ভবঘুরেকথা
ভক্তের প্রকার ভক্তি ভক্ত

মহৎ জীবন : পর্ব তিন

-লুৎফর রহমান

মা অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন- বাপ তোর মধ্যে এত মহত্ত্ব, এত মনুষ্যত্ব জেগেছে? আমার বহু রাত্রির নয়ন-জলের প্রার্থনা তা হলে খোদা শুনেছেন। তোর বাপকে যেদিন রোমবাসীরা হত্যা করে, সেদিন তার কণ্ঠের খানিকটা লাল রক্ত আমি সংগ্রহ করেছিলাম, আমার বুকে যে মাদুলি দেখছিস এর মাঝে সেই রক্তটুকু একটু ছোট ন্যাকড়ায় ভরে রেখে দিয়েছি।

আজ আঠার বছর শয়নে-স্বপনে এর রক্ত আমি টেনে বেড়াচ্ছি। তোর বাপের সেই ত্যাগ-মহিমার চিহ্ন আজ তোর গলে পরিয়ে দেবো। এই কথা বলে প্যানক্রিয়াসের মা চোখের জলে কণ্ঠের মাদুলিটি ছেলের গলে পরিয়ে দিলেন।

এর কয়েকদিন পরে রোমবাসীরা যুবক প্যানক্রিয়াসকে ধরে নিয়ে চিতা বাঘ-দিয়ে খাইয়ে দিয়েছিল। এ জগতে আগুন, আঁখিজল আর রক্তের ভিতর দিয়েই সত্য, কল্যাণ জয়যুক্ত হয়ে থাকে।

কত দুঃখের ভিতর দিয়ে হযরত মোহাম্মদ (স), হযরত ঈছার (আ) ধর্মের সংস্কার সাধন করেন। মানব-সমাজের যখন অধঃপতন হয়, তখন শুধু ধর্মবিশ্বাস তাদেরকে বড় করে রাখতে পারে না। হযরত ঈছার (আ) মহাধর্ম যখন বিলুপ্ত হয়েছিল, তখনই আরব মরুভূমির মাঝে এক নতুন মহাপুরুষ মানুষের জন্য কল্যাণ-মন্ত্র নিয়ে দাঁড়ালেন।

মহৎ যিনি, তিনি বড়। ক্ষমতা আছে, কিন্তু যে ক্ষমতার নিত্যই অপব্যবহার হয়, অর্থ আছে- কিন্তু যে অর্থ কেবল জমিদারি ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যায়, এরূপ ক্ষমতা ও অর্থের মালিককে বড় বলা যায় না। যারা তার কাছে লাভের আশা করে, যারা তার আত্মীয় তারাই। তার তোষামোদ ও প্রশংসা করে। জ্ঞানী ও সত্যের সেবক যারা তারা এদেরকে সম্মান করেন না।

যে কঠিন কথা বলতে পারে, সে নিজকে কত ছোট করে ফেলে। যে নীরবে অপমান। সহ্য করে শত্রুর মঙ্গল চায়- সে কত মহৎ! যিনি মহৎ। তিনি অপমানের বিরুদ্ধে সহজে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন না, তিনি অপেক্ষা করেন। আল্লাহর কাছে তিনি শত্রুর সুবুদ্ধির প্রার্থনা করেন। তিনি কাতরভাবে বললেন- হে খোদা, এরা কিছু বোঝে না, এদিগকে ক্ষমা কর।

জাতীয় অপমান সহ্য করা মহত্ত্বের লক্ষণ নয়, বরং তা কাপুরুষতা! প্রতিশোধ নেবার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যদি প্রতিশোধ না নেই, সেখানেই চরিত্র মাহাত্ম্যের পরিচয় দেয়া হয়।

অপদার্থ ব্যক্তির অন্যায় ক্রোধের কথা শুনে চুপ করে থাকায় বিপুল মহত্ত্ব আছে। অন্যায় বা অপমানের কথা শুনে মনকে শান্ত করে রাখা সহজ কথা নয়। ক্রোধ যদি সংযত করতে পার, লোকে জানুক বা না জানুক, মহত্ত্বের পরিচয় নিয়ে যদি তুমি প্রাণে তৃপ্তি লাভ করতে পার তাহলে তোমার ভিতরে একটা দুর্জয় শক্তি জেগে উঠবে। ভিতরকার শক্তিই আমাদেরকে বড় করে তোলে- এ শক্তি লাভ হয় জ্ঞান চরিত্রবল আর পুণ্যকার্যে।

