শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পনেরো
প্রেমের জাল
অদ্যও বহু যুবক কৈলাসবসু ষ্ট্রীটে ভীড় করিয়াছেন। সকলেই কথা শুনিতে চাহেন। শ্রীশ্রীবাবামণি হাসিতে হাসিতে বলিলেন,-
জেলেরা বোনে সূতোর জাল, মাছ ধরবার জন্যে। কেউ বোনে কথার জাল, লোক ধরবার জন্যে। আমি কিন্তু তোদের প্রেমের জালে ধর্ তে চাই, কথায় আমার আস্থা নেই।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
প্রেমের জালের সূতো হ’ল ভগবানের নাম। নাম যে যত বেশী জপে, প্রেম তার তত বেশী বাড়ে। কৌশলে নয়, ফন্দীতে নয়, অবিচ্ছিন্ন নামের সেবায় প্রাণের মাঝে প্রেম জাগে।
অখণ্ড-সংহিতা সপ্তম খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ১২৫)
ধন্য আভরণ
ত্রিপুরা বাঙ্গরা-নিবাসী জনৈক পত্রলেখকের পত্রের উত্তরে শ্রীশ্রীবাবামণি লিখিলেন,-
পাপী জন পুণ্য করে লাভের আশায়
পাপমুক্তি হবে ভাবি পরিতৃপ্তি পায়।
পুণ্যবান পুণ্য করে স্বভাবের বশে
প্রতি বাক্য চিন্তা তার পূর্ণ প্রেম-রসে।
পাপী কিম্বা পুণ্যবান্ সবার লাগিয়া
কর তুমি পুণ্য নিত্য প্রেমে বাঁধি’ হিয়া।
সবার লাগিয়া তব পুণ্য আচরণ,-
তাই তুমি জগতের ধন্য আভরণ।
অখণ্ড-সংহিতা দ্বাদশ খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ২০৫)
জগজ্জননীর পুনরাবির্ভাব
রাত্রি সাত ঘটিকায় জমিদারবাড়ীর ভিতরের নাট-মন্দিরে শুধু মহিলাদিগকে লইয়া একটী বিশেষ সভার অধিবেশন হইল। শ্রীশ্রীবাবামণি অর্দ্ধ ঘন্টা কাল একটী প্রেরণাপূর্ণ বক্তৃতা করিলেন।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-
রমণীমাত্রের মুখ-দর্শনে আমার নয়ন-সম্মুখে আমার পরমারাধ্যা শ্রীশ্রীমাতৃদেবীর পবিত্র মুখমণ্ডল এসে প্রতিভাত হয়, যিনি আমার ঐহিক এবং আধ্যাত্মিক উভয় দৃষ্টিতে জন্মদাত্রী। তাঁর প্রতি পদধূলিতে কোটি কোটি তীর্থরাজি বিরাজ করে। তোমরা প্রত্যেকে আমার সেই জননীর মত হও। দয়ার অফুরন্ত আকর, স্নেহের জীবন্ত বিগ্রহ, মমতার প্রতিচ্ছবি, জীবকুলের দুঃখে আকুলহৃদয়া, বিশ্বমৈত্রীর আধারস্বরূপা, অভয়দায়িনী, সান্ত্বনাভাষিণী, পতিতোদ্ধারিণী সেই জননীর মত তোমরা হও।
জগন্মাতা এই দেশেই না বারংবার নারীমূর্ত্তি-ধারণ ক’রে আর্বিভূতা হয়েছিলেন ব’লে তোমরা পুরাণ-শাস্ত্রে পাঠ কর,-তোমাদের নিজেদের মধ্য দিয়ে সেই অত্যাশ্চর্য্য অবির্ভাবকে তোমরা পুনরায় সম্ভব কর। মালিন্যহীন চিত্ত, আবিলতাহীন মন, দুর্ব্বলতাহীন হৃদয়, লালসাবিহীন স্নেহ, স্বার্থ-বুদ্ধিহীন দয়া,
কাম-কলুষ-বর্জ্জিত করুণা দিয়ে তোমরা এই পৃথিবীকে এমন ক’রে ঘিরে ধর, যেন জগৎ বল্ তে বাধ্য হয় যে, তোমরা নির্দ্দিষ্ট কতিপয় পুত্রকন্যার মাতা নও, তোমরা নিখিল জগতের জননী। জগজ্জননীর পুনরাবির্ভাবের জন্যই আজ দুঃখার্ত্ত, বিপন্ন, বিষণ্ণ জগৎ ব্যাকুল।
তোমরা নিজেদের স্বরূপ-মূর্ত্তিতে আত্মপ্রকাশ ক’রে জগতের দুঃখ হরণ কর মা, জগতের বিপৎত্রাণ কর, জগতের বিষাদ-কালিমা-গ্রস্ত মুখ-মণ্ডলে সুখের, তৃপ্তির, অভয়ের এবং পবিত্রতার দিব্য হাসি ফুটাও। সত্যি সত্যি জগজ্জননীর পুনরাবির্ভাব হউক।
শান্তির বারতা দ্বিতীয় খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ৫২ – ৫৩)
নির্ভরই প্রয়োজনীয়
অদ্য প্রাতে নয়টার সময়ে নিকটবর্ত্তী একটি মঠের মোহান্ত শ্রীশ্রীবাবামণির পাদপদ্ম দর্শনে আসিয়াছেন। মোহান্ত মহাশয়ের বিনয় ও নম্রতা দর্শনে শ্রীশ্রীবাবামণি মুগ্ধ হইলেন।
মোহান্ত মহারাজ কিঞ্চিৎ উপদেশের প্রার্থী হইলে শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-নিখিল ভুবনে আর কোনো উপদেশের প্রয়োজন নেই, শুধু এইটুকু বাদে যে, আমার কি প্রয়োজন, আমার চেয়ে ভগবান্ তা বেশী জানেন, সুতরাং দেহি দেহি ব’লে তাঁর কাছে প্রার্থনা করার কোনও প্রয়োজন নেই।
সে আবার কেমন মা, ছেলের ক্ষুধা পেয়েছে কিনা বোঝে না? যা যখন কর্ত্তব্য বোধ কর্ ব, সেই মত পরিশ্রম ক’রে যাব, ভগবানের কাছে পারিশ্রমিক দাবী কর্ ব না, তাঁর যদি ইচ্ছা হয় তিনি তা’দেবেন, না হয়, না দেবেন, আমি নিঃশব্দে কাজ ক’রেই তৃপ্ত, এই হবে সাধকের আদর্শ।
যখন যা প্রয়োজন, তিনি তাঁর অপার প্রেমবশে তা দেবেন, আমি যদি সৎ হই, সাধু হই, অকপট হই, নিষ্কাম হই, জগতের প্রয়োজন বুঝে তিনি প্রাপ্যের অতিরিক্ত শতগুণও দেবেন। তাঁর উপরে সর্ব্বকালে সর্ব্ববিষয়ে সর্ব্বতোভাবে নির্ভর ক’রে থাকাই হচ্ছে আমার তপস্যা।
মোহান্ত মহারাজ বড়ই পরিতৃপ্ত হইলেন।
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিতে লাগিলেন,-
হাত পা ছেড়ে দেওয়ার নাম নির্ভর নয়, তার নাম অলসতা বা ক্লৈব্য। ফলাফল ভগবানের হাতে সঁপে রেখে, ভাল মন্দ কোনও ফলের প্রতিই সোল্লাস বা সবিষাদ দৃষ্টি না দিয়ে, কর্ত্তব্য ক’রে যেতে হবে।
কোন্ টা কর্ত্তব্য, কোন্ টা অকর্ত্তব্য, তা নির্দ্ধারণের জন্য তাঁরই মুখপানে তাকাব, কিন্তু কর্ত্তব্য ব’লে কিছু বোঝবার পরে আর বিলম্ব কর্ ব না, সিংহ-বিক্রমে শ্রম কত্তে লেগে যাব। সমগ্র পুরুষকারকে তাঁরই কাৰ্য্য সাধনের জন্য প্রয়োগ করার নামই নির্ভর।
অখণ্ড-সংহিতা সপ্তম খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ৩২ – ৩৩)
অপরাহ্ণ চারি ঘটিকায় ধর্ম্ম-সভার কার্য্য আরম্ভ হইল। শ্রীশ্রীবাবামণি সভাপতিরূপে তাঁহার অননুকরণীয় ভঙ্গীতে জ্ঞান-ভক্তি-কর্ম্ম-মার্গের মর্ম্ম ভেদ করিয়া প্রণব-তত্ত্ব ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন।
ওঙ্কার ইতিবাচক মন্ত্র
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিলেন,-প্রণবের ত্রিবিধ ব্যাখ্যা আছে। একটী হ’ল সাহিত্যিক, একটী হ’ল দার্শনিক, একটী হ’ল বৈজ্ঞানিক। সংস্কৃত সাহিত্যে ‘ওম্’ শব্দ “হাঁ” এই মানেতে বহুস্থানে ব্যবহৃত হয়েছে।
ওম্ মানে yes নিত্যকালের হাঁ, eternal yea. ওঙ্কার জপের মানে সকল মন্ত্রকে, সকল তন্ত্রকে, সকল তত্ত্বকে সত্য ব’লে মেনে নেওয়া। ওঙ্কারের সাধক কোনও পথকে মিথ্যা বলেন না, কোনো ধর্ম্মকে ভ্রান্ত জ্ঞান করেন না। ওঙ্কার হচ্ছেন ইতিবাচক মন্ত্র।
ওঙ্কার সর্ব্বমন্ত্রের সমষ্টি
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিতে লাগিলেন,-জগতের যত ধ্বনি, সব ধ্বনি মিলে যে supreme synthesis . সেইটি হ’ল ওঙ্কার। জগতের সব কিছুর সমাহার হচ্ছে প্রণবে। ওঙ্কার-মন্ত্র সকল মন্ত্রের সমষ্টি। ওঙ্কার-জপনে সকল মন্ত্র জপ করা হয়। ওঙ্কার-ধ্যানে সকল তত্ত্বের ধ্যান করা হয়। এইটী হ’ল প্রণবের দার্শনিক ব্যাখ্যা।
ওঙ্কার সর্ব্ব-মন্ত্রের প্রাণ
শ্রীশ্রীবাবামণি বলিতে লাগিলেন,-
জগতের যত ধ্বনি, সব ধ্বনির প্রাণ ওঙ্কার। কায়ায় কায়ায় তফাৎ থাকে, প্রাণের স্বরূপ সর্ব্বত্র এক। হ্রীং, ক্লীং, শ্রীং, ঐং, হুং ও ক্রীং প্রভৃতি সকল মন্ত্রেরই বাহ্যরূপেই মাত্র পার্থক্য। কিন্তু এর যে-কোনও একটীর সাধন কত্তে কত্তে যখন মন্ত্রের প্রাণে গিয়ে পৌছুবে, তখন দেখ্ বে, একমাত্র ওঙ্কারই আছেন, আর কিছু নাই। এইটী হ’ল প্রণবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
শান্তির বারতা দ্বিতীয় খণ্ড
(পৃষ্ঠা নং ৩৮ -৩৯)
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ষোল>>
……………..
আরও পড়ুন-
স্বামী স্বরূপানন্দের বাণী
স্বামী স্বরূপানন্দ : গুরু-শিষ্য
স্বামী স্বরূপানন্দ : সরল ব্রহ্মচর্য্য
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ : চিঠিপত্র
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ : উপাসনা
স্বামী স্বরূপানন্দ : কবিতা/গান
স্বামী স্বরূপানন্দ : উপদেশ
স্বামী স্বরূপানন্দ : উপদেশ দুই
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এক
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দুই
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তিন
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চার
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পাঁচ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ছয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সাত
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আট
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : নয়
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : দশ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : এগারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : বারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : তেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : চোদ্দ
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : পনেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : ষোল
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : সতেরো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : আঠারো
শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের বাণী : উনিশ
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
……………….
আরও পড়ুন-
মহানবীর বাণী: এক
মহানবীর বাণী: দুই
মহানবীর বাণী: তিন
মহানবীর বাণী: চার
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: এক
ইমাম গাজ্জালীর বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: এক
গৌতম বুদ্ধের বাণী: দুই
গৌতম বুদ্ধের বাণী: তিন
গৌতম বুদ্ধের বাণী: চার
গুরু নানকের বাণী: এক
গুরু নানকের বাণী: দুই
চৈতন্য মহাপ্রভুর বাণী
কনফুসিয়াসের বাণী: এক
কনফুসিয়াসের বাণী: দুই
জগদ্বন্ধু সুন্দরের বাণী: এক
জগদ্বন্ধু সুন্দরের বাণী: দুই
শ্রী শ্রী কৈবল্যধাম সম্পর্কে
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বাণী
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ১ম খন্ড
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ২য় খন্ড
শ্রী শ্রী রামঠাকুরের বেদবাণী : ৩য় খন্ড
স্বামী পরমানন্দের বাণী: এক
স্বামী পরমানন্দের বাণী: দুই
স্বামী পরমানন্দের বাণী: তিন
স্বামী পরমানন্দের বাণী: চার
স্বামী পরমানন্দের বাণী: পাঁচ
স্বামী পরমানন্দের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: এক
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: দুই
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: তিন
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: চার
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: পাঁচ
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: ছয়
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: সাত
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: আট
সীতারাম ওঙ্কারনাথের বাণী: নয়