ভবঘুরেকথা
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি

-মূর্শেদূল মেরাজ

সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- তিন

সাথে শাহিন ভাই আর জুয়েল ভাই ছিল। শাহিন ভাই সফর সঙ্গী হিসেবে খারাপ না। কিন্তু জুয়েল ভাই পেইনফুল। তিনি কোনো কিছুতেই সন্তুষ্ট হন না। যা দেখেন তাই বলেন কই নিয়ে আসলেন ভাই। দেখবার মতো তো কিছুই নেই।

এমন একটা ভাব ধরে যেন, আমি ট্যুর অপারেটর। আর তাকে হাতে পায়ে ধরে ট্রুরে এনেছি। উল্টো দেখা যায়, উনিই জোর করে আমাকে সঙ্গে নিয়েছেন। যাওয়ার জন্য পিরাপিরি করেছেন বারংবার। সফরে এই রকম সঙ্গী হলে সফরটাই বিরক্তিকর হয়ে উঠে।

এই ধরনের মানুষ নিজে যেমন প্রতি পদে পদে বিরক্ত হয়। তেমনি আশপাশের সকলকেও অতিষ্ঠ করে তোলে। সকল কিছুতেই তাদের থাকে নানান অভিযোগ। আসলে সফরে এমন সঙ্গী সবচেয়ে সুখকর। যারা সকল পরিস্থিতিকে সহজভাবে নিতে পারে।

সকল পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে। সকল পরিস্থিতিতেই আনন্দ-ভালোলাগা-প্রশান্তি খুঁজে নিতে পারে। সর্বোপরি বিরক্ত করে না। তবেই সফর আনন্দময় হয়ে উঠে। যাক সে সব কথা। এইবারের যাত্রাটা যে বেশ জমাটি হবে তাতে সন্দেহ নেই। যতদূর মনে হচ্ছে কয়েকটা দিন ভালোই কেটে যাবে। জমিয়ে ঘুমাতে হয় পাহাড়ে। আহারে।

প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনাটা এমন ছিল যে- দ্বিতীয় দিনে আমরা ঝড়ঝড়ি থেকে নেমে চন্দ্রনাথের পাহাড়ের নিচে কোথাও থাকবো। পরদিন চন্দ্রনাথে উঠবো। আমি অবশ্য সেই পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিয়ে বললাম। কাল আমি নামছি না।

একদিন ঝড়ঝড়িতে থেকে কিছু হবে না। কালও ঝড়ঝড়িতেই থাকবো। ছোটরা সক্কলে খুশি। আশিক প্রথমে একটু ক্ষীণ আপত্তি তুললেও পরে হাসি মুখে মেনে নিলো। সিদ্ধান্ত হলো পরদিন সকালে রাহাত নিচে নামবে। ও বাজার করে আনবে। বারবিকিউ করা হবে মাছের।

কাটাকাটি রান্নাবান্নার দায়িত্ব নিয়েছে ফয়েজ আর সৌম্য। তাদের সহায়তায় আছে রাহাত আর আউলিয়া। আর আমরা আছি আরো অনেক অনেক বড় দায়িত্ব। তা হলো ল্যাটানো। সারা দিন এদিকে ঘুম তো ও দিকে ঘুম। ফাঁকে ফাঁকে এদিন সেদিক ঘুরে আসা।

আমাদের ক্যাম্পেং এর উপরের দিকটা আরো সুন্দর। আমি অবশ্য বেশি উপরে উঠিনি। আসার পরদিন সকালে আশিক আর সুমন অনেকটা দূর পর্যন্ত গিয়েছিল। তাদের কাছে অপার সৌন্দর্যের কল্পকাহিনী শোনা গেলো। পরদিন ফয়েজ আর আউলিয়া গিয়েছিল আরো অনেকটা দূর পর্যন্ত।

তারা আরো মুগ্ধ করা বর্ণনা দিলো। বললো যতই উপরে উঠা যায় সুন্দর্য নাকি ততটাই বাড়তে শুরু করে। আমি আবশ্য শুনেই খুশি হলাম। কল্পনায় দেখে নিলাম সেই সব। আমার মতো অলস মানুষের পক্ষে এতো পাহাড়ে উঠা কি আর সম্ভব!

