ভবঘুরেকথা
ভক্তের প্রকার ভক্তি ভক্ত

মহৎ জীবন : পর্ব দুই

-লুৎফর রহমান

একটা রমণী কী একটা কাজে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বালকের রোদন শুনতে পেলেন। নারীর প্রাণ-স্নেহ মমতায় ভরা। রমণী বালকের নিকটে এসে স্নেহের স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা তোমার কী হয়েছে? বালক মায়ের মতোই এক নারীমূর্তিকে দেখে কথা বলতে সাহস পেলো।

সে বললো- মা, তোমার মতনই বাড়িতে আমার এক মা আছেন। তাঁর কথার অবাধ্য হয়ে আমি পালিয়ে এসেছিলাম, এখন বিপদের একশেষ। হয়েছে। শীতের দিনে গায়ে কাপড়-চোপড় নাই, গায়ে জ্বর এসেছে, অজানা-অচেনা দেশ, কোথায় যাই। মায়ের অবাধ্য হয়ে এখন আমাকে পথে পড়ে মরতে হল।

নারী বললেন, তোমার কেউ না থাকুক, আমি আছি। আমি তোমার মা। চল আমার সঙ্গে, বেশি দূর নয়। কাছেই আমার বাড়ি।

বালক- মা, আমার তো উঠবার সাধ্য নাই, হাত-পাগুলি হিম হয়ে ভেঙ্গে আসছে।

আচ্ছা, তা হলে আমার কোলে এসো, এই বলে রমণী বালককে কোলে তুলে নিলেন। বালককে বুকে নিয়ে নানা সান্ত্বনার কথা বলতে বলতে রমণী বাড়িতে এলেন। ঘরের মেঝেয় বিছানা পেতে সেখানে বালককে শোয়ালেন। সে রাত্রিতে আর তার খাওয়া হলো না- সারা রাত্রি বালকের বিছানার পাশে বসে রইলেন।

তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি পড়ছিল। আহা! কার এ ব্যথার ধন। এই অজানা দেশে পথে পড়ে মরছিলো। ভাগ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, এর কী অবস্থা হতো?

পরদিন রমণী নিজের খরচে ডাক্তার ডাকলেন। অনেক সেবা-শুশ্রূষায় অবশেষে। বালক বেঁচে উঠলো। রমণীটিও আনন্দে ভাবলেন আমার কষ্ট স্বীকার সার্থক হল। এখন মায়ের ছেলে মায়ের কোলে ফিরে যাক।

আরও কয়েকদিন পরে রমণীটি বালককে কিছু রাস্তা খরচ আর একখানা নূতন কাপড় দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে প্রস্তুত হলেন। প্রাণের কৃতজ্ঞতায় চোখের পানিতে রমণীর আঁচল ভিজিয়ে বালক বাড়ির পথে রওয়ানা হলো।

ভদ্রলোকের প্রাণের প্রশংসা না করে পারি না। তার নির্মল সুন্দর আত্মাটি ভক্তি পাবার যোগ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা প্রশ্নের উদয় হয়। তার এই দান সত্যই কি মানবজাতির অনুকরণের জিনিস? আমার মন ভয়ে সঙ্কোচে উত্তর দেয়-না।

ব্যথিত বিপন্ন মানুষকে যে একটা স্নেহের কথা বলেছে, সেই মহত্ত্বের পরিচয় দিয়েছে। মানুষ যখন বিপন্ন হয়ে পড়ে, যখন রোগযন্ত্রণায় তার শরীর ভেঙ্গে আসে, যখন সে মরণ পথের যাত্রী, তখন তার সেবাশুশ্রূষা করাতে যথার্থ মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া হয়। বিপন্ন।

ব্যক্তি পরিচিতই হউক আর অপরিচিতই হউক, তাকে আপন বলে বুকে টেনে নিতে হবে। মানুষ মাত্রই মানুষের আত্মীয়- এ যে মনে করতে পারে তার ধর্ম বিশ্বাসের মূল্য খুব বেশি।

সারা পৃথিবীর বিপন্ন মানুষকে তুমি কাছে টেনে আন, এত বড় দাবির কথা বলবার সাহস আমার নাই, কিন্তু তোমার চোখের সামনে যে মরে যাচ্ছে তার দিকে তুমি ফিরে তাকাবে।? তোমার কানের কাছে যে আর্তনাদ করছে তার পানে কি তুমি একটুও অগ্রসর হবে না?

সিরাজগঞ্জে এক কাঠওয়ালার কলেরা হয়। বাজারের এক পতিতা নারীকে তার সেবা করতে দেখেছিলাম। সেই পতিতার মধ্যে দেখেছিলাম আমি- নারীর মাতৃমূর্তি, সে কী পবিত্র দৃশ্য! শ্রদ্ধাভক্তিতে আমার মাথা নত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মুখ খুলে কিছুই প্রকাশ করতে পারি নি।

নারী মাতৃমূর্তি কত সুন্দর! কত পবিত্র! মাতৃরূপিনী নারী জাতির যখনই আমরা অপমান দেখি, তখন মন দুঃখিত হয়ে উঠে। সে হিন্দু কি মুসলমান, সে কথা ভাববার অবসর থাকে না।

এক ব্যক্তির কথা জানি, তিনি এক সময়ে একজনের কাছ থেকে এক আনা পয়সা ধার নিয়ে কী একটা জিনিস কিনেছিলেন, কাছে তখন পয়সা ছিল না। বাড়ি এসে টাকা ভাঙ্গিয়ে সেই লোকটিকে পনেরো আনা দিয়ে নিজে মাত্র এক আনা রাখলেন;

লোকটি বিস্মিত হয়ে বললেন- আপনি আমার কাছ থেকে মাত্র এক আনা নিয়েছেন, এখন পনেরো আনা দিচ্ছেন কেন? আপনার ভুল হয়েছে। ভদ্রলোক বললেন, বাকি পনেরো আনা তোমাকে দিলাম ওটা তোমার নিতেই হবে। লোকটি অগত্যা সে পয়সা নিতে বাধ্য হল।

এখানে এই ভদ্রলোকের চরিত্র-মাহাত্ম সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক। জ্ঞান ব্যতীত মানুষের কোনো জায়গাতেই কল্যাণ নাই, কেমন করে যে উদারতা ও মহত্ত্বের পরিচয় দিতে হয় তা সে বুঝতে পারে না। এজন্যে জ্ঞানের আসন সর্বোপরি।

ভদ্রলোকের প্রাণের প্রশংসা না করে পারি না। তার নির্মল সুন্দর আত্মাটি ভক্তি পাবার যোগ্য। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা প্রশ্নের উদয় হয়। তার এই দান সত্যই কি মানবজাতির অনুকরণের জিনিস? আমার মন ভয়ে সঙ্কোচে উত্তর দেয়-না।

যা বিশ্বাস করি, মানুষের ভয় অথবা লাভের আশায় তা বলতে ভয় করা কত বড় দুঃখের বিষয়! এই অবিচারটুকু জয় করবার জন্যেই মানুষ স্বাধীনতা চায়। বিশ্বাসকে যে যতখানি চেপে রাখে সে ততখানি দরিদ্র। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, তিনি কিছুতেই জীবনের সত্যকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দিতে চান না। এতে তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হয়।

মানুষকে দান কর, কিন্তু দান করবার জন্যই কি দান করতে হবে? দেখতে হবে প্রদত্ত পয়সায় দানপ্রাপ্ত ব্যক্তির প্রকৃত উপকার হবে কিনা। যার আছে, তাকে আরও দিলে পয়সার অপব্যবহার করা হয় না কি? সে সেই পয়সা পেয়ে আনন্দ লাভ করতে পারে, কিন্তু সে আনন্দটুকু তার না হলেও বিশেষ ক্ষতি আছে বলে মনে হয় না।

এইসব টাকা দিলে জাতির কত কল্যাণ হয়, অজ্ঞান মূর্খ লোকেরা তা বোঝে না! অগণিত টাকা ব্যয় করে তার মহত্ত্বের পরিচয় দেয়। মানুষকে সবার আগে জ্ঞান অর্জন করতে হবে, জ্ঞানের দ্বারা মানুষ তার জীবনের সকল কর্ম ঠিক করে নিতে পারে তাকে বলে দিতে হয় না, এই পথে তুমি চল। জ্ঞান যার নাই, সে কিছুই বোঝে না, মহত্ত্বের পরিচয় দেওয়া তার পক্ষে অসম্ভব।

রামতনু লাহিড়ী মহাশয় একবার রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ তিনি খুব ব্যস্ততার সঙ্গে পথ অতিক্রম করতে লাগলেন, যেন কে তাকে মারতে তাড়া করছে। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আবার স্থির হলেন। সঙ্গের বন্ধুটি ব্যস্ততার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন- ভাই, এক ভদ্রলোক আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন।

আমি জানি তার অবস্থা বড় শোচনীয়, টাকা দেবার কোনো সঙ্গতি নাই। আমার দিকে তিনি আসছিলেন। আমি দ্রুত গতিতে পাশ কাটিয়ে সরে এসেছি। আমাকে দেখলে তার ভারি লজ্জা হত! ভদ্রলোককে কী করে লজ্জা দেব, এই ভেবেই আমি পালিয়ে এলাম। এমন করে পরের লজ্জায় ব্যথাকে অনুভব করবার ক্ষমতা কয়জনের থাকে। সাধারণত সব সময়ই মানুষ লজ্জা, ব্যথা দিতে আনন্দ বোধ করে।

জাতি বল, বংশ-মর্যাদা বল, মহত্ত্বের তুলনায় কিছুই কিছু নয়। মানুষ যেখানেই চরিত্র মাহাত্ম্য দেখে সেখানেই ভক্তিতে তার মাথা নত হয়। বড়লোক বলেই কি মানুষ বেশি শ্রদ্ধা পাবার উপযোগী? বড়লোককে মানুষ লাভের আশায় শ্রদ্ধা দেখতে পারে, কিন্তু কুস্বভাব লোক কখনও মানুষের অন্তরের রাজা হতে পারে না।

মানুষ ছোট হোক, বড় হোক, দরিদ্র হোক, যখনই তার মধ্যে মহত্ত্ব দেখবো, তখনই তাকে আমরা শ্রদ্ধা করবো। ছোটলোক বলে সমাজে যে সর্বনিম্ন স্তরে পড়ে আছে সে কি মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারে না?

আমি দেখেছি ব্যথিত মানুষের গৌরবদীপ্ত মুখ, সে মুখ কত সুন্দর! কত পবিত্র? রূপ যদি মানুষের থাকে, তবে তা মহত্ত্বের আলোকভরা মুখেই আছে। রূপবান রূপময়ী নর নারীর নীচাশয়তা তাদের রূপকে কতখানি কুৎসিত করে, তাও আমি দেখেছি।

যা বিশ্বাস করি, মানুষের ভয় অথবা লাভের আশায় তা বলতে ভয় করা কত বড় দুঃখের বিষয়! এই অবিচারটুকু জয় করবার জন্যেই মানুষ স্বাধীনতা চায়। বিশ্বাসকে যে যতখানি চেপে রাখে সে ততখানি দরিদ্র। যার মধ্যে মনুষ্যত্ব আছে, তিনি কিছুতেই জীবনের সত্যকে এমনভাবে ব্যর্থ করে দিতে চান না। এতে তাঁর মৃত্যুযন্ত্রণা উপস্থিত হয়।

অনেক টাকা মাইনে পাই, সেই লোভে কী করে আমি আমার কোটি টাকার আত্মাটিকে বিক্রয় করতে পারি? আমার দুর্জয় মনুষ্যত্ব আমার জীবনের উচ্চ সার্থকতা আমি কোনো জিনিসের বিনিময়েই নিরর্থক করে দিতে পারি না।

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময় বালক প্যানক্রিয়াস বাহির হতে ‘মা’ বলে ডাকল। হাতের কাজ ছুঁড়ে ফেলে প্রৌঢ়া দরজা খুলে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন-বাপ, আজ যে তোর এত দেরি হল? বালক বললো- “কেন ‘মা’ এত ব্যস্ত হয়েছ? আমার বয়স তো আঠার।” মা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে একখানা চেয়ারের উপর বসলেন।

অর্থ অর্জন করে শরীরকে বাঁচান হবে, অশিক্ষিত গ্রাম্য লোকদের কাছে খুব প্রশংসা লাভ করা যাবে, বন্ধু-বান্ধবেরা আমার সুনাম জ্ঞান করবে; কিন্তু তাতে যদি আমার আত্মার ভাষা নীরব হয়ে যায়, আমার মনুষ্যত্ব নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে, তা হলে আমি আমার শরীরকে বাঁচাতে চাই না, আমি কারো প্রশংসা, কারো সুনাম পাবার লোভ করি না।

তখনও হযরত মোহাম্মদ (দ) তার সংস্কারের বাণী নিয়ে জগতে আসেন নি। রোম নগরে এক বাড়িতে বসে একদিন এক মহিলা সেলাইয়ের কাজ করছিলেন। বাড়িতে তিনি একাকিনী ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি দরজার দিকে চাচ্ছিলেন কেউ দরজা ঠেলে ভিতরে আসে কি না।

তখন ছিল হযরত ঈছার (আ) যুগ। রোমের যারা মূর্তি পূজা ছেড়ে হযরত ঈছার (আ) সত্য ধর্ম গ্রহণ করেছিল, তাদের উপর ভারি অত্যাচার হতো। কোনো রকমে যদি শাসক সম্প্রদায়ের কেউ জানতে পারত কোনো ব্যক্তি ঈছার (আ) ধর্ম গ্রহণ করেছে, তখন তখনই তাকে বাঘের মুখে ফেলে দেয়া হতো।

নানান নির্যাতনে তাকে মেরে ফেলা হতো। ফলে নব ধর্মাবলম্বীদিগকে নিজেদের ধর্মবিশ্বাস গোপন করে রাখতে হতো। যারা তা পারত না, তাদের মৃত্যু অনিবার্য ছিল, এইভাবে বহু ধর্মপ্রাণ রোমবাসীকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। যে নারীর কথা বলছিলাম,- এর স্বামী কিছুদিন আগে ধর্মবিশ্বাসের জন্যে শহীদ হয়েছিলেন।

প্রাণভয়ে মানুষ নিজের বিশ্বাস ও সত্যকে অনেক সময় গোপন করে চলে, কিন্তু সামান্য লাভে বা কল্পিত সুখের জীবনের জন্যে যে নিজেকে অবনমিত করে, নিজের মনুষ্যত্ব ও বিবেক-বুদ্ধিকে বিসর্জন দেয় সে কীরূপ মানুষ!

মহিলাটির একটি ছেলে ছিল তাকে রেখে তাঁর পিতা প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। ছেলেটি বাড়িতে মাকে একাকিনী রেখে প্রত্যহ স্কুলে যেতো। স্বামীর একমাত্র ছেলে প্রৌঢ়ার নিঃসহায় নারী জীবনের একমাত্র সান্ত্বনা। আজ বিদ্যালয় হতে ফিরে আসতে বিলম্ব করছে তাই আকুল ও ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

নারী জাতির সন্তানের প্রতি কত মায়া তা আমরা ধারণা করতে পারি না। মায়ের মূর্তিতে নারী কত বড়! নারী দরিদ্র হোক, পতিতা হোক, সন্তানকে বুকে করে সে রানীর আসন অধিকার করে। নারী যখন শিশুর মুখে সুধা ধারা ঢালে, তখন তাকে মা বলে সালাম করলে দোষের হয় না। নারীকে যেখানে আঁখিজল ফেলতে হয়, সেখানে খোদার অভিশাপের আগুন জ্বলে।

প্রৌঢ়ার হাতের কাজ ভুল হয়ে যাচ্ছিল। ছেলে বাড়ি আসতে দেরি করছে। বাতাস দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেল, প্রৌঢ়া চমকিত হয়ে চেয়ে দেখলেন, কেউ না।

সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে, এমন সময় বালক প্যানক্রিয়াস বাহির হতে ‘মা’ বলে ডাকল। হাতের কাজ ছুঁড়ে ফেলে প্রৌঢ়া দরজা খুলে ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন-বাপ, আজ যে তোর এত দেরি হল? বালক বললো- “কেন ‘মা’ এত ব্যস্ত হয়েছ? আমার বয়স তো আঠার।” মা ছেলেকে আঁকড়ে ধরে একখানা চেয়ারের উপর বসলেন।

প্যানক্রিয়াস- তারপর আমি আর ছেলেদের সঙ্গে স্কুলের মাঠে এসে দাঁড়ালাম। নগরের হাকিমের ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ে। সেই ছেলেটি ভারি বদমাইস। কী কারণে জানি না, ও আমাকে বিষ চোখে দেখে। আমি ক্লাশের মাঝে সবার চোখে ভালো ছেলে, আর সে ক্লাশের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছেলে।

ছেলে মাটিতে মায়ের পায়ের কাছে বসে কোলে বাহু রেখে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মা ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বললেন- “আজ কেন এত দেরি হল? তুই তো রোজ বেলা থাকতে আসিস। জানিস তো নিজের দেশে আমরা কতটা প্রবাসী হয়ে বাস করছি। তোর বাপকে রোমবাসীরা হত্যা করেছে- আমার সব সময় মনে ভয় হয়।”

ছেলে- মা কীসের ভয়? বিশ্বাসের জন্যে বাপ মৃত্যুবরণ করেছিলেন, এর চেয়ে মহনীয় মৃত্যু কি আর আছে? আমার যদি অমনি করে মরণ হয়, তাতে আমার জীবন ধন্য হবে!

মা- বাপ, তুই অমন কথা কী করে বললি? তুই যে এখনো আমার দুধের ছেলে। আজ আমার জীবন সার্থক হল। কে তোকে এমন মধুর কথা শিখিয়েছে?

ছেলে- মা, তুমিই তো আমাকে শিখিয়েছো, সত্য ও ন্যায়ের জন্য আমাদিগকে যে কোনো ক্ষতি স্বীকার করতে হবে! গৌরবময় মরণের মধ্যে দিয়ে যে মুক্তি আমরা পাই, তা কত সুন্দর। মহান মৃত্যু দিয়ে দুঃখময় পঙ্কিল জগতের মাঝ থেকে যদি জীবনের অভিশাপকে সরিয়ে নেওয়া যায়, তবে তা মানুষের পক্ষে কত বড় লাভ!

মা- বাপ, তুই আর ছোট ন’স, এই এখন মানুষের মতোই কথা বলতে শিখেছিস। আজ আমার নারী জীবন সার্থক হয়েছে কিন্তু তোর বাড়ি ফিরতে এত দেরি হল কেন, সে কথা তো এখনও বললি না?

প্যানক্রিয়াসের মুখ হঠাৎ কালো হয়ে গেল। অশ্রুভারে চোখ দুটি ছলছল করতে লাগলো। বললে- তুমি আর তা শুনো না মা।

মার চোখেও পানি এলো- সন্তানের এতটুকু ব্যথাও যে তিনি সইতে পারেন না। তিনি জিদ করে বললেন- না বাপ, আমার কাছে কোনো কথা গোপন করিস না। কী হয়েছিল বল।

প্যানক্রিয়াস- আজ স্কুলে একটা সভা ছিল- সভার আলোচ্য বিষয় ছিল- পণ্ডিত যিনি, সত্যের জন্য সব সময় মরতে প্রস্তুত থাকবেন। আমি এ সম্বন্ধে সভায় যখন প্রবন্ধ পড়ছিলাম, তখন সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়েছিল। প্রবন্ধ শুনতে শুনতে কেউ কেউ কেঁদে ফেলেছিল।

আমাদের শিক্ষক মহাশয়ও কেঁদেছিলেন। প্রবন্ধ পড়বার কালে মনের আবেগে হযরত ঈছার (আ) নাম করে ফেলেছিলাম। তাই সভা যখন শেষ হয়ে গেল, শিক্ষক মহাশয় গোপনে ডেকে বললেন- বাবা, দেশের অবস্থা খারাপ, চারদিকে শত্রুর কান খাড়া হয়ে আছে। এই কথা বলে তিনি চোখ মুছে আমার কাছ থেকে চলে গেলেন।

মা- শিক্ষক মহাশয় কি তা হলে হযরত ঈছাকে (আ) মানেন? তার চরিত্রবল, তার পবিত্র জীবনের প্রশংসাই এতকাল শুনেছি, তিনি যে এমন করে আত্মগোপন করে আছেন, তা তো বুঝি নি। খোদাকে ধন্যবাদ, তোমাকে উপযুক্ত শিক্ষকের হাতেই দিতে পেরেছি। তারপর?

প্যানক্রিয়াস- তারপর আমি আর ছেলেদের সঙ্গে স্কুলের মাঠে এসে দাঁড়ালাম। নগরের হাকিমের ছেলে আমাদের সঙ্গে পড়ে। সেই ছেলেটি ভারি বদমাইস। কী কারণে জানি না, ও আমাকে বিষ চোখে দেখে। আমি ক্লাশের মাঝে সবার চোখে ভালো ছেলে, আর সে ক্লাশের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট ছেলে।

ভিতরকার ক্রোধ শয়তানকে শেষকালে জয় করতে পেরেছিলাম। হেসে বললাম- ভাই কারভিন, তুমি আমাকে অন্যায় করে আঘাত করলে। তবে আমার বিশেষ লাগে নি, একটু রক্ত পড়েছে মাত্র, শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। প্রার্থনা করি তোমার স্বভাবের এই প্রচণ্ড উগ্রতার শীঘ্রই পরিবর্তন হোক। আমাদের শত্রুতার এইখানে অবসান হোক- এরপরে যেন তোমার বন্ধু হতে পারি।

আমার প্রশংসা শুনলে তার যেন মরণযন্ত্রণা উপস্থিত হয়। আমাকে মোটেই দেখতে পারে না। আমি যে তার কাছে কী অপরাধ করেছি। জানি নে, ভারি হিংসুক আর বদ ছেলে সে। আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে,- কিহে প্যানক্রিয়াস, তুমি আমাকে ভয় কর না? এই কথা বলে সে বিনা কারণে আমায় ধাক্কা দিলে।

আমি বললাম- এরূপ অসভ্যতার পরিচয় দিচ্ছ কেন? সে বললে- দ্যাখ প্যানক্রিয়াস, তুই নানা রকমে আমার সঙ্গে শত্রুতাচরণ করেছিস, আমার পায়ে ধরে যদি ক্ষমা চাস তা হলে তোকে ক্ষমা করবো, নইলে নয়। রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল, কিছু না বলে আমি চুপ করে রইলাম- তুমি না আমায় বলেছ, যে রাগকে জয় করতে পারে, সে-ই মানুষ,- সেই কথা আমি তখন মনে করছিলাম।

মা- তাই ঠিক বাপ।

প্যানক্রিয়াস- মা, এরপর যা ঘটেছে তা আর বলতে পাচ্ছি নে- এই কথা বলে প্যানক্রিয়াস কাঁদতে লাগল।

মা ছেলের মাথা বুকের কাছে টেনে বললেন, “বাপ, তুই আমার কাছে সব কথা বল।”

প্যানক্রিয়াস আবার বলতে শুরু করলে, আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তার রাগ যেন আরও বেড়ে গেল। সেই ছেলেটির নাম কারভিন।

কারভিন আবার বললে- প্যানক্রিয়াস, আমি কার ছেলে তা তুই জানিস? ক্লাশে লেখাপড়ায় তুই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তোর অহংকার ভরা চাউনিগুলি আমার অন্তর বিদ্ধ। করে। আচ্ছা এইবার আয়, কার গায়ে কত জোর পরীক্ষা হোক। আমাকে ভয় করতে হবে কিনা এখনই দেখিয়ে দিচ্ছি।

আমি বললাম তোমার গায়ে আমার চেয়ে বেশি শক্তি আছে। আমি মারামারি করতে পারব না।

মা- এরপর কী হল?

ছেলে- আমি তাকে খুব পিটিয়ে দিতে পারতাম। কী কষ্টে যে আমি আমার রাগ দমন করতে পেরেছি, তা আর কী বলব মা। ‘কাপুরুষ’ গালটা আমার বড় লাগে। যার বাকা হৃৎপিণ্ডের রক্ত দিয়ে নিজের বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছেন- সে কাপুরুষ! প্রাণে কী জ্বালা উপস্থিত হল, তা খোদাই জানেন।

ভিতরকার ক্রোধ শয়তানকে শেষকালে জয় করতে পেরেছিলাম। হেসে বললাম- ভাই কারভিন, তুমি আমাকে অন্যায় করে আঘাত করলে। তবে আমার বিশেষ লাগে নি, একটু রক্ত পড়েছে মাত্র, শীঘ্রই বন্ধ হয়ে যাবে। প্রার্থনা করি তোমার স্বভাবের এই প্রচণ্ড উগ্রতার শীঘ্রই পরিবর্তন হোক। আমাদের শত্রুতার এইখানে অবসান হোক- এরপরে যেন তোমার বন্ধু হতে পারি।

গোলমাল শুনে শিক্ষক মহাশয় সেখানে এলেন। আমি তাকে হাতে ধরে অনুনয় করে বললাম-শিক্ষক মহাশয়, কারভিনকে দয়া করে কিছু বলবেন না। ছেলেমানুষী করে এই কাজ করে ফেলেছে, ওকে ক্ষমা করুন। এজন্য আমি ওর উপর একটুও ক্রুদ্ধ হইনি।

শিক্ষক মহাশয় ভয়ানক চটে ছিলেন। আমার কথায় অগত্যা শান্ত হয়ে গেলেন। এসব কারণে বাড়ি আসতে বিলম্ব হয়েছে। মা, তোমার মনে কি ব্যথা লাগছে? মা, ব্যথার তো

কিছু নাই, দেখ দেখি আমি কেমন করে নিজেকে জয় করতে পেরেছি, এতে তোমার আনন্দ হচ্ছে না? পরকে যদি অন্যায় করে ব্যথা দিতাম, তাতেই আমার দুঃখের কারণ হতো। যে আঘাত দিয়েছে, তারই লজ্জার কারণ বেশি।

(চলবে…)

<<মহৎ জীবন : পর্ব এক ।। মহৎ জীবন : পর্ব তিন>>

………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!