শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ছয়
নামই একান্ত শরণ
বেলা সাড়ে নয় ঘটিকায় ভগিনী শ্রীযুক্তা সুরবালা পাল, তাঁহার ভক্তিমতী কন্যা আশালতা দত্ত, জামাতা অশ্বিনীকুমার এবং প্রফুল্লবালা প্রভৃতির দীক্ষা হইল।
দীক্ষান্তে শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
শত যোজন দূর থেকেই আমি তোমাদের প্রাণে ঈশ্বর-ব্যাকুলতা বর্দ্ধিত কর্ব্ব এবং শ্রীভগবানের প্রভাব ও উপস্থিতি সর্ব্বেন্দ্রিয়ে অনুভব করাব। আমার এই প্রতিশ্রুতিতে তোমরা বিশ্বাস রাখ। বাহিরের সহস্র মত সহস্র পথ তোমাদের নানা দিকে আকর্ষণ কত্তে চাইলেও তোমরা গৃহীত সাধনের প্রতি নিষ্ঠাকে বিন্দুমাত্রও ক্ষুন্ন হ’তে দিও না। জোর ক’রে নামে লেগে থাকবে।
সুখে, দুঃখে, সম্পদে, বিপদে, ইষ্টে, অনিষ্টে, উণ্থানে, পতনে, মানে, অপমানে, নিন্দায়, প্রশংসায়, লাভে, ক্ষতিতে, সর্ব্বদা সর্ব্বাবস্থায় অমৃতময় নামকে ইহপর জীবনের একমাত্র আশ্রয় ব’লে জ্ঞান কর্ব্বে। অখণ্ড-নাম, তোমার জীবনের সম্বল, মরণের আশ্রয়, সৌভাগ্যের সহায়, দুর্ভাগ্যের অবলম্বন, উন্নতির প্রসারক, অবনতির রোধক। নামকে তোমাদের পরম শরণ, পরম তারণ, পরম পাবন ব’লে গ্রহণ কর।
অখণ্ড-সংহিতা ত্রয়োদশ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২৭ – ২৮)
ভগবদনুরাগকে গোপন করা বনাম প্রকাশ করা
ঢাকা আরমানিটোলা-নিবাসী জনৈক পত্রলেখকের পত্রের উত্তরে শ্রীশ্রীবাবামণি লিখিলেন,-
অন্তরের সুগভীর ভগবদনুরাগকে সযত্নে প্রচ্ছন্ন রাখিয়া বাহিরে সাধারণ মানুষের ন্যায় জীবন যাপন করা এক মহাকৃতিত্বের ব্যাপার। কিন্তু সামান্য ব্যক্তি কখনও এইরূপ কৃতিত্ব প্রদর্শন করিতে সমর্থ নহে। ভিতরের অনুরাগকে গোপন করিবার জন্য বাহিরে ভগবদ্ বিদ্বেষী বা নাস্তিক সাজিবার চেষ্টা কিন্তু আবার বড়ই আত্মঘাতমূলক।
সেইরূপ চেষ্টা কখনই এবং কোনও অবস্থাতেই প্রশংসনীয় বা সমর্থনযোগ্য নহে। অন্তরের অনুরাগকে বাহিরে প্রকাশ করিলে লোকমান আসে, এজন্য ইহা অবাঞ্ছনীয়। কেননা, লোকমান যেভাবে সাধকের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, এমন ক্ষতি অন্য ভাবে খুব কমই হইয়া থাকে।
ভগবৎ-প্রেমের অতি উচ্চ গ্রামে আরোহণ করিয়া লোকমানের দৌরাত্ম্যে মহান্ সাধকেরও হটাৎ গভীর নিম্নে অধঃপতন ঘটিয়া যায়। কিন্তু অন্তরের ভগবদনুরাগকে বাহিরে প্রকাশ হইতে দিবার পশ্চাতে যদি লক্ষ্য থাকে অনুরাগ-বৃদ্ধির আনুকূল্য সৃষ্টি করা,
দশ জনকে ভগবদ্-বিশ্বাসী করিয়া নিজের প্রতিবেশকে ভজন-কর্ম্মে বাধাহীন করা, চতুর্দ্দিকের নানা দুষ্প্রবৃত্তি ও প্রলোভনের শক্তি হ্রাস করা, তাহা হইলে প্রাণের প্রেমকে বাহিরে প্রকাশ করিতে দেওয়া দোষের ত’ নহেই, বরং গুণের ; ক্ষতির ত’ নহেই, বরং লাভের।
কিসে প্রকৃত লাভ, কিসে প্রকৃত ক্ষতি, তাহার বিচার করিয়া প্রাণকে প্রকাশ কর বা ঢাকিয়া রাখ। এই বিষয়ে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য বা সকল অবস্থায় নির্ব্বিচারে একই উপদেশ হইতে পারে না।
অখণ্ড-সংহিতা ষোড়শ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ৮৪ – ৮৫)
তোরা আমার আপন যদি
শ্রীশ্রী বাবামণি স্মিতহাস্য করতঃ গুঞ্জন করিয়া গাহিলেন,-
তোরা আমার আপন যদি
থাক্ বি দূরে কেমন ক’রে?
