ভবঘুরেকথা
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে

-মূর্শেদূল মেরাজ

দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই

গল্পের কাহিনীটা শুরু হয় আমরা যখন গণি শাহ্ বাবার দরবারে এসে অটো থেকে নামবার উপক্রম করছি। ঠিক তক্ষুণি। ঐ যে বলছিলাম না অটো থেকে নামতেই এক অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলাম? যেই না আমরা অটো থেকে নামছি।

ঠিক সেই সময় এক অল্প বয়সী নারী দৌঁড়ে এসে। ছোটভাই ফয়েজকে দেখে বলে উঠে- আমার ভাই। আমার ভাই। আমার ভাই। ফয়েজ চমকে উঠে। সাথে আমরাও। কয়েক সেকেণ্ডেই স্বাভাবিক হয়ে এলো। সব দরবারেই এমন কিছু না কিছু নয়।

নানান পাগল-মস্তান থাকে। তারা মানুষজন এলে কাছে এসে দেখে। এটা সেটা বলে। কেউ কেউ টাকা-পয়সা চায়। কেউ খাবার চায়। কেউ বা বিরক্ত করে আনন্দ পায়। কেউ ভয় দেখায়। এসবে আমরা মোটামুটি অভ্যস্ত। তাই বিষয়টাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে ব্যাগ পত্র নামাতে ব্যস্ত হয়ে পরলাম।

আমরা প্রথমে বিশেষ পাত্তা না দিলেও সেই নারী বলতেই থাকলো- আমার ভাই। আমার ভাই। আমার ভাই। ফয়েজ যতই তাকে কাটাতে চায়। সে কিছুতেই মানতে চায় না। তার এক কথা ফয়েজই তার ভাই। সে এসেছে। সে অনেক খুশি।

প্রথমটায় ভেবেছিলাম মজা করছে। অনেক জায়গাতেই এমনটা হয়। নানা ছল করে টাকা পয়সা চাওয়ার বাহানা করে। কিন্তু সময় যতই গড়াতে লাগলো সেই নারী ততই আবেগে আপ্লুত হতে লাগলো। সে ফয়েজকে ধরে রাখতে চায়।

আমরাও মজা করতে লাগলাম। বলতে লাগলাম- যা নিয়ে যা তোর ভাইকে। এদিকে ফয়েজের মুখ রক্ত শূন্য হতে শুরু করেছে। আতঙ্কে সে দিশেহারা। আমরাও তাকে দিয়ে দিতে চাইছি। সেই নারীও তাকে ভাই রূপে গ্রহণ করে ফেলেছে। কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না। আমরা যে দিকে যাই সেও সেদিকে যায়।

বিদায়ের সময় তাকে পাওয়া যায়নি। সুমন পরে বলেছিল, দাদা ও থাকলে আমাদের ফিরতে খবর হয়ে যেত। ওকে এড়িয়ে আশা মুশকিল হতো। আমরা হাসির ছলে বলেছিলাম বটে, তাহলে আর কি ফয়েজকে আমরা তার বোনের কাছে রেখে আসতাম।

আর গগন বিদারী শব্দে বলেই চলছে- আমার ভাই। আমার ভাই। আমার ভাই। দূর থেমে মানুষজন মজা দেখছে। কেউ কেউ হাসছে।

ফয়েজ পালিয়ে যেতে চায়, কিন্তু সেই নারী ছাড়ে না। আশিক কিছুটা ধমকের সুরে তাকে থামাবার চেষ্টা করলো। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ফয়েজ ভয় পেয়ে যাচ্ছে। আমরাও তার হাত থেকে মুক্তি চাইছি। তখন আমাদের উদ্দেশ্য ছিল শান্তা পাগলার দরবারের দিকে যাওয়ার।

আশিকের ধমকে কিছুটা কাজ হলো। সে গলার স্বর একটু নিচুতে এনে বলে চললো- আমার ভাই। আমার ভাই। আমার ভাই। আমাদের পিছু পিছু অনেকটা এসে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পরলো। এই ঘটনা দেখতে যারা ভিড় করেছে তাদের পাশে।

তাকে পেছনে ফেলে অনেকটা এগিয়ে হঠাৎ বলে উঠরাম- আরে! আমরা তো এখন পূর্ণ। সাত ভাইয়ের বোন উপস্থিত। সাত ভাই চম্পা। ও আমাদের চম্পা বোন। কে যেনো গেয়ে উঠলো সাথে সাথে- সাত ভাই চম্পা জাগোরে…

শান্তা পাগলার দরবার বন্ধ পেয়ে যখন ফিরে আসলাম দয়ালের দরবারের সামনে। সেই নারী খুশিতে চিৎকার করে আবার ডাকতে শুরু করলো- আমার ভাই! আমার ভাই! আমার ভাই!

