জীবনের মহত্ত্ব
-লুৎফর রহমান
প্রায় ৩২ বৎসর আগে খুলনার এক স্টীমার থেকে একজন বুড়ো আর একটি ছোট মেয়ে নামলেন। ঠিক তাদের সঙ্গে একটি যুবক অবতরণ করলেন। যুবকটি খুব সম্ভব বাগেরহাটের উকিল, সবে বারে যোগ দিয়েছেন।
বুড়ো দুর্বল, কুঁজো হয়ে হাঁটছিলেন। একটু পথ হেঁটে আর একখানি স্টীমারে চড়তে হবে, বালির চরায় নদী ভরাট হয়ে গেছে, তাই স্টীমার কোম্পানী দু’ধারে দু’খানা স্টীমারের ব্যবস্থা করেছেন। ৮/৯ বৎসরের ছোট্ট মেয়েটি একটা বৃহৎ বোঝা এক হাত দিয়ে পিঠে তুলে নিচ্ছিল অন্য হাত দিয়ে বুড়োর দুর্বল হাত চেপে ধরেছিল।
বুড়ো সস্নেহে বলছিলেন, “তুই কি অত বড় বোঝা নিতে পারবি, আমায় দে।”
মেয়ে ততোধিক স্নেহে বলছিল, “দাদা, তুমি দুর্বল, হাঁটতে পারছ না, তোমাকে আমি শক্ত করে ধরছি। এ বোঝাটা তুমি নিতে পারবে না, আমিই বেশ পারব।” বোঝার ভারে মেয়েটি কাঁপছিল, কিন্তু স্নেহ প্রদর্শনে তার ক্লান্তি নেই।
এই স্বর্গীয় দৃশ্যটি যুবক চেয়ে দেখলেন, তারপর নিকটে এসে বললেন, “মা লক্ষ্মী, দেখ, আমার গায়ে অনেক বল আমার হাতে ঐ বোঝাটি দাও; আমি বয়ে নিয়ে দেবো, তুমি তোমার দাদার হাতখানি শক্ত করে ধর।”
মেয়েটি যুবকের দিকে সকরুণ নেত্রে চেয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। যুবক তৎক্ষণাৎ ভারী বোঝাটা দৃঢ়-বাহুর একটানে পিঠের উপর ফেলে চলতে লাগলেন। বুড়ো যুবককে প্রাণভরে দোয়া করলেন।
আলী নামক এক পুলিশ কর্মচারী একদা এক রেল স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, এক অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা স্টেশনে কাউন্টারের কাছে এসে খুব ব্যস্ততার সঙ্গে টিকেট চাইল। স্টেশন মাস্টার বললেন, এখানে অপেক্ষা করুন, রাত্রিকালে গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে যাবেন।
জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজে আমরা যে দয়া ও মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারি, তা একটা সুবর্ণ মুদ্রার মতোই মূল্যবান এবং উজ্জ্বল! তা একেবারে খাঁটি সোনা- আঘাত করলে তার মাঝে একটুখানিও নকল পাওয়া যায় না।
কৃপণ জীবন ভরে এক একটা মুদ্রা প্রাণের রক্তের মতো সঞ্চয় করে। আমরা কি সুন্দর সুন্দর মহৎ কাজ করে, কৃপণের মতো জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজের সুবর্ণ মুদ্রাগুলি সঞ্চয় করতে পারি না? তাতে যে আমাদের জীবনের মূল্য কত বেড়ে যাবে?পার্থিব ধন-সম্পদ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বিনষ্ট হবে।
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মহৎ কাজগুলি যেমন আমাদের চিত্তকে প্রসন্ন করে, তেমনি অক্ষয় সুবর্ণরেখার মতো চিরদিন মনুষ্য আত্মাকে সম্পদশালী করে।
পুলিশের নাম শুনলে মানুষ বিরক্ত হয়, থানা-ঘর দেখলেই সেইখান থেকে মুখ ফিরিয়ে মানুষ ঘৃণায় সরে যায়। মানুষ থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করছে, কিন্তু যে স্থানে পীড়িত মানুষ নিজের মর্মব্যথা নিবেদন করে, যেখানে অত্যাচারিত দীন-দুঃখী আশ্রয় পায়, সেই স্থান কি সত্যই অপবিত্র?
মানুষ নিজের দোষে থানা-ঘরের মর্যাদা নষ্ট করেছে। পবিত্র বিচারস্থানের মূল্য এবং মর্যাদা প্রকৃত খোদাভক্ত এবং ধার্মিক লোকদের কাছে চিরদিনই অক্ষুণ্ণ থাকবে- তারা থানা-ঘরের সংস্রবেই বা বাইরের লোকই হন।
আলী নামক এক পুলিশ কর্মচারী একদা এক রেল স্টেশনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেলেন, এক অনিন্দ্যসুন্দরী মহিলা স্টেশনে কাউন্টারের কাছে এসে খুব ব্যস্ততার সঙ্গে টিকেট চাইল। স্টেশন মাস্টার বললেন, এখানে অপেক্ষা করুন, রাত্রিকালে গাড়ি আসবে, সেই গাড়িতে যাবেন।
এর কয়েক দিন পরেই ভদ্রমহিলার স্বামী ‘বেঙ্গল’ পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধে এই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাটি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, সহৃদয় পুলিশ যুবকটির সাহায্য না পেলে তার যে কী বিপদ হত, তা চিন্তা করাও কঠিন।
যুবক দেখলেন- মাস্টারের ব্যবহার সন্দেহজনক। মহিলাটি ভদ্রঘরের বলেই মনে হয়; মাস্টারের কথায় সন্দেহ করে মহিলাটি আর বিলম্ব না করে বিনা টিকেটেই গাড়িতে উঠে পড়ল। পুলিশ যুবকটিও তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মহিলাটির উপর রেখে মহিলার গাড়িতেই এক প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলেন।
তারপর গাড়ি ছেড়ে দিল। মাহিলাটির হাতে একটা পোটলা ছিল, খুব সম্ভব তাতে কতকগুলি দামি গহনা ছিল। পুলিশ যুবকটি তাকে লক্ষ্য করে বসেই আছেন। ২/৪ স্টেশন যেতেই একটা লোক হঠাৎ গাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে মহিলার সঙ্গে ভারি আলাপ শুরু করে দিলো।
এমন কি কয়েক মিনিটের আলাপে মহিলাটি যে তার অনেক জন্মের মা, এই কথা প্রকাশ করে ফেলল। পুলিশ-যুবক লোকটির সব কথা লক্ষ্য করেছেন। তারপর এক স্টেশনে এসে লোকটি মহিলাটিকে লক্ষ্য করে বলল, “আপনি যেখানে যাবেন, আমিও সেখানে যাব।
আজ গরিব সন্তানের বাড়িতে বিশ্রাম করুন, কাল আপনাকে একেবারে নিজে গিয়ে বাসায় রেখে আসব।” ভদ্রমহিলা হচ্ছেন এক উঁকিলের বউ, শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া করে রাগের মাথায় এক কাপড়ে স্বামীর কাছে যাবে বলে বেরিয়ে এসেছে; বেরিয়ে যখন পড়েছে তখন আর উপায় নাই।
পথে এসে অন্তরে তার বিলক্ষণ ভয় হয়েছে। লোকটির কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে, সেখানেই নেমে পড়ল, পুলিশ-যুবকটিও সেখানে নেমে পড়লেন। নেমে পড়েই তিনি মহিলাটিকে আটকে রাখবার জন্যে টিকেট কলেকটরকে বললেন, “এই মহিলাটির কাছে টিকেট নাই, একে আটক করুন।”
জুয়াচোর লোকটি তাকে মহাবিপদে ফেলবার চেষ্টা করছিলো তা সে বুঝতে না পেরে কাঁদতে লাগল। সেই বদমায়েশ লোকটি ইত্যবসরে সরে পড়েছিল। মহিলাটি তখন আরও বেশি করে হাউ-মাউ করে কাঁদতে লাগল। পুলিশ যুবক তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “আপনার কোনো ভয় নাই।”
তার স্বামীর ঠিকানা জিজ্ঞাসা করে, যুবক তৎক্ষণাৎ সেখানে একটি টেলিগ্রাম করে দিলেন। তারপর মহিলাটিকে গার্ড সাহেবের জিম্মা করে বললেন, “এর জন্যে আপনি দায়ী, কোনো বিপদ হলে আপনাকে সেজন্য জবাবদিহি করতে হবে।”
গন্তব্যস্থানের স্টেশন মাস্টারের কাছেও তিনি একটা তার করে দিলেন, মাহিলাটিকে যেন সযতে স্টেশনে অপেক্ষা করবার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয় এবং তার স্বামী উপস্থিত না হওয়া পর্যন্ত যেন তিনি তাকে আপন হেফাজতে রেখে দেন।
এর কয়েক দিন পরেই ভদ্রমহিলার স্বামী ‘বেঙ্গল’ পত্রিকায় এক দীর্ঘ প্রবন্ধে এই কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনাটি প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছিলেন, সহৃদয় পুলিশ যুবকটির সাহায্য না পেলে তার যে কী বিপদ হত, তা চিন্তা করাও কঠিন।
অনেক বছর আগে একদা চুয়াডাঙ্গা হতে ঝিনাইদহ মহকুমা পর্যন্ত যে রাস্তা এসেছে, ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। তখন হেঁটে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। রাস্তা দীর্ঘ ৪০ মাইল। পথের মাঝখানে একটা পুকুরের ধারে বসে এক কৃষককে বিড়ি খেতে দিয়েছিলাম। তখন আমার বাল্যকালের ধূমপানের কুঅভ্যাসটি ছিল।
মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের পরিচয় দেবার সুযোগ পুলিশ কর্মচারীদের যেমন আছে তেমন আর কারো নাই।
দুর্বলের যারা রক্ষক, ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্যে যাদের জীবন, তারা কি লোভের সম্মুখে বিচলিত হবেন? শুধু অবস্থা ভালো করে কি হবে? মনুষ্যত্বের কাছে আর কি অধিকতর গৌরবের বিষয় আছে?
কয়েক বৎসর আগে একজন লোককে একটা জাল টাকা নিয়ে কলিকাতার এক মিঠাইওয়ালার দোকানে গিয়ে কিছু মিঠাই চাইতে দেখেছিলাম। দোকানদার মিষ্টান্নগুলি একটা পাতায় বেঁধে লোকটির হাতে দিয়েছে, আর ডান হাতে টাকা ধরেই চিৎকার করে বলে উঠল- শয়তান!
পাজী’- আরও অনেক অশ্লীল ভাষায় সে গাল দিল। গোলমাল শুনে,আমি এগিয়ে গিয়ে শুনতে পেলাম, পথিক সবিনয়ে বলছে, “ওটি জাল টাকা তা আমি জানি নে, তুমি মাফ কর। আমার কাছে আর পয়সা নাই। তোমার মিঠাই তুমি ফিরিয়ে নাও।”
মিঠাইওয়ালা বললে, “তোমার ছোঁয়া জিনিস আর ফিরিয়ে নেবো না- পয়সা ফেলো, নইলে জুতো খাবে।” পথিক ভারি অপ্রস্তুত হল! তার হাতে সত্য সত্যই আর পয়সা ছিল না। টাকাটি জাল তা পথিক জানত বলেই মনে হল, অভাবগ্রস্ত বলে ক্ষুধায় কাতর হয়ে মিঠাইওয়ালাকে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল।
তার চোখে-মুখে অপরাধীর দীনতা, আমি দেখতে পেলাম। এমন সময় হঠাৎ একটি ভদ্রলোক এসে তার পকেট হতে পয়সা তুলে মিঠাইওয়ালার দাম চুকিয়ে দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে সে স্থান ত্যাগ করলেন। অপরাধী লোক। তার আন্তরিক কমতোজ্ঞতা কিছুতেই চেপে রাখতে পারল না;
সে ভদ্রলোকের পেছনে পেছনে ছুটল, আমিও তার পেছনে পেছনে চলোম- লোকটি কী বলে, আর ভদ্রলোকই বা কী বলেন, তাই শোনার জন্যে।
অনেক দূর দৌড়িয়ে গিয়ে ভদ্রলোকটির সম্মুখে দাঁড়ালাম। অপরাধী পথিকটি তখনও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করছিল। আমি দেখলাম সেই ভদ্রলোকের মুখে খোদার জ্যোতি। খোদাকে চোখে দেখি নাই, কিন্তু মানুষের মুখে তার ছায়া দেখলাম।
নিম্নস্তরের লোক, যাদের কৃষক বলে অবজ্ঞা করি, তাদের ভিতর খোদায়ি (Divine) ভাব কেমনভাবে ফুটে উঠে, তা নিম্নলিখিত আর একটি ঘটনায় বেশ জানা যাবে।
অনেক বছর আগে একদা চুয়াডাঙ্গা হতে ঝিনাইদহ মহকুমা পর্যন্ত যে রাস্তা এসেছে, ঐ রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছিলাম। তখন হেঁটে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। রাস্তা দীর্ঘ ৪০ মাইল। পথের মাঝখানে একটা পুকুরের ধারে বসে এক কৃষককে বিড়ি খেতে দিয়েছিলাম। তখন আমার বাল্যকালের ধূমপানের কুঅভ্যাসটি ছিল।
এক দু’বছর পর আর একদিন আমি চুয়াডাঙ্গা হতে রওয়ানা হই। রাস্তা অতিশয় বিপজ্জনক- দুই ধারে বিরাট মাঠ। ১৬ মাইল আসার পর সন্ধ্যা হয়ে গেল, পাগুলিও অবশ হয়ে এসেছিল; কোথাও আশ্রয় চাইবার অভ্যাস আমার ছিল না। এদিকে ওদিকে না চেয়ে অতিকষ্টে অগ্রসর হতে লাগলাম।
সে বললে, “আচ্ছা, তা হলে নিকটেই এক বাজার আছে, সেখানে কোনো দোকান ঘরে আপনাকে শুয়ে রেখে দি, প্রাতে উঠে চলে যাবেন।” আমি দ্বিরুক্তি না করে ফিরলাম। কিছু দূরে হেঁটেই একটা বাজার পাওয়া গেল। বাজারের সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
ক্রমে রাত্রি অনেক হল, আমিও আর পথ চলতে পারি না। যতই অগ্রসর হই পথ ততই দীর্ঘ বলে মনে হতে লাগল। ঝিনাইদহের প্রায় ৬ মাইল দূরে যখন এসে পৌঁছলাম, তখন দুই ধারে বিরাট দৈত্যাকার গাছের সারি- মনে হতে লাগলো, গাছের ডালে ডালে ভূতেরা সব হেসে বেড়াচ্ছে, জনমানবশূন্য রাস্তা। চাঁদের আলো ঘনসন্নিবিষ্ট গাছের ভিতর দিয়ে অস্পষ্টভাবে এখানে-ওখানে উঁকি মারছিল।
পা আর চলে না, তবুও এগোচ্ছিলাম, কারণ তখন আর কোনো উপায় ছিল না। ভয় যা হচ্ছিল, তো খোদাই জানেন। এর উপর সম্মুখে রাস্তার পার্শ্বে গভর্নমেন্টের মরা কাটবার (Post mortem) ঘর।
এমন সময় দেখতে পেলাম, দুটি লোক অপর দিক থেকে আসছে। ভাবলাম এরা এখনই আমায় অতিক্রম করে চলে যাবে। আমি যে অবস্থায় আছি, সেভাবেই এগোতে হবে। আর উপায় কী?
একজন জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কে?” আমি উদাসীনভাবে বললাম- ”পথিক!” পা টেনে টেনে হাঁটছিলাম, তা সে লক্ষ্য করেছিল। বললে, “এত রাতে একা একা- এখনও অনেক পথ বাকি।”
আমি ভীতকণ্ঠে বললাম, “তা হলে, আর কী করি? কোনো উপায় দেখি না”।
এমন সময় লোকটি বললে, “আমি তো আপনাকে চিনি, (কী একটা স্থানের নাম করে সে বলল) দু’বছর আগে আপনি অমুক স্থানে আমাকে বিড়ি খেতে দিয়েছিলেন- কেমন, না?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ!” একটা বন্ধুর দেখা পেয়েছি বলে আমার মনটি একটু আশান্বিত হয়ে উঠলো।
সে বললো, “চলুন, নিকটেই রাস্তার ধারে বাড়ি। রাত্রিতে আমার বাড়ি থাকবেন। ভোরে উঠেই রওয়ানা হবেন। কী মহাবিপদ আপনার যে, এ অবস্থায় এই রাত্রিতে আপনি একা এতদূরে চলেছেন।” আমি লমিতো হয়ে বললাম, “আমার হাঁটবার ক্ষমতা নেই; বেশি দূরে হলে কী করে যাবো?”
সে বললে, “আচ্ছা, তা হলে নিকটেই এক বাজার আছে, সেখানে কোনো দোকান ঘরে আপনাকে শুয়ে রেখে দি, প্রাতে উঠে চলে যাবেন।” আমি দ্বিরুক্তি না করে ফিরলাম। কিছু দূরে হেঁটেই একটা বাজার পাওয়া গেল। বাজারের সবাই দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
মৃমতো মধ্যম ভ্রাতার পুত্রকে তিনি আপন অর্জিত ভূসম্পত্তির শ্রেষ্ঠ অংশ দান করে যান। আপন পুত্রদ্বয়কে সংসারের জমান টাকার কিছুই দেন নাই, স্থাবর সম্পত্তির অতি সামান্য অংশই এরা পেয়েছিল। এই উদার হৃদয় ব্যক্তি নিরক্ষর ছিলেন; তার ত্যাগ ও মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকদেরও বিস্ময় উৎপাদন করে।
কৃষক প্রত্যেক দোকানীকে আমার কথা জানিয়ে আশ্রয় চাইল। কেউ অপরিচিত লোককে স্থান দিতে স্বীকৃত হল না। অগত্যা কৃষক বন্ধুটি আশ্বাস দিয়ে বললে, “অনেক দূরে হেঁটে এসেছেন, আর কিছুদূর গেলেই আমার বাড়ি। একটু কষ্ট করে আস্তে আস্তে চলুন।” অগত্যা স্বীকৃত হলাম।
অনেক কষ্টে তার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হলাম। সে আমায় অতি উত্তম খাদ্যসামগ্রী দিয়ে আহার করালে এবং উৎকৃষ্ট বিছানা দিয়ে আমাকে শুয়ে রাখলে। এই কৃষকের কথা যতবারই ভাবি, ততবারই আমার মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।
ভাবি, তার সঙ্গে আর কোনো দিনও দেখা হবে না, তার কোনো উপকার করি নাই। নিঃস্বার্থ প্রেমের পরিচয় মানুষ খোদার ভাবে অভিভূত হয়েই দেয়।
মানুষের একদিক পশুর অন্যদিক তার খোদাময় প্রভাত-সৌন্দর্যের মতো নির্মল, মধুর জননীর বুকের মতো সরল। খোদায়ীভাবে মনুষ্য মনুষ্যের নমস্য।
নিরক্ষর মানুষের মধ্যে আমরা অনেক সময় আশ্চর্য ত্যাগ ও মহত্ত্বের পরিচয় পাই, সেরূপ মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকেরাও দেখাতে পারেন না। আমরা এখানে পল্লীগ্রামের একটা সামান্য মানুষের দৃষ্টান্ত দিতে চাই যার হৃদয়ের বিশালতা অনেক মানুষের ঈর্ষার বিষয় হতে পারে।
মাগুরা মহকুমার হাজীপুরের জরদার বংশের তমিজুদ্দীন জরদার নিজ জীবনে প্রায় ৮ হাজার টাকার সম্পত্তি ক্রয় করেন। এর মধ্যম ভ্রাতা তার একমাত্র শিশুপুত্রকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা তমিজুদ্দীনের হাতে সমর্পণ করে এর পূর্বেই অকালে প্রাণ ত্যাগ করেন। তমিজুদ্দীনের আর একটি ভ্রাতা ছিলেন তিনি সর্বকনিষ্ঠ।
জীবনের সঞ্চিত সমস্ত ধনই এই কনিষ্ঠ ভ্রাতার হাতে তিনি রাখতেন এবং তার হাত থেকে খরচ হত। তমিজুদ্দীন ভ্রাতাকে এতই স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন যে, তিনি খরচের বা রাশি রাশি জমান টাকার কোনো হিসাবই রাখতেন না। এত করেও তমিজুদ্দীন শেষ জীবনে নিঃস্ব অবস্থায়, বিনা চিকিৎসায় প্রাণত্যাগ করেন।
মৃমতো মধ্যম ভ্রাতার পুত্রকে তিনি আপন অর্জিত ভূসম্পত্তির শ্রেষ্ঠ অংশ দান করে যান। আপন পুত্রদ্বয়কে সংসারের জমান টাকার কিছুই দেন নাই, স্থাবর সম্পত্তির অতি সামান্য অংশই এরা পেয়েছিল। এই উদার হৃদয় ব্যক্তি নিরক্ষর ছিলেন; তার ত্যাগ ও মহত্ত্ব শিক্ষিত লোকদেরও বিস্ময় উৎপাদন করে।
মনুষ্য যখন মহত্ত্বের পরিচয় দেয়, তখন আর সে মানুষ থাকে না। তখন খোদায়ি ভাব তার মাঝে প্রকাশ পায়। জগতের সমস্ত হীনতা অতিক্রম করে মানুষ তখন মহাগৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হয়।
(চলবে…)
<<সংস্কার মানুষের অন্তরে ।। স্বভাব-গঠন>>
………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত
………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই
……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা