন্যদেরও একই মত। তাই গান শুনতে শুনতেই মেলার দিকে হাঁটা দিলাম। সকলেই রুটি-পরাটা খাবে বলে কথা চালাচালি করছে। আমি একটু নিরবই আছি। মনে মনে ভাবছি একটু ভাত হলে মন্দ হয় না। রুটি খাওয়ায় তেমন উৎসাহ পাচ্ছি না।

মেলায় ঢুকতেই আশিক বললো এই পথে চলেন। এখানে সব হোটেল। সুমন দাস বাউল রুটি খুঁজছে। আশিক পরটার দোকান। আমার চোখ খুঁজছে ভাতের দোকান। রুটি পরটার দোকানে খাবারের সাথে কি কি আছে জানতে জানতে আমরা এগিয়ে চলছি মেলার মাঠ ধরে। শীত অনেকটাই বেড়েছে।

পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কুয়াশা। বেশ ঘন কুয়াশা। তাই মানুষও অনেকটাই কমেছে এখন। আশপাশের মানুষজন সম্ভবত চলে গেছে যা যাচ্ছে আর যারা জায়গা পেয়েছে তারা সেখানে গুটিসুটি মেরে বসে পরেছেন। এমন সময় একটা বিশাল হোটেল চোখে পরলো।

এক কিশোরী চারপাশে খাবার সাজিয়ে মেঝেতে বসে আছে। মাদুর পাতা হোটেল। আমার বেশ লাগলো। আশিকের দিকে তাকাতে দেখি তার চোখও জল জল করছে। আমরা চট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম ভাত খাবো। মাছ দিয়ে গরম গরম ভাত। আহ্।

উৎসবের সময় বলে মন্দির কক্ষে বেশি সময় কাউকে অবস্থান করতে দেয়া হচ্ছে না। ভক্তি দেয়ার পরই বিনীত ভাবে বাইরে চলে যাওয়ার নিদের্শনা দেয়া হচ্ছে। আমি আর সুমন দাস অবশ্য অনেকটা সময় বসে বসে সব দেখলাম। দেখলাম মানুষের ভক্তি। মানুষের চালাকি। মানুষের চাহিদা। মানুষের আদিখ্যেতা।

সুমন দাস অবশ্য রুটিতেই টিকে রইলো। তার সাথে জুটেছে ফয়েজ। আমি আশিক আর মিঠুন দা ভাতের দলে। চটপট মাদুরে বসে পরলাম। আশিক বললো, বইনে ভালো করে ভাত খাওয়াও মাছ দিয়া। আর কি কি আছে। কিশোরী পোড় খাওয়া মানুষ।

আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো, বসেন। দিতেছি।

ভাজি, মাছ, ভাত দিয়ে আমাদের খাবার শুরু হলো। সুমন দাস আর ফয়েজও রুটি কিনে এনে আমাদের পাশে বসেই মাছ দিয়ে খাওয়া শুরু করলো। পরে এক এক করে আমাদের দলে যোগ দিলো রিয়াদ উল্লাহ ভুইয়া, নুরুল আমিন ভাই, আরমান বাউল ও কেউ কেউ।

বোন সত্যিই পরম যত্নে আমাদের খাওয়ালো। রান্নাও সেই স্বাদ। প্রথম পতে করল্লা ভাজি। তারপর রুই মাছের বিশাল টুকরা। সাথে ফুলকপি, শীম আর আলু। টমেটো, ধনেপাতা বাড়তি স্বাদ দিচ্ছিল। শেষ পাতে পাতলা ডাল।

আশিক গোগ্রাসে খেতে খেতে বললো, বইনে! সান দাও।

আমি মাথা ঘুড়িয়ে সুরু চোখে তাকাতেই আশিক বলো, আমাদের নরসিংদীতে তরকারিকে সান বলে বুঝলেন।

খাওয়ার পর মেলা ঘুরে দেখবো ভেবেছিলাম। কিন্তু শীতের মাত্রা বেশি হওয়ায় মেলার বেশিভাগ দোকানই ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। অগত্যা আশ্রয়ের দিকেই হাঁটা দিলাম। আশিক সহ কেউ কেউ গানবাজনার মাঝেই ঘুমের আয়োজন করে নিলো।

আমি আর সুমন দাস বের হলাম মনোমোহনের মন্দিরের দিকে। এই বেলা ভক্তিটা সেরে নেয়া যাক। পরিপাটি করে সাজানো সমাধি মন্দিরের একই কক্ষে পর পর শায়িত আছে মহর্ষির সহধর্মীনি সাধ্বী সৌধামনি দত্ত, মহর্ষি মনোমোহন দত্ত, মহর্ষির পুত্র শ্রী সুধীরচন্দ্র দত্ত এবং তার সহধর্মীনি সাধ্বী কমলা রানী দত্ত।

উৎসবের সময় বলে মন্দির কক্ষে বেশি সময় কাউকে অবস্থান করতে দেয়া হচ্ছে না। ভক্তি দেয়ার পরই বিনীত ভাবে বাইরে চলে যাওয়ার নিদের্শনা দেয়া হচ্ছে। আমি আর সুমন দাস অবশ্য অনেকটা সময় বসে বসে সব দেখলাম। দেখলাম মানুষের ভক্তি। মানুষের চালাকি। মানুষের চাহিদা। মানুষের আদিখ্যেতা।

সম্ভবত সুমন দাস বাউল ছিল বলেই আমাদের বসতে দিয়েছে। ভেবেছে বিশেষ অতিথি।

আমরা আনন্দ আশ্রমে ঘুরে বেড়াচ্ছি এদিক সেদিক। সাগর দেওয়ান এখনো গান গেয়েই চলেছেন। সত্যি বলছি প্রথমে তার ধ্রুপদী ঢং বেশ লাগলেও। এতো সময় ধরে শুনতে আর ভালো লাগছিল না। মনে হচ্ছিল একটু পরিবর্তন দরকার। একটানা শুনতে শুনতে বড্ড বিরক্ত লাগছিল।

মহর্ষির অনেকগুলো বই পাওয়া যাচ্ছে। সবগুলোই কিনবার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু পাতা উল্টে উল্টে বইয়ের দাম দেখাই সারা হলো। নাড়াচাড়া করতে করতে শেষে কয়েকটা বই কেনা হলো বটে। কিন্তু না কেনা বইগুলোর জন্য হাহাকারটা রয়েই গেলো।

কুষ্টিয়ায় পরিচিত এক সাধুগুরু আছেন। তিনি একই ঢঙে সব লালন পদ করেন। মনোযোগ দিয়ে না শুনলে বেশিভাগ সময়ই আলাদ করা যায় না। উনি সাঁইজির কোন পদটা করছেন। দৈন্য করছেন। না প্রবর্ত করছেন। না সাধক দেশ না সিদ্ধির দেশের গান। কোনোটাই আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

এক অবসরে উনার কাছে বিনীত স্বরে জানতে চেয়েছিলাম, সাধু আপনি সব গানই একই সুরে করেন কেনো?

উনি রহস্যময় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, কিন্তু কিছুই বলেন নাই।

আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সাধুগুরু কি অভিমান করলেন? আমার কি প্রশ্নটা করা ভুল হলো?? নিজে নিজে যখন নিজের উপরই বিরক্ত হচ্ছি তখন সাধুগুরু হাতের দোতারার তার পাল্টাতে পাল্টাতে খুবই নিচে স্বরে বলতে লাগলো, “আমার গলায় সুর নাই। ছিলও না কোনো দিন।

গুরু একদিন বললো সাঁইজির পথে চলবা। তার নাম নিতে হইবো না? গান গাবা। আমি পরলাম বিপদে। কি করি। গুরু তো কথা শোনে না। কয় গান কর। কি আর করবো বাপ। অনেক কষ্টে একটাই সুর তুলতে পারলাম। ভয়ে ভয়ে গুরুরে শুনাইলাম।

গুরু কইলো তর দ্বারা আর কিছু হইবো না। তুই এই সুরটারেই ধর। তাও গুরুর নাম কর। সাঁইজির পদ কইরা যা। সেই থেকে কইরা যাইতেছি বাপ। যা পারি তা দিয়াই সাঁইজির নাম করি। পদ শুইনা আনন্দ না পাইলে ক্ষমা দিয়েন বাপ।”

আমার মতো একজন অতি অতি সাধারণ-নগন্য মানুষের কাছে সাধুগুরুর এমন স্বীকারোক্তি তার প্রতি আরো অনেক বেশি ভক্তি জন্মেছিল। মাথা নত হয়েছিল তার প্রতি প্রেমে।

বহুদিন পর সেই কথা মনে পরে গেলো। সাগর দেওয়ানের গান বেশ ভালো। মনোমুগ্ধকর। কিন্তু কি জানি কি হয়েছিল। হয়তো এতো রাগ-রাগিনীতে অভ্যস্ত নই বলেই আর নিতে পারছিলাম না। ঘুরতে ঘুরতে বইয়ের দোকানে গেলাম।

মহর্ষির অনেকগুলো বই পাওয়া যাচ্ছে। সবগুলোই কিনবার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু পাতা উল্টে উল্টে বইয়ের দাম দেখাই সারা হলো। নাড়াচাড়া করতে করতে শেষে কয়েকটা বই কেনা হলো বটে। কিন্তু না কেনা বইগুলোর জন্য হাহাকারটা রয়েই গেলো।