অনেকটা সময় মজা করলেও একটা সময় আমরা সবাই ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমাদের বোনের বেদনটা। তার চোখে জল। ভাই হারা এক বোনের হৃদয়ের চাপা কান্না বের হয়ে এসেছে। তার ভাইয়ের মতো দেখতে ফয়েজকে পেয়ে।

তার চোখের জলে কোনো ছল ছিল না। ছিল না কপটতা। আমরা আর খুব বেশি কঠিন হতে পারলাম না। গলার স্বরে কোমলতা চলে আসলো। বুঝিয়ে বলতে লাগলাম। সে তার ভাইয়ের জন্য পরদিন সকাল পর্যন্ত যখনই আমাদের দেখেছে তখনই দৌড়ে দৌড়ে এসেছে।

বিদায়ের সময় তাকে পাওয়া যায়নি। সুমন পরে বলেছিল, দাদা ও থাকলে আমাদের ফিরতে খবর হয়ে যেত। ওকে এড়িয়ে আশা মুশকিল হতো। আমরা হাসির ছলে বলেছিলাম বটে, তাহলে আর কি ফয়েজকে আমরা তার বোনের কাছে রেখে আসতাম।

কিন্তু খুব গোপনে বুঝবার চেষ্টা করছিলাম এই ভাই হারা বোনের আর্তনাদটা কতটা গভীর হতে পারে। আমরা বোনকে না বলেই চলে এসেছিলাম। নাকি পালিয়ে এসেছিলাম কে জানে। পরে জেনেছি তার ভাই আর আসে না পাগল বোনের কাছে।

তাই দিলো সে পরম যত্নে। কিন্তু তা পরে কুকুরের ঘুম চলে গেলো। সে আর শোয় না। ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কতক্ষণ তা নিয়ে কথাবার্তা চললো। কামরার মধ্যে আশিক, মিঠুন দা আর বাউল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমরাও ঘুমাতে যাব ভাবছি। সুমন দাস ভক্তি দিতে গেলো। ফিরলেই ঘুমানো যাব এমনটা ভাবছিলাম।

আমাদের বোন চম্পা দরবারেই থাকে। পাগলামি করে ছোট্ট এক কোলের সন্তান নিয়ে। কেউ তাকে কিছু বলে না। দরবারে থাকে। ঘুরে বেড়ায়। ভাইকে খোঁজে।

আমরাও তাকে কিছু না বলেই চলে এসেছি এতোটা পথ। আচ্ছা এখনো কি আমাদের সাত ভাই চম্পা বোন তাই ভাইয়ের মতো কাউকে দেখলে চিৎকার করে বলে- আমার ভাই! আমার ভাই! আমার ভাই!

তখন মাঝরাত, হাত-পা ধুয়ে দরবারে ভক্তি দিয়ে আমাদের বরাদ্ধ করা কামরায় ঢুকবো ঢুকবো ভাবছি। শীত শীত লাগছে। ঘুমানোও দরকার। সকালে আবার বের হতে হবে। ঘুমও আসছে না। কিন্তু ঘুমানও দরকার। কামরার সামনের মেঝেতে যে কুকুরটা শুয়ে আছে সে স্বত্বিতে নেই। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে।

পাকা মেঝে ঠাণ্ডা হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ একপাশ দিয়ে শুয়ে আবার পাল্টে ঘুমাচ্ছে। আমাদের কামরার মধ্যে এক ফোটা জায়গা অবশিষ্ট নেই যে তাকে ঘরে তুলবো। কামরায় বাউল পাগলাও আশ্রয় নিয়েছে। খাটে তিনজন আর নিচে পাঁচ জন শোয়ার পর কামরা টইটুম্বুর।

দয়াল বাবা গণি শাহ্ বাবার নৌকা
দয়াল বাবা গণি শাহ্ বাবার নৌকা

ঘুমের চিন্তা আপাতত তুলে রেখে ছোট্ট চর্টখানা জ্বেলে এক খণ্ড গরম কাপড় কোথাও পাওয়া যায় কিনা সেদিকে মনোযোগ দিলাম। রাত প্রায় তিনটা। দরবারের কেচিগেট বন্ধ। তবে আলো জ্বলছে। আমরা কয়জন ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। এক মা আমাদের সাথে জেগেছিলেন অনেকটা সময়।

কিছু সময় আগে তিনিও ঘুমাতে গেছেন। কি এক কম্বল নাকি কে তার কাছে রেখে গিয়েছিল। সেটা খুঁজে পাচ্ছেন না। সেই চিন্তায় তার দুই চোখের পাতা এক করার জো নেই। কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে আবার উঠে এসে একা একাই কম্বল খুঁজে। আর যার কম্বল সে এলে কি বলবে তা নিয়ে নিজে নিজেই আলাপ চালাচ্ছে।

দরবার ছাড়িয়েও অনেকটা জায়গা জুড়ে খোঁজাখুঁজির পর একটা ফেলে দেয়া জ্যাকেট পেলাম। তা কুড়িয়ে আনবার পরে। অন্যরাও হাত লাগালো। প্রথমে ভাবলাম সেটা বিছিয়ে দেই তার উপর কুকুরটা ঘুমাক। কিন্তু সুমন দাস বাউল বললো না পড়িয়ে দেই গায়ে।

