সেবা
-লুৎফর রহমান
যে দুঃখী পীড়িতের ব্যথা মর্মে অনুভব করে সেবার কাজে আত্মদান করে, সে মানুষের গৌরব। কোনো কোনো ভ্রাতা বলে থাকেন, “খ্রিস্টান ও হিন্দুরা সেবার দ্বারা মানুষের চিত্ত জয় করে, তাদের প্রতারণা-জাল থেকে সাবধান।”
সেবা ও প্রেমকে অশ্রদ্ধা করা মুমিনের কাজ নয়। যারা সেবা-ধর্মে নিজেদের জীবনকে ধন্য করেছে, তারা বিধর্মী হলেও উদার মুসলমান শ্রদ্ধা করেছে, ভালোবেসেছে।
বিধর্মী ম্রাট নওশেরোয়া বিচার ও ন্যায়নিষ্ঠায় চিরদিন মুসলমানদের শ্রদ্ধা-পুস্পাঞ্জলি পেয়েছেন। যিনি প্রেমিক এবং সেবক, তিনি ন্যায়-বিচারক ও দুঃখীর বন্ধু।
পণ্ডিত হয়ে লাভ কী, যদি না প্রেমে পাণ্ডিত্যকে সার্থক করি? বড়লোক হয়ে লাভ কী, যদি না আপন বিত্ত মহিমা প্রেমে সার্থক করি? অফুরন্ত উপাসনায় আল্লাহর কী প্রয়োজন, যদি না উপাসনা প্রেমে সার্থক হয়। বস্তুত প্রেমহীন জীবন, জ্ঞান এবং ধার্মিকতা কিছু নয়। মানবের সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাধনা প্রেম-সাধনায় সার্থক হয়।
যখন বিধর্মী তায়ী সম্প্রদায় বন্দি হয়ে হযরতের সম্মুখে নীত হল, তখন বন্দিদের মধ্য হতে একজন মহিলা বললেন- “মহানুভব, আমি হাতেমের বংশধর।” হযরত বললেন”এদের মুক্ত করে দাও। বিধর্মী হলেও সেবাধর্মে হাতেম আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করেছেন। তার কন্যাকে আঘাত করা হবে না, সবাইকে মুক্ত কর।”
হযরত মহিউদ্দীন জিলানী যখন সামান্য ছাত্র, তখন একদিন রাস্তার ধারে পতিত এক পীড়িতকে বুকে করে আপন শয্যায় আশ্রয় দিলেন। তার সেবায় রোগীর রোগমুক্ত হল। সে মহিউদ্দীনকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করলো। সেইদিন রাত্রে তিনি স্বপ্নে শুনলেন-
“তোমার জীবনের এই প্রেম সার্থক হবে। মানব-কল্যাণের সাধনায় তোমার জীবন ধন্য হবে। আল্লাহ তোমায় মহৎ স্থান দান করেছেন।”
সৈনিক সবুক্তগীন যেদিন হরিণ-মাতার মুখের দিকে চেয়ে করুণা বিগলিত চিত্তে মৃগ শিশুকে ছেড়ে দিলেন, সেইদিন আল্লাহ তাঁকে লোকপালনভার দিয়ে তাঁর প্রেমকে পুরস্কৃত করলেন। প্রেমের পুরস্কার হবেই প্রেমে আল্লাহর আরশ জোরে নড়ে। প্রেম, দয়া ও সেবা ইসলামের অঙ্গ। দুঃখীর জন্য দান (জাকাত) ইসলামে অপরিহার্য বিধান। ইসলামের জাকাতের টাকা থেকে অনেক হাসপাতাল, অনেক সেবা-সঙ্গ চলতে পারে।
জল-প্লাবনে, রোগে, দুর্ভিক্ষে বিভিন্ন দেশে সেবা-সঙ্গের ভিতর দিয়ে মানুষ অর্থ ও অন্নবস্ত্র দান করেছে- যারা জীবন দিয়ে তার সেবা করেছেন, সেবার দুঃখ সয়েছেন- তারা প্রেমিক। মানুষের শ্রদ্ধা সংবাদপত্রের নাম তাঁরা চান নি; বিবেক, মনুষ্যত্ব ও আত্মার ধর্মকে তারা সার্থক করেছেন জগৎ এদের পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে।