তোদের আমার পাওনা-দেনা,
জানিস্ কত জনম ধ’রে?
পেয়েও তোদের হয় না পাওয়া
দিয়েও তোদের হয় না দেওয়া,
না দিয়ে সব দিয়ে ফেলিস্,
না পেয়ে পাস্,-বিচিত্র রে!
নিত্য-মধুর প্রেমের খেলা
সাজ্ ল কেমন সুখের মেলা,
দেওয়া-নেওয়ার ঊর্দ্ধ্ব দেশে
দেওয়া-নেওয়া হৃদয় ভ’রে।
অখণ্ড-সংহিতা চতুর্দ্দশ খণ্ড
নামাশ্রয়ের লক্ষণ
প্রশ্নকর্ত্তা,- ভগবানের নামাশ্রয়ের লক্ষণ কি?
নিজের আভ্যন্তরে চেতনার ভিতরেও নামকে অবিচ্ছেদ যোগে যুক্ত ক’রে রাখাই হচ্ছে, নামাশ্রয়ের লক্ষণ। ঘুমিয়ে যদি পড়ি, তবু ভগবানের নান ভুলি না, পাগল যদি হ’য়ে যাই, তবু ভগবানের নাম ভুলি না, -এমন অবস্থায় এলে বুঝা যাবে, সত্যি নামাশ্রয় হয়েছে।
কীর্ত্তন ক’রে খুব চেঁচালাম যাতে প্রতিবেশীর শান্তিভঙ্গ হয়, খুব লাফালাফি কর্ল্লাম যাতে আঙ্গিনায় মাটি ভরাট কত্তে হয়, খুব বিরহাশ্রু বিসর্জ্জন কর্ল্লাম যাতে কালই সব কাপড়চোপড় ধোপার বাড়ী দিতে হবে,-এর নাম নামাশ্রয় নয়।
সারা অন্তর জুড়ে অবিরাম আর্ত্তনাদ উঠ্ ছে,- “কৈ হে নামের নামী, আত্মপ্রকাশ কর, স্বরূপ-দর্শন করাও” এর নাম নামাশ্রয়। হৃদয়ের পরতে পরতে শুধু নামটীই হ’ল লেখা, প্রতি তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে শুধু নামেরই ঝঙ্কার, নাম-ছাড়া অন্য স্মৃতির চিত্তে হবে না উদ্দীপন, এই অবস্থার নাম নামাশ্রয়।
নামাশ্রয় যে করে, তার দর্প, দম্ভ, অহঙ্কার, অভিমান চিরতরে দূরে চ’লে যায়। নামাশ্রয় যার সফল হয়, সে বিশ্বে সর্ব্বত্র সর্ব্ববস্তুতে একমাত্র নামই দেখে, সকল ধ্বনিতে একমাত্র নামই শোনে,সর্ব্বজীবে নামীর অস্তিত্ব অনুভব করে।
অখণ্ড-সংহিতা ত্রয়োদশ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ১৮৮)
মনুষ্যত্ব-পথের প্রথম পাদক্ষেপ
শ্রীশ্রীবাবামণি অপরাহ্ণে ব্রহ্মপুত্র-তীরে বসিয়াছেন। জনৈক যুবকের প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
প্রতিযোগীকে বিধ্বস্ত করাই পাণ্ডিত্যের উদ্দেশ্য হ’তে পারে না। সত্য আবিষ্কারই তার উদ্দেশ্য হবে। পরনিন্দাই রসনা লাভের উদ্দেশ্য হ’তে পারে না, সৎ-কথনই তার উদ্দেশ্য হবে। পরচ্ছিদ্রান্বেষণই চক্ষুলাভের উদ্দেশ্য হ’তে পারে না, যে বস্তু দেখ্ লে তোমার লাভ, তোমার প্রতিবেশীর লাভ,
তোমার দেশের লাভ, নিখিল জগতের লাভ, সেই বস্তু দর্শনই এর উদ্দেশ্য। ভার বইবার জন্যই শরীর নয়, মাথা খুঁড়ে মরবার জন্যই মুণ্ডু নয়,-এদের কোনও বৃহত্তর, মহত্তর, উচ্চতর সার্থকতা আছে। এই কথা মনে রাখাই হচ্ছে মানুষ হবার পথের প্রথম পাদক্ষেপ।
ভোগবুদ্ধি প্রধানতম শত্রু
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
ভোগবুদ্ধিই বদ্ধতা। ভোগবুদ্ধিই মুক্তি-পথের প্রথম বাধা। প্রাণপণে ভোগবুদ্ধি বর্জ্জন কর। ভোগের জন্যই জীবন পেয়েছ, এসব অশ্রদ্ধেয় মত অগ্রাহ্য কর। বেশভূষার ভিতর দিয়ে ত্যাগের নিশান উড়িয়ে লোক-শ্রদ্ধা আকর্ষণ ক’রে নিয়ে তার সুযোগে আত্ম-সুখ চরিতার্থতার সকল সংগুপ্ত অভিসন্ধি মন থেকে নির্ব্বাসিত ক’রে দাও।
ভোগবুদ্ধিই মানুষকে বহির্ম্মুখ করে। ভোগবুদ্ধিই তাকে স্বার্থপর করে। ভোগবুদ্ধিই তাকে নিজের শত্রু, জগতের শত্রু করে।
ভোগবুদ্ধি বনাম ভগবৎ-সেবা
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-কিন্তু ভোগবুদ্ধি বিদূরণ কর্ব্বে কি ক’রে? যিনি ভগবৎ-সেবাকেই জীবনের একমাত্র ব্রত করেছেন, ভোগবাসনা বর্জ্জন করা, ইতর সুখে নিঃস্পৃহ থাকা তাঁর পক্ষেই সম্ভব। ত্যাগীর বেশ অনেক ক্ষেত্রে বৈরাগ্যের বাহ্য-দ্যোতক কিন্তু সব সময়ে তা বৈরাগ্যের অভ্রান্ত লক্ষণও নয়, বৈরাগ্যের অভ্রান্ত সহায়কও নয়।
কিন্তু ভগবৎসাধন বৈরাগ্যের অভ্রান্ত সহায়ক, নিত্য সহায়ক। এইজন্যে ভগবৎ-সাধনেই মনঃপ্রাণ সমর্পণ কর্ব্বে। সূর্য্যোদয়কালের পৃথিবী দেখেছ ত? আলো যতটা আস্ ছে, আঁধার ততটা কাট্ ছে। ভগবৎ-ভক্তিও তোমার যতটা আস্ ছে, ভোগবুদ্ধিও তোমার ততটা কাট্ ছে।
অখণ্ড-সংহিতা সপ্তম খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২৩৬ – ২৩৭)
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সাত>>
……………..
আরও পড়ুন-
স্বামী স্বরূপানন্দের বাণী
স্বামী স্বরূপানন্দ : গুরু-শিষ্য
স্বামী স্বরূপানন্দ : সরল ব্রহ্মচর্য্য
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ : চিঠিপত্র
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ : উপাসনা
স্বামী স্বরূপানন্দ : কবিতা/গান
স্বামী স্বরূপানন্দ : উপদেশ
স্বামী স্বরূপানন্দ : উপদেশ দুই
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এক
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দুই
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তিন
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চার
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পাঁচ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ছয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সাত
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আট
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : নয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দশ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এগারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : বারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চোদ্দ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পনেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ষোল
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সতেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আঠারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : উনিশ
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………….
আরও পড়ুন-
মহানবীর বাণী: এক
মহানবীর বাণী: দুই
মহানবীর বাণী: তিন
মহানবীর বাণী: চার
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: এক
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: এক
গৌতম বুদ্ধের বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: তিন
গৌতম বুদ্ধের বাণী: চার
গুরু নানকের বাণী: এক
গুরু নানকের বাণী: দুই
চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী
কনফুসিয়াসের বাণী: এক
কনফুসিয়াসের বাণী: দুই
জগদ্বন্ধু সুন্দরের বাণী: এক
জগদ্বন্ধু সুন্দরের বাণী: দুই
শ্রী শ্রী কৈবল্যধাম সম্পর্কে
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বাণী
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ১ম খন্ড
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ২য় খন্ড
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ৩য় খন্ড
স্বামী পরমানন্দের বাণী: এক
স্বামী পরমানন্দের বাণী: দুই
স্বামী পরমানন্দের বাণী: তিন
স্বামী পরমানন্দের বাণী: চার
স্বামী পরমানন্দের বাণী: পাঁচ
স্বামী পরমানন্দের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: এক
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: দুই
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: তিন
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: চার
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: পাঁচ
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: সাত
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: আট
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: নয়