তাই দিলো সে পরম যত্নে। কিন্তু তা পরে কুকুরের ঘুম চলে গেলো। সে আর শোয় না। ঘুরে বেড়াতে লাগলো। কতক্ষণ তা নিয়ে কথাবার্তা চললো। কামরার মধ্যে আশিক, মিঠুন দা আর বাউল বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমরাও ঘুমাতে যাব ভাবছি। সুমন দাস ভক্তি দিতে গেলো। ফিরলেই ঘুমানো যাব এমনটা ভাবছিলাম।

আমার মতো তুচ্ছ মানুষের কাছে তার উত্তর নেই। থাকবার কথাও না। আমরা তো কেবল যাত্রী। যাত্রাপথে যতটা চোখে পরে ততটাই দেখবার চেষ্টা করি মাত্র। চাইলেই কি যাত্রা বিরতি দিয়ে কোথাও নোঙ্গর করে থেকে যেতে পারি কোথাও?

কামরায় আর না ঢুকে বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলাম। কখন যেন চোখ বন্ধ করে ভাবনায় ডুবে গেছি। সেই কত কি ভাবনা। কত কি মেলানোর চেষ্টা। হঠাৎ দেখি সুমন দাস আমার পাশে। বললো দাদা চলেন, দরবার পরিষ্কার করি।

কয়েকদিন আগেই হয়ে গেছে গণি শাহ্ বাবার দরবারে বার্ষিক সম্মেলন। তার রেশ এখনো কাটেনি। খোলা প্রান্তরটা পরিষ্কার করা হলেও এখানে সেখানে অগনিত ময়লা চোখে পরছে। যাক ডিউটি পাওয়া গেলো। লেগে পরলাম দুই জন কাজে।

হাত লাগাতে এগিয়ে এলো ফয়েজ, রাহাত, রিয়াদ সাধুও। সক্কলে মিলে শীতের রাতে দরবারের ময়লা পরিস্কারে হাত লাগিয়েছি। সেই মা আবার উঠে এসেছেন। তিনিও উৎসাহে হাত লাগালেন। পান খাওয়া মুখে ফিক করে হেসে বলে উঠলো, কি দয়াল ডিউটি দিয়া দিছে?

সুমন অনেকটাই দূরে দরবারের দিকটায় পরিষ্কার করছে। আমি খালের পাশটায় সরে এসেছি পরিস্কার করতে করতে। কয়েক মুর্হূত মা-জননীর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মা বললো, করো করো সব পরিস্কার করো। ডিউটি যখন পরছে। দয়াল সক্কলরে ডিউটি দেয় না।

খুব বেশি ভাববার সময় নেই আসলে। ডিউটি যখন পরছে তা করে যেতে হবে। সেটাই আসলে বিধান। সাধুগুরুরা তার দরবারে আগত কাকে কোনো কাজে লাগাবে। কার কাছ থেকে কোনো সেবা নিবে। সেটা কে কবে বলতে পরেছে? কে কবে বলতে পারবে?

আমার মতো তুচ্ছ মানুষের কাছে তার উত্তর নেই। থাকবার কথাও না। আমরা তো কেবল যাত্রী। যাত্রাপথে যতটা চোখে পরে ততটাই দেখবার চেষ্টা করি মাত্র। চাইলেই কি যাত্রা বিরতি দিয়ে কোথাও নোঙ্গর করে থেকে যেতে পারি কোথাও?

তাই পাগল বিজয় ভাষাটাই যেন রাতের আধারে নিজের ভাষা হয়ে উঠে-

তুমি আমার হও হে দয়াল যদি আমি তোমার হই।
তখন স্নেহে আমায় রাখো ঘিরে
যখন তোমার বাণী শিরে বই।।

যে গৃহে বাস করলাম আমি
চিনলাম না সেই গৃহস্বামী;
করলাম শুধু আমি আমি
আমার আমি চিনলাম কই।।

আমি তো চিনলাম না আমায়
চিন্ময় তাই চিনলাম না তোমায়;
তুমি কোথায় আর আমি কোথায়
কভু কি তার সন্ধান লই।।

জ্ঞানেন্দ্রিয় জ্ঞানের দ্বারায়
কর্মেন্দ্রিয় কর্মে চালায়;
তাঁর মাঝখানে রয় মনমনুরায়
বোকার মতো আমি একা রই।।

পাগল বিজয় বলে, এবার বাঁচাও
ইন্দ্রিয়গণ কেন্দ্রে পাঠাও;
আমার মনকে মনের মতো সাজাও
চলবো না আর তোমা বই।।

(চলবে…)

<<দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক ।। শাহান শাহ্’র দরবারে>>

………………………..
আরো পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব নয়
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এগারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব তেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব চোদ্দ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব পনেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব ষোল
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব সতেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব আঠারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব উনিশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বিশ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!