ভদ্রতা : এক
-লুৎফর রহমান
যুক্তরাজ্যের নায়ক এক সময় ভ্রমণে বার হয়েছিলেন। তাঁর গাড়িতে মোটে স্থান ছিল না- লোকের ভিড় খুব বেশি হয়েছিল। এমন সময় একটা নিগ্রো রমণী সেই গাড়িতে উঠলে, দেশনায়ক অমনি উঠে দাঁড়িয়ে সেই সামান্য নারীকে বসবার স্থান দিলেন। বাকি পথটুকু তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন।
রাষ্ট্রনায়কের এই ভদ্রতা কি মহত্ত্বের পরিচয় নয়? রমণীটি নিম্নশ্রেণীর তাকে সম্মান করে বিশেষ লাভ কী! তার মতো সামান্য স্ত্রীলোকের পক্ষে দেশনায়কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই ভদ্রতা, এই সব চিন্তা রাষ্ট্রপতির মাথাকে অস্থির করে নি হোক না সে পথের নারী, নীচ বংশোদ্ভবা তাতে কী আসে যায়! নীচ বলে, ছোট বলে, ভদ্র ব্যবহার করতে দেশনায়ক লজ্জাবোধ করেন নি।
রেলগাড়ির দুয়ারের কাছে কোনো লোক এলে সবাই যদি হেঁকে বলি- স্থান নাই, তাতে মোটেই ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া হবে না। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, আমি যদি জায়গা জুড়ে বসে থাকি- তাতেও বিশেষ মহত্ত্ব বা মনুষ্যত্ব দেখান হবে না।
পরাধীন দেশের মানুষ সব সময়ে যথার্থ বিনয়ের পরিচয় দিতে সক্ষম হয় না। অভাব ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ভদ্রতাও অনেক সময় খাঁটি হয় না। যাকে মানুষের ভয় করে চলতে হয়, তার পক্ষে সব সময় সভ্য ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। জীবনের এই কঠিন কলঙ্ক হতে মানুষকে সব সময় মুক্ত হতে চেষ্টা করতে হবে। কারণ এ অবস্থাটা আত্মার। পক্ষে খুবই অপমানজনক। স্বাধীন মুক্ত মানুষের ভদ্রতাই প্রকৃত ভদ্রতা। দরিদ্রের পক্ষে ভদ্র।
যিনি ভদ্রলোক, তিনিই ভদ্রতার পরিচয় দেন। একটি কঠিন কথা বলে তো প্রাণে আনন্দ অনুভব করবার কিছু নাই।
সারাদিন পরিশ্রম করে বড় ক্লান্ত হয়েছ, একটা অবোধ মানুষ এসে তোমাকে বিরক্ত করছে, তাই বলে কি তাকে কঠিন কথা বলবে? ডাকঘরে, বাজারে, কাঁচারীতে অথবা থানায়, যেখানে তুমি থাক না, তোমাকে সব জায়গাতেই দ্র ও মধুর-স্বভাব হতে হবে।
ডাকঘরে কাজ কর, ভিতরে পাখার নিচে বসে মনে মনে যেন ক্ষমতার গর্ব না আসে, বাইরের লোকগুলির উপর যেন কোনও রকম নিষ্ঠুর ব্যবহার করবার প্রবৃত্তি তোমার না জাগে।
থানা-ঘরের চারিদিকে তোমার হুকুম তামিল করার জন্য সিপাইরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তোমার ইঙ্গিতে ওরা মানুষ পর্যন্ত খুন করে ফেলতে পারে, কিন্তু তবু তোমাকে নম্র ও মধুর স্বভাব হতে হবে, কারণ তুমি ভদ্রলোক। কারণ ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করিতে তুমি লজ্জাবোধ কর, বিনয়ে মধুর হয়ে মানুষের সঙ্গে দ্র ব্যবহার কর, চোর বদমাইশকে শাস্তি দাও কর্তব্যের খাতিরে- ক্রোধ বা বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে নয়।
এ জগতে উগ্র হয়ে দুর্বলকে কঠিন কথা বলবার অধিকার কারো নাই। মানুষ সব সময়ে দরিদ্র, এ জগতে এতটুকু অহঙ্কার করবার সুযোগ আমাদের নাই। মাথা নত করে কর্তব্যের আদেশ মেনে জীবন-পথের অগ্রসর হতে হবে।
এমার্সন বলেছেন- একটা সুন্দর মুখের চেয়ে একটা কুৎসিত মুখের মধুর কথা অধিকতর সুন্দর। সত্যই তো সুন্দর সুশ্রী মুখ আমাদের চিত্তকে আনন্দ দান করে না। মধুর জ্ঞানপূর্ণ সরলপূর্ণ সরল আলাপে কাফির জঘন্য চেহারাও আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে।
জনসন দ্রতা জিনিসটাকে মোটেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু তবু তিনি ভদ্রতার পরিচয় দিতেন, যা শুনলে বিস্মিত হতে হয়। যে ভদ্রতার মনের সঙ্গে যোগ নাই, তাই হয়তো তিনি ভালবাসতেন না।
পরাধীন দেশের মানুষ সব সময়ে যথার্থ বিনয়ের পরিচয় দিতে সক্ষম হয় না। অভাব ও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের ভদ্রতাও অনেক সময় খাঁটি হয় না। যাকে মানুষের ভয় করে চলতে হয়, তার পক্ষে সব সময় সভ্য ভদ্রতার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। জীবনের এই কঠিন কলঙ্ক হতে মানুষকে সব সময় মুক্ত হতে চেষ্টা করতে হবে। কারণ এ অবস্থাটা আত্মার। পক্ষে খুবই অপমানজনক। স্বাধীন মুক্ত মানুষের ভদ্রতাই প্রকৃত ভদ্রতা। দরিদ্রের পক্ষে ভদ্র।
মানুষ মানুষকে যে ঘৃণা করে, তার কারণ কী? যার মধ্যে মনুষ্যত্ব নাই, যে মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড, নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর, যার ব্যবহার মিথ্যার সঙ্গে জড়িত; বল দেখি লোক যদি তাকে ঘৃণা করে, তা হলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়? এ কথাও ঠিক, মানুষ মানুষকে অনেক সময় অন্যায় করে ঘৃণা করে। অন্যায় করে মানুষকে অত্যাধিক ঘৃণা করলে মনের অবনতি ঘটে।
হয়ে উপায় কী? দুর্বল বা অনুগ্রহদগ্ধ জীবের পক্ষে বিনয়ে নম্র হওয়া ছাড়া পথ কৈ?
স্যার হেনরী সিনী তাঁর পুত্র ফিলিপ সিডনীকে বলেছিলেন, তুমি বড় বংশে জন্মেছ, বিনয় ও চরিত্র-মহিমায় তোমাকে তা প্রমাণ করতে হবে, তোমার সৎস্বভাব, তোমার বিনয় নম্র ব্যবহার, তোমার সত্য-প্রীতি; তোমার উচ্চকুলের পরিচয় দেবে। পিতার নাম করে যেন তোমাকে বড় বংশের লোক বলে পরিচয় দিতে না হয়।
যদি ভীরু সঙ্কীর্ণহৃদয় ও নীচাশয় হও, তা হলে তোমার বড় বংশের কলঙ্ক হবে। পিতার এই উপদেশগুলি ফিলিপ সিনী গ্রহণ করেছিলেন। মৃত্যুশয্যায় তিনি যে মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, তার তুলনা। পাওয়া যায় না। ভদ্রতার প্রধান উপাদান ত্যাগ।
স্বার্থে প্রাণ পূর্ণ হয়ে আছে, পরের জন্য এতটুকু কষ্ট স্বীকার করতে মন চায় না, নিজেদের দাবি কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে নিতে খুব মজবুত, সব সময় নিজের সুখের সম্বন্ধে মন জাগ্রত; কিন্তু বাইরের লৌকিকতার খাতিরে প্রাণহীন ভদ্রতার পরিচয় দিচ্ছ, দেখা হলেই আদাব সালাম করে বিনয়ে মাথা অবনত করছ, এরূপ ভদ্রতার বিশেষ মূল্য আছে বলে মনে হয় না।
পরের জন্য ত্যাগ স্বীকার, নিজের সুখের সঙ্গে সঙ্গে পরের সুখের প্রতি দৃষ্টি রাখা, পরকে আঘাত না দেওয়া, অর্থ দিয়ে হোক বা পরিশ্রম করে তোক অন্যকে সাহায্য করবার নাম ভদ্রতা।
