দৈনন্দিন জীবন
-লুৎফর রহমান
জীবনের প্রতিদিন আমরা কত মিথ্যাই না করি, সেজন্যে আমাদের অন্তর মানুষ লজ্জিত হয় না। আল্লাহর কালাম পাঠ করি, কিন্তু সে কালাম আমাদের প্রতারণা, মিথ্যা ও অন্যায় হতে রক্ষা করে না।
পুটার্ক (Plutarch) বলেছেন, যে বড় যুদ্ধে জয় লাভ করে, তার মনুষ্যত্ব সূচিত হয় না। প্রতিদিনের ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ব্যবহার, হাসি-রহস্য একটুখানি সহৃদয়তা, একটা স্নেহের বাক্যে মানুষের মনুষ্যত্ব সূচিত হয়। যে মানুষ জীবনে এক একটা দিন নিষ্ঠুর বাক্য, মানুষের সঙ্গে মিথ্যা ব্যবহার এবং প্রতারণা থেকে মুক্ত করে রাখতে পারবে জীবন শেষে সে দেখতে পারবে, সে তার জীবনকে সার্থক করেছে।
প্রতিদিনকার জীবন যার নিষ্ঠুরতা, মিথ্যা ও প্রতারণায় ভরা-তার সমস্ত জীবনটাই একটা ভাঙ্গা ঘরের মতো অন্তঃসারশূন্য। প্রাতঃকালে উঠেই প্রতিজ্ঞা কর, “আজিকার দিনটা সফল ও সার্থক করবো! আমার আজিকার এই দিনের কার্যে যেন মানব সমাজ উপকৃত হয়। যার সঙ্গে কথা বলি, তাকেই যেন আনন্দ দিতে পারি, যেন কোনো কার্যে কাপুরুষ না হই। যেন এর প্রতিমুহূর্ত আমার জীবনে সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায়।”
কত পাপ, কত অন্যায়, কত প্রকার হীনতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে অপবিত্র করে, আমাদের আত্মাকে কতখানি মলিন করে। দিনের মধ্যে কতবার আমরা মিথ্যা পক্ষ সমর্থন করি। দিনের প্রভাতে উঠে আমরা দেখতে পাই উদার, নীল গগন শী- কী সুন্দর! কী শোভাময়! তারপর পূর্বাকাশের নির্মল প্রভাত ছবি- গাছে গাছে স্বর্গের কী মোহন মাধুরী! বিশ্বময় নির্মলের দেবতাকে একবার প্রণাম কর-তারপর মানুষের মুখের দিকে চেয়ে দেখ।
যত প্রকার পাপ আছে, মানুষের চিত্তে ব্যথা দেওয়াই তার মাঝে বড় পাপ। এ মহাপাপ কেউ করো না! ক্ষমতা এবং বাহুর গর্বে, জনবলের গর্বে মানুষের মুখের দিকে চেয়ে কঠিন কথা বলো না। সরে এস, ভীত হও।
এমন সুন্দর আলো-বাতাস প্রবাহে, এমন সুন্দর বিধাতার আশীর্বাদ ঐশ্বর্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে, হে মানুষ- সর্ব পাপমুক্ত হবার দুর্জয় প্রতিজ্ঞা কর। বিধাতার জড়সৃষ্টির মত তুমি নির্মল হও।
প্রভাতে উঠেই কী ভাবছ?- হিংসা প্রতিশোধের বিষ তোমার নির্মল আত্মাকে বিষাক্ত, অপবিত্র করে দিচ্ছে? সতর্ক হও, কী চিন্তা করছ? কার ক্ষতির চিন্তা মনে জেগেছে? কার পানে মন তোমার নিষ্ঠুর বিরূপতায় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে? ক্ষান্ত হও! মানুষকে প্রেম করতে শেখ।
ঘর হতে বের হয়ে যাও। পথে পথে মানুষের সুন্দর, শুভ মুখ দেখে জীবন সার্থক কর- মনুষ্যকে আলিঙ্গন কর।
মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করো না-এই মহাপাপ হতে সরে এস, মানুষের সঙ্গে শঠতা করো না, মনুষ্যকে গালি দিও না। সর্ব প্রকারেই জীবনকে সফল ও সুন্দর করে তুলতে চেষ্টা কর। মানুষকে চিনি না এ কথা কাউকে বলো না।
আত্মার প্রেমকে সার্থক করবার জন্যে,- মনুষ্য জীবনের দানকে সার্থক করবার জন্যেই রত্ন সংগ্রহে দিকে দিকে ছুট। মনুষ্যকে পূর্ণ করবার জন্যে নিজের পরিবারের সুখের জন্যে, মানুষের ধনরত্ন কেড়ে এনে বাক্সজাত করো না। মনুষ্য যে তোমার ভাই, এ কথা কি তুমি জান না?
তোমার আত্মসর্বস্ব জীবনের কথা ভেবে তুমি লজ্জিত হও। মানুষ নিজের জন্য বেঁচে নেই। অনেক টাকা-কড়ি উপায় করছ, আরও টাকার জন্য ব্যস্ত হয়েছ? এই টাকা-কড়ি আহরণ করার অন্তরালে কী উদ্দেশ্য তোমার আছে! তোমার সমস্ত জীবন-স্পন্দনের মাঝে দাঁড়িয়ে যে সমস্ত মহাপুরুষ অদৃশ্যভাবে তোমার জীবনকে পরিচালিত করেছেন, তাঁরা মানবজীবন সম্বন্ধে কী বলেছেন?
মানুষ কি বেঁচে আছে নিজের জন্যে?- মানুষের নিজের অভাব কতটুকু? আর জগতে রাজা হয়েই বা কী লাভ?- অপরিসীম প্রতিপত্তি লাভ করেই বা কী এমন লাভ আছে, যদি না দুর্বলের পার্শ্বে যেয়ে দাঁড়াও? যদি না মানব-দুঃখ তোমাকে ব্যথিত করে?-
মানব সেবার জন্যে যদি না তুমি তোমার সমস্ত ধন-সম্পদ, সমস্ত জ্ঞান ও শক্তি নিয়ে অগ্রসর হও? কী লাভ হবে বড়লোক হয়ে?- কতদিন মানুষ তোমার নাম করবে? তোমার চাইতে অনেক শ্রেষ্ঠ সম্পদশালী মানুষ মাটির ধূলার সঙ্গে মিশে গেছে। তুমি কোন ছার!
মন যার পাষাণ, মানুষকে শুধু উপদেশ দিয়েই যে কর্তব্য শেষ করে, প্রেমে অগ্রসর হয় না, দুর্বল, অপরাধীকে ক্ষমা করে না, সে মানুষ নহে।
এ শিক্ষা মনুষ্য কোনো পুস্তক, কোনো বক্তৃতা হতে পায় নাই, এ শিক্ষা, এ প্রেমের শিক্ষা মানুষ আপনা আত্মা হতেই পেয়েছে। সমস্ত ধন-সম্পদ দিয়ে তোমার আত্মার প্রেমকে সার্থক করতে হবে। পশুর মত আপন বিবরে প্রবেশ করো না- মানুষের কথা ভাব- মানুষের প্রতি তোমার কর্তব্য আছে। এই কর্তব্য উদযাপনের নাম এবাদত, তা শুধু প্রাণহীন আবৃত্তি নয়।
দুঃখের সামনে, ব্যথার সামনে, নিষ্ঠুর পাষাণের মতো স্থির হয়ে থেকো না। মানব দুঃখের সম্মুখে আপন পত্নীর প্রেমে পূর্ণ থেকো না। অবিচারের সম্মুখে আপন পুত্রের মুখে চুম্বন দিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করো না।
ধর্মগ্রন্থ তোমায় কী দীক্ষা দিয়েছে? ইঞ্জিল, জব্দুর, তৌরাত, কোরান এবং পবিত্র হাদীস সমষ্টি কী শিক্ষা তোমায় দিয়েছে? তোমাকে স্নেহশীল, প্রেমিক হতে বলে নি? কতবার কতভাবে তোমাকে বলেছে, হে মানুষ, প্রেমিক হও, পাষাণ হয়ো না।
আত্মার প্রেমকে সার্থক করবার জন্যে,- মনুষ্য জীবনের দানকে সার্থক করবার জন্যেই রত্ন সংগ্রহে দিকে দিকে ছুট। মনুষ্যকে পূর্ণ করবার জন্যে নিজের পরিবারের সুখের জন্যে, মানুষের ধনরত্ন কেড়ে এনে বাক্সজাত করো না। মনুষ্য যে তোমার ভাই, এ কথা কি তুমি জান না?
এ কথা তো যুগে যুগে আল্লাহর বাণীরূপে তোমরা পেয়েছ, তবুও তা বিশ্বাস করো না? মনুষ্য সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে কি আনন্দ-রসে পূর্ণ হয়ে উঠতে পার না? তাকে কি কাছে বসাতে জান না? মনুষ্য হয়েও কেন মনুষ্যকে এত বিষ নয়নে দেখ?
সব ধর্মেরই সমস্ত মানব-চিত্তের ইহা অপেক্ষা পরম লাভ আর কি আছে? শুধু শয়তানের সঙ্গে বিরোধ কর। সকল জাতির মানুষ সমস্ত হানাহানি ত্যাগ কর, সর্ববিধ পাপ বর্জন কর। আত্মার পক্ষে যাহা কিছু অসম্মানজনক, তাহা ত্যাগ কর। এটাই পরম শান্তির পথ। মনুষ্যকে এই পরম শান্তির পথে আকর্ষণ কর, মানুষকে বিনষ্ট হতে দিও না। জীবনের সমস্ত সাধনা, শক্তি, ধন-সম্পদ এরই জন্যে, জীবনের আর কোনো সার্থকতা নাই
এই তোমার ধর্ম?- যাও, ফিরে যাও। ভালো করে চিন্তা কর, তোমার ধর্ম কী? মিথ্যা করে তাড়াতাড়ি চিন্তা করে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা করো না।
মনুষ্যকে প্রেম করাই আল্লাহর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। এ ছাড়া মনুষ্যের জন্যে দ্বিতীয় কোনো ধর্ম নাই। মনুষ্যকে প্রেম কর- মানুষের জন্য ত্যাগ স্বীকার কর। মনের হৃদয়ে ব্যথা অনুভব কর। পৃথিবীর দুঃখ তোমরা সকল ভাই সমান ভাগ করে নাও। মানব সমাজের জন্য জগৎ স্বর্গে পরিণত হোক- ধর্মের নামে মিথ্যাচরণ করো না।
দরিদ্র সন্তানের সম্মুখে নিজের সন্তানকে সজ্জাভূষিত করো না- এ নিষ্ঠুর কাজ। আবার বলি, মনুষ্যকে আত্মীয়ের চোখে, প্রেমের চোখে দেখ। পরিচিত বেগানার মতো মানুষের দিকে চেয়ে দেখ না। কীসের তোমরা গর্ব কর?- বংশ মর্যাদার? অর্থের? বেশ ভূষার? অট্টালিকার? জমিদারির? তোমরা জান না-মানুষ কীসের গর্ব করতে পারে!
তোমরা যে কত নত হয়েছ, সেই গর্ব কর, প্রেমের গর্ব কর, মনুষ্যত্বে পরস্পরের প্রতিযোগিতা কর। সেবার এবং ত্যাগের প্রতিযোগিতা কর। সত্য বলছি, যে নত হতে পেরেছে, সেই তত শ্রেষ্ঠ হতে পেরেছে। মানুষের চোখে সে তত বড় আসন লাভ করেছে।
হে ভণ্ডেরা, মোহাম্মদ (স) তোমার কাছে দরুদ চান নাই। আবার বলছি, তোমরা অযথা দরুদ পাঠ করো না। মোহাম্মদ (স) দেখতে চেয়েছেন যারা তাকে প্রেম করে, তারা মানব-প্রেমিক কিনা, তারা সর্বপ্রকার অহঙ্কার বর্জন করেছে কিনা, দিকে দিকে আল্লাহর বাক্য তারা বহন করেছে কিনা। হাত-পায়ে সাবান লাগাবার মসলা (ব্যবস্থা) তোমরা প্রচার করো না, এতে তিনি সত্যিই লজ্জিত হন। ইসলাম মানে এ নয়।
সত্য বলতে কী, সমস্ত মানব জাতির জন্য মাত্র একটি ধর্ম আছে, সমস্ত মানুষই মুসলমান হবার জন্য, পরম শান্তির জন্যে লালায়িত। মানুষের সঙ্গে মানুষের কোনো বিরোধ নেই, বিরোধ আছে শুধু শয়তানের এবং আল্লাহর। আমরা সবাই আল্লাহকে চাই,পরম শান্তি চাই, ইহাই ইসলাম, পরম শান্তি।
সব ধর্মেরই সমস্ত মানব-চিত্তের ইহা অপেক্ষা পরম লাভ আর কি আছে? শুধু শয়তানের সঙ্গে বিরোধ কর। সকল জাতির মানুষ সমস্ত হানাহানি ত্যাগ কর, সর্ববিধ পাপ বর্জন কর। আত্মার পক্ষে যাহা কিছু অসম্মানজনক, তাহা ত্যাগ কর। এটাই পরম শান্তির পথ। মনুষ্যকে এই পরম শান্তির পথে আকর্ষণ কর, মানুষকে বিনষ্ট হতে দিও না। জীবনের সমস্ত সাধনা, শক্তি, ধন-সম্পদ এরই জন্যে, জীবনের আর কোনো সার্থকতা নাই।
(চলবে…)
<<শয়তান ।। সংস্কার মানুষের অন্তরে>>
………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত
………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই
……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা