কাজ : পর্ব তিন
-লুৎফর রহমান
জীবনে অর্থ লাভ করবার জন্য নিজেকে বড় করে তোলার জন্য পরিশ্রম কর। কখনও বলো না আমি যা বুঝি তা সম্পূর্ণ। সারা জীবন ভরে জ্ঞানালোচনা করলেও তো বুঝার শেষ হবে না।
জ্ঞানের জন্য যে পরিশ্রম করা যায়, তার মূল্য খুব বেশি। জ্ঞানই জগতের কাজকে সরল, সুখময় ও সহজ করে তোলে। কাষ্ঠের বাক্সগুলি হাতে তৈরি করতে গেলে, একদিনে তো একটাও করা যাবে না এবং তার প্রত্যেক বাক্সের দাম পড়বে এক টাকার কম নয়। জ্ঞানবলে মানুষ ঐরূপ হাজার হাজার বাক্স প্রতি ঘণ্টায় তৈরি করছে।
মাটিতে ধান ফেললে যে ফসল উৎপন্ন হয়, একথা পণ্ডিতেরাই মানুষকে শিখিয়েছে, এ জগতের সকল কাজ জ্ঞান ও বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়। দিনে রাতে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম কর- তার মূল্য পাবে ছাই। শারীরিক হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রমের সঙ্গে যদি তোমার বুদ্ধিবল থাকতো, তা হলে তুমি রাজা হতে পারতে।
সংসারের সকল কাজ চলছে, শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, তবু বৃষ্টি-বাদলার মাঝে, গভীর রাতে, দুপুর রৌদ্রে সংসারে কাজে হেঁটে বেড়াতে পার, আর তোমার আত্মার মঙ্গলের কোনো চেষ্টা করতে পার না?
অপক্ব অনুন্নত ও অবোধ মন নিয়ে বহু উপাসনা করলেও বিশেষ লাভ হয় না। হযরত মোহাম্মদ (স) বলেছেন, জ্ঞানী ব্যক্তির এক মুহূর্তের উপাসনা মূখের চল্লিশ বৎসরের উপাসনার সমান! তুমি যে অবস্থায় থাক না যে কাজই কর না, তোমাকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এই-ই তোমার বিধান।
পয়সার লোভে যুবক বয়সেই পড়া শেষ করে এখন আরাম। ভোগ করছ? এটা মানুষের জীবন নয়, কাজের চাপে বই-পুস্তক ধরবার মোটে অবসর হয়, এও মানুষের কথা নয়। জ্ঞানকে বাদ দিয়ে উপাসনাকে যে বেশি আঁকড়ে ধরে, সে অপদার্থ। তার ধর্ম-বিশ্বাসের কোনো মূল্য নাই।
এ জগতে কতকগুলি লোক আছেন, যাদের কাছে বসে থাকা নিতান্তই অসম্ভব বলে। মনে হয়। তারা ভাবেন, জীবন আমাদের ক্ষুদ্র- কাজ অসীম। সারা জীবন ভরে কাজ করলে যা আমাদের করবার ছিল, শেষ হবে না। আলস্য করবার সময় নাই। মুহূর্তগুলি তাঁদের কাছে অমূল্য জিনিস, জীবনের সুখই হল তাদের সাধনা ও পরিশ্রমে।
কারো কারো ধারণা, কোরান (শ) ছাড়া কোনোও পুস্তকে জ্ঞান নাই। এ অতি বড় মূর্খ মানুষের কথা। শিশু কোরানের (শ) অর্থ গ্রহণ করতে পারে? কোরান (শ) বুঝতে হলে, গীতার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করতে হলে আমাদের মনটিকে বহু জ্ঞানভাণ্ডারে পরিপূর্ণ করে তুলতে হবে।
জ্ঞান চিন্তার দ্বারা আত্মার দৃষ্টি খুলে দাও, সে সমস্ত প্রকৃতির ভিতর দিয়ে আল্লাহকে উপাসনা তুল্য হবে! মুখের সম্মুখে কোরান (শ) খুলে রাখ, সে সহস্রবার পাঠ করুক,- ধর্ম পথের কিছুমাত্র সন্ধান সে পাবে না। তার আত্মতৃপ্তির কোনো মূল্য নাই, জাতির যখন অধঃপতন হয়, তখনই সে এমন সঙ্কীর্ণ পন্থায় নিজের জীবনকে সার্থক করতে চায়; সে বাদুড়ের মতো দীপালোক হতে চোখ বুজে বসে থাকে।
মানুষকে সব দিক চাইতে হবে, তাকে অনন্ত বড় হতে হবে, তাকে অনন্ত পথে চলতে হবে, তাকে খুব কথা ভাবতে হবে, সে তো সহজ জীব নয়। জাতির পতন হলে, যে গর্বে আপনাতে আপনি ডুবে থাকে, তার সম্বল হয় শুধু ঘৃণা ও অহঙ্কার। যাবৎ কোনো মহাপুরুষ তাকে নতুন করে পথ না দেখিয়ে দেন, তাবৎ সে আঁধারেই পড়ে থাকে। জ্ঞানসাধনা ব্যতীত জাতির দেহে শক্তির সৃষ্টি হয় না, সে তার ধর্ম ও মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে।
ইংরেজ কোথায় না গিয়েছে? বরফের দেশে, দুর্গম গিরিশিরে, আকাশে, মরুভূমে, সমুদ্রর তলে- কোথাও তার যেতে বাকি নাই? সে ভীল, কোল সাওতালী ভাষা হতে পৃথিবীর সমস্ত ভাষার চর্চা করেছে। সে কত পরিশ্রম করে। মুহূর্তকালও তো তার আলস্যে কাটে নাই। তার এই সাধনা ব্যর্থ হয় নাই।
নিজেকে এবং জাতিকে বড় করতে হলে তোমার সমস্ত শক্তির পূর্ণ ব্যবহার চাই। তোমার নিজের বড় হবার উপরেই জাতির বড় হওয়া নির্ভর করে। তুমি ছাড়া জাতি স্বতন্ত্র নয়। জাগরণের অর্থ তোমাদের সকলের জাগরণ। জাতিকে আহবান করা।
অনবরত কাজ করতে করতে মানুষ নিষ্ঠুর প্রাণহীন হয়ে পড়ে। তা যেন স্মরণ থাকে। নিষ্ঠুর প্রাণহীন হয়ে বড় হওয়ার কোনো লাভ নাই।
নিজের জন্য এবং মানুষের জন্য তোমাকে কাজ করতে হবে। নিজের সুখটুকু আদায় করে নিতে পারছ বলে, তোমার তৃপ্ত হবার কোনো কারণ নাই। এই দুঃখ-শাভরা দেশের অনন্ত দুঃখী মানুষের কথা না ভেবে, যে আপনার পূর্ণতায় প্রাণহীন হয়ে বসে থাকে, তাকে আর কী বলবো! সে যদি উপাসনা করে, তা দেখে আমার মন যেন সুখী হয় না।
এ জগতে কতকগুলি লোক আছেন, যাদের কাছে বসে থাকা নিতান্তই অসম্ভব বলে। মনে হয়। তারা ভাবেন, জীবন আমাদের ক্ষুদ্র- কাজ অসীম। সারা জীবন ভরে কাজ করলে যা আমাদের করবার ছিল, শেষ হবে না। আলস্য করবার সময় নাই। মুহূর্তগুলি তাঁদের কাছে অমূল্য জিনিস, জীবনের সুখই হল তাদের সাধনা ও পরিশ্রমে।
লিউনার্ড ডি ভিনসী (Leonardo De Vinci) এক সঙ্গে হাজার গণ্ডা কাজ করতেন, তাতে তার কোনো ক্লান্তি হতো না। সারা জসুয়া রেনল্ডকে এক সময় বন্ধুরা গ্রামে ধরে নিয়ে যান। সেখান হতে ফিরে এসে পুনরায় কাজে হাত দিয়ে তিনি যেন পূর্ণ জীবন লাভ করেন।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা যে মহানবীর জীবনের বিশেষত্ব, সে বিশেষত্ব তোমার মধ্যে কই? সময়ের পরিবর্তনে মানুষের আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন হয়, জগতের রুচি ও সভ্যতা পালন না করে চললে, লোকের কাছে তোমার শিক্ষা-দীক্ষা ও মনুষ্যত্বের আদর হবে না।
পেসিন (Poussin) যতই বুড়ো হচ্ছিলেন; ততই তিনি সাধারণ পূর্ণতার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। এত যে কাজ করা, তবু তার তৃপ্তি ছিল না। প্রতিভাবান পরিশ্রম করে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। অনবরত কাজ, অনবরত পরিশ্রম- তবুও তাদের মনে হয় কিছু হচ্ছে না। ভার্জিল এগার বছর ধরে তাঁর ইনিদ কাব্যখানি লেখেন।
লেখা শেষে তিনি কিছু হয় নাই ভেবে আগুনে পোড়াতে যাচ্ছিলেন। ভলটেয়ার (Voltaire) কোনো বই লিখেই তৃপ্তি লাভ করেন নি! প্রকৃত কর্মী যারা তারা সব সময়েই নিজেকে খুব দীন মনে করেন নিজেদের দরিদ্র অপরাধী ভেবে কর্মের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে দেন। তাদের লক্ষ্য হয়, জয়-সাফল্যের গৌরব পতাকা।
যে জাতি সময়ের মর্যাদা জানে, কাজের মূল্য বুঝে, যারা পরিশ্রম করতে কুণ্ঠাবোধ করে না, তাদের ভবিষ্যৎ কত উজ্জ্বল! লক্ষ লক্ষ মানুষের আলস্য কত কোটি কোটি টাকা মাটি করে ফেলে দিচ্ছে। সময়ের অপব্যবহার করা, আলস্য করে জীবনকে মাটি করে দেওয়ার অর্থ, জাতির কোটি কোটি টাকা অবহেলা করে নষ্ট করে ফেলা।
যে পরিশ্রম করতে তোমার মনে আনন্দ হয়, তাই করো। তোমাকে প্রত্যহ কিছু কিছু করতে হবে। কিছু কিছু করে কয়েক বছর ধরে বিশেষ কোনো কাজ করলে শেষে কাজের ফল দেখে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
কাজ করলেই যখন বিনিময়ে অর্থ, সম্মান, সুখ ও কল্যাণ লাভ হয়, তবে কেন তা করবে না? আলস্যে জীবনকে নিরর্থক করে না দিয়ে, সময় ও সুযোগ থাকতে কিছুকাল পরিশ্রম করে নাও। কে এমন হতভাগ্য আছে, যে জীবনের উন্নতি চায় না? পরমুখাপেক্ষী, অলস ও অভাবগ্রস্ত ভদ্রলোক হয়ে থাকায় কত লজ্জা।
তুমি সমাজের এক স্তর নিচে নেমে যাও, বন্ধুরা তোমার সঙ্গে কথা না বলুক, তোমার কোনো আত্মীয়ের নাম করবারও তোমার দরকার নাই, তুমি পরিশ্রম করে যেমন করে হোক অর্থ উপার্জন কর। তোমার ঘরে যেন ভাত থাকে, দান করার জন্য তোমার হাতে যেন পয়সা থাকে, তোমার পত্নীর কাপড়ের যেন অভাব না হয়, অসাধুতা করে অভাব মোচনের প্রবৃত্তিও যেন তোমাতে না জাগে।
হযরত দাউদ (আ) নিজ হস্তে উদরান্নের সংস্থান করতেন। হযরত ঈছার (Jesus Christ) (আ) কোনো চাকর ছিল না। হযরত মোহাম্মদ (স) পানি তুলতে গিয়ে ইহুদির হাতে চড় খেয়েছিলেন। ক্ষুধার তাড়নায় হযরতের পরিবার যখন ব্যাকুল, তখন তিনি পয়সা উপায় করতে গেলেন ইহুদির পানি তুলে।
তিনি বন্ধু-বান্ধবের কাছে ধার করতে যান নি। কাউকে নিজের অভাবের কথা বলতেও যান নি। বড় বংশের ছেলে বলে পানি তুলে পয়সা উপায় করতে লজ্জা বোধ করেন নি। মূর্খেরা বাহ্য অনুকরণ করেই মনে করে যে সুন্নত। হযরত মোহাম্মদ (দ) এর কাজের অনুকরণ পালন করা হল, কিন্তু মহানবীর দীনতা, তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, তাঁর সৎসাহস, তাঁর মহামানবতা, তার নৈতিক বল অনুকরণ করার জন্য তাদের কোনো আগ্রহই নাই।
অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা যে মহানবীর জীবনের বিশেষত্ব, সে বিশেষত্ব তোমার মধ্যে কই? সময়ের পরিবর্তনে মানুষের আচার-ব্যবহারের পরিবর্তন হয়, জগতের রুচি ও সভ্যতা পালন না করে চললে, লোকের কাছে তোমার শিক্ষা-দীক্ষা ও মনুষ্যত্বের আদর হবে না।
অপদার্থেরা তোমাকে সম্মান করুক না করুক, তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। আমরা তোমাকে সম্মান করবো। তোমার ছোট সরল। জীবনকে দেখে তোমার কাছে কেউ না আসুক কোনো ক্ষতি নাই। অসত্যের উপাসক, দুষ্ট, বদমাইশ লোককে বেশি সম্মান প্রদর্শন করো না।
পাপকে ধ্বংস করা, ন্যায়পরায়ণ হওয়া, জ্ঞান আলোচনা করা, মানুষের প্রতি প্রেম পোষণ করা- এসব মহাসত্যের কোনো কালে পরিবর্তন হবে না। মানুষেরা চান- তোমাদের পবিত্র জীবন, তোমাদের মনুষ্যত্ব, তোমাদের চরিত্র।
ঘুষ খেয়ে, মানুষের উপর অত্যাচার করে যে বাড়িতে দালান দিয়েছে, ধিক তার জীবন। ধিক সেই অপদার্থ মানুষগুলিকে, যারা তাদের সম্মান করে। বাইরের চাকচিক্যের মধ্যে কী সম্মান বিদ্যমান? শুভ্র, সুরুচি সঙ্গত পোশাক এবং দেশের অবস্থা ও শিল্প বাণিজ্যের কথা বিবেচনা করে মূল্যবান সাজসজ্জা বেশি করে পরলে দোষ হয় না কিন্তু তাই বলে কী সেগুলি চুরি করে পরতে হবে?
পোশাক পরে মনে যদি বিন্দুমাত্র অহঙ্কার আসে, তবে সেগুলি ফেলে দাও। আল্লাহ্র কাজ করবার জন্য সুবিধার নিমিত্ত অনেক সময় পদ-মর্যাদার নিদর্শনস্বরূপ ভাল পোশাক আবশ্যক হয়; কিন্তু সত্য জীবন অবলম্বন করতে যেয়ে যদি সেগুলি না জোটে, তাতে বিশেষ কী আসে যায়?