ছোট বংশে যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের কি দ্র হবার অধিকার নাই? সাধনার। সামনে কিছুই তো অসম্ভব নয়। মনের অহঙ্কার দূর করে দিয়ে, নিরপেক্ষ সমালোচক হয়ে। নিজেদের স্বভাবের প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখ, সেখানে যে ভুলটুকু আছে, চরিত্রের যে দৃঢ়তা আছে, তা ধীরে ধীরে দূর করে ফেল, জ্ঞান রাজ্য হতে সর্বদা বড় মানুষদের অমূল্য উপদেশগুলি পালন কর, তোমাকে কেউ ছোটলোকের ছেলে বলতে সাহস পাবে না।
মানুষ মানুষকে যে ঘৃণা করে, তার কারণ কী? যার মধ্যে মনুষ্যত্ব নাই, যে মিথ্যাবাদী ও ভণ্ড, নিষ্ঠুর ও স্বার্থপর, যার ব্যবহার মিথ্যার সঙ্গে জড়িত; বল দেখি লোক যদি তাকে ঘৃণা করে, তা হলে কি তাদের দোষ দেওয়া যায়? এ কথাও ঠিক, মানুষ মানুষকে অনেক সময় অন্যায় করে ঘৃণা করে। অন্যায় করে মানুষকে অত্যাধিক ঘৃণা করলে মনের অবনতি ঘটে।
ভদ্রঘরের ছেলেই যে ভদ্র হয়, এমন কোনো কথা নয়। প্লেটো খুব বড় ঘরের ছেলে ছিলেন না; তবুও জগতের পণ্ডিতমণ্ডলীর মধ্যে তার স্থান কত উঁচুতে। দার্শনিক ক্লিয়ানথাসের (Cleanthus) বাপ ছিলেন বাগানের মালী। ইউরোপিডিসের (Euripides) বাপও ছিলেন মালী।
শেক্সপীয়ার ছোট-ঘরের ছেলে ছিলেন। বেন জনসন, ওয়াট, জাসিয়া ওয়েজউড Josiah Wedgwood) নিম্নশ্রেণীর লোক হতে উদ্ভূত। বার্নস লাঙ্গল চষতেন। কীটসকে (Keats) ওষুধ বেচে জীবিকা অর্জন করতে হতো।
জ্যোতির্বিদ পিথাগোরাসের (Pythagoras) বাপ কামারের কাজ করতেন। ডিমসূথেনিসের বাপ ছুরি-কাচি তৈয়ার করতেন। কবি ভার্জিলের বাপ ছিলেন কুম্ভকার। কত রত্ন কত জায়গায় পড়ে থাকে; তার খবর কে রাখে? প্রতিকূল অবস্থার চাপে কত প্রতিভা কত মহৎ আত্মা অজ্ঞাত, অবজ্ঞাত হয়ে পৃথিবীর হতে বিদায় গ্রহণ করে।
কবি গ্রে বলেছেন, সমুদ্রের অতল তলে কত মণিমুক্তা লোকচক্ষুর, অন্তরালে বালি কাদার মধ্যে পড়ে থাকে, কত গিরি-উপত্যকায় কত ফুল ফুটে আপন মনে। ঝরে পড়ে।
যে ছোট হয়ে পড়ে আছে, সে হয়তো ছোট নয়। তার মধ্যে কত মনুষ্যত্ব, কত মাধুরী ঘুমিয়ে আছে তা তুমি আমি না জানতে পারি, সুবিধা ও সুযোগ পেলে সেও মানব সমাজে সম্মান পেতো।
মানুষ যতই ছোট হোক, যতই সে অবজ্ঞাত হয়ে থাকুক, তার মধ্যে অসীম ক্ষমতা, অনন্ত প্রতিভা ঘুমিয়ে রয়েছে; অনুকূল বাতাস পেলে তার ভিতরকার রূপ ও মহিমা অনন্ত শিখায় ফুটে উঠবে।
জাতির ভিতরকার লক্ষ মৌন আত্মাকে ডেকে তুলতে হবে। যে জাতির মাঝে সাধারণ মানুষের সামনে মুক্তির পথ খোলা নাই, সে জাতি দিন দিন দুর্বল হতে থাকে। তাদের শক্তি সাধারণ পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।
কতকগুলি ভদ্রলোক উচ্চবংশ নিয়ে জাতি কখনও গৌরবের পথে অগ্রসর হতে পারে। মানবসমাজে মানুষের ঘরে নিত্য নূতন আত্মা নবীন শক্তি ও অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নিচ্ছে, তাদের গতিপথ রুদ্ধ করে রাখ, তাতে জাতিই ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
আভিজাত্য গর্বের মূলে কিছু সত্য থাকলেও মিথ্যা বংশগৌরব এবং ছোটকে অবজ্ঞা করার পাপে দেশ ও জাতির সমূহ ক্ষতি হয়। যে ছোট সে যদি বড় গুরুর আসনে বসে, তাতে আনন্দ ছাড়া নিরানন্দের কোনোই কারণ নাই।
শেক্সপীয়ার ছোট-ঘরের ছেলে ছিলেন। বেন জনসন, ওয়াট, জাসিয়া ওয়েজউড Josiah Wedgwood) নিম্নশ্রেণীর লোক হতে উদ্ভূত। বার্নস লাঙ্গল চষতেন। কীটসকে (Keats) ওষুধ বেচে জীবিকা অর্জন করতে হতো।
শুধু মুখের কথার মধ্যেই ভদ্রতা নিবদ্ধ নয়! ভদ্র ব্যক্তি সর্বদাই সহৃদয় ও স্নেহশীল। কাজেই তুমি সর্বদা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দাও, তোমার কথার কোনো মূল্যই নাই, স্বতন্ত্র হয়ে নিজের মতো নিজে বাস করাতেই তোমার আনন্দ হয়, প্রতিবেশী মারা গেলেও তুমি।
পণ্ডিত প্রবর কার্লাইল নিজেকে মিস্ত্রীর ছেলে বলে পরিচয় দিতে কোন দিন লজ্জা বোধ করেন নি বরং সে কথা বলতে তিনি বিচক্ষণ গৌরব অনুভব করতেন। মিস্ত্রীর ছেলে বলে কার্লাইলের বড় হবার পথে কোনো অন্তরায় আসে নাই।
ভদ্র যিনি তিনি সহজে ক্রুদ্ধ হন না, আঘাত পেলেও অনেক চিন্তা করে দেখেন, তাঁর কোনো অপরাধ হয়েছে কি না, মানুষকে ব্যথা দেওয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ। দুঃস্থ মানুষকে দেখলে তার মনে বেদনা উপস্থিত হয়। তিনি সাধ্যমত পীড়িতের বেদনা দূর করতে চেষ্টা করেন।
দ্র যিনি তার কথা বড় মধুর, প্রকৃতি অতি অমায়িক, ক্ষতি স্বীকার করেও নিজেদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেন। যিনি সত্যপ্রিয়, তার কথা ও কাজের মধ্যে কোনো ব্যবধান থাকে না। পরনিন্দা করা তাঁর পক্ষে খুব কঠিন। তিনি সাধ্যমত কারো কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করেন না।
সর্বদা প্রতিবেশী, বন্ধু ও আত্মীয় স্বজনের সংবাদ দেওয়া তার স্বভাব। খোদার উপর নির্ভর করা তাঁর অভ্যাস। মানুষের মন খুশি করবার জন্যে তিনি অন্যায় কথা বলেন না। সৎসাহস তার স্বভাবের ভূষণ। তিনি ভদ্রতা দেখাবার সময় জাতি বিচার করেন না।
তুমি যে জাতিই হও না, ভিন্ন জাতির লোকের প্রতি তোমাকে অভদ্র হতে হবে কেন? তোমার মনুষ্যত্ব তোমার জ্ঞান দেখেই মানুষ তোমার ধর্ম ও সমাজকে সম্মানের চোখে দেখবে।
হযরত মোহাম্মদ (স) যে এত মানুষকে মুসলমান করেছিলেন, সে কীসের বলে? তার মনুষ্যত্ব, তাঁর আশ্চর্য ভদ্রতা মানুষের মনকে মুগ্ধ করে দিত। বস্তুত হযরত মোহাম্মদের (স) জীবনে তাঁর ভদ্রতা ছিল আশ্চর্য জিনিস। তাঁর স্নেহ তার সহনগুণ, তাঁর স্বভাবের অনন্ত মাধুরী মানুষকে পাগল করে দিত।
শুধু মুখের কথার মধ্যেই ভদ্রতা নিবদ্ধ নয়! ভদ্র ব্যক্তি সর্বদাই সহৃদয় ও স্নেহশীল। কাজেই তুমি সর্বদা নিষ্ঠুরতার পরিচয় দাও, তোমার কথার কোনো মূল্যই নাই, স্বতন্ত্র হয়ে নিজের মতো নিজে বাস করাতেই তোমার আনন্দ হয়, প্রতিবেশী মারা গেলেও তুমি।
মানবজীবনে যতই দুঃখ-বেদনা থাক না, আনন্দের সঙ্গে তা বরণ করে নিতে হবে। মুখের হাসি চিত্তের স্ফুর্তি, সরল আলাপ, সকল বিপদ-আপদকে দূর করে দেয়। জীবনে নিরানন্দের কিছুই নাই-এ জীবন আনন্দ প্রবাহের একটা বিরাট বন্যা।জীবন-আকাশে মেঘের সঞ্চার হয়েছে, আল্লাহর নামে কেবল হাসতে থাক- ঐ মেঘ উড়ে যাবে।
সেদিকে ফিরে তাকাও না, তোমার ওষ্ঠের মৃদু-মধুর হাসি অভিবাদনের কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। বাইরেটা রূঢ় রেখেও যদি তোমার অন্তরের মানুষটিকে মধুর, সরল ও বিনয়ী করে তুলতে পারতে হবে তাই সুন্দর হতো।
কামান গোলা যত কিছুই আয়োজন কর না, তুমি তোমার জাতিকে পতন ও দুর্দশার হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে না। জাতির মনুষ্যত্বই তার সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি। যে জাতির মধ্যে নীচতা, হৃদয়হীনতা ও অজ্ঞানতা পরিপূর্ণ রকমে বিরাজ করছে, তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী।
মনুষ্যত্বকে যারা শ্রদ্ধা করতে শেখে নাই, তাদের স্বাধীনতা পাবার কোনো অধিকার নাই। মনুষ্যত্ব মানব জীবনের উচ্চাঙ্গের দ্রতা ছাড়া মূলত আর কিছুই নয়।
মানুষের প্রতি প্রেম, দেশের আর্ত-পীড়িতের প্রতি মায়া, অত্যাচারিত, ক্লিষ্ট মানুষের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি যার নাই, তিনি ভদ্রলোক নন। যে জাতির মধ্যে ভদ্রতা নাই, যারা পাপ ও অন্যায় করতে ব্যস্ত, তাদের বেঁচে থাকা না থাকা একই কথা।
জগতের এই যে কর্মব্যস্ততা, মানব-সুখের জন্য এই যে শত আয়োজন, এই যে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রচার, সবার উদ্দেশ্য জাতির প্রত্যেক মানুষকে ভদ্র ও মানুষ করে তোলা। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে তিনি ভদ্র। মানবের কল্যাণ হয় কীসে?
সত্য-সাধন নিয়ত মধুর বিনয়ী জীবনে। যে জীবনে ভদ্রতার পরশ নাই, সে যতই কোনো ধর্ম-কাজ করুক না, তার মূল্য খুব কম। সেই ব্যক্তিরই ধার্মিক বলে পরিচয় দেবার অধিকার আছে, যার অন্তর-বাহিরে ভদ্র, সুন্দর ও সত্য।
মানুষকে কোনো বিশেষ ধর্ম গ্রহণ করার জন্যে আহ্বান করে বিশেষ কোনো লাভ আছে কি না, ঠিক বুঝতে পারি না। মানুষকে সুন্দর, মহৎ ও প্রেমিক হতে বলাই বোধ হয় শ্রেষ্ঠ ধর্মপ্রচারকের কাজ।
যে দুঃখ করে, যে ভয় করে, যে অনবরত হায় হায় করতে থাকে, তার অভিশপ্ত জীবন জগতে দুঃখ বর্ধন করে!
যদি পাপ-অন্যায়ে জীবন কলঙ্কিত হয়ে থাকে, যদি কারো প্রতি কোনো অবিচার করে থাকে, যদি সত্য পালন করতে পরাজিত হয়ে থাকে, তা হলেই তোমার দুঃখ হতে পারে! আর কোনো কারণেই তোমার মুখ ভার করবার দরকার নাই।
অনন্ত মানুষকে নত মাথায় নমস্কার করে হাসি ও গানের আনন্দে তুমি জীবনপথে অগ্রসর হও। হিংসা পরশ্রীকাতরতা, অহঙ্কার তোমার ভিতর হতে দূর হোক। মানুষের বুকের সঙ্গে বুক লাগিয়ে প্রেম ও পুণ্যের গান গাও।
মানবজীবনে যতই দুঃখ-বেদনা থাক না, আনন্দের সঙ্গে তা বরণ করে নিতে হবে। মুখের হাসি চিত্তের স্ফুর্তি, সরল আলাপ, সকল বিপদ-আপদকে দূর করে দেয়। জীবনে নিরানন্দের কিছুই নাই-এ জীবন আনন্দ প্রবাহের একটা বিরাট বন্যা।জীবন-আকাশে মেঘের সঞ্চার হয়েছে, আল্লাহর নামে কেবল হাসতে থাক- ঐ মেঘ উড়ে যাবে।
(চলবে…)
<<কাজ : পর্ব চার ।। ভদ্রতা : দুই>>
………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………….
আরও পড়ুন-
দর্শনের ইতিহাস বিচার
আইয়োনীয় দর্শন
টোটেম বিশ্বাস
নির্ধারণবাদ
বিতণ্ডাবাদী
অতীন্দ্রিয় রহস্যবাদ
জনগণের দর্শন ও বস্তুবাদী দর্শন
লোকায়ত ও সাংখ্য
লোকায়ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া
প্রকৃতিবাদী দার্শনিকবৃন্দ
………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই
……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা
……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত