শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এগারো
অদ্বিতীয় নাম
বেলা এগারটায় দীক্ষার্থীদের দীক্ষা হইল। দীক্ষিতদিগকে শ্রীশ্রীবাবামণি উপদেশ দিলেন,-আজ যে মহামন্ত্র পেলে, একে জানবে একেবারে অদ্বিতীয়। এর সমকক্ষ আর কোনো মন্ত্র নেই। জগতের যত মন্ত্র, সবমন্ত্রের এটী শ্রেষ্ঠ, এটী হচ্ছেন মন্ত্ররাজ, সকল মন্ত্রের ইনি রাজাধিরাজ।
এই একটী মন্ত্র ধ’রে ভগবানকে ডাকলে তাঁর সকল নাম এক সঙ্গে করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন মন্ত্রে, ভিন্ন ভিন্ন নামে তাঁকে ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। এই একটী মাত্র নামে তাঁকে ডাক্ লেই তিনি পরম তুষ্ট, পরম তৃপ্ত।
শান্তির বারতা দ্বিতীয় খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ৫৮ – ৫৯)
গুরুভাই
একজন তার গুরুভাই-এর সহিত কলহে লিপ্ত বলিয়া জানা গেল। শ্রীশ্রীবাবামণি তাহা শুনিয়া বলিলেন,-
চমৎকার গুরুভাই তোমরা। এক গুরুভাই অপর গুরুভাইয়ের সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হ’লে সেটাকে গৌণ ভাবে গুরুদ্রোহ বলা চলে। পিতা যেমন তাঁর সন্তানের ভিতরে বিদ্যমান থাকেন, গুরু তেমন তাঁর শিষ্যের ভিতরে থাকেন।
ভাইকে মঙ্গলের পথে পরিচালনা করা যেমন প্রকারান্তরে পিতৃসেবা করা, গুরুভাইকে কল্যাণযুক্ত করার জন্য শ্রম করা ঠিক তেমনি গুরুদেবের সূক্ষ্ম বা গৌণ সেবা করা। এই বোধ নিয়েই গুরুভাই গুরুবোন্ দের সঙ্গে ব্যবহার কত্তে হয়।
যারা গুরুর প্রতি অতীব শ্রদ্ধাশীল, তারা গুরুভাই বা গুরুভগিনীর প্রতি অতিশয় দরদী, অতিশয় সুবিবেচক ও নিরতিশয় সাহায্যকারী হ’তে বাধ্য হয়। গুরুভাইবোনদের ভিতরে পাপ ও অপরাধ প্রবেশ কর্ল্লে তা সংশোধন করার ভদ্র চেষ্টা তারা কর্ব্বেই কিন্তু প্রয়োজন হ’লে গুরুভাই ও গুরুবোনের স্বার্থ ও সম্মান রক্ষার জন্য প্রাণও দেবে। এটাই গুরুভাই বা গুরুবোন্ কে শ্রদ্ধা করার বাস্তব প্রমাণ।
অখণ্ড-সংহিতা ত্রয়োবিংশ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২৬১ – ২৬২)
গুরুকৃপা ও পুরুষকার
একজন যুবক বলিলেন,-লোকে বলে গুরুকৃপায়ই সব হয়, পুরুষকার কিছুই নয়।
শ্রীশ্রীবাবামণি হাসিতে হাসিতে বলিলেন,-
আমিও ত’ তাই বলি, আর তার জন্যই ত’ প্রাণপণে কোদাল মারি, প্রাণপণে দেশ ঘুরি, প্রাণপণে চিঠি লিখি আর প্রাণপণে নাম জপি!
যুবক বলিলেন,- মানে?
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
গুরুসঙ্গই তোমার পুরুষকারকে উৎসাহ প্রদান করে। এটীই হচ্ছে তাঁর কৃপা।
ভবিষ্যতের গুরু
অন্যান্য নানা কথাপ্রসঙ্গে শ্রীশ্রীবাবামণি একজনকে বলিলেন,-আমার যা ধারণা, আমার পরে আমার গোষ্ঠীতে আর কেউ গুরু থাক্ বেন না। বিধি অনুযায়ী দীক্ষার্থীর দীক্ষার ব্যবস্থা থাক্ বে, কিন্তু ব্যক্তিগত গুরু কেউ থাক্ বেন না। তখন শিষ্যগুলি গুরুকৃপা অনুভব কর্ব্বে কার সঙ্গ ক’রে বল ত?
পৃষ্ঠ ব্যক্তি নিরুত্তর রহিলেন।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
নামই হবেন তখন প্রত্যক্ষ গুরু। তাঁর সেবাই হবে গুরুসেবা। তাঁর পূজাই হবে, গুরুর পূজা। তাঁর কৃপাই হবে গুরুর কৃপা। জ্যেষ্ঠ গুরুভ্রাতারা গুরুকে দেখিয়ে দেবেন, কিন্তু কেউ এসে স্বয়ং গুরু হবেন না বা গুরুত্বাভিমান পোষণ কর্ব্বেন না।
অখণ্ড-সংহিতা সপ্তম খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২২৯ – ২৩০)
দীক্ষার পরে সাধনা প্রয়োজন
দীক্ষান্তে শ্রীশ্রীবাবামণি উপদেশ দিলেন,-দীক্ষা নিয়েই মনে ক’রো না, কাজ হ’য়ে গেল। এর পর সাধন করা চাই। নামকে-ওয়াস্তে সাধন নয়-একাগ্র, উদগ্র, একনিষ্ঠ ভাবে সাধন কত্তে হবে।
টিকিট কিন্ লেই কেউ বৃন্দাবন যেতে পারে না, গাড়ীতে চেপে বসা চাই, ভীড়ের ঠেলা সহ্য ক’রেও গাড়ীর আসনটী আঁকড়ে ধরা চাই, ধাক্কাধাক্কির ঠেলায় ছিট্ কে গাড়ীর বাইরে প’ড়ে গেলে চল্ বে না। চতুর্দ্দিকের বিশৃঙ্খলা চিৎকারে গ্রাহ্য মাত্র না ক’রে নিজের জায়গায় জোর ক’রে লেগে থাকা চাই।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
তোমরা কেউ জানো না যে, তোমাদের এক একজনের প্রাণের অন্তস্তলে কত অপরিমেয় প্রেম সঞ্চিত হ’য়ে লুকিয়ে আছে। তোমরা কল্পনাও কত্তে পারনা যে, প্রেমের অতুলনীয় গুপ্তধনে তোমরা এক এক জনে কত বড় ধনী। নামের সেবা ক’রে ক’রে অন্তরের আবরণকে উন্মোচিত কর, নিজের মূর্ত্তি নিজের চখে একবার ভাল ক’রে তাকিয়ে দেখ। অবাক্ হ’য়ে যাবে!
দেখ্ বে, প্রেমই তোমার স্বভাব, প্রেমই তোমার স্বরূপ, প্রেমেই তোমার উৎপত্তি, প্রেমেই তোমার বিলয়, প্রেমেই তোমার নিঃশ্বাস-বায়ু প্রেমই তোমার হৃৎস্পন্দন, প্রেম ছাড়া তোমার অস্তিত্বই অসম্ভব।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-তোমার সেই অপার্থিব দৈব স্বরূপকে চিনে নেবার জন্যই আজ তুমি দীক্ষা পেয়েছ। দীক্ষা শুধু কাণে কাণে একটী মন্ত্র শুনে নেওয়াই নয়, দীক্ষার মানে আত্মস্বরূপ চেনার পথে প্রথম পাদচারণা করা। এই যে সাধন সুরু হ’ল, শেষ নিঃশ্বাস পর্য্যন্ত পূর্ণ আস্থার সহিত, পূর্ণ বিশ্বস্ততার সহিত এই সাধন ক’রে যাবে। আজ তারই সঙ্কল্প কর।
শান্তির বারতা
(পৃষ্ঠা নং ২২ – ২৩)
কোলাহলের মধ্যে ধ্যান-সাধনা
অপরাহ্ণে শ্রীশ্রীবাবামণি হেদুয়ার মাঠে (কর্ণওয়ালিশ স্কোয়ারে) গেলেন, চতুর্দ্দিকে জনতা, কিন্তু কেহ কাহারও প্রতি আসক্ত নহে, প্রত্যেকটী মানব নিজ নিজ রুচির স্রোতে ভাসিয়া স্বাধীন ভাবে বেড়াইতেছে।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
বাইরের বিশ্বের প্রতি ঔদাসীন্যের সাধনা থাক্ লে, এই জনতাই তপঃসাধনের উপযুক্ত ক্ষেত্রে পরিণত হ’তে পারে। কেউ এখানে স্থায়ী নয়, কেউ আস্ ছে, কেউ যাচ্ছে, যে এসেছে সে থাক্ বে না, যে গিয়েছে হয়ত সে শীঘ্র আস্ বে না, যদি বা আসে, তবে আবার যাবে, এই যে চির-চঞ্চল বিকারশীল বিপ্লবময় অবস্থা,
এর মাঝখানে নির্ব্বিকার হ’য়ে সাধন করা খুব কঠিন নয়। চাই মাত্র একটু ঔদাসীন্য, একটু নিরপেক্ষতা। বলিয়াই শ্রীশ্রীবাবামণি ধ্যান–নিমগ্ন হইলেন। শ্রীশ্রীবাবামণির সঙ্গে যে তিনটী যুবক ছিলেন, তাঁহারাও ধ্যানস্থ হইলেন।
পাপ-পুণ্য উভয়েরই অতীত হও
ধ্যান-ভঙ্গের পরে শ্রীশ্রীবাবামণি উপদেশ দিতে লাগিলেন,-পাপে জর্জ্জরিত হ’য়ে কলুষের জ্বালায় জ্ব’লে পুড়ে অনুভব করেছ যে, পাপের অতীত হ’তে হবে, নইলে তাপের অতীত হওয়া যায় না। তাই তুমি ঈশ্বরানুধ্যানে রুচি পাও, তৃপ্তি পাও, তাই তাঁর কথায় তোমার প্রাণে আশা জাগে, উৎসাহ জাগে।
কিন্তু সাধন কত্তে কত্তে তুমি পুণ্যেরও অতীত হবে। পাপ বা পুণ্য কোনও কিছুরই তুমি অপেক্ষা রাখ্ তে পার না। তুমি হবে উভয়ের সম্পর্কেই নিরপেক্ষ।
নিরপেক্ষ আস্বাদন
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
দুঃখের অতীত হ’লে সুখ আসে, কিন্তু সুখ-দুঃখের অতীত হ’লে আনন্দ আসে। পাপের অতীত হ’লে পুণ্য আসে কিন্তু পাপ-পুণ্য উভয়ের অতীত হ’লে শান্তি আসে। শান্তি ও আনন্দ হচ্ছে নিরপেক্ষ আস্বাদন।
অখণ্ড সংহিতা সপ্তম খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ১৪০ – ১৪১)
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : বারো>>
……………..
আরও পড়ুন-
স্বামী স্বরূপানন্দের বাণী
স্বামী স্বরূপানন্দ : গুরু-শিষ্য
স্বামী স্বরূপানন্দ : সরল ব্রহ্মচর্য্য
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ : চিঠিপত্র
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ : উপাসনা
স্বামী স্বরূপানন্দ : কবিতা/গান
স্বামী স্বরূপানন্দ : উপদেশ
স্বামী স্বরূপানন্দ : উপদেশ দুই
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এক
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দুই
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তিন
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চার
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পাঁচ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ছয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সাত
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আট
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : নয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দশ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এগারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : বারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চোদ্দ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পনেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ষোল
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সতেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আঠারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : উনিশ
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………….
আরও পড়ুন-
মহানবীর বাণী: এক
মহানবীর বাণী: দুই
মহানবীর বাণী: তিন
মহানবীর বাণী: চার
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: এক
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: এক
গৌতম বুদ্ধের বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: তিন
গৌতম বুদ্ধের বাণী: চার
গুরু নানকের বাণী: এক
গুরু নানকের বাণী: দুই
চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী
কনফুসিয়াসের বাণী: এক
কনফুসিয়াসের বাণী: দুই
জগদ্বন্ধু সুন্দরের বাণী: এক
জগদ্বন্ধু সুন্দরের বাণী: দুই
শ্রী শ্রী কৈবল্যধাম সম্পর্কে
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বাণী
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ১ম খন্ড
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ২য় খন্ড
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ৩য় খন্ড
স্বামী পরমানন্দের বাণী: এক
স্বামী পরমানন্দের বাণী: দুই
স্বামী পরমানন্দের বাণী: তিন
স্বামী পরমানন্দের বাণী: চার
স্বামী পরমানন্দের বাণী: পাঁচ
স্বামী পরমানন্দের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: এক
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: দুই
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: তিন
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: চার
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: পাঁচ
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: সাত
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: আট
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: নয়