হ্যা মৃত্যু নিশ্চিত। মানে যে জীবনটা ছিল। যে জীবনধারা ছিল। সব ছেড়ে নতুন জীবনের দিকে অগ্রসর। প্রথাগত জীবনকে নাশ করে। নতুন জীবনের দিকে যাত্রা। আলোতে যাত্রা। তবে আমার মতো পাপী মানুষ সেই পথের দিশা কি আর পায়। আমি বা আমরা তো কেবল ঘুরে মরার দল।

গতবার এসে বইয়ের দোকান খোলা পাইনি বলে কি আক্ষেপ। কি আক্ষেপ। আর এই বার বইয়ের দোকান মাঠের মধ্যে মধ্যরাত্তিতেও খোলা। কিন্তু পকেট হাতিয়ে আর বই কেনা হলো না। আমাদের মতো মানুষের কাছে বিষয়টা এমনই। একটা পেলে আরেকটা হারাই।

ঘন কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। খুব কাছের মানুষগুলোও ঝাপসা হয়ে উঠছে। বাতিগুলো সেই তীব্রতা ধরে রাখতে পারছে না। সব যেন একটা মোড়কে ঢাকা পরে যাচ্ছে। ঠিক যেভাবে সাধকরা নিজেদের আড়াল করে রাখেন।

সবই আছে কিন্তু আমাদের চোখের কুয়াশার ঘোর লাগা চাদরের জন্য সেসব কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। সাধকরা সেই চাদর ভেদ করার কথা বলে যান নিজ নিজ পন্থায়। মন্ত্রণা দেন চাদর ভেদ করে দেখবার। কেউ গানে, কেউ সুরে, কেউ শাস্ত্রে ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদিতে। অর্থাৎ কর্মে-জ্ঞানে-ভক্তিতে। মূলত প্রেমে।

আর সেই প্রেমের টানেই মানুষ জড়ো হয় সাধকদের ঘিরে। ঠিক যেমন আলো দেখতে পেলে পোকামাকড় আর দূরে থাকতে পারে না। তেমনি আলোকিত মানুষ দেখলেও প্রেমিককুল ঠিক থাকতে পারে না। জানে মৃত্যু নিশ্চিত। তারপরও সে দিকেই যাত্রা করে।

হ্যা মৃত্যু নিশ্চিত। মানে যে জীবনটা ছিল। যে জীবনধারা ছিল। সব ছেড়ে নতুন জীবনের দিকে অগ্রসর। প্রথাগত জীবনকে নাশ করে। নতুন জীবনের দিকে যাত্রা। আলোতে যাত্রা। তবে আমার মতো পাপী মানুষ সেই পথের দিশা কি আর পায়। আমি বা আমরা তো কেবল ঘুরে মরার দল।

নিজেকে আর নাশ করতে পারলাম কই। তারপরও মহাজনরা যখন তাদের পদেও নিজেকে আমাদের মতোই প্রতিয়মান করেন। তখন মনে সাহস হয়। একদিন আমরাও… । মনোমোহন যেন আমার হয়েই বলছেন-

শুন্ তোরে কই মনোমোহন।
তুই তিক্ত রসে লিপ্ত হলি ভুলে সুধার আস্বাদন।।

জন্মাবধি করে এত, শিখলি না তুই শিখার মত,
মন হলি না মনের মত, আর কত ঘুরাবি মন।।

সামান্য ধন পাবার আশে, ঘুরলি কেবল হুস বেহুসে,
নিধন কালে, সেধন কি তোর, ধনের কাম দিবেরে কখন।।

সাধ করে পেতে বিছানা, পুষেছ এক বাঘের ছানা,
সে যে রক্ত খেয়ে শক্ত হয়ে, নিল তক্ত সিংহাসন।।

ফচকা বাঁধের হেচকা টানে, মন আমার ঠেকেছ প্রাণে,
বুঝলি না তুই দিন যে গণে, দিন দুনিয়ার মহাজন।।

মন তোমার স্বভাব দোষে, আমি আমার মন মানুষে,
পারলেম্ নারে রাখতে হুসে, করতে পূজা মনের মতন।।

কই আমি মন তোমার কাছে, এখনও তোর সময় আছে,
ঠিক্ থাকিস্ তুই আগে পাছে, ঠিক রাখিস্ গুরুর চরণ।।

(চলবে…)

<<মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি ।। দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক>>

………………………..
আরো পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব নয়
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এগারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব তেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব চোদ্দ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব পনেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব ষোল
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব সতেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব আঠারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব উনিশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বিশ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!