আমার আবার ঘুমের নানান ফ্যাকড়া। প্রতিদিন যে সময়টায় ঘুমাই সেই সময়টায় না ঘুমাতে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। তারপর সারাদিন যতই ক্লান্ত লাগুক না কেনো দুই চোখের পাতা আর এক হয় না। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাতেও বেশ অসুবিধা হয়। নতুন জায়গায় গেলেও ঘুম হয় না।

প্রথম দিন তাবু খাটাতে খাটাতে ছোটরা ক্লান্ত হয়ে গেলো। দুপুরও গড়িয়ে গেছে। ততক্ষণে আমাদের একদফা ঘুম হয়ে গেছে। তাই আর বাড়াবাড়ি না করে নুডুলস দিয়েই দুপুরের সেবা সেরে নেয়া হলো। আশিকের ছোট ভাই সৌম্য রীতিমতো প্রশিক্ষিত শেফ।

যদিও আমরা তার হাতের রান্না আগে খাইনি। তাই এই যাত্রায় সেই এই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিলো। দফায় দফায় সে আর ফয়েজ মিলে আমাদের মজাদার সব খাবার খাওয়াতে লাগলো। গান-বাজনা, খাওয়া-দাওয়া আর ঘুম দিয়ে চলছে জীবন।

আশিকের এক বাণী সকল সময়। তার কাছে যাত্রায় জীবন হলো- সেবা, পটি আর ঘুম। এই খানে এই কাজ শুধু সে নয়, আমরা সকলেই সেই কাজে মত্ত্ব হয়ে গেলাম। ছোটরা আমাদের প্রায় কোনো কাজই করতে দিচ্ছে না। আমরাও সুযোগ পেয়ে করছি না কিছুই।

সকল কিছু চাইবার আগে হাজির হয়ে যাচ্ছে। শীতটা বেশ। তবে অসহ্য নয়। সহ্যের মধ্যেই শীত। আমি আর আউলিয়া ঘুরে ঘুরে শুকনা কাঠ জোগার করলাম বেশ কিছু। তাই দিয়ে রান্না আর আগুন জ্বালানো হলো দুপুরের সেবা পর্যন্ত। বিকেলের পর রাহাত নিচ থেকে আমাদের সংগ্রহের কয়েকগুণ কাঠ নিয়ে আসলো একাই।

সারারাত আগুন জ্বললো। আমরা আগুন ঘিরে বসলাম। সুমন-আউলিয়া গান করে চললো। রাতকে অনেকটা সকাল করে দিয়ে তারপর আমরা যে যার মতো ঘুমাতে গেলাম। অবশ্য এর মাঝে আশিক তার স্বভাব সুলভ কয়েক দফা ঘুমিয়ে নিয়েছে।

রাতের খাবারের পরও সারা রাতই আমরা এটা সেটা খেলাম। একে শীত তার উপর পাহাড়। খাবারটা এখানে বেশ হজম হয়। পরদিন বেশ বেলা করে উঠলাম আমি। উঠেই শুনি সুমন দাস বাউল আর আশিক অনেকটা পথ ঘুরে এসেছে।

অবশ্য তারা যখন সকালে যাত্রা করেছে তখন আমাকে ডেকেছিল। আমিও তা ঠিকই শুনতে পেয়েছিলাম। কিন্তু সাড়া দেইনি মোটেও। কারণ একবার সাড়া দিলে তারা ঠিকই আমাকে নিয়ে যাবে। একে সারারাত ঘুম হয়নি। তারপর এই অত্যাচার সহ্য করা মুশকিল।

