-মূর্শেদূল মেরাজ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
এতো এতো মানুষকে যিনি প্রেমে মাতোয়ারা করেছেন, তিনি কোথায়? এই প্রশ্নটিই সবচেয়ে প্রথম মাথায় খেলতে শুরু করে। নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলনের ঘুরে বেড়াতে লাগলে। যাকে ঘিরে এতো মানুষ একত্রিত হয়েছে হরি নাম করতে।
সেই মানুষটির টিকিটি পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। নেন কি কোনো আসন। গায়ে দেননি বিশেষ কোনো পোশাক। আয়োজন রাখেননি কোনো কিছু, নিজেকে ঘিরে। ভক্তরা বলেন, সকল সময়ই নিরা গোঁসাই ঘুরে ঘুরে দেখেন ভক্তদের সেবাশান্তি ঠিকঠাক মতো হচ্ছে কিনা।
উৎসবের সময়ও তার ব্যাতিক্রম হয় না কোনো। একইভাবে তিনি ভক্তদের সেবা দিয়ে যান। ভক্তরা আবর্জনা করলে নিজে মাথায় করে সেই আবর্জনা বয়ে পরিস্কার করেন। সেবাই তার ধর্ম। তিনি সেবা দিয়ে জান। এতেই তার আনন্দ।
এর ভেতর দিয়েই হয়তো ভক্তদের শিক্ষা দিয়ে যান এই কর্মযোগী। খোলা চোখে সে সব দেখে হয়তো কিচ্ছুটি বুঝবার উপায় নেই। আসলে ভক্তের চোখেই ভক্তি ধরা দেয়। অন্যরা তো সমালোচনা নিয়েই কাল কাটায়।
যেহেতু আমরা গোটা কয়েক দিন আগেই কালেখার বেড় এলাকায় চলে এসেছি। তাই গোঁসাইয়ের পুরো অনুষ্ঠানটা ফাঁকা মাঠ থেকে কি করে পূর্ণরূপ নিলো। তা অনেকটাই ঘটেছে আমাদের চোখের সামনে। এর মাঝে নিরা গোঁসাই বা নিরাপদ গোঁসাইয়ের আশ্রমের সবচেয়ে উল্লেকযোগ্য যে বিষয়টা প্রথমেই চোখে পরেছে। সেটা হলো।
এখানে কোনো প্রকার কমিটি না থাকলেও সকলেই জানে কার কি করতে হবে। কাউকেই কিছু বলে দিতে হয় না। সকলে সকলের কাজ ঠিকঠাক মতো করে যায় কেবল। শোনা গেলো এখন পথঘাট ঠিক হওয়ায় অনেক ভক্তই কাজ সেরে বাড়ি ফিরে যায়।
একটা সময় ছিল যখন ভক্তরা উৎসবের কাজ করার জন্য কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই অবস্থান নিতো আশ্রমে। এখনো অনেকেই থাকে বিশাল আশ্রমের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে বিশাল আশ্রমের সেই সব মানুষদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কে কোথায় আছে তা ভক্তরাই জানে।
তারা এর বিশালত্বে হারিয়ে যায় হয়তো বা। তবে প্রয়োজনের স্থানে ঠিকই লোকজন পাওয়া যায়। যাক সে কথা। নিরা গোঁসাইয়ের আশ্রমের সেই মতে কোনো শক্ত পাটাতনের দরজা নেই। চারপাশটা যেমন গোলের পাতা দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে।
তেমনি বাঁশের চটা দিয়ে সদর দরজা করা হয়েছে। প্রধান দরজা ছাড়াও দুই পাশে ছোটো ছোটা দুইটা প্রবেশ পথ। এই তিন দরজাই একই পথের পাশে পরপর। কিছুটা জায়গা ছেড়ে। রাস্তাটা এখনো পাকা হয়নি। তবে সংস্কার কাজ চলছে।
সাথে বোয়ামে করে রাখা শুকনা মরিচ যখন দিলো সেবায়েত তখন স্বাদ আরো বেড়ে কয়েকগুণ। যতটা খাওয়া যায় তারচেয়ে অনেকটা বেশি সেবা নেয়ার পর যখন থামবো ভাবছি। তখন সেবায়েত বললো একটু তাল জ্বাল নিতে হবে।
আশ্রমের অভ্যন্তরে ভোজনালয় ভিন্ন আর তেমন কোনো পাকা স্থাপনা চোখে পরে না। একসাথে তেইশ মানুষ বসতে পারে এই মাপের বিশাল ভোজনালয়ের ছাদ টিনের হলেও ফ্লোরে চকচটে বাহারি টাইলস। পরম যত্নে আর ভক্তিতে যে এই ভোজনালয় নির্মাণ হয়েছে তা দেখলেই বোঝা যায়।
ভক্তদের জন্য এইবারই আধাপাঁকা টয়টেল নির্মাণ করছেন গোঁসাই। রান্নাঘরের কিছুটা অংশ পাকা করার কাজ চললেও এখনো তা শেষ হয় নি। উৎসব শুরুর আগে একরাতে এইখানেই কাজ করা অবস্থায় গোঁসাইকে এক ঝলক দেখা পেলায়। পুরো যাত্রায় এটাই আমার গোঁসাইকে দেখা।
অবশ্য আশিক সহ অন্যরা গোঁসাইকে বার কয়েকে দেখেছেন। আমি আর দেখা পাইনি। হয়তো অভক্তরে দেখা দেন না গোঁসাই। মনে ভক্তি না থাকলে যা হয় আর কি। কি আর করা গোঁসাইয়ের সঙ্গ তো পেলাম না। কিন্তু প্রথম যে দিন আশ্রমে ঢু মারতে গেলাম সক্কলে কালেখার বেড়ে যাওয়ার রাতেই।
সেখানে এক সেবায়েত যখন রাতের সেবা নেয়ার আহ্বান করলো। তখন আর কেউ আপত্তি করি নাই। সুমন দাস বাউল যদিও প্রথমে বলেছিল, ‘আমি কিন্তু এইখানেই সেবা নেবো।’ মিঠুন দা’র বাড়িতে আমাদের জন্য খাবারের আয়োজন থাকলেও। আমরা আশ্রমের সেবা নেয়ার লোভ কেহই সংবরণ করতে পারি নি।
অনেকটা রাত হয়ে যাওয়ায় পদের সংখ্যা কমে গেলেও। যে পরিমাণ ভক্তি দিয়ে সেবা দিতে লাগলেন সেবাইত তাতে আমরা মোহিত। ডাল, সবজি তরকারি, টক পর্যন্ত খেয়ে আমরা সকলে টইটুম্বুর। টমেটোর টক যে কি পরিমাণ মজাদার স্বাদ হতে পারে তা আমাদের গোগ্রাসে খাওয়া দেখলে যে কেউ বলতে পারতো।
সাথে বোয়ামে করে রাখা শুকনা মরিচ যখন দিলো সেবায়েত তখন স্বাদ আরো বেড়ে কয়েকগুণ। যতটা খাওয়া যায় তারচেয়ে অনেকটা বেশি সেবা নেয়ার পর যখন থামবো ভাবছি। তখন সেবায়েত বললো একটু তাল জ্বাল নিতে হবে।
সেবার মায়ের হাতে সেই টক খেয়ে প্রমাণিত হয়েছে। জগতে টক রান্নায় মায়ের চেয়ে উত্তম কেউ নাই। হতেও পারে না। খাবারে অস্কার দেয়ার দায়িত্ব প্রাপ্ত হলে আমরা নির্ঘাৎ মায়ের হাতে তার টকের জন্য তুলে দিতাম। আহ্ আহ্। সেই স্বাদ যেন জিভে চলে আসছে।
খেজুরের রসের একজ্বাল দেয়া রসকে বাগেরহাটের মানুষ বলে তাত জ্বাল। পাতে যখন তাত জ্বাল পরেছে তখন খাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই পেটে। কিন্তু স্বাদের কাছে বাঙালীর জিহ্বা বারবার হেরে যায়। অগত্যা জায়গা না থাকলেও আবারো চললো কিছুক্ষণ খাওয়া।
যখন আর উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই। তখন আমরা থালা হাতে উঠে দাঁড়িয়েছি। এই ফাঁকে থালার কথাটা বলে নেয়া ভালো। নিরার আশ্রমে সিলভারের উপর সাদা কোড দেয়া আর বর্ডারে চিকন গাঢ় নীল রঙের দাগটা সেই শৈশবে নিয়ে যায়।
এ রকম থালা আমাদের ছোটবেলায় বেশ দেখছি। অনেকের বাড়িতেই সেই সময় দেখা যেত। যদিও ততদিনে এর ব্যবহার অনেকটাই কমেছে। কিন্তু ছিল। নিরার আশ্রমের থালার গভীরতা আরো অনেকটা বেশি। কব্জি ডুবিয়ে টক খাওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত থালা।
মনে মনে কষে নিলাম। এমন একখানা থালা কিনে তবে এই দফায় ঢাকায় ফিরতে হবে। আগের প্রজন্ম যারা কব্জি ডুবিয়ে দুধ খাওয়ার গল্প দিয়েছেন। তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে কব্জি ডুবিয়ে টক খেতে হবে। টক খাওয়ার কথা কেনো বার বার আসছে সেই কথাটাও এই কথায় একটু বলে নেয়া ভালো।
সুমান দাস বাউলের কাছে তেঁতুলের পাতলা টকের কথা। তা কি করে রান্না করতে হয়। কি করে খেতে হয়। সুমন কি ভাবে খায়। খাওয়ার সময় কতটা নেয়। মা কি বলে। এর কত কত কাহিনী যে আমরা শুনেছি তার শেষ নেই। শেষ পর্যন্ত প্রথমবার যখন সত্যি সত্যি সুমনের বাসায় গিয়ে উপস্থিত হলাম।
সেবার মায়ের হাতে সেই টক খেয়ে প্রমাণিত হয়েছে। জগতে টক রান্নায় মায়ের চেয়ে উত্তম কেউ নাই। হতেও পারে না। খাবারে অস্কার দেয়ার দায়িত্ব প্রাপ্ত হলে আমরা নির্ঘাৎ মায়ের হাতে তার টকের জন্য তুলে দিতাম। আহ্ আহ্। সেই স্বাদ যেন জিভে চলে আসছে।
যতটা টককে টকের বাড়াবাড়ি বলা যায় না আবার মিষ্টিও বলা যায় না। সেই মাত্রায় রেখে মা প্রতিবার কি করে টক রান্না করে সেই কৌশলটা মা’ই ভালো জানেন। আমরা কেবল খাওয়ার পর টকের জন্য বারবার থালা বাড়িয়ে দিয়ে স্বাদ নিতে পারি।
আমরা গেলে প্রতিদিন প্রতিবেলায় টক করতে হবে এটা এখন বিধান। মা’ও সে ভাবেই প্রস্তুত থাকেন। আমাদের জন্য টক চাই-ই চাই। এমনও ভাবছি আমরা পদ্মা সেতু হলে ঢাকা থেকে ভাত খেয়ে টক খাওয়ার জন্য সুমনের বাসায় রওনাও হতে পারি।
বাগেরহাটের আর কিসের কিসের প্রেমে পরেছি সেই তালিকা এই যাত্রায় আর নাই বা লিখলাম। তবে সবার উপরে যে মায়ের হাতের টক সেটা বলে রাখলাম। সেই বার রানা বলেছিল, তোমরা কি আর কেউ টক নিবা?
আমরা গলা পর্যন্ত খাওয়ার পরও তার কাছে জানতে চেয়েছিল, এই কথা বলছে কেনো??
