ভবঘুরেকথা
ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান

-মূর্শেদূল মেরাজ

ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান : এক

সম্ভবত বছর দুয়েক আগে ফর্সা হাজীর মাজারের ছবি দেখেছিলাম বন্ধুবর আশিক আফজালের কাছে। ফেসবুকে ম্যাসেজিং-এর এক পর্যায়ে ফর্সা হাজীর মাজারের কিছু ছবি দেখিয়ে বলেছিল। আমার বাসার ঠিক পেছনেই ফর্সা হাজীর মাজার। একবার আসেন। দারুণ জায়গা। আপনার পছন্দ হবে।

তখন যাওয়া হয়নি। তারও অনেক অনেক দিন পর সাধুগুরু হুমায়ুন সাধুর আখড়াবাড়ির অনুষ্ঠানে গিয়ে উঠলাম আশিকের বাড়িতে। এক সকালে আশিক নিয়ে গেলো বাড়ির পেছনের পথ ধরে ফর্সা হাজীতে। আসলেই মনোমুগ্ধকর এক মাজার।

যদিও অবকাঠামো তেমন গড়ে উঠেনি। আলিশান স্থাপনা নির্মিত হয়নি সত্য। কিন্তু যে নির্মল পরিবেশের মাঝে এই সাধক রয়েছেন। তা দেখে মুগ্ধ হতেই হয়। বিশাল বিশাল আম গাছ মাথার উপর ছাতা হয়ে আছে। প্রখর সূর্যের তাপেও থাকে শীতলতার অনুভূতি।

দেখেই মনে পড়ে গেলে সাত্তার বাজানের বাড়ির পেছনের হক নুরুল্লাহ্’র মাজারের কথা। একই রকম আম বাগানের মাঝে শুয়ে আছেন সাধক। এমন সব পরিবেশে সাধকরা কেমন করে বিরাজ করেন তা আমাকে ভাবায়। আসলে এমন সব পরিবেশ খুঁজে খুঁজে কি তারা আশ্রয় নেন?

নাকি তাদের ঘিড়েই প্রকৃতি এতো সুমধুর হয়ে উঠে?? কে জানে কোন কারণে কি ঘটে। তার উত্তর আমার কাছে নেই। তবে এসব দেখে মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা আমার কাছে আছে। আছে বারবার সাধকদের প্রেমে পরার সক্ষমতা। তাই তাতেই ডুব দিলাম।

বাসে অনুকুল ঠাকুরের এক ভক্তকে পাওয়া গেলো। সুধাম তার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। অতিমারি চলে যায় নি এখনো। বিচিত্র সব মাস্ক পরে আমরা সকলে বসে আছি। এই যে মাস্ক পরা লোকজনের সাথে কথা বলছি। ঘনিষ্টতা হচ্ছে।

বিশাল বিশাল আম গাছগুলোর ঠিক মাঝে অনেকটা উঁচু ঢিবির উপরে ফর্সা হাজী ঘুমিয়ে আছেন। কয়েক প্রস্থ সিঁড়ি বেড়ে উঠতে হয় মাজারের ভিটায়। দেয়াল ঘেরা মাজার। চারপাশের ঘর সহ পুরো জায়গাটাই থাকে বেশ পরিপাটি।

এরপর কেটে গেছে অনেক দিন। মাঝে করোনা অতিমারির প্রথম ঢেউয়ের কালও। এরই অনেকদিন পরে এক সন্ধ্যায় আশিক বললো সামনে ফর্সা হাজীর ওরশ আছে। চলেন একটা কিছু করি। ছোট করে একটা অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু একটু বড় করে করতে চাই। আপনি কি বলেন?

আমি আর কি বলি, বললাম করা যায়। কিন্তু কি করে কি করা?? দুইজনই ভাববার সময় নিলাম। তারপর ধীরে ধীরে চূড়ান্ত হয়ে গেলো ৮ মাঘ মোতাবেক ২২ জানুয়ারিতে একটা কিছু করবো। কথা বলতে বলতে একটা নাম মাথায় আসলো- “ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান”

এক কথাতেই নামটা পাশ হয়ে গেলো। এটাই হয়ে উঠলো আমাদের থিম। এই একটা লাইনকে ঘিরেই শুরু হলো জল্পনাকল্পনা। অবশ্য আমি তেমন কিছুই করি নাই, সবটাই আশিক করেছে। সবাইকে জানানো হলো। একে একে সম্মতি আদায় করা শুরু হলো।

বিশ তারিখের সূর্য দুপুরের দিকে গড়িয়ে পরার আগেই আমি আর সুধাম সাধু রওনা দিলাম নরসিংদী রায়পুরার উদ্দেশ্যে। সুধাম সাধু ঢাকাতেই ছিল। তাই তাকে বগলদাবা করতে সহজ হলো। কুষ্টিয়া থেকে তাকে টেনে আনা এতোটা সহজ ছিল না।

ট্রেনের সময়ের জন্য বসে না থেকে বাসেই উঠে বসলাম। উঠাই সারা। বাস আর ছাড়ে না। এই লাইনে বাসের এই এক সমস্যা। যাত্রী না ভরলে বাস কিছুতেই ছাড়তে চায় না। আর এমন সময় ঘর থেকে বের হয়েছি যাত্রীও হচ্ছে না। আর বাসও ছাড়ছে না।

বাসে অনুকুল ঠাকুরের এক ভক্তকে পাওয়া গেলো। সুধাম তার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। অতিমারি চলে যায় নি এখনো। বিচিত্র সব মাস্ক পরে আমরা সকলে বসে আছি। এই যে মাস্ক পরা লোকজনের সাথে কথা বলছি। ঘনিষ্টতা হচ্ছে।

ক্রমাগত পাল্টাতে লাগলো মঞ্চ সাজানোর পরিকল্পনাও। প্রথম থেকেই ভেবেছিলাম স্থানীয়ভাবে যা যা পাওয়া যাবে তা দিয়েই করা হবে মঞ্চ। কিন্তু ডেকোরেটরের লোকজন মঞ্চ তৈরি করতে এতোটাই সময় নিলো যে ঠিকঠাক মতো কাজ করা দায় হলে গেলো।

পৃথিবী যদি আবার শান্ত হয়। যদি আমরা আর মাস্ক না পরি। তাহলে কি আবার দেখা হলে আমরা পরস্পর পরস্পরকে চিনতে পারবো? নাকি চেনার জন্য বলতে হবে। আরে ভাই ঐ যে আপনার সাথে আলাপ হয়েছিল অমুক জায়গায়। আমি সার্জিক্যাল রঙের মাস্ক পরেছিলাম? মনে পরে??

বিকাল হতে তখনো অনেকটা বাকি। আমরা নেমে পরলাম বরৈচা বাসস্ট্যান্ডে। এখান থেকে আশিকের বাসা আধ ঘণ্টার সিএনজির পথ। অবশ্য আশিক আসবে আমাদের নিতে। ফোনে সেই রকমই কথা হয়েছে। নামতে না নামতে আশিককে পেয়ে গেলাম।

তিনজনে এদিক সেদিক ঘুরে টুকটাক কাজ সেরে রওনা দিলাম শ্রীরামপুর আশিকের বাড়ির দিকে। একই দিনে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এক এক করে ছোটভাইরাও জড়ো হতে লাগলো। শ্রীরামপুরের আফজাল সাহেবের বাড়িতে লোকসংখ্যা বাড়তে লাগলো। সঙ্গের লোকজনে ভরে উঠতে লাগলো উঠোন।

যে ঘরখানা আমাদের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তা ছেড়ে আমরা দেয়াল লাগোয়া পাশের উজ্জ্বল কাকার বাড়ির টিনের ঘরটাকেই আপন করে নিলাম। একঘরেই সকলে আশ্রয় নিলাম প্রথম রাতেই। শুরু হলো গান-বাজনা আর মঞ্চ সাজানোর আয়োজন।

সিফাত, রাহাত, রাহি, ফয়েজের সাথে কুষ্টিয়া থেকে ছোটভাই রানাও যোগ দিলো। পরদিন আমাদের সাথে যোগ দিলো সুমন দাস বাউল। সুদূর বাগেরহাট থেকে চলে এসেছে ভালোবাসার টানে। এরপর কেবল সংখ্যা বাড়ার খেলা। সমান তালে চলতে লাগলো খাওয়া-দাওয়া, মঞ্চ সাজানোর জোগারযন্ত্র আর ঘুমের প্রতিযোগীতা।

ক্রমাগত পাল্টাতে লাগলো মঞ্চ সাজানোর পরিকল্পনাও। প্রথম থেকেই ভেবেছিলাম স্থানীয়ভাবে যা যা পাওয়া যাবে তা দিয়েই করা হবে মঞ্চ। কিন্তু ডেকোরেটরের লোকজন মঞ্চ তৈরি করতে এতোটাই সময় নিলো যে ঠিকঠাক মতো কাজ করা দায় হলে গেলো।

যেমনটা ভেবেছিলাম তেমনটা আর হলো কই। তারপরও স্থানীয়ভাবে সহজলভ্য যা যা পাওয়া গেলো তা দিয়েই একটা পরিকল্পনা করে ফেললাম মঞ্চ সাজাবার। কপালগুণে সেই দিনই ছিল শ্রীরামপুর বাজারের হাটবার। যদিও এখন অনেক গ্রামগঞ্জেই হাটের দেখা মেলে না।

এমনকি নিজে দেখে দেখে ভালো ভালো পণ্যগুলো খুঁজে বের করে দিল। তার আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ। উল্টো দিকে মাটির পণ্য বিক্রেতা সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি এক কথার মানুষ। কোনো কিছুর দাম এক পয়সাও কমাবেন না। যা বলেছেন তাই।

কিন্তু শ্রীরামপুর গ্রাম না হলেও এখানে বসে বিশাল হাট। সপ্তাহে দুই দিনের হাট। দূরদূরান্ত থেকে বিক্রেতারা যেমন আসেন হাটে। তেমন খরিদদারও ভিড় করে কেনাকাটা করে। সপ্তাহের শুক্র আর সোমবার বসে হাট। আমি আর রানা চললাম হাটের দিকে। হাট-বাজার দেখতে আমার চিরকালই দারুণ লাগে।

কোথাও হাট বসেছে চোখে পরলে না দেখতে পেলে মনটা আকুপাকু আকুপাকু করতে থাকে। তাই হাটে গিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো। কিন্তু ঝামেলা ঐ একটাই। অল্প সময়ের মধ্যে মঞ্চ সাজাতে হবে। তাই হাট দেখা মাথায় উঠলো। আমাদের সহায়তা করতে সাথে ছিল ছোটভাই ওবাইদুর।

আমরা যা যা খুঁজছি সেগুলো হাটের কোথায় কোনটা পাওয়া যাবে ওবাইদুরই আমাদের নিয়ে যেতে লাগলো। রাস্তার দুই ধার জুড়ে অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়িয়ে বসে হাট। ওবায়দুর সাথে না থাকলে সত্য সত্যই আমাদের হাবুডুবু খেতে হতো। এতো অল্প সময়ে সবকিছু খুঁজে বের করা মোটেও সহজ হতো না।

হাটের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটা হলো, একেবারে হাতে বানানো জিনিসপত্র। নিজের বাড়িতে উৎপাদিত বা প্রস্তুতকৃত জিনিসপত্র যারা বিক্রি করতে এসেছে তাদের পণ্য। আর মাছের বাজার, মাটির হাড়িপাতিল, স্থানীয় খাবার। এসব দেখতে বেশ লাগে।