আমার আবার ঘুমের নানান ফ্যাকড়া। প্রতিদিন যে সময়টায় ঘুমাই সেই সময়টায় না ঘুমাতে গেলে আর ঘুম আসতে চায় না। তারপর সারাদিন যতই ক্লান্ত লাগুক না কেনো দুই চোখের পাতা আর এক হয় না। নিজের বিছানা ছাড়া ঘুমাতেও বেশ অসুবিধা হয়। নতুন জায়গায় গেলেও ঘুম হয় না।

আর সেই অংশের ঝর্ণার জলটা কিছুটা উপর থেকে ঝর্ণাধারায় নেমে এসেছে। তার ডান পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠা যাওয়া যায় অনেকটা। আর বা পাশটায় কিছুটা উঠলেই ঐ ধারে ঢাল। সেই বা পাশে পাথুড়ে খাঁজের মধ্যে থেকে সুমন দাস বাউল একটা পাকানো লাঠি আবিষ্কার করলো।

এতো দিন ঘোরাঘুরি করেও এই একটা স্বভাব আমি কিছুতেই আয়াত্ব করতে পারিনি। তা হলো যখন তখন ঘুম। তাই যারা যত্রতত্র যখনতখন ঘুমিয়ে পরতে পারে তাদের দারুণ একটা মিষ্টি হিংসা হয়। ভাবি ইশ্ আমিও যদি এভাবে ঘুমাতে পারতাম।

এই দিকে অবশ্য আমাদের গ্রুপের সকলেই এগিয়ে। আশিক আর ফয়েজ তো বলে বলে ঘুমাতে পারে। যাক সে সব কথা। আমি তাদের কথা কানে নিলেও সাড়া দিলাম না। ঘাপটি মেরে পরে রইলাম কম্বল চাপা দিয়ে। দুইজন অনেকক্ষণ আকারে ইংগিতে আমাকে ডাকার চেষ্টা করলো। যদি উঠে।

কারণ তারাও ভালো করে জানে আমি ঠিকই সব শুনছি। যাই হোক তারা রওনা দিলো। আমিও পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরলাম। সকালের দিকে ঘুমালে ঘুম গাঢ় হয় না। স্বপ্নময় ঘুম হয়। এই স্বপ্নগুলো কয়েক সেকেন্ডের হয় না। টানা স্বপ্ন হয়।

আমি এর সাথে অভ্যস্ত। দীর্ঘকাল ধরেই আমি ভোরে ঘুমাতে যাই। নানান সব স্বপ্ন দেখতে দেখতে মন ভালো করা একটা ঘুম হলো। ঘুম থেকে উঠতেই একটা সূর্যময় দিনের মধ্যে প্রবেশ করলাম। নতুন দিনের নতুন গল্প। এই গল্পে কোনো তাড়া নেই।

কেবল অলস সময় কাটানো। আর খাওয়া। মাঝে একটু বরফ শীতল জলে গোসলটা সেরে নেয়া। এভাবেই সময় চলতে লগলো। ঐ দিকে রান্না চলছে দফায় দফায়। সময় মতো ডাক আসছে। আমরা বসে পরছি। খাওয়া চলছে আয়েশ করে।

আমাদের ক্যাম্পিং-এর এক ধাপ উপরে যে পাথুড়ে সমতল জায়গাটা আছে। সেখানে ঝর্ণার জলটা বেশ সরু হয়ে এক পাশে দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলছে। সেই জায়গাও বেশ অনেকটা ছড়ানো। সমতল অংশটা ক্রমশ ধীরে ধীরে সরু হয়ে একটা কুমে মিশেছে।

আর সেই অংশের ঝর্ণার জলটা কিছুটা উপর থেকে ঝর্ণাধারায় নেমে এসেছে। তার ডান পাশ দিয়ে উপরের দিকে উঠা যাওয়া যায় অনেকটা। আর বা পাশটায় কিছুটা উঠলেই ঐ ধারে ঢাল। সেই বা পাশে পাথুড়ে খাঁজের মধ্যে থেকে সুমন দাস বাউল একটা পাকানো লাঠি আবিষ্কার করলো।