তখন রানা তার স্বভাব সুলভভাবে গদগদ হয়ে বলেছিল, তোমরা না নিলে আমি বাটি ধরেই মাইরা দিবো।
আসলেই তাই। স্বাদই এমন যে, নেয়ার সময় না বলা যায় না। যতটা দেয় ততটাই খেয়ে নেয়া যায়।
কাঁচা তেঁতুলের একেবারে পানি পানি করে রান্না করা টকের উপর ভাসতে থাকা সর্ষের দানাগুলো মুখে এনে দেয় বাড়তি স্বাদ। খাওয়ার শেষে এক থালা টক যেন সব হজম করিয়ে দেয়।
একদিন মধ্যরাতে যখন আমরা হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম। তখন পথে হিরক রাজার সাথে দেখা। সে মধ্যরাতে একা একা রাস্তায় ডেকোরেটরের বাতি লাগিয়ে যাচ্ছে। তার কাছ থেকেই জানা গেলো, নিরা গোঁসাই ভক্তদের বলেছে। তোমাদের কি কি লাগবে বলবা। সব কিনে দিবো। বাইরে থেকে যাতে কোনো কিছু আনতে না হয়।
যাক সেই কথার বিস্তারিত তোলাই থাক। বলছিলাম নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহোৎসবে আমাদের দৃষ্টিতে দেখা অভিজ্ঞতার যৎকিঞ্চৎ কথা। চোখের সামনে দেখতে দেখতে হরি মন্দিরটা দাঁড়িয়ে গেলো। বিশাল চত্বর জুড়ে খুঁটি গেড়ে ছাউনিও নির্মাণ হয়ে গেলো।
কোথা থেকে এতো গোলপাতা আসলো। কারা যে কখন এতো সব কাজ এতো অল্প সময়ে। কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ না করে কি করে করে গেলো। সেই হিসেব মেলাতে গেলে মাথা নষ্ট হবে। সেই চেষ্টায় না গিয়ে আমরা উৎসবের মগ্ন হওয়াতে মনোযোগ দিলাম।
এদিকে উৎসব যত এগিয়ে আসছে, ততই নিরার ভক্তদের। হরিচাঁদের ভক্তদের। মতুয়ারা কতটা মাতোয়ারা হতে পারে সেই ভেদই ধরবার চেষ্টা করতে লাগলাম। যদিও কোনো কুল কিনারা পেলাম না। প্রেমের আসলে কোনো কুল-কিনারা হয় না। হয় না দলিল পত্র। না হয় হিসেব-নিকেষ।
প্রেম হলো সেই আবেগ-অনুভূতির চূড়ান্ত। যেখানে আবেগ-অনুভূতির স্থান তেমন নেই। আছে সীমাহীন-দিগন্তহীন ভক্তি-শ্রদ্ধা-বিনয়, সমর্পন-বিশ্বাস সর্বোপরি অনুরাগ। যেখানে চাওয়া-পাওয়া থেকেও অনেক বিশাল ব্যাপার হলো নিজেকে উজার করে দেয়া। বিলিয়ে দেয়া।
এ এমনই পথ। এমনই মত। যার আগাগোড়া কেবলই প্রেম আর সেবা। সকল কর্মই হয় প্রেমে। তা সে ভক্তিই হোক। আহারই হোক। কিংবা বকাঝকা-গালমন্দ। সকল কিছুতেই প্রেমের পরশ পাওয়া যায়। যে যার মতো দায়িত্ব পালন করে গেলে কোনো কিছুই ঠেকে থাকে না।
একদিন মধ্যরাতে যখন আমরা হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম। তখন পথে হিরক রাজার সাথে দেখা। সে মধ্যরাতে একা একা রাস্তায় ডেকোরেটরের বাতি লাগিয়ে যাচ্ছে। তার কাছ থেকেই জানা গেলো, নিরা গোঁসাই ভক্তদের বলেছে। তোমাদের কি কি লাগবে বলবা। সব কিনে দিবো। বাইরে থেকে যাতে কোনো কিছু আনতে না হয়।
(চলবে…)
<<সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ ।। নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই>>
………………………..
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