বাঁশের পণ্য বিক্রেতা বেশ অবাক হলো, যখন বললাম অল্প সময়ের জন্য কিছু জিনিস নিতে চাই। আগামীকালই ফেরত দিয়ে দিবো। কারণ যা যা পছন্দ হয়েছে সেগুলো কিনতে গেলে বাজেট পার হয়ে যাবে। দোকানী আমাদের অবাক করে দিয়ে নাম কোয়াস্তে সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে সব কিছু দিয়ে দিলো।

এমনকি নিজে দেখে দেখে ভালো ভালো পণ্যগুলো খুঁজে বের করে দিল। তার আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ। উল্টো দিকে মাটির পণ্য বিক্রেতা সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি এক কথার মানুষ। কোনো কিছুর দাম এক পয়সাও কমাবেন না। যা বলেছেন তাই।

সব দিকে নজর দিয়ে, সকলকে দিয়ে কাজ করিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজটা উঠিয়ে নেয়া সহজ হয় না। যখন শখের বসে কাজ করানো হয়। তবে কাজের চাপ না থাকলে যেমন কাজ শেষ হয় না। আবার কাজ করতে আনন্দ না পেলে কাজ করাও যায় না।

আমাদের হাতেও তেমন সময় নেই। তাই বাজেটে যা যা কুলালো তাই নিয়ে মঞ্চের দিকে রওনা দিলাম। ফর্সা হাজির সমাধির চত্বরে দুটি আম গাছের মাঝে মঞ্চ বাধা হয়েছে। আজব এক ডেকোরেটরের লোক পেয়েছি। যাই বলি তাই হাসি মুখে বলে নাই। কি আর করা। যা কিছু পাওয়া গেলো তাই নিয়ে কাজ শুরু করতে হলো।

সময় কম হাতে, তাই সকলকেই হাত লাগাতে হলো। তবে এই ক্ষেত্রে ঝামেলা একটু হয়ই। সকলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে পারে না। কেউ কেউ হাত বাড়িয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ কাজ হাতে নিয়ে বসে থাকে। ফাকি দেয়ার বাহানা খোঁজে।

আবার কেউ কেউ বুঝেই উঠে না কি করবে। তবে এখানে তেমনটা হওয়ার সুযোগ নেই। হাতে মাত্র ঘণ্টা দুয়েক সময় তার মাঝে মঞ্চ সাজাতে হবে। ইতিমধ্যেই লোকজন জড়ো হতে শুরু করেছে। আর লোকজন জড়ো হলে সাজানো মুশকিল হয়ে যায়।

নানান ধরণের প্রশ্ন শুরু হয়ে যায়। কে কবে কোথায় কত সুন্দর সাজ-সজ্জার বাহার দেখেছে তা নিয়ে আলোচনা শুনতে হয়। শেষ হবে কিনা তা নিয়ে নানান উক্তি শুনতে হয়। এর মাঝে কাজ করা বিশাল ফ্যাসাদ।

সব দিকে নজর দিয়ে, সকলকে দিয়ে কাজ করিয়ে শেষ পর্যন্ত কাজটা উঠিয়ে নেয়া সহজ হয় না। যখন শখের বসে কাজ করানো হয়। তবে কাজের চাপ না থাকলে যেমন কাজ শেষ হয় না। আবার কাজ করতে আনন্দ না পেলে কাজ করাও যায় না।

একবার এক আদিবাসী পাড়ায় গেছি। সেখানে তাদের কি একটা উৎসব চলছিল। সেই উপলক্ষে পুরো পাড়া। সমস্ত ঘর পথঘাট সাজানো হচ্ছে। এমন এক সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে আমরা সেখানে পৌঁছালাম। পাড়াটার নাম ভুলে গেছি।

(চলবে…)

ফর্সা হাজী স্মরণে লালন সাঁইজির গান-দুই>>

………………………..
আরো পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব নয়
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এগারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব তেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব চোদ্দ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব পনেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব ষোল
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব সতেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব আঠারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব উনিশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বিশ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!