চতুর্থ দিন সকালে পাহাড় থেকে নেমে দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। একদল যাবে চন্দ্রনাথের চূড়ায়। অন্যদল এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করবে। প্রথমদল অর্থাৎ চন্দ্রনাথের দলে সুমন, আউলিয়া, ফয়েজ আর সৌম্য। আর অন্য দলে আমি, আশিক আর রাহাত। তাই আরেকটা গোটা দিন পাওয়া গেলো পাহাড়ে।

সেই লাঠি নিয়ে কি তার বাহাদুরি। এমন করে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে। তেমন করে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে। তেল মাখে। এদিকে সাজিয়ে রাখে। ওদিকে সাজিয়ে রাখে। একে তাকে ধরতে পর্যন্ত দেয় না।

খুঁজে পাওয়ার নেশায় চেপে বসেছে সুমনকে। যা পায় তাতেই তার মুগ্ধতা। এর মাঝে কয়েকটা পাথর খণ্ড পেয়ে সে তব্দা খেয়ে বসে আছে। যে পাথর দেখে তাতেই কোনো না কোনো আকার আকৃতি আবিষ্কার করে বসে। আমিও সে পথে যেতে যেতে আমার ছোট্ট মন ভালো করে দেয়া ধ্যানাশ্রম আবিষ্কার করলাম।

পাথরের ভাজে এমন একটা অংশ যেখানে আসন করে কেবল একজনই বসতে পারে। মারাত্মক পছন্দ হয়ে গেলো জায়গাটা। মনে হলো কত জনমের পরিচিত এই আসনখানা আমার। আসনের ঠিক সামনে দিয়েই কুলকুল ধ্বনিতে ঝর্ণার জল বয়ে চলছে।

শীতল জল পা ডুবিয়ে আশ্রমে বসে থাকলাম। শুকনা পাতা দিয়ে আসনের নিচে বসার ব্যবস্থা করে নিলাম। একটা সন্ধ্যার অনেকটা সময় সেখানে বসে কাটিয়ে দিলাম। শেষে শীত বাড়তে থাকায় নেমে আসতে হলো নিচে। আজ বেশ কুয়াশা কুয়াশা ভাব।

মাঝের তাবুটায় আমি আশিক আর সুমন। একটা তাবুতে সৌম্য আর ফয়েজ। অন্যটাতে রাহাত আর আউলিয়া। এভাবেই ঘুমের আয়োজন হয়েছে। সকলেই ক্লান্ত। তারপরও ঘুম নেই চোখে। এক কথা শেষ হয়ে অন্য কথা শুরু হয়ে যায়। এই তাবু ঐ তাবুতেও কথা চলতে লাগলো।

তারপর কে কখন ঘুমিয়ে পরেছে। আমি কখন ঘুমিয়েছি তাও কিছু টের পাইনি।

সংশোধিত কথা ছিল তৃতীয় দিন সকালে আমরা নিচে নেমে যাব। কিন্তু তাও হলো না। সিদ্ধান্ত হলো সেদিনও পাহাড়েই থাকা হবে। যেহেতু আমরা ফিরতি টিকেট কেটেছি চতুর্থদিন রাত সাড়ে বারোটায়। তাই সেই মতোই সিদ্ধান্ত হলো।

চতুর্থ দিন সকালে পাহাড় থেকে নেমে দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাবে। একদল যাবে চন্দ্রনাথের চূড়ায়। অন্যদল এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করবে। প্রথমদল অর্থাৎ চন্দ্রনাথের দলে সুমন, আউলিয়া, ফয়েজ আর সৌম্য। আর অন্য দলে আমি, আশিক আর রাহাত। তাই আরেকটা গোটা দিন পাওয়া গেলো পাহাড়ে।

(চলবে…)

<<সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই ।। সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার>>

………………………..
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!