-মূর্শেদূল মেরাজ
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
বিষয়টা ভাবা সহজ, কিন্তু বিকল্প না থাকলে কার্যকর করা মোটেও সহজ না। মনে মনে আমি সব সময়ই এগুলো এড়িয়ে যেতে চাই। কিন্তু পারি কই। একটা সময় জোড়তড়ো ভাবে চেষ্টা নিয়েছিলাম। তখন প্রায় একঘরা টাইপ হতে হয়েছিল।
প্লাস্টিক-পলিথিন এড়াতে চাইলে পকেটে টাকার পরিমাণ বেশি হওয়া প্রয়োজন মনে হয়েছিল কিছুদিন পরেই। কারণ যখন আশপাশের মানুষকে বলেছি এসব না কিনতে তখন যে কথাটার মুখোমুখি হতে হয়েছে তা হলো। এরজন্য বাড়তি যে টাকা লাগবে তা আমাকে দিতে হবে।
তা যেহেতু সকলক্ষেত্রে সম্ভব না। বা আমি যেহেতু আমার আশপাশের মানুষকে পলিথিন-প্লাস্টিক মুক্ত করার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি; তাই এখন আর সেই কঠিনত্বে যাই না। তবে মনে মনে যুদ্ধটা চলতে থাকে। চেষ্টা করি যতটা কম ব্যবহার করা যায়।
এই সব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে মেলার দিকে যাচ্ছি। কিন্তু তেমন কিছুই চোখে পরছে না। আমরা প্রয়োজনের কথা ভুলে মেলা দেখতে শুরু করে দিয়েছি কখন; তা আর মনে নেই। নানান সব বাহারি জিনিসপত্রে ঠাসা দোকানপাটের চেয়ে সস্তা দরের জিনিসপত্রের দিকেই বরাবর আমাদের নজর।
তাদের কাছ থেকে কিনতেও সুখ। কিন্তু যারা বাজার থেকে কিনে পণ্য বিক্রি করে। বিশেষ করে ঢাকার বাজার থেকে কিনে পণ্য বিক্রি করে। তাদের ব্যবহার হয় কর্কশ। তারা বিনয়ের ধার ধারে না। মুনাফাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তাদের কাছ থেকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোনো কিছু কিনে সুখ নেই।
যা কিছু মানুষ ভিড় করে কেনে সেসবে আমাদের রুচি কম। তাই আমরা আমাদের পছন্দের দোকানে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম। সেসময়ই ফোন বেজে উঠলো, জায়গা পাওয়া গেছে। বিছানোর জন্য কিছু কেনার প্রয়োজন নেই।
আমরা এবার আনন্দে মেলায় ডুবে গেলাম। জায়গার ব্যবস্থা যখন হয়েছে পরে ফিরলেও হবে। তারচেয়ে এই যাত্রায় মেলাটা দেখে নেয়া যাক। গত এক দশকে মেলাগুলো ক্রমশ হতাশ করছে আমাকে। সব জায়গায় গেলেই মনে হয় ফটোকপি দেখছি।
সেই একই অবস্থা। একই রকমের কিছু খাবারের দোকান, ফাস্ট ফুডের দোকান, ফুচকার দোকান, আচারের দোকান, তারপরই সানগ্লাস-কসমেটিক্স, চায়না খেলনার দোকান, মেলামাইনের প্লেট থালাবাটি ইত্যাদি ইত্যাদির পাশে একটা ম্যাজিকের পণ্য বিক্রির দোকান, তৈজসপত্র, আসবাব পত্র ইত্যাদি।
এসবেও মুগ্ধ হওয়াই যায় যদি স্থানীয় পণ্য হয়। কিন্তু তা তো নয়। প্রায় সবই বিদেশী জিনিস। ঢাকার চকবাজারে যা যা পাওয়া যায় মেলাগুলোতেও তাই তাই পাওয়া যায়। আমি খুঁজে ফিরি সেই সব মেলাকে, যেখানে পাওয়া যাবে স্থানীয় সব জিনিসপত্র।
যা দেখে নতুন করে চেনা যাবে জনপদ। পরিচয় পাওয়া যাবে স্থানীয় ভাবনা। স্থানীয় নামের সাথে হওয়া যাবে পরিচিত। এতে মুগ্ধতা থাকে। থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। যারা নিজের তৈরি বা সৃজনী পণ্য বিক্রি করে, তাদের উৎপাদিত পণ্যের মধ্যেও একটা মমত্ব থাকে। নিজস্বতার ছোঁয়া থাকে।
তাদের কাছ থেকে কিনতেও সুখ। কিন্তু যারা বাজার থেকে কিনে পণ্য বিক্রি করে। বিশেষ করে ঢাকার বাজার থেকে কিনে পণ্য বিক্রি করে। তাদের ব্যবহার হয় কর্কশ। তারা বিনয়ের ধার ধারে না। মুনাফাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। তাদের কাছ থেকে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোনো কিছু কিনে সুখ নেই।
অবশ্য প্রতি মেলাতে এমন কিছু মানুষকে ঠিকই পাওয়া যায়। যারা কেবল মুনাফার জন্য না। ভালোবাসা বিলাবার জন্য মেলায় পণ্য নিয়ে বসে। যদিও তাদের সংখ্যা দিন দিনই কমছে। কোনো কোনো মেলায় তো তাদের খুঁজেও পাওয়া যায় না।
নুরুল আমিন ভাই জায়গা করে দিলো আমাদের। আমরা একেবারে মধ্যমণি হয়ে বসলাম। একের পর এক শুনতে লাগলাম মনোমোহনের গান। গাইছিল আরমান বাউল। এক সময় হারমোনিয়াম ছেড়ে একতারা হাতে নুরুল আমিন ভাই ধরলো সেই গান।
দয়াময়ের মেলায় স্থানীয় পণ্য না হলেও কিছু ব্যাতিক্রমী খুব সামান্য পণ্যের দোকান চোখে পরলো। বিশেষ করে কাসা-পিতল আর বইয়ের দোকানগুলো। সেসব পণ্য স্থানীয় না হলেও দোকানীরা বেশ পুরানো সেটা বোঝা যায়। বিষয়টা ভালো লাগলো। আমি আর সুমন দাস বাউল ঘুরে ঘুরে সেসবে মন দিলাম।
এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলাম। কিন্তু সুখ কি আর কপালে সয়। ঐ দিক থেকে আশিক-রিয়াদ ফোনের পর ফোন দিয়েই যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে জায়গা পাওয়া গেছে। জায়গা পেলে ব্যাগপত্র নিয়ে গিয়ে বসবে। সেখানে আমাদের কি দরকার হলো তা বুঝতে পারলাম না।
সুখের ঘরে আগুন দিয়ে মেলা থেকে বেড়িয়ে আসলাম। এসে দেখলাম মাধবদীর ‘সাঁইজির বারামখানা’ আখড়া খ্যাত নুরুল আমিন ভাইয়ের আস্তানায় আমাদের জায়গা হয়েছে। নুরুল আমিন ভাইরা ত্রিপল দিয়ে বিশাল এক ঘর বানিয়েছে আশ্রমের মাঠে।
সেখানে বিশেষ ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের জন্য। আর আশিক যথারীতি এরই মাঝে গা এলিয়ে দিয়ে লেটানি শুরু করে দিয়েছে। মেলাটা ভালো ভাবে দেখা হয়নি তার কিছুটা খেদ মনে নিয়ে ফিরলেও। ঘরের মধ্যে সুমধুর সুরে মহর্ষি মনোমোহনের গান শুনে মনটা ভরে গেলো।
নুরুল আমিন ভাই জায়গা করে দিলো আমাদের। আমরা একেবারে মধ্যমণি হয়ে বসলাম। একের পর এক শুনতে লাগলাম মনোমোহনের গান। গাইছিল আরমান বাউল। এক সময় হারমোনিয়াম ছেড়ে একতারা হাতে নুরুল আমিন ভাই ধরলো সেই গান।
যা আমাকে এতো বেশি আবেগী করে যে এ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতেই পারি না। বিশ্বাসই করতে পারি না। মাত্র একত্রিশ বছর কয়েক মাত্র কাল ধরাধামে থেকে একজন মানুষ কি করে এমন এমন সব পদ রচনা করেন। নুরুল আমিন ভাই ধরেছিল মহর্ষি মনোমোহনের-
শিখাইয়া দে তুই আমারে
কেমন করে তোরে ডাকি,
এক ডাকে ফুরাইয়া দেইরে
জনম ভরার ডাকাডাকি।।
যেমন করে ডাকলে পরে
শুনতে পাস তুই,
হঠাৎ করে প্রাণ ভরে
যায় রয় না বাকি।।
ডাক দিয়ে তুই ডাক শিখাইয়া
ফাক না দিয়ে আয় না ধেয়ে
খেলায় আমি তোরে লয়ে
তোর প্রানে মোর প্রান মাখি ।।
যে রূপে তোর নয়ন ধারা
সে রূপ ধরে নয়ন ধারা,
বারণ করে হও না ছাড়া
চেয়ে থাকি দুই পাগলা আঁখি।।
মনোমোহন বেহাসুর মন কমতি
পড়ে নাই তার ওজন,
আপনি কয় তাঁরে শোধন
হৃদয়ে জাগ্রত থাকি।।
এই যাত্রায় নুরুল আমিন ভাই সম্পর্কে দুই এক কথা বলি। উনার সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় কুষ্টিয়ার দেলোয়ার ভাইয়ের হেচারিতে। সাথে ছিল সদ্য দেহত্যাগী নাজিমুদ্দিন সাধু। আমরা পরিশ্রান্ত হয়ে হেচারিতে গিয়েছি। জয়-মহেশসহ কয়েকজন বসে বড় ঘরটায় গান করছিল।
সেখানে একটা পাশে আমাদেরও জায়গা হলো। আমরা বসে পরলাম। এমন সময় দুই জন প্রবেশ করলো। দুইজনই এমন যাদের একবার দেখে ভুলে যাওয়ার উপায় নেই। একজনের সরু গোঁফ দুই ঠোট ছাড়িয়ে চলে গেছে বহুদূর। অন্যজন সাদা কমলা চুল মাথার ঠিক উপরে ছোট্ট একটা খোপা করেছেন।
দুইজনেরই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। এসেই ভক্তিভরে বিনীত হয়ে বললো, ২৬ তারিখ আমার গুরুর প্রথম ওফাত দিবস আপনাদের পদধূলি চাই। গুরুর নাম জানতে চাইলে বললো, সাধুগুরু হুমায়ুন ফকিরের নাম। হুমায়ুন সাধুর সাথে পরিচয় দীর্ঘদিনের।
প্রথমবার যখন কুষ্টিয়া গেছি তখন থেকে তাকে দেখে আসছি। তার দেহত্যাগের খবরটাও বিশেষ ধাক্কা দিয়েছিল। এতো অল্প সময়ে চলে গেলেন এই সাধক। মুক্তিযোদ্ধা এই সাধক স্বাধীনতার দিন অর্থাৎ ২৬শে মার্চেই দেহ রেখেছেন। বিষয়টা আসলেই বিস্ময়কর। তাই না?
যদিও মানুষের জন্য কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না। কেবল মানুষ আর মানুষ। প্রতিবছর দুই বা তিন দিনের অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু করোনার কারণে এইবার অনুমতি পাওয়া গেছে মাত্র একরাতের অনুষ্ঠানের। তারপরও দেশ-বিদেশ থেকে অগনিত ভক্ত ও গুরুবাদী মানুষ জড়ো হয়েছে দয়াময়ের দয়ার প্রত্যাশায়।
হুমায়ুন সাধুর বহু ভক্তকেই দেখেছি। দুই একজনের সাথে আলাপও হয়েছে। কিন্তু উনাদের আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারলাম না। তবে সেটা কোনো বড় ঘটনা হয়ে রইলো না। অল্প সময়েই তারা আপনজন হয়ে উঠলেন। এরপর বহুবার বহুজায়গায় সাক্ষাৎ হয়েছে।
উনাদের নিমন্ত্রণে সেইবার হুমায়ুন সাধুর আখড়ায় না যাওয়া হলেও তারপর বেশ কয়েকবারই যাওয়া হয়েছে। বছর দুয়েক আগের সাধুসঙ্গে তো নুরুল আমিন সাধুর আসরেই আমরা কাটিয়েছি কম বেশি দুই দিন। যাক সে কথা।
মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান শুরু হওয়ায় আমরা মঞ্চের কাছাকাছি রওনা হলাম। এর আগে দয়াময়ের আশ্রমের অনুষ্ঠানে আসা হয়নি। তাই সবকিছু একটু কাছ থেকে দেখবার বাসনা হলো। বিশাল মঞ্চে আলোচনা শেষে যন্ত্রীরা যন্ত্রে শান দিয়ে নিচ্ছে গান শুরু হবে হবে করছে।
শীতটা আজ বেশ ভালোই। তবে মাত্রটা সহ্য করার মতোই। মঞ্চের সামনে অনেকটা জায়গা ছেড়ে কিছু চেয়ার দেয়া হয়েছে অতিথিদের বসবার জন্য। তারপর প্রায় পুরো মাঠটা জুড়েই প্যান্ডেল করা হয়েছে। চারপাশেও বেশ কয়েকটা জায়গায় বসবার বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তাছাড়া চারপাশে যতটা জায়গা আছে চলাচলের পথ ছেড়ে সবটা জায়গাতেই মানুষজন নিজ নিজ আসন নিয়ে বসে পরেছে। করোনার আতঙ্ক তখনো বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও। অনেকেই মাস্ক পরে ঘোরাফেরা করছে। আর করোনা আতঙ্কে মানুষজনও নাকি এইবার বেশ কম।
যদিও মানুষের জন্য কোথাও যাওয়া যাচ্ছে না। কেবল মানুষ আর মানুষ। প্রতিবছর দুই বা তিন দিনের অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু করোনার কারণে এইবার অনুমতি পাওয়া গেছে মাত্র একরাতের অনুষ্ঠানের। তারপরও দেশ-বিদেশ থেকে অগনিত ভক্ত ও গুরুবাদী মানুষ জড়ো হয়েছে দয়াময়ের দয়ার প্রত্যাশায়।
আমরাও এগিয়ে যাচ্ছি গান শুনবো বলে। তবে মঞ্চে প্রথমে যিনি গান ধরলেন তার গান বিশেষ মনকে ছুঁয়ে গেলো না। এতো দ্রুত লয়ে চিৎকার করে গাইছিলেন যে ঠিকঠাক মতো গানের কথাগুলো বোঝাই যাচ্ছিল না। তাই এদিক সেদিক ঘুরে পরিচিতদের সাথে কথাবার্তা বলছিলাম।
(চলবে…)
<<মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি ।। মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি>>
………………………..
আরো পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব নয়
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এগারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব তেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব চোদ্দ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব পনেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব ষোল
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব সতেরো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব আঠারো
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব উনিশ
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব বিশ