বড় মরণে যদি জীবনের বালাই হতে মুক্তি পাওয়া যায়, তবে তা কত সুখের হয়। এ জগতে কামনা-বাসনার কোনো তৃপ্তি নাই। অনন্ত ক্ষুধা মানুষকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিচ্ছে। দুঃখ-পাপের কঠিন চাপে মানুষের হৃদপিণ্ড ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। এ জগতে কীসের সুখ? গত জীবনে যত সুখভোগ করেছি, তার একটুও তো মনে নাই- সে কেবল একটা বিরাট স্বপ্ন আর কিছু নয়।

যতকাল বেঁচে আছি ততকাল যেন কোনো অন্যায় না করি, জীবনে যে মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেবো সেই স্মৃতিটুকু মৃত্যুকালে আমার প্রাণে যথার্থ আনন্দ আনবে। যতক্ষণ বেঁচে আছি ততক্ষণ পাপ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো, যথাসাধ্য মানুষের দুঃখ-কষ্ট মোচন করতে চেষ্টা করবো।

তারপর মৃত্যুর দ্বারা আমাদের মুক্তি হবে। এ জগতে অনন্ত কোটি মানুষ এসেছিল, কোথায় তারা? কত যুবক-যুবতী এ জগতে কত হাসি হেসেছে- কোথায় সে সব হাসি? কেন মিছে এই স্বপ্ন-ভস্মের জন্য এত মারামারি?

অভাব ও দারিদ্র মানুষের মনুষ্যত্বকে চূর্ণ করে দেয়, কী মহত্ত্বের পরিচয় সে দেবে? প্রাণ দিয়েই যে সব সময় মানুষের কল্যাণ করতে হবে, এমন কথা হতে পারে না। দুঃখী দরিদ্রকে অর্থ দিতে হবে, দরিদ্রের জন্য ভিখারি হতে হবে। কিন্তু যার কিছু নাই, সে তো পূর্বেই ভিখারি হয়ে আছে, সে আর কী দিয়ে ভিখারি হবে? অর্থ উপার্জন কর মানুষের জন্য, এরই নাম মহত্ত্ব!

নয়নে অশ্রু, হৃদয়ে প্রেম, আর হাতে অর্থ মানুষকে মহৎ করে। জীবনে অর্থ সঞ্চয় করতে হবে- পরের জন্য। যে সঞ্চয় করে, পরের জন্য যিনি দরিদ্র জীবনযাপন করেন, মানব মঙ্গলে অর্থ ব্যয় করেন, তিনি নিশ্চয়ই মহৎ।

ব্রহ্মদেশে একবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, এক ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকার চাল দুঃস্থ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছিলেন। দরিদ্রের পক্ষে মানুষের এত কল্যাণ করা কি সম্ভব?

মহৎ যিনি, তিনি বড়। ক্ষমতা আছে, কিন্তু যে ক্ষমতার নিত্যই অপব্যবহার হয়, অর্থ আছে- কিন্তু যে অর্থ কেবল জমিদারি ক্রয় করতেই শেষ হয়ে যায়, এরূপ ক্ষমতা ও অর্থের মালিককে বড় বলা যায় না। যারা তার কাছে লাভের আশা করে, যারা তার আত্মীয় তারাই। তার তোষামোদ ও প্রশংসা করে। জ্ঞানী ও সত্যের সেবক যারা তারা এদেরকে সম্মান করেন না।

মেয়ে বললে- না মা, সে কি হয়? দেখ, আমি এখন অবিবাহিতা, আমার জীবনের মূল্য নাই। আমার মৃত্যুতে জগতের বিশেষ কিছু আসবে যাবে না। তুমি মরে গেলে তোমার এ ছোট শিশুটির যত্ন করবে কে? মেয়েটির পিতা অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন- মা, আমি বুড়ো হয়েছি, আমার জীবনের মূল্য খুব কম। তোমরা বাড়ি যাও, আমিই বিপন্নদের সেবা করতে যাবো।

ইচ্ছা করলে ধনীরা জীবনে কত মহত্ত্বের পরিচয় দিতে পারেন? মানুষের লক্ষ মণ অর্থ থাকলেও যদি সে জ্ঞান- দরিদ্র হয়, সে বোঝে না প্রকৃত ধর্মপালন কীসে হয়। প্রেমহীন মায়াহীন নিষ্ঠুর প্রাণের উপাসনার যে কোনো মূল্য নাই- এ কথাও সে জানে না। সে পীড়িত নর-নারীর বুকের উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি ওজু করে মিলাদ ও ধর্মসভায় যোগ দেয়।

আমেরিকার কাছ দিয়ে সমুদ্রপথে একখানি যাত্রী জাহাজে এক ইংরেজ দম্পতি যাচ্ছিল। সঙ্গে তাদের কয়েকটি ছেলেমেয়ে। বড় মেয়েটির বয়স আঠার বৎসর হবে- তার নামটি আমার ঠিক মনে নাই। হঠাৎ জাহাজের কাপ্তানের কানে দূরের একখানি জাহাজের বিপদ সংকেতের ধ্বনি এসে লাগল।

কাপ্তান দূরবীন দিয়ে দেখলেন, বহুদূরে একখানি জাহাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নাবিকদের তিনি সেদিকে জাহাজ চালাতে হুকুম দিলেন। প্রায় অর্ধ ঘণ্টা পরে বিপন্ন জাহাজের নিকটবর্তী হয়ে দেখা গেল, জাহাজখানি জনমানবশূন্য।

মাত্র ২-৩ জন লোক বিষণ্ণ মনে ডেকের একধারে মলিন মুখে বসে আছে। নূতন জাহাজখানি বিপন্ন জাহাজের পাশে লাগতেই তারা উঠে এল, সমস্ত যাত্রীরা তাদের কী বিপদ জানবার জন্যে সমুৎসুক হয়ে জাহাজের এক পাশে এসে দাঁড়ালেন।

কাপ্তানের প্রশ্নের উত্তরে তারা বললো ভীষণ কালাজ্বরে সবাই মারা গিয়েছে, যারা এখনও মরে নি তারাও মরার মতো হয়ে কেবিনের মাঝে পড়ে আছে। কেউ তাদের দেখবার নাই। আমরা মাত্র তিনটি প্রাণী ভালো আছি। কালাজ্বরের কথা শুনে যাত্রীদের ভিতরে একটা চাঞ্চল্য দেখা দিল, কারণ এই জ্বর ভয়ঙ্কর ছোঁয়াচে- এ জ্বর হলে রোগী মরবেই!

কাপ্তান গভীরভাবে যাত্রীদিগকে লক্ষ্য করে বল্লেন- যাত্রীদের মাঝে এমন কেউ কি নাই, যিনি এই বিপন্ন লোকগুলিকে সাহায্য করবার জন্য যেতে পারেন! এ কথাও বলছি, যিনি এদের মাঝে যাবেন, তাঁর প্রাণের আশা খুব কম। মরবার পণ করেই এদের মাঝে যেতে হবে।

কেউ কথা বলছিল না। কাপ্তান আবার বললেন, এখানে যাত্রীর সংখ্যা অল্প, কিন্তু। তবুও মনুষ্যত্বের পরিচয় দেবার মতো কি কেউ নাই?

একটি মেয়ে বললে- আমি এদের মাঝে যাব। সবার মুখ প্রশংসা ও শ্রদ্ধায় উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। যে ইংরাজ দম্পতির কথা বলেছিলাম এই মেয়েটি তাদেরই!

মহৎ প্রাণ যুবতীটির মা কেঁদে বললেন, মা তুমি প্রাণ দেবার জন্য এদের মাঝে যাবে? তুমি মরো না, বেঁচে থাক।- আমার মরবার সময় হয়েছে, আমি এদের মাঝে যাবো।

মেয়ে বললে- না মা, সে কি হয়? দেখ, আমি এখন অবিবাহিতা, আমার জীবনের মূল্য নাই। আমার মৃত্যুতে জগতের বিশেষ কিছু আসবে যাবে না। তুমি মরে গেলে তোমার এ ছোট শিশুটির যত্ন করবে কে? মেয়েটির পিতা অশ্রুসিক্ত চোখে বললেন- মা, আমি বুড়ো হয়েছি, আমার জীবনের মূল্য খুব কম। তোমরা বাড়ি যাও, আমিই বিপন্নদের সেবা করতে যাবো।

কন্যা বল্লো- বাবা, তুমি গেলে আমার ভাই-বোনগুলি আর কাকে অবলম্বন করে বাঁচবে? আর তুমি পুরুষ- তোমার কি সেবা-শুশ্রূষা করা সাজে? দয়া করে আমাকে অনুমতি দাও। সেবা দ্বারা জীবনকে ধন্য করবার সুযোগ আমাকে দাও। এর চেয়ে জীবনকে সুব্যবহার সব সময় ঘটে না।

সময় সংক্ষিপ্ত। অধিকক্ষণ অপেক্ষা করবার সময় ছিল না। পিতা স্নেহে কন্যার ললাট চুম্বন করলেন। মা, কন্যাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে সজল নয়নে বললেন- মা, ধন্য তোমার জীবন, তোমাকে পেটে ধরে আমিও আজ ধন্য হলাম।

বড় বাজারে এক তাঁতীর একখানা দোকান ছিল। একদিন দোকানে বেচাকেনা করবার সময় একটা জরুরি কাজে করিম বখ্শ বলে এক ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেলেন। করিম বখশ এক ঘন্টা দোকানে বসে থাকলো, কিন্তু তবুও দোকানদার ফিরে এলো না।

জাহাজের যাত্রীরা সবাই এসে বালিকাটির সঙ্গে করমর্দন করলেন। ছোট ভাই বোনগুলিকে একবার কোলে করে এই মহাপ্রাণা বালিকা বিপন্ন যাত্রীদের জাহাজে নেমে গেলেন।

অনেক সময় দরিদ্রের মাঝে মহত্ত্বের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখা যায়, শিক্ষিত ও বড়োলোকদের মাঝেও তা পাওয়া যায় না। দরিদ্র সাধারণ মানুষের মহত্ত্ব, সহৃদয়তা ও ছোট ছোট দানের নিকট জগৎ বহু পরিমাণ ঋণী। কয়েকটি হাসপাতাল বা অতিথিশালা মানুষের দুঃখের বহু পরিমাণ মীমাংসা করলেও পল্লীর সহৃদয় দীন-দুঃখী মানুষ নীরবে দুঃখ মোচন করে।

পরের অর্থ অপহরণ করে লোকে বড় মানুষ হয়েছে এরূপ দৃষ্টান্ত অনেক আছে। কিন্তু পরকে মানুষ কেমন করে একেবারে নির্লোভ হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা তুলে দিয়েছে, তার গোটা দুই দৃষ্টান্ত আমি এখানে দেবো। এই সব মানুষ জড় দেহের ভোগ অপেক্ষা আত্মার সাত্ত্বিক তুপ্তির ভিখারি।

মানব সংসারে এই ভাবের মানুষের আবির্ভাব বেঁচে থাকে। ভণ্ড নরপিশাচেরা এ জগতের কেবলই অকল্যাণ করে, আর মহাপ্রাণ জাতিরা জগতের কল্যাণ, সুখ ও আনন্দ বর্ধন করেন।

কলিকাতা মদন মোহন দত্তের বাড়ির ঝি-এর ছেলে রামদুলাল, দত্তের বাড়িতে সরকারের কাজ করতো। এই যুবক এক সময় প্রভুর টাকায় এক লক্ষ টাকা লাভ করে। রামদুলাল ইচ্ছে করলে এই টাকা নিজে নিতে পারত, তাতে তার বিশেষ অন্যায় হতো না।

প্রভুর টাকা প্রভুকে ফিরিয়ে দিয়ে লাভের টাকা নিজে নিলে প্রভু কিছুই জানতে পারতেন না। রামদুলালের ভিতরে যে আশ্চর্য মহত্ত্বের গৌরব ঘুমিয়ে ছিল, তা তাকে বলেছিল, দুলাল, এই টাকা তুমি তোমার প্রভুকে দিয়ে দাও। জীবনের মহত্ত্বের কাছে এই লক্ষ টাকার মূল্য খুবই কম।

দুলাল প্রভুর সামনে যখন লক্ষ টাকা রেখে দিয়ে বললে- মহাশয়, আপনাকে না জানিয়ে আপনার টাকায় লাভ করেছি- এর উপর আমার কোনো অধিকার নাই, দয়া করে গ্রহণ করলে সুখী হবো। মদনমোহন বিস্মিত হয়ে বললেন- দুলাল, তোমার মধ্যে এত মহত্ত্ব এত মনুষ্যত্ব ছিল; তা তো কখনো বুঝি নি!

মানুষ এক পয়সার জন্য কতখানি নীচতার পরিচয় দেয়, আর তুমি এক লক্ষ টাকা কী করে আমাকে দিচ্ছ? আমি তো এর কিছুই জানি নে। তুমি মানুষ না দেবতা!- এ টাকা আমাকে দিতে হবে না। এ টাকা তোমারই, এর উপরে আমার কোনো অধিকার নাই।

প্রভুর আদেশে টাকা দিয়ে রামদুলাল ব্যবসা আরম্ভ করেন। উত্তরকালে তিনি বিখ্যাত ধনবান হয়েছেন। দুঃস্থ নর-নারীকে তিনি অনেক সময় গোপনে টাকা পাঠাতেন, কে যে কোথায় থেকে টাকা পাঠিয়েছে, কিছুই তারা জানতে পারতো না। মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষে তিনি লক্ষ টাকা দান করেন। কলিকাতা হিন্দু কলেজ স্থাপনের জন্য তিনি ত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।

এইবার এক মুসলমান যুবকের মাহাত্ম বলবো- যা শুনলে আপনারা মনে করবেন এও কি সম্ভব!

বড় বাজারে এক তাঁতীর একখানা দোকান ছিল। একদিন দোকানে বেচাকেনা করবার সময় একটা জরুরি কাজে করিম বখ্শ বলে এক ছেলেকে দোকানে বসিয়ে রেখে তিনি কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে গেলেন। করিম বখশ এক ঘন্টা দোকানে বসে থাকলো, কিন্তু তবুও দোকানদার ফিরে এলো না।

দোকান কি আর এত দিন আছে? করিম, আমি যে তোকে এমন রাজার হালে দেখবো, কখনও মনে করি নি। আর তুই যে কী, এমন করে। আমার কাছে পরিচয় দিলি, এ ভেবে আমার মনে যে আনন্দ হচ্ছে, তা আর কী বলবো। বল বাবা, তুই মানুষ না ফেরেস্তা!

এদিকে ক্রেতারা জিনিসপত্রের জন্যে তাগাদা করতে লাগলো, করিম বখশের জিনিসপত্রের দাম জানা ছিল, সে কয়েকখানা কাপড় বিক্রি করলো। দুঃখের বিষয় সারাদিন চলে গেল তবুও দোকানদার ফিরে এল না। করিম অগত্যা সেদিন আর বাড়ি যেতে পারলো না, দোকানদারের অপেক্ষায় সেখানেই রাত্রি যাপন করলো।

পরের দিন যথাসময়ে দোকান খুলে করিম মালিকের অপেক্ষা করতে লাগলো- কিন্তু মালিকের আর সন্ধান নাই। করিম অগত্যা নিজেই বেচাকেনা করতে লাগলো। এইভাবে ২/৩ দিন, শেষে এক মাস কেটে গেল, তাঁতী ফিরল না। করিম দোকানের ভার ফেলে যাওয়া অধর্ম মনে করে বিশ্বস্ত ভূত্যের মতো কাজ চালাতে লাগলো।

তাতী যাদের কাছে ঋণী ছিল, করিম তাদের সব টাকা পরিশোধ করলো। তাতীর হয়েই সে নতুন কাপড়ের চালান এনে দোকানের আয় ঠিক রাখলো। এক বৎসর অতিবাহিত হয়ে গেল। করিমের আন্তরিক চেষ্টায় দোকানের ক্রমেই উন্নতি হচ্ছিলো, শেষে এক দোকানের পরিবর্তে তিনটি দোকান স্থাপিত হল। করিম সব দোকানই তাঁতীর নামে চালাতে লাগলো।

লোকে ভাবলো, করিম তাঁতীর দোকান কিনে নিয়েছে। করিমের সম্মান প্রতিপত্তি ইত্যবসরে খুব বেড়ে গেল, সে মস্ত সওদাগর হয়ে বিরাট কারবার চালাতে লাগলো।

প্রায় সাত বছর অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। একদিন করিম দোকানের গদিতে বসে আছে, এমন সময় সে দেখলো, একটা বুড়ো লাঠি ভর করে তারই দোকানের সামনে করিম বলে একটা বালকের খোঁজ করছে। বুড়োর পরণে একখানা ময়লা কাপড়, রোগা চেহারা। শরীর একেবারে ভেঙ্গে গিয়েছে।

তাকে ভিক্ষুক বলে মনে হচ্ছিল। করিম দৌড়ে এসে বুড়োকে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরে বললো- আমি হচ্ছি সেই করিম, এই সাত বছর আমি আপনার দোকান পাহারা দিচ্ছি- দয়া করে এখন আপনি আপনার দোকানের ভার নিন, আমি বিদায় হই।

বৃদ্ধ করিমের মহৎ প্রাণের পরিচয় পেয়ে দুই চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলেন। বললেন- করিম, আমার আর কিছুর দরকার নাই, এসবই তোর! আমার এ সংসারে যারা আপন ছিল, সবাই ছেড়ে গেছে; এখন তুই আমার আপন। সেই সাত বছর আগের কথা, এখান হতে বেরিয়ে পথে সংবাদ পেলাম আমার পীর সাংঘাতিক পীড়া।

কালবিলম্ব না করে আমাকে বাড়ি যেতে হয়েছিল। যেয়ে দেখলাম পত্নীর মৃত্যুর কয়েকদিন পরে ছেলে দুটি মারা গেল। তারপর নানা দুর্বিপাকে আমি পড়ি। কিছুতে বাড়ি ত্যাগ করতে পারলাম না। তারপর এই দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে।

এখন আমার কেউ নাই, আত্মীয় স্বজন, অর্থ, দেহের বল সব হারিয়ে এখন পথের ফকির হয়েছি। অতি দুঃখে অনেক আশা নিরাশায় মনে হল কলিকাতায় যেয়ে একবার করিমের সন্ধান করি, তাকে যদি পাই তার কাছ থেকে ২/১ টাকা ভিক্ষা নেবো।

দোকান কি আর এত দিন আছে? করিম, আমি যে তোকে এমন রাজার হালে দেখবো, কখনও মনে করি নি। আর তুই যে কী, এমন করে। আমার কাছে পরিচয় দিলি, এ ভেবে আমার মনে যে আনন্দ হচ্ছে, তা আর কী বলবো। বল বাবা, তুই মানুষ না ফেরেস্তা!

উচ্চ অট্টালিকার আলোক-উজ্জ্বল কক্ষ, সাহানা- মল্লার মুকরিত ধনীর মর্মর সৌধ অপেক্ষা দরিদ্রের পর্ণকুটিরও সন্ধ্যার অন্ধকার সমাচ্ছন্ন বকুলগাছের পাতা-ভরা উঠানটিকে কবে বেশি শ্রদ্ধা করতে শিখবে? দেবতার জন্য সবাই পথ সাজিয়ে রেখেছে, পাপীর জন্য কবে তুমি ক্ষমা আর স্নেহ ছড়িয়ে দেবে?

করিম সবিস্ময়ে বললো- আপনি পিতার মতো আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন। সে বিশ্বাসকে আমি রক্ষা করতে পেরেছি, এই আমার পক্ষে ঢের। এর বেশি আমি কিছু আশা করি নি।

তাঁতী করিমের হাত থেকে দোকানের ভার গ্রহণ করলেন না। জীবনে তার আর কোনো বন্ধন রইল না। একটা মাসিক বন্দোবস্ত করে তিনি অতঃপর তীর্থে চলে গেলেন।

মানুষের জীবন যে এত সুন্দর, এত পবিত্র হয়, তা বিশ্বাস করতে মন চায় না। এই পাপময় মানব সমাজে মহৎপ্রাণ মানুষ আছে, মানুষ এদের নাম জানুক আর না জানুক, এরা যে জগৎকে ধন্য করে দিয়েছেন, সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নাই।

জীবনের প্রকৃত আনন্দলাভ হয়- মহত্ত্বের ও মনুষ্যত্বের পরিচয় দিয়ে। যে জীবন পবিত্রতা, মনুষ্যত্ব ও মহত্ত্বের আনন্দ হতে বঞ্চিত থেকে গেল, বৃথাই সে জীবন। এই উদার আকাশতলে এই আলোগন্ধভরা পৃথিবীর বুকে একবার পাপ, নীচতা ও অন্যায় হতে ফিরে দাঁড়াও- জীবনকে মহৎ ও গরীয়ান করে তোল।

শত্রুকে আঘাত দেওয়া খুব সহজ, কিন্তু তার জন্য অশ্রুপাত করা বড় কঠিন। পরাজয়ের পর হিমু (হেমচন্দ্র বন্দি হয়ে আকবরের সম্মুখে নীত হলেন, তখন তরবারি হাতে করে অশ্রুপূর্ণ নয়নে বৈরামকে তিনি বললেন- ওস্তাদ সাহেব, এই দুর্বল রোগজীর্ণ বন্দিকে হত্যা না করে কী ক্ষমা করা যায় না?

আকবরের প্রাণের মহত্ত্ব বোঝবার ক্ষমতা বৈরামের ছিল না। তিনি দুর্বল শত্রুর মাথা নিজ হস্তে ছেদন করেছিলেন। বৈরামের শক্তি ও শৌর্য দেখে মানুষ যখন ভীত শঙ্কিত হয়ে উঠছিল।- সে আজ কত দিনের কথা, মানুষ সে গরিমার কথা ভুলে গিয়েছে কিন্তু মানুষ এখনও বালক আকবরের অশ্রু সম্ভ্রমের সঙ্গে মনে করে রেখেছে।

মহাপুরুষ ডাক্তার বার্নাডো সারাজীবন গৃহহারা পথের বালক-বালিকাকে কুড়িয়ে বেড়িয়েছেন। মানুষ যাদের কথা ভাবে নি; বার্নাডো তাদের জন্য অশ্রু ফেলেছেন। এ জগতে এক একটা মানুষ কত মহৎ, কত বিরাট প্রাণ নিয়ে আসেন। তাদের নয়নে শুধু অশ্রু ঝরে, হৃদয়ে অনন্ত প্রেম বয়-মহত্ত্ব ও পুণ্যের প্রতিচ্ছবি,- তাঁরা যে পথ দিয়ে যান, সে পথের ধূলিকণাগুলিও পবিত্র হয়ে উঠে। তারা নিজের জন্য বেঁচে থাকেন না।

সব সময়ই কি ঐশ্বর্য ও সুন্দরী পত্নীর জন্য লালায়িত থাকবে? ত্যাগ ও প্রাণের পূজা করতে কি তোমরা শিখবে না? দরিদ্রের করুণ মুখ, নিঃসহায় নর-নারীর দীর্ঘশ্বাসকে সম্মান জানাতে তোমাদের মন কবে আনন্দ বোধ করবে?

উচ্চ অট্টালিকার আলোক-উজ্জ্বল কক্ষ, সাহানা- মল্লার মুকরিত ধনীর মর্মর সৌধ অপেক্ষা দরিদ্রের পর্ণকুটিরও সন্ধ্যার অন্ধকার সমাচ্ছন্ন বকুলগাছের পাতা-ভরা উঠানটিকে কবে বেশি শ্রদ্ধা করতে শিখবে? দেবতার জন্য সবাই পথ সাজিয়ে রেখেছে, পাপীর জন্য কবে তুমি ক্ষমা আর স্নেহ ছড়িয়ে দেবে?

মধুর কথা শুনে, সদ্ব্যবহার পেয়ে আমার মন পুলকে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে- নিষ্ঠুর কথা আর মানুষের দুর্ব্যবহার পেয়েও কবে তুমি নির্বিকার ও শান্ত হয়ে থাকতে শিখবে?

(সমাপ্ত)

<<মহৎ জীবন : পর্ব দুই ।। কাজ : পর্ব এক>>

………………..
মহৎ জীবন -লুৎফর রহমান।

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………….
আরও পড়ুন-
মহৎ জীবন : পর্ব এক
মহৎ জীবন : পর্ব দুই
মহৎ জীবন : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব এক
কাজ : পর্ব দুই
কাজ : পর্ব তিন
কাজ : পর্ব চার
ভদ্রতা : এক
ভদ্রতা : দুই

……………………
আরও পড়ুন-
মহামানুষ … মহামানুষ কোথায়
মহিমান্বিত জীবন
মহামানুষ
যুদ্ধ
স্বাধীন গ্রাম্যজীবন
আত্মীয়-বান্ধব
সত্য প্রচার
নিষ্পাপ জীবন
উপাসনা
নমস্কার
তপস্যা
তীর্থ-মঙ্গল
আত্মার স্বাধীনতার মূল্যবোধ
মনুষ্য পূজা
মন্দতাকে ঘৃণা

……………………….
আরও পড়ুন-
মানব-চিত্তের তৃপ্তি
আল্লাহ্
শয়তান
দৈনন্দিন জীবন
সংস্কার মানুষের অন্তরে
জীবনের মহত্ত্ব
স্বভাব-গঠন
জীবন সাধনা
বিবেকের বাণী
মিথ্যাচার
পরিবার
প্রেম
সেবা
এবাদত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!