এদের প্রেম ও অশ্রুর মূল্য রাজার রাজতখতও নয়। মানুষের দুঃখে অশ্রু যারা ফেলেছেন, মানব দুঃখের জন্য যারা সেবাকার্যে অগ্রসর হয়েছেন, তাঁরা আল্লাহর আর্শীবাদ পেয়েছেন। জীবন শেষ হবেই কিন্তু ধন্য হবার এই-ই পথ।
পণ্ডিত হয়ে লাভ কী, যদি না প্রেমে পাণ্ডিত্যকে সার্থক করি? বড়লোক হয়ে লাভ কী, যদি না আপন বিত্ত মহিমা প্রেমে সার্থক করি? অফুরন্ত উপাসনায় আল্লাহর কী প্রয়োজন, যদি না উপাসনা প্রেমে সার্থক হয়। বস্তুত প্রেমহীন জীবন, জ্ঞান এবং ধার্মিকতা কিছু নয়। মানবের সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত সাধনা প্রেম-সাধনায় সার্থক হয়।
বুজর্গ ও সাধুর প্রধান ধর্ম সেবা, প্রেম এবং ত্যাগ, দুঃখীর প্রতি অফুরন্ত সহানুভূতি, জীবন দিয়ে সয়ে আল্লাহর এবাদত করা; আরামে কম্বলের মধ্যে বসে পরের পয়সায় উদরপুষ্ট করা নয়। সাধু মৃত্যুকে ভয় করেন না- তিনি ফুঁ দিয়ে কাজ করেন না।
পর সেবায় আমরা অনেকে হয়তো জীবন দান করতে পারি কিন্তু যারা আপন প্রাণ সেবার কার্যে উৎসর্গ করেছেন- অর্থ দিয়ে তাদের কাজে সাহায্য কি আমরা করতে পারি না? পীড়িতের জন্যে সাহায্য কিছু দান করাও কি কষ্টকর হবে? কে ব্যাধি দেখে নির্ভয়ে চলেছে? কে শঙ্কা, সন্দেহ, মরণকে উপহাস করে আল্লাহ্ বলে ছুটছে? মুসলিম।
কার প্রাণে ভয় নাই? সে মুসলমান। মরণাপন্ন পীড়িতের শয্যাপার্শ্বে মুসলিম যুবককে দেখি না কেন? বিপদ ও মরণ-বিজয়ী মুসলিম তোমাকে তো কোনোদিন কাপুরুষ দেখি নাই? পরকালের পুরস্কারের আশায় হে বিশ্বাসী! তোমাকে দেখেছি তোমার মহাযাত্রাকে সার্থক করতে। মৃত্যুকে তুমি কি ভয় কর? প্রেম ও ত্যাগই যে জীবন।
প্রায় তিন শত বৎসর পূর্বে মীলানে (Milan) প্লেগের আবির্ভাব হয়। প্লেগ অতিশয় ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধি। মনুষ্য প্লেগের ভয়ে দিশাহারা হয়ে পলায়ন করে। অনাহারে, বিনা চিকিৎসায়, মানুষ পথে পড়ে মরে। আত্মীয় আত্মীয়কে ত্যাগ করে, বন্ধু বন্ধুকে ফলে যায়।
এই পাপপূর্ণ দুঃখের সংসারে অনেক মানব দেবতাও বাস করেন। তাঁদের স্পর্শ কী শক্তিপূর্ণ। তাদের বাক্য কী প্রেম-মধুর। আল্লাহর ছায়ারূপে পৃথিবীর দুঃখ-দগ্ধ মানবসন্তানকে সান্ত্বনা দিয়ে তারা সংসারকে মধুর করেন।
মীলানে ভয়াবহ প্লেগ আরম্ভ হয়েছে, বরোমী (Barromes) নামে এক জন সাধু বললেন—”আমাকে এইখানে যেতে হবে।” বন্ধুরা শঙ্কিত হয়ে বললেন, “আপনি কি প্রাণ দিতে যাচ্ছেন? আপনি কি মরণকে ভয় করেন না?” বরোমী বললেন-
“আমার জীবনের চাইতে দুঃখীর ব্যথার মূল্য বেশি। আমাকে যেতেই হবে। সাধু ও মারফতপন্থী বুজর্গ বললে আমরা বুঝি তিনি দিবারাত্র ঘরের মধ্যে আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন। দোয়া পড়ে রোগীকে রোগমুক্ত করেন। বুজর্গের ইহাই ভাব নয়। ইহা ধর্মহীন লোকের চালাকি।
বুজর্গ ও সাধুর প্রধান ধর্ম সেবা, প্রেম এবং ত্যাগ, দুঃখীর প্রতি অফুরন্ত সহানুভূতি, জীবন দিয়ে সয়ে আল্লাহর এবাদত করা; আরামে কম্বলের মধ্যে বসে পরের পয়সায় উদরপুষ্ট করা নয়। সাধু মৃত্যুকে ভয় করেন না- তিনি ফুঁ দিয়ে কাজ করেন না।
এই কাজ,- এই সেবা এবং সাহস, আর এই অপরিসীম প্রেম ও শত্রুর প্রতি স্নেহভাবই সাধু জীবনের পুণ্য সত্য চিত্র এবং সে চিত্র স্বর্গীয়, মহৎ, পবিত্র পাপীর পথ-প্রদর্শক। চন্দ্রে কলঙ্ক আছে, এ স্বর্গীয় চিত্তে কলঙ্ক নাই।
তিনি পীড়িতের মধ্যে যান, দরিদ্রের সেবা করেন, দুঃখীদের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেন এবং হযরত মোহাম্মদের ন্যায় আপন হস্তে মলমূত্র পরিষ্কার করেন। সেবক শুধু দরূদ পড়েন না, সেবাকার্যের প্রয়োজন হলে প্রাণ দেন। সেবায় তাঁর কোনো অহঙ্কার নাই।
মীলান শহরের প্লেগ চার মাস কাল থাকে। সাধু বরোমী ঔষুধ ও পথ্য হস্তে সর্বত্র যেতেন, দুঃখীর সংবাদ নিতেন, ওষুধ বিতরণ করতেন। রাত্রিকালে দুঃখীর জন্যে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন, মরণোন্মুখ রোগীর পার্শ্বে বসে বন্ধুর মতো, মায়ের মতো তাকে আল্লাহর অনন্ত প্রেমের কথা শুনাতেন।
এই সাধু সেবা ও প্রেমকে অনুসরণ করে আরও অনেক গুণমুগ্ধ ব্যক্তি তাকে অনুসরণ করলেন এবং যতদিন না ব্যাধি সম্পূর্ণভাবে শেষ হল, তাবৎ তারা ভয়ে সেবার ক্ষেত্র ত্যাগ করলেন না।
বরোমী কিছুদিন পর দেখলেন, তাঁর নগরের নৈতিক অধঃপতন, অপবিত্র পাপীজীবন; মনুষ্য পশুর মতো পাপাচারে উল্লাস করে, অভিশপ্ত, ঘৃণিত, জীবনের গৌরবে মত্ত থাকে। তিনি সর্বত্র লোক শিক্ষার জন্যে প্রাইমারি স্কুল স্থাপন করতে লাগলেন, সাধারণের মাঝে প্রচার করতে লাগলেন।
এর ফল কী হল, সাধু নামধারী কতকগুলি ভণ্ড বললেন,- বরোমী কাফের। একে খুন করো। যে কথা সেই কাজ। বলরামী একদিন যখন ইতর লোকদের মাঝে আল্লাহর বাণী প্রচার করছিলেন, সেই সময় এক ভাড়াটে নরহন্তা তাকে লক্ষ্য করে। গুলী ছোঁড়ে। ভক্তের প্রতি আল্লাহর কী দয়া।
তিনি আপন ভক্তকে, সাগরবক্ষ; অগ্নিসমুদ্র, ঝড়ঝঞ্ঝা হতে আশ্চর্যভাবে রক্ষা করেন। গুলী বলরামীর বস্ত্র ভেদ করে তার শরীরে প্রবেশ করতে পারল না। তিনি হাস্যমুখে তার শত্রুদের আশীর্বাদ করলেন, তাদের জন্যে আল্লাহর দয়া ভিক্ষা করলেন।
এই কাজ,- এই সেবা এবং সাহস, আর এই অপরিসীম প্রেম ও শত্রুর প্রতি স্নেহভাবই সাধু জীবনের পুণ্য সত্য চিত্র এবং সে চিত্র স্বর্গীয়, মহৎ, পবিত্র পাপীর পথ-প্রদর্শক। চন্দ্রে কলঙ্ক আছে, এ স্বর্গীয় চিত্তে কলঙ্ক নাই।
(চলবে…)
………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত
………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই
……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা