ভবঘুরেকথা
ইমাম গাজ্জালী

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক

-নূর মোহাম্মদ মিলু

বিশ্ববরেণ্য মহামনীষী ইমাম গাজ্জালী (র) এর প্রকৃত নাম আবু হামিদ মুহম্মদ। তাঁর পিতা ও পিতামহের উভয়ের নামই মুহম্মদ। তার মর্যাদাসূচক পদবী হুজ্জাতুল ইসলাম। খোরাসানের অন্তর্গত তুস জেলার তাহেরান নগরে গাজালা নামক স্থানে হিজরি ৪৫০ সনে, মুতাবেক ১০৫৮ খৃষ্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

ইমাম গাজ্জালীর যুগে পারস্যের সম্রাট ছিলে সলজুক বংশীয়সুলতান রুকনুদ্দিন তোগরল বেগ। এই যুগে মুসলমানদের বিদ্যার্জন স্পৃহা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। সেসময় প্রচলিত ইয়াহুদী, খ্রিস্টান ও পারসিকদের সঞ্চিত জ্ঞান আহরণ করে মুসলমানরা ভারতীয় জ্ঞানাহরনে আগ্রহী হয়ে উঠেন।

কিন্তু বিভিন্ন প্রকার মতবাদের সংমিশ্রণে মুসলমান সমাজে বহু মতানৈক্যের সূত্রপাত হয় এবং ইসলামী আকাইদ ও জ্ঞানের নানাবিধ মারাত্মক অনৈসলামী ধর্ম-বিশ্বাস ও জ্ঞান এমনভাবে মিশে যায় যে খাঁটি ইসলামী আকাইদ ও অনৈসলামী আকাইদে পার্থক্য করা দুরূহ হয়ে উঠে।

অত্যাধিক পরিমাণ পার্থিব জড়জ্ঞানের প্রভাবে ধর্ম জ্ঞানের শ্বাস প্রায় রুদ্ধ হয়ে পরে এবং মুসলমান সমাজে আকাইদ ও ধর্ম-কার্যের ক্ষেত্রে চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। এর থেকে সমাজকে রক্ষার দায়িত্বই ইমাম গাজ্জালীর উপর অর্পিত হয়। এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের অতুলনীয় প্রতিভা যে নিপুণতার সাথে এই দায়িত্ব সমাপন করেছেন, সমগ্র বিশ্ব তারজন্য বিস্ময় ও ভক্তিআপ্লুত হৃদয়ে তাঁকে স্মরণ করবে।

 

তৎকালীন শিক্ষাব্যবস্থা

সেসময় মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বত্র প্রাথমিক স্তর থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত ছিল। ছাত্রদের খাওয়া পরার খরচসহ মাদ্রাসার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করতেন। তদুপরি সকল মসজিদ ও সঙ্গতি সম্পন্ন লোকদের গৃহেও বহু বেসরকারি মাদ্রাসার ব্যবস্থা ছিল।

দূরদেশীয় ছাত্রদের ভরন-পোষণ ও যাবতীয় ব্যয়ভার আমীর উমরাহ্‌গন বহন করতেন। সুতরাং সেইকালে শিক্ষার পথ ধনী-নির্ধন সকলের জন্যই অত্যন্ত সুগম ছিল। প্রবীণ ও উচ্চশিক্ষিত সুধীজন যে সকল স্থানে শিক্ষাদান করতেন, সে সব স্থানই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র পরিণত হত।

 

শৈশবকাল ও ছাত্রজীবন

ইমাম গাজ্জালীর পিতা অতি দরিদ্র হলেও তিনি পুত্রের শিক্ষার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেন নাই। ইমাম গাজ্জালী অতি শৈশবই পিতৃহীন হন। মৃত্যুর সময় তার পিতা তার জনৈক বন্ধুর কাছে দুইপুত্র আহ্‌মদ ও মুহম্মদ (ইমাম গাজ্জালী) এর প্রতিপালন ও শিক্ষার ভার অর্পন করেন এবং তারজন্য সামান্য অর্থও প্রদান করেন।

তারা দুজনই অসাধারণ মেধা-শক্তির অধিকারী ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই পবিত্র কুরআন হিফয্‌ সমাপ্ত করলে তাদেরকে শহরের এক মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেয়া হয়। আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনী, আল্লামা আবু মুহম্মদ যোবায়নী প্রমুখ মহজ্ঞানী ওস্তাদের কাছে গাজ্জালী শিক্ষালাভ করেন। খ্যাতনামা ফিকাহ্‌শাস্ত্রবিদ আল্লামা আহ্‌মদ বিন মুহম্মদ রাযকানীর কাছে ফিকাহ্‌শাস্ত্রের প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন।

 

উচ্চশিক্ষার জন্য জুরজানে যাত্রা

মসজিদ আল আকছায় অবস্থান করে ইমাম গাজ্জালী অনেক মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তাহেরানে শিক্ষা সমাপ্তির পর ইমাম গাজ্জালী উচ্চশিক্ষার জন্য জুরজান শহরে গমন করেন। এখানে তিনি হযরত আবু নসর ইসমাইল (র) এর তত্ত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণ আরম্ভ করেন।

তাঁর তীক্ষ্ণ মেধা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় পেয়ে পুত্র স্নেহে শিক্ষাদান শুরু করেন। সেসময় শিক্ষকরা পাঠ্যবিষয়ে যে ব্যাখ্যা দিতেন শিক্ষার্থীরা তা হুবহু লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য হতেন। এই লিখিত নোটগুলিকে তা’লিকাত বলা হত। ইমাম গাজ্জালীর তা’লিকাতের এক বিরাট দপ্তর সঞ্চয় করলেন করেছিলেন বলে জানা যায়।

তারানার উদ্দেশ্যে যাত্রা পথে দস্যুদল তা’লিকাতসহ তার সর্বস্ব লুট করে নেয়। অর্থ-পোশাক-পরিচ্ছদ লুট হওয়াতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। কিন্তু তা’লিকাতের লুট হওয়াতে তিনি অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে পরেন। সেসব ফেরত দেবার জন্য দস্যু সরদারের কাছে অনুরোধ করে বলেন, ‘এতে আমার সমস্ত অর্জিত বিদ্যা সঞ্চিত আছে।’

দস্যু সরদার উপহাসের স্বরে বলল, ‘তুমি তো বেশ বিদ্যা অর্জন করেছ! সবই কাগজে রয়েছে, মনে কিছুই নাই?’ এই কথা বলে সে তা’লিকাত ফিরিয়ে দিল। সরদারের ব্যঙ্গোক্তি গাজ্জালীর মনে দাগ কাটল। তার অল্পদিনের মধ্যেই তিনি সমস্ত তা’লিকাত মুখস্ত করার দূরহ কাজটি করে ফেললেন।

 

নিযামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন

ইহ্‌ইয়াউ উলুমিদ্দিন খোরাসানে অর্ন্তগত নিশাপুরের নিযামিয়া মাদ্রাসা সেসময় বিশ্বের সর্বোচ্চ শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। জুরজানে অধ্যয়ন সমাপ্তির পরও গাজ্জালীর জ্ঞান-পিপাসা নিবৃত্ত হইল না। তাই তিনি নিযামিয়া মাদ্রাসায় গমন করলেন। সেকালে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ আলিমরূপে স্বীকৃত ইমামুল হারামাইন (র) ছিলেন এই মাদ্রাসার প্রধান অধ্যক্ষ।

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে বহু লোক উচ্চশিক্ষার জন্য তার কাছে আসত। তিনি এত গভীর জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন যে, গোটা দুনিয়ার সুলতানরাও জটিল বিষয়ের মীমাংসার জন্য তার কাছে উপস্থিত হত এবং তার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে মেনে নিত। ইমাম গাজ্জালী উপযুক্ত ওস্তাদ পেয়ে তার তীব্র জ্ঞান-পিপাসা মিটাতে লাগল। ইমামুল হারামাইনও ইমাম গাজ্জালী দর্শন ও জ্ঞানের বিভিন্ন স্তরে খুব আগ্রহের সাথে শিক্ষা দিতে লাগলেন।

৪৮৭ হিজরিতে ইমামুল হারামাইন দেহত্যাগ করেন। তিনি এত জনপ্রিয় ছিলেন যে, তারা মৃত্যুতে ছাত্ররা উম্মাদের মতো আচরণ করতে শুরু করে। অনেকে শিশুর মতো গড়াগড়ি দিয়া কাঁদতে থাকে। তার চারশত ছাত্রের সকলেই নিজ নিজ দোয়াত-কলম ভেঙ্গে ফেলে। কারণ এর সাথে তাদের প্রিয় ওস্তাদের স্মৃতি বিজড়িত ছিল। তার শোকে ছাত্ররা প্রায় এক বছরকাল মুহ্যমান হয়ে থাকে।

ইমাম গাজ্জালীর কাছেও ওস্তাদের তিরোধান-যাতনা অসহনীয় হয়ে উঠে। নিশাপুত তার কাছে অন্ধকার পুরি হয়ে উঠল। তাই তিনি নিশাপুর ত্যাগ করে বাগদাদে রওনা হন। এ সময়ে গাজ্জালীর বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর। তিনি জানতেন, কেবল কিতাব পাঠ আল্লাহ্‌র জ্ঞানের জন্য যথেষ্ঠ না। এর জন্য দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন জীবন্ত ওস্তদের প্রয়োজন। তাই তিনি প্রখ্যাত পীরে কামেল হযরত শায়খ আবু আলি ফারমেদী (র) এর হাতে বায়ত হন।

(চলবে…)

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই>>

……………………………..
আরো পড়ুন: 
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
……………………………..

………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!