ভবঘুরেকথা
রাখিলেন সাঁই কূপজল করে ফকির লালন সাঁইজি

অনুদান ও দুঃখের উপশম চেষ্টা

-লুৎফর রহমান

মানুষকে অন্ন দেবার মতো মহাধর্ম আর নাই। ভরা পেটে খাবার দান করা এমন কিছু নয়, কিন্তু জগতে তাই হয়। বাইরে রাস্তায় পড়ে মানুষ এক মুঠো অন্নের জন্য কাতর চিৎকার জানাচ্ছে। ভিতরে নিমন্ত্রিত ব্যক্তি জোড়হস্ত হয়ে ক্ষমা চাইলেও তাকে আরো খেতে অনুরোধ করা হচ্ছে।

বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী, বড়লোক, এদের প্রীতিভোজ দিতে নিষেধ করি না- কারণ এরও একটা আবশ্যকতা আছে। যার আছে তারও তো ক্ষুধা লাগে। আনন্দ তার। জন্যেও দরকার। অন্নহীন দরিদ্রের কথা একেবারে ভুলে যেও না। তোমরা বড়লোকের সন্তান, ঘরে অন্নের অভাব নেই।

কিন্তু রোজার মাসে আল্লাহ তোমাদের অন্নহীন উপবাসীর বেদনা বুঝবার সুবিধা করে দিয়েছেন সেই ব্যথা ভেবে দরিদ্রের কথা চিন্তা কর। প্রতিবেশীকে অভুক্ত রেখে পেট ভরে খেয়ে শুয়ে থেকো না- তার মতো পাপ আর নাই।

দেশের অন্নহীনদের অর্থ উপার্জনের সুবিধা করে দেওয়া মহৎ লোকের কাজ- দেশ সেবকের কাজ, পুণ্যবানের কাজ। শুধু শুক্রবারে সমবেত উপাসনা করলে উপাসনা সিদ্ধ হবে না- ওরে অবোধ!

কৃষি কর- এবং প্রচুর ধান গোল ভর্তি করে তোল। দান কখনো সুদি করে লাগাতে নাই। দানের জন্যেই অন্ন। মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই তাকে অন্ন গ্রহণ করতে বল- এরই নাম প্রেম ও ভালবাসা। যাবৎ না মানুষকে আপনার ভাই বলে ভালবাসতে পার, তাবৎ স্বর্গের যোগ্য তোমরা হবে না।

শুধু অক্ষর পালন করলে আল্লাহর আদেশ পালন হবে না। সমবেত হও সবাই, দেশের জনহিতে কাজ কর, মানুষের ক্ষুধার স্থায়ী মীমাংসা কর- ভিক্ষা দিয়ে কটা লোককে কদিন বাঁচান যায়। তথাপি ভিক্ষা দাও- দান কর, দান ব্যতীত নামাজ সিদ্ধ হয় না।

দেশের লোকের বেদনার চিৎকার শোন না? ওরে অবোধ! এই কি তোমার প্রাণের দরদের পরিচয়! দরদ ছাড়া কি স্বর্গের যোগ্য হওয়া যায়? দরদ চাই, প্রেম চাই।

যদি জ্ঞানে, পাণ্ডিত্যে, ফকিরিতে আকাশ দিয়ে উড়ে যেতে পার, তবু তোমার কোনো মূল্য হবে না, যদি না তোমার প্রাণে প্রেম, দরদ, আদর-মহব্বত থাকে। প্রেম করতে শেখ, অহঙ্কার ত্যাগ কর- মানুষকে, আপন ভ্রাতাকে দরদের দাবি হতে বঞ্চিত করো না।

ওরে পশু! ভ্রাতাকে বঞ্চিত করে মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছ? পশুতেও তো গোয়াল ঘরে তার বন্ধুর অঙ্গ চাটে। তুমি মানুষের বেদনা-চিৎকার শুনে কি ঘরের দরজা দিয়ে শুলে? হায়, মানুষের কী হল? মানুষ ঈশ্বরের সন্তান হয়ে কি এত নিষ্ঠুর হল! পিতার মৃত্যুতে ফাতেহা উপলক্ষে বৃথাই ৫০০ টাকা ব্যয় করলে?

যে মানুষ জীবনে ধর্ম করে নাই, পয়সা দান করে নাই, মরণের পর তার দান আর একজন করলে কী হবে? জীবিতের জন্য ধর্ম। মৃতের জন্য নয়। জীবনে বেঁচে থাকতেই ধর্ম করে যাও। দেশের আর্ত পীড়িতের জন্য ফাতেহার পরিবর্তে বরং হাসপাতাল স্থাপন কর।

এতে মানুষের কত মঙ্গল হয় তা কি একটু বুঝতে পার না! এমন পাগল কোথায় আছে?- যে আপন মঙ্গল, জাতির মঙ্গল ভাল বুঝে না? দেশের সর্বত্র শিশুদের জন্যে, পীড়িত প্রসূতির জন্যে, বৃদ্ধের জন্যে হাসপাতাল স্থাপন কর এবং মানুষকে বাঁচাও। এর মতো ধর্ম আর কী আছে? এই দুঃখের দেশে এই দরিদ্রের দেশে কি মান করা সাজে?

অর্থশালী হও, অর্থ উপার্জন কর- সেই অর্থ দিয়ে পীড়িত দুঃখীর সেবা কর। মাঠে পরিশ্রম কর, ঘর ধানে অনে ভরে উঠুক। মানুষকে অনুদান কর। অন্নদানের মতো পুণ্য কী আর আছে! বাড়িতে অতিথি এলে যে অন্য বাড়ি দেখিয়ে দেয়, ধিক তাকে! মানুষকে, অতিথিকে, প্রতিবেশীকে অন্ন দাও- তারা পেট ভরে খাক এবং দোয়া করুক!

কৃষি কর- এবং প্রচুর ধান গোল ভর্তি করে তোল। দান কখনো সুদি করে লাগাতে নাই। দানের জন্যেই অন্ন। মানুষের সঙ্গে দেখা হলেই তাকে অন্ন গ্রহণ করতে বল- এরই নাম প্রেম ও ভালবাসা। যাবৎ না মানুষকে আপনার ভাই বলে ভালবাসতে পার, তাবৎ স্বর্গের যোগ্য তোমরা হবে না।

দরিদ্র মানুষের সঙ্গে টাকার হিসাব করো না। অফুরন্ত উপার্জন কর এবং যোগ্য ব্যক্তিকে দান কর। তোমার গ্রামের নিঃসহায় বিধবা পীড়িতেরা যেন অভুক্ত এবং বেদনায় ব্যথিত না থাকে।

মানুষকে গোপনে দান কর যেন তোমার দানশীলতার পরিচয় কেউ না পায়।

দানে যার হস্ত পবিত্র হয় না, সে যেন অজু করে নামাজ না পড়ে।

যে বাহুল্য ব্যয় করে, যার নিজেরই বিলাস আকাঙ্ক্ষার তৃপ্ত হয় না, সে ক্ষুধিত, মরণ মূৰ্ছিতকে কী দেবে? সেই নিষ্ঠুর আপন সুখ-চিন্তায় ব্যস্ত-ব্যথিতের বেদনা-চিৎকার তার কানে কী পৌঁছাবে?

Lay by something in youth, so that you may not serve in old age.

মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক ধর্ম যা তাই বড় ধর্ম। মানব-সমাজে থেকে নিত্য মানুষ যা করবে, মানুষ মানুষের সঙ্গে যেভাবে নিত্য ব্যবহার করবে, তারই আদর্শ এ ধর্ম জীবনে দেওয়া হয়েছে। কোনো গুপ্ত মন্ত্র, কোনো তত্ত্ব এখানে প্রচার করা হচ্ছে না।

এক স্থানে বসে থাকি, আপনা-আপনি আহার আসবে। সেই কথা ভেবে দরবেশ এক অন্ধকার ঘরে বসে রইলেন। ১৫ দিন অতিবাহিত হল, কোনো সাহায্য এলো না। তখন তিনি জ্ঞান- বাণী পেলেন। কেন শৃগালের মতো হতে চাও? সিংহের মতো নিজে চেষ্টা করে বৃষ হত্যা কর- শৃগালেরা খাবে।

আম গাছে কাঁঠাল তৈরি করা, পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, মরা মানুষ বাঁচান- এসব জগতে হয় না! ওসব কথা সত্য হলেও বা শুনতে ভালো শোনা গেলেও ধার্মিকের কাজ নয়। ঈমানের বলে মরা মানুষকে জীবিত করা যায়- এসব বিশ্বাস বর্তমানে না করাই উচিত।

“কাল কী খাবে, তার চিন্তা আর করো না-
কালকের জন্য কালকের চিন্তাই যথেষ্ট।”

যে জাতির পুরোহিত এই বাণী প্রচার করেছেন, তার শিষ্যেরা কোটি কোটি টাকা সঞ্চয় করে বসে আছেন। রিক্তহস্ত হওয়া তাঁরা পাপ ও মূর্খতা মনে করেন। এই বাণী যতই মহৎ কার্যত মানুষের অভাব সঞ্চয় ব্যতীত, নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রম ব্যতীত অতি কঠিনভাবে পূরণ হয়-এক রকম হয় না।

অভাবে, দুঃখে-দারিদ্রে মানুষ মরে যায় অথবা চির অবহেলিত হয়ে শৃগাল-কুকুরের মতো জগতে বাঁচে। এ অভাব পূরণ করা পূর্ব হতে সতর্ক হওয়া, বুদ্ধি করে পূর্ব হতে বিপদের দিনের জন্যে সঞ্চয় করে রাখাই ধর্ম করা- অভাবের দিনে আল্লাহই পূরণ করবেন, এ বিশ্বাস পোষণ করা ধার্মিকের কাজ নয়- এই বিশ্বাস মূখেরাই পোষণ করে। সন্তান হবার আগে মায়ের স্তন দুগ্ধ ভর্তি হয় এ কি দেখ না।

– পূর্ব হতে সঞ্চয় করে রাখ এবং সতর্ক হও। এ জগতে কেউ কারো কথা ভাবে না। নিজের অভাব পূরণ না করে মানুষ তোমার অভাব পূরণ করবে, এ আশা করা উচিত নয়।

এক দরবেশ দেখলেন মাঠে এক মরা পড়ে আছে। সিংহ বৃষ হত্যা করে রেখে গেছে, শৃগাল আনন্দে বিনা পরিশ্রমে তাই খাচ্ছে। দরবেশ ভাবলেন, শৃগাল যখন বিনা পরিশ্রমে বসে বসে খাচ্ছে, তখন খোদাতায়ালা ইচ্ছা করে এইভাবেই বসিয়ে খাওয়াতে পারেন, তবে আমি কেন অন্নের জন্য উদ্বিগ্ন হই।

এক স্থানে বসে থাকি, আপনা-আপনি আহার আসবে। সেই কথা ভেবে দরবেশ এক অন্ধকার ঘরে বসে রইলেন। ১৫ দিন অতিবাহিত হল, কোনো সাহায্য এলো না। তখন তিনি জ্ঞান- বাণী পেলেন। কেন শৃগালের মতো হতে চাও? সিংহের মতো নিজে চেষ্টা করে বৃষ হত্যা কর- শৃগালেরা খাবে।

কথাও তাই, শৃগাল হতে ইচ্ছা করা বীর ধার্মিকের কাজ নয়।

তার পক্ষে সিংহ হওয়াই উচিত।

যার অর্থ নাই, সে মানুষকে কি করে বাঁচাবে?- মানুষকে কি খাওয়াবে?

প্রার্থনা

যখন-তখন, দিনের মধ্যে যতবার ইচ্ছা- যে অবস্থায় থাক না, আপন ভাষায় সময় ও অবস্থার সঙ্গে তাল রেখে প্রার্থনা করা যায়। প্রত্যেক কাজের প্রারম্ভে, যে কোনো প্রকার দুঃখে, অশান্তিতে, উদ্বেগে, বেদনায় এক অথবা দুই একজন মিলে শব্দ করে আল্লাহর কাছে। আন্তরিকভাবে, পরম নির্ভরশীর সরল শিশুদের মতো প্রার্থনা করবে।

প্রার্থনা যদি আন্তরিক হয়- তবে সঙ্গে সঙ্গেই আত্মায় পরম ভরসা আসে। প্রার্থনা মানব জীবনের পরম অবলম্বন। মানবাত্মাকে ঈশ্বরের পথে আত্মোন্নতির পথে আকর্ষণ করার এই-ই একমাত্র পথ। সর্ব দুঃখের মীমাংসা প্রার্থনায় সম্ভব। প্রার্থনার দ্বারা পীড়া এমন কি সর্ববিষ শান্ত হয়।

যেন অবৈধ অসিদ্ধ অন্ন মুখে তুলে না দিই। ছলনা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতায় আমার জীবন যেন কলঙ্কিত না হয়। প্রতিদিন যেন তোমার কাজ সার্থক হয়। আমাকে বিধর্মীদের মতো করো না। যেন সব বিষয়ে তোমার উপর নির্ভর করি, তোমার কাছে শক্তি ভিক্ষা করি, অধার্মিকদের উপর আমার কর্তৃত্ব দাও।

এই ধরনের প্রার্থনার সঙ্গে নামাজের কোনো সংশ্রব নাই। আজান ও নামাজ সামাজিক সঙ্গতি, এক কথায় পৃথিবীতে মানুষের ঈশ্বর বিশ্বাস ও ধর্ম জীবনকে চিরজীবিত করে রাখবার জন্যে একটা বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান। মানুষের স্মরণপথে তার মনের সম্মুখে ঈশ্বরকে সদাজাগ্রত করে রাখবার জন্য মুসলমান নামাজ পড়ে একটা অপরিহার্য কর্তব্য পালন করে।

প্রার্থনা দুই প্রকার : প্রথম সাধারণ শ্রেণীর জন্যে, যেমন আত্মোন্নতির মানব জীবনের কল্যাণের জন্যে, মানবাত্মার চির আত্মোন্নতির সমস্যা সমাধানের জন্যে। যেমন পাপের ক্ষমার উদ্দেশ্যে- ঈশ্বর নৈকট্য লাভ উদ্দেশ্যে। দ্বিতীয়, সাময়িক কোনো ঘটনা বা বিষয় নিয়ে নামাজকে প্রথম প্রকারে অন্তর্গত করা যায়।

না বুঝে প্রার্থনা, না বুঝে কোরান পাঠ অসিদ্ধ। সর্বদাই আত্মায় অনুভব করে এমন প্রার্থনা কর। শুক্রবারের নামাজ-পরিচালকের বক্তৃতা, সাধারণ ধর্ম কথা এবং উপস্থিত বা সাময়িক প্রসঙ্গ দেশীয় ভাষায় হবে। যদি বিদেশী ভাষায় হয় এবং শ্রোতৃমণ্ডলী না বুঝতে পারেন, তা অসিদ্ধ।

নামাজ শেষে হাত তুলে যে ব্যাক্তিগত শেষ প্রার্থনা করা হয়, তা অবশ্যই নিজের ভাষায় হওয়া উচিত। মোট কথা, না বুঝে প্রার্থনার উদ্দেশ্যে আল্লাহর কোনো বাক্য আবৃত্তি অসিদ্ধ। প্রার্থনা স্বরচিত হওয়া উচিত। ঈশ্বর রচিত কথাও যদি প্রার্থনার মতো হয়, তবে সমাজে তা ব্যবহার করা, যায়। অপ্রাসঙ্গিক কথা যেমন যুদ্ধ বর্ণনা, নারীর শুচিতার ও অশুচিতার কথা, ঐতিহাসিক কথা- এসব নামাজে ব্যবহৃত না হওয়াই উচিত।

স্বরচিত ব্যক্তিগত প্রার্থনা এই ধরনের হবে। যেমন প্রাতে উপাসক নামাজ শেষে ব্যক্তিগত প্রার্থনা করছেন, প্রভু! হে মহামহিম, রাত্রির নিরাপত্তার জন্যে তোমায় ধন্যবাদ। রাত্রিতে যখন আমি দ্রিায় অচেতন ছিলাম, তখন তোমার দৃষ্টি আমাকে সর্ব বিপদ হতে রক্ষা করেছে।

আজকাল আমার এই জীবনের দিন যেন তোমার কার্যে ব্যবহৃত হয়- যেন আমার জন্য আজকের দিন বৃথা এবং ব্যর্থ না হয়। দিবসের প্রতি কথা এবং প্রতি কাজে যেন তোমার গৌরব রক্ষা করি। যেন সকল কাজে তোমার ইচ্ছা পালন করি। যেন তোমায় ভুলে না থাকি।

আমার জীবনের দ্বারা পৃথিবীর মঙ্গল হউক। যেন মানুষের অভিশাপের পাত্র হয়ে জগতে বাস করি। মানবকল্যাণে আমার দিনগুলি সার্থক ও সুন্দর হউক। যেন হৃদয়ে নীচ চিন্তা, পাপের চিন্তা প্রবেশ না করে- আমাকে অহঙ্কারী হতে দিও না। তোমার স্বভাব ও ভাবে আমার জীবনকে রঙিন কর। পার্থিব চিন্তায় আমার জীবনকে ব্যর্থ করো না।

যেন অবৈধ অসিদ্ধ অন্ন মুখে তুলে না দিই। ছলনা, প্রতারণা, নিষ্ঠুরতায় আমার জীবন যেন কলঙ্কিত না হয়। প্রতিদিন যেন তোমার কাজ সার্থক হয়। আমাকে বিধর্মীদের মতো করো না। যেন সব বিষয়ে তোমার উপর নির্ভর করি, তোমার কাছে শক্তি ভিক্ষা করি, অধার্মিকদের উপর আমার কর্তৃত্ব দাও।

আমায় বল, স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান, রূপ, ঐশ্বর্য, আনন্দ, শান্তি, বিশ্বাস দাও- যেন তোমার যোগ্য দাস হই ইত্যাদি।

অথবা এইরূপ : প্রভু! আজ প্রভাতের উজ্জ্বল আলোমুকুরে দেখলাম তোমার নির্মল সুখ। প্রভাতের নির্মল বাতাস কুসুমের সৌন্দর্যের মতো, প্রভু। আমায় নির্মল কর, সুন্দর কর ইত্যাদি।

সম্মানিত ব্যক্তি ও পণ্ডিতদের সঙ্গে নিঃস্বার্থ সাক্ষাৎ

পণ্ডিত, আলেম, জ্ঞানী, সম্মানিত, পূজনীয় ব্যক্তির সাথে নিঃস্বার্থভাবে মাঝে মাঝে দেখা করা ধর্ম জীবনের অঙ্গ। আজকাল নিঃস্বার্থ দেখা-সাক্ষাৎ উঠে গিয়েছে- যেখানে লাভের আশা থাকে, স্বার্থসিদ্ধির আশা থাকে, সেইখানে মানুষ মধু-মক্ষিকার মতো ঘোরে।

যে মানুষ অর্থশালী, যে রাজপদে নিযুক্ত তার বাড়িতে লোক ধরে না, তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ আত্মীয়তা করতে মানুষের উৎসাহের সীমা থাকে না। কিন্তু মহাজনেরা কখনও স্বার্থ চিন্তায় বড়লোকের কাছে আসা যাওয়া করেন না।

ঈশ্বর উদ্দেশ্যে, ঈশ্বর কার্যে জীবিত থাক- সেই উদ্দেশ্যে সজ্জনের সঙ্গে দেখা কর। এই-ই তোমাদের জীবিত থাকবার একমাত্র দাবি হোক।

ঈশ্বরের কার্য কী? তা মানব কল্যাণ, মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের সংবাদ বহন, বিদ্যালয় স্থাপন, হাসপাতাল নির্মাণ, মানুষকে সুখী ও মানুষ করবার প্রচেষ্টা, নিজে সুখী ও সম্পদশালী হওয়া, পরিবারবর্গ প্রতিপালন, প্রতিবেশীর মঙ্গল কামনা, নিজের মধ্যকার পশুভাব দমন, মানুষকে সত্যময় ও সুন্দর করা।

দেশের সম্মানিত ব্যক্তি যারা, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা উচিত। দাম্ভিক অহঙ্কারী হয়ে সম্মানিতকে তুচ্ছ করো না। প্রভুর কাছে দাস হয়ে নত হও এবং সর্ব প্রকারে তার। অনুগত থেকে তার মঙ্গল কর। সম্মানিতদের, পণ্ডিতজনকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা কর।

ঈশ্বরের কাছে ঐশ্বরিক শক্তি ও সাহায্য ভিক্ষা এবং এই জন্য আন্তরিকভাবে প্রার্থনা, সামাজিক ধর্ম জীবনের মর্যাদা রক্ষা, অর্থাৎ রোজা এবং আজানসহ সমবেতভাবে নামাজ পড়া।

তোমাদের দৈনিক জীবনের আলাপ ও গল্পের বিষয় এইসব লোক। হায়! মুসলমান সমাজের দৈনিক্সআলাপ হয় কী বিষয়ে যা বলতে লজ্জা করে। মানুষ মানুষের সহিত দেখা করে অতি জঘন্য স্বার্থে। কেউ কারো সঙ্গে আল্লাহর জন্যে সাক্ষাৎ করে না।

যেমন জগতে রাজার শাসন সম্বন্ধে সর্বদাই তোমরা আলোচনা কর, সভা কর, তেমনি আল্লাহর রাজ্য, তাঁর শাসন, নীতি, তাঁর রাজ্য বিস্তার সম্বন্ধে তোমরা আলোচনা কর, সভা কর। মানুষের সঙ্গে ভক্তি ও প্রেমের প্রেরণার উৎসাহে আন্তরিকতায় দেখা কর, সাক্ষাৎ কর। কীভাবে আল্লাহর রাজ্য চলেছে, চলবে।

প্রভুর সম্বন্ধে আমরা আরও কী করতে পারি। কীভাবে আল্লাহর সেবা আমরা তার কোটি কোটি ভক্ত সৈনিক সন্তান মিলে করতে পারব। কী করে পাপী আর তার অনুচরদলের অভিযান চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেব। এ আয়োজনে, এ কল্পনা কি তোমাদের আছে?

তোমরা আল্লাহর রাজ্যে বাস কর না তোমরা বাস কর ইংরেজদের রাজ্যে, সেই জন্যেই সেই কথা বল, সেই রাজ্যে বড় চাকরি পাবার জন্যে বড়লোকের দুয়ারে হানা দাও। তাঁর শাসন সম্বন্ধে কোনো আলোচনাও তোমরা কর না।

দেশের সম্মানিত ব্যক্তি যারা, তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা উচিত। দাম্ভিক অহঙ্কারী হয়ে সম্মানিতকে তুচ্ছ করো না। প্রভুর কাছে দাস হয়ে নত হও এবং সর্ব প্রকারে তার। অনুগত থেকে তার মঙ্গল কর। সম্মানিতদের, পণ্ডিতজনকে আন্তরিকভাবে শ্রদ্ধা কর।

দুষ্ট, অনাচারী, যে আল্লাহর পথে নাই, তাকে সম্মান করো না, তার কাছেও যেও না।

হাসপাতাল নির্মাণ

হাসপাতাল নির্মাণের কথা একবার কেন, অনেকবার বলেছি। আবার বলি, দেশের সর্বত্র পীড়িতের জন্য বিদ্যালয় স্থাপনের পাশে পাশে হাসপাতাল, যক্ষ্মাগার স্থাপিত হওয়ার মতো ধর্মকাজ আর নাই। পীড়িতের সেবা কর। এই হচ্ছে ধর্ম। শুষ্ক লবণহীন রোজা নামাজে কোনো ফল হবে না।

ইচ্ছা থাকলে এসব কাজে টাকার অভাব হবে না। প্রত্যেক মসজিদ ঘরে সম্মানিত, সাধু এবং যোগ্য পণ্ডিতকে পুরোহিত নিযুক্ত কর। তিনি চাঁদা তুলবেন, তিনি বিদ্যালয় স্থাপন করবেন, হাসপাতাল স্থাপন করবেন।

মৃত্যুর জন্যে ফাতেহা উপলক্ষে যে অর্থ একবেলায় ব্যয় করে ফেল তার কতক অংশ এইসব মহৎ জনহিতকর কাজে ব্যয় কর শত শত নারী ‘হোম’ গড়ে উঠবে! হে বন্ধু, শুধুই রোজা-নামাজ করে, ধর্ম জীবনের ইতি করো না। তোমার ধর্ম- জীবনের সার্থকতা ক্ষেত্র আরও বৃহত্তর। কসম আল্লাহর, তা আরও বৃহত্তর- কী করলে পাগলেরা, ধর্মজীবনকে এমনভাবে মিথ্যা করে দিলে?

তোমরা যে জীবনযাপন করলে ওকে কি ধর্মজীবন বলে? টিকির উপর টুপিটা রেখে গুনগুন করে সুর করে দরূদ পড়লেই কি ধার্মিক হওয়া যায়- মাঝে মাঝে বাড়িতে মৌলুদ দিলেই কি ধর্মের সংসার পাতা শেষ হল? তোমার জীবনের কাজ কই, পরিচয় কই?

পাপীর প্রতি ক্ষমাশীলতা

ধার্মিকের পক্ষে অহঙ্কার করা বড়ই অন্যায়। যে ধার্মিক মনে মনে অহঙ্কার করে, অধার্মিক, বেনামাজি বা পাপী অবোধকে ঘৃণা করে- তাকে ধার্মিক বলা যায় না। ধার্মিকের প্রাণে পাপীর জন্যে দরদ থাকা চাই।

আত্মমর্যাদা জ্ঞান

ধার্মিক ব্যক্তির আত্মমর্যাদা জ্ঞান থাকা চাই। আত্মমর্যাদা জ্ঞানকে অহঙ্কার বলা যায় না। জীবনে সূক্ষ্ম অনুভূতি চাই। যেন আত্মমর্যাদা জ্ঞান অহঙ্কাররূপে প্রকাশ না পায়। ছোটর কাছে যা মহত্ত্ব এবং শ্রেষ্ঠত্ব তা ভয়ে নত হওয়া উচিত নয়- এই-ই আত্মমর্যাদা জ্ঞানের ভাব।

ক্রোধ এবং অহঙ্কার

যতক্ষণ মনে ক্রোধ এবং অহঙ্কার আছে ততক্ষণ স্বর্গের আশা করো না। ক্রোধ মাটি করে ফেল। নিজে মাটি হও তবেই স্বর্গের যোগ্য হবে। তার একটু আগে নয়। যুদ্ধকালে জনৈক কাফের হযরত আলীর মুখ ভরে থুতু নিক্ষেপ করলো। তৎক্ষণাৎ আলী তাকে ত্যাগ করলেন।

কাফের কারণ জিজ্ঞাসা করলে আলী বললেন- বন্ধু যদি হত্যা করতে হয়, কর্তব্যের খাতিরে তা করতে হবে। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে নয়! তোমার। ব্যবহারে আমি ক্রুদ্ধ হয়েছি, তাই তোমায় ত্যাগ করলুম। কাফের তৎক্ষণাৎ আলীর কাছে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলো।

সে বললো, যে ধর্মে এমন কথা বলে, সে ধর্ম নিশ্চয় সত্য। জনৈক সাধুকে পরীক্ষার জন্যে ৮০ বার ডাকা হল। ৮০ বার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হল। সাধু কিছুমাত্র ক্রুদ্ধ বা উত্তেজিত হলেন না।

নবী করিম বলেছেন- যার ভিতর এক বিন্দু অহঙ্কার আছে সে স্বর্গের যোগ্য নয়। ক্রোধ আর অহঙ্কার একই জিনিস। যিনি ক্রোধ জয় করতে পেরেছেন, তিনি অহঙ্কারও জয় করেছেন।

নামাজ পড়তে পড়তে শিশুদের কলরব শুনে ক্রোধে তাদের উপর মুখভঙ্গি করে ওঠ। এখনও ঠিক পাও নাই, ধর্ম কি জিনিস? নামাজের ঘরেই শুধু যাওয়া-আসা কর।

নিজের ভিতরকার পশুগুলিকে চূর্ণ কর- তা হলেই তোমার ধার্মিকতা সিদ্ধ হবে।

প্রতিহিংসা

যদি পার মহতের কল্যাণ কর নিষ্ঠুরাচারীর অকর্মের প্রতিশোধ নিও। সেই তো ধার্মিকের প্রকৃতি। যেমন পশুর আচরণ পেয়েছ, ঠিক তেমনি করে তুমিও কি করবে? না, না, না, কখনও না।

যে তোমায় আঘাত করেছে, হৃদয়ে বেদনা দিয়েছে, হত্যা করতে এসেছে, তাকে প্রেম করে ভালবেসে, জীবন দিয়ে প্রতিশোধ নাও। সেই হচ্ছে ধার্মিকের কাজ। স্বামীকে বিষ দিয়ে জায়দা নারী-ধর্ম পালন করেছেন। এমাম মরণকালে বললেন, জায়েদার সমস্ত পাপ আমি ক্ষমা করেছি। যাবৎ না তিনি স্বর্গে প্রবেশ করেন, তাবৎ স্বর্গ আমার জন্যে হারাম।

জনৈক স্পেনিস্ ভদ্রলোকের একমাত্র পুত্রকে হত্যা করে জনৈক খ্রিষ্টান যুবক তারই গৃহে আশ্রয় নিয়েছে। ভদ্রলোক যুবককে একটি অশ্ব আর একখানি তরবারি দিয়ে বললেন, যুবক রাত্রি, প্রভাত না হতেই পালিয়ে যাও, কী জানি পিতার মন, দুর্বল হয়ে তোমাকে আঘাত করতে পারি। এই হচ্ছে হত্যার উত্তম প্রতিশোধ!

জনৈক লম্পট হিন্দু নরপতি দরিদ্র ব্রাহ্মণ বধূর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে হরণ করবার জন্যে সহস্র সুবর্ণ মুদ্রাসহ লোক পাঠিয়েছেন। ব্রাহ্মণবধূ স্বহস্তে আপন গোপন পুষ্পবৎ স্তনযুগল কেটে রক্তমাখা করে একখানি থালায় স্থাপন করে নিজ হস্তে দূতের হাতে দিয়ে বললেন- এই নাও তোমার রাজ্য।

যে জিনিসের লোভ করেছেন, তাই নিয়ে তাকে দাও, নির্লজ্জ লম্পটের নির্লজ্জ ব্যবহারের এই-ই উত্তম প্রতিশোধ!

(সমাপ্ত)

<<ঈমান ধর্ম-বিশ্বাস

…………………….
ধর্ম জীবন – লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

.……………………
আরও পড়ুন-
ঈমান ধর্ম-বিশ্বাস
ধর্মের ব্যাখ্যা
ধর্মের জীবিত উৎস
ঈশ্বরের রাজ্য বিস্তার
অনুদান ও দুঃখের উপশম চেষ্টা

……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত

………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!