মহর্ষি টলস্টয় এত বড় লোক হয়েও খালি পায়ে বেড়াতেন, মহর্ষি জনসন নোংরা পোশাকে থাকতেন। তোমাদের শুভ্র পোশাকের পূর্বে চাই তোমাদের শুভ্র আত্মাটি- তোমার চিত্তের স্বাধীনতা- তোমার মনুষ্যত্ব।
পরিবারের মান-মর্যাদা বজায় রাখবার জন্য পোশাক পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, ডিস বর্তন, দাস-দাসী আবশ্যক, কিন্তু অবোধ জিজ্ঞাসা করি- মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে এই পদমর্যাদার মূল্য কী? যে তস্কর, যে পরস্বার্থহারী দস্যু, তার পত্নীর গায়ে সোনার গহনা, তার ছেলেদের গায়ে জরির পোশাক দেখলে মনে কি ঘৃণা হয় না?
লোকে কী বলবে? ওরে পাগল! জীবনকে পাপ, অন্যায় ও অজ্ঞানের আঁধার দিয়ে কলঙ্কিত করে ফেলছো তা তো ভাব না! ভাব লোকে কী বলবে? অন্যায় করে, চুরি করে নিজেকে সাজাতে পাচ্ছ না বলে ভাবছ লোকে কী বলবে?
মানুষের সমালোচনাকে একেবারেই উপেক্ষা কর, সৎ উপায়ে পয়সা অর্জনের জন্য যে কোনো কাজ কর। লজ্জায় যখন মুখ কাল হয়ে আসবে তখন মহাপুরুষের জীবনের কথা ভেব। কাজে কখনও মানুষের অপমান হয় না। অপমান হয়- অভাবগ্রস্ত হয়ে থাকায়, অসত্য জীবনযাপনে, দরিদ্রকে সাহায্য করতে না পাড়ায়, দাম্ভিক ও অহঙ্কারী হওয়ায়।
যদি সম্মান চাও, তা হলে মানুষের দুয়ারে কুল-মর্যাদা ভিক্ষা না করে জ্ঞানের সেবা কর। জ্ঞানের বজ্রবাণ দিয়ে তুমি আভিজাত্যের মাথা ভেঙ্গে ফেল। কাজ কর, পরিশ্রম কর, কারো কাছে ঋণী হয়ো না! আমি কারো ধার ধারি না, কাউকে ধার দেই না, এসব কথা। বলে মানুষের কাছে গর্ব করা কিন্তু নিষেধ।
অপদার্থেরা তোমাকে সম্মান করুক না করুক, তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। আমরা তোমাকে সম্মান করবো। তোমার ছোট সরল। জীবনকে দেখে তোমার কাছে কেউ না আসুক কোনো ক্ষতি নাই। অসত্যের উপাসক, দুষ্ট, বদমাইশ লোককে বেশি সম্মান প্রদর্শন করো না।
যে জাতির মানুষ শ্রমশীল, যারা জ্ঞান-সাধনায় আনন্দ অনুভব করে তারাই জগতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে। কর্তব্যজ্ঞানহীন নীতিজ্ঞানশূন্য আলসে মানুষের স্থান জগতে সকলের নিচেই হয়ে থাকে। তারা জগতে অবজ্ঞার ভার, অসম্মানের অগৌরব নিয়ে বেঁচে থাকে। জগতে ধন-সম্পদ জয় করতে হলে, জীবনের কল্যাণ লাভ করতে হলে, পরিশ্রম ও সাধনা চাই।
হযরত মোহাম্মদ (স) বলেছেন, “কেউ যদি কাপড় কেনে আর তার দেওয়া দামে যদি অন্যায়ের পয়সা থাকে, তা হলে সে কাপড় পরে সে যেন নামাজ না পড়ে।”
দরিদ্র সরল কৃষক, কামার, দর্জি, মিস্ত্রী, স্বর্ণকার, ক্ষৌরিক ও মুচি হও, সেও ভালো, তবু অসত্য জীবনযাপন করে ভদ্রলোক হতে চেও না। চিত্তের স্বাধীনতা হারিয়ে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে মানুষের কৃপা ভিক্ষা করে জীবনকে ব্যর্থ করে দিও না।
এ কথাও বলে দিচ্ছি, যে সত্য পথ অবলম্বন করে, যে বিনয়ী ও সত্যবাদী জ্ঞান পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগ রাখে, যে পরিশ্রমী, সে দরিদ্র হয়ে থাকবে না। সে বড় হবেই; তার দৃঢ়তা, তার সৎসাহস তার নৈতিক বলের পুরস্কার সে অবশ্যই পাবে।
অনবরত কাজ করে বিপুল অর্থ উপার্জন, তোমার এই পরিশ্রমের কোনো মূল্য নাই। কলিকাতার আদিম অধিবাসী কোনো এক ব্যবসায়ী শ্রেণী যেমন পরিশ্রমী, তেমনি অর্থশালী কিন্তু এদের চরিত্রবলের খুব অভাব। এইরূপ নীতিহীন স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন মূর্খ নিকৃষ্ট জাতির পক্ষে সাজে। সভ্য ভদ্র মানুষ এরূপভাবে অর্থশালী হতে ঘৃণা বোধ করেন।
হযরত আলী (রা) বলেছেন- “আমার রাত কাটে এবাদতে আর দিন কাটে পরিশ্রমে”। তুর্কী সম্রাট সেলিম সারাদিন কাজ করতেন। রাত্রিতে অল্পই নিদ্রা যেতেন। সারারাত্রি বসে বসে তিনি পড়তেন। জীবনে কাজ ছাড়া অন্য কিছুতে তার আনন্দ ছিল না। নারীসঙ্গ তিনি পছন্দ করতেন না।
শিবনাথ শাস্ত্রী প্রত্যহ বিশ ঘণ্টা করে পড়তেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী ঘুমে পড়া নষ্ট হবে এই ভয়ে বালিশ মাথায় দিতেন না।
মাইকেল এঞ্জেলো কাজ না করতে পারলে অস্থির হয়ে যেতেন। কোনো কোনো সময়ে দুপুর রাত্রে জেগে উঠে তিনি কাজ শুরু করে দিতেন।
অর্থ পাবার লোভেই সকলে কাজ করে না। কাজ সবাইকে করতে হবে। সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দেশের মানুষের উন্নতির জন্যে কাজ করা দরকার। সম্রাট ষোড়শ লুই একখানি বই উৎসর্গ পাবার সম্মানের লোভে স্পিনোজাকে পেন্সন দিতে চেয়েছিলেন। স্পিনোজা চশমার পাথর সাফ করে জীবিকা অর্জন করতেন।
সম্রাটের এই দান তিনি গ্রহণ করেন নি,- বইও উৎসর্গ করেন নি। তিনি এত পড়তেন যে কোনো সময় তাঁকে অনবরত দুই-তিন দিন ধরে ঘরের মধ্যে বসে থাকতে দেখা যেত। হাঙ্গেরীর জনৈক গণিতজ্ঞ গ্রীষ্মকালে দুই ঘণ্টা এবং শীতকালে চারঘণ্টা মাত্র শুতেন। বেলী প্রত্যহ চৌদ্দ ঘণ্টা করে চল্লিশ বৎসর ধরে পরিশ্রম করেন।
যে জাতির মানুষ শ্রমশীল, যারা জ্ঞান-সাধনায় আনন্দ অনুভব করে তারাই জগতের শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে। কর্তব্যজ্ঞানহীন নীতিজ্ঞানশূন্য আলসে মানুষের স্থান জগতে সকলের নিচেই হয়ে থাকে। তারা জগতে অবজ্ঞার ভার, অসম্মানের অগৌরব নিয়ে বেঁচে থাকে। জগতে ধন-সম্পদ জয় করতে হলে, জীবনের কল্যাণ লাভ করতে হলে, পরিশ্রম ও সাধনা চাই।
(চলবে…)
<<কাজ : পর্ব দুই ।। কাজ : পর্ব চার>>
………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই
……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা
……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত