দিল্লীর খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়া: কিস্তি তিন
-মূর্শেদূল মেরাজ
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার শিষ্য
যতদূর জানা যায়, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার ছয় শতাধিকের বেশি খলিফা ছিল। তার মধ্যে নাসিরউদ্দিন চিরাগ দেহলভি, আমির খসরু, আঁখি সিরাজ আয়নায়ে হিন্দ, বোরহানউদ্দিন গরীব, জালালউদ্দিন ভাণ্ডারী, সৈয়দ মাহমুদ কাশকিনাকার, আজান ফকির প্রমুখের খ্যাতি বিশ্বজোড়া।
শিষ্যদের মধ্যে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সবচেয়ে প্রিয় ছিল আমির খসরু। আমির খসরু সম্পর্কে নিজামউদ্দিন বলেছিলেন, ‘যদি শরিয়ত অনুমতি দিত তাহলে আমি খসরুকে আমার সঙ্গে একই কবরে সমাহিত করতে বলতাম।
…কেউ যদি আমার রওজা জিয়ারত করতে আসে, তাহলে সে যেন আমির খসরুর রওজা আগে জিয়ারত করে পরে তার রওজা জিয়ারত করে।’
‘প্রার্থী যদি দিব্যজ্ঞানের আকাংখী হয় তবে তার পক্ষে ভেতরে চলে আসাই উচিত। হয়ত সে আমাদের সমব্যথী ও সাধনসঙ্গীতে পরিণত হতে পারে। আর যদি মূর্খ ও নাদন হয়ে থাকে তবে যে পথে সে এসেছে সে পথে ফিরে যাওয়াই তার পক্ষে শ্রেয়।’
মধ্যযুগে ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ এই আমির খসরু। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গায়ক, সুফি, দার্শনিক ও যোদ্ধা। প্রধানত ফারসি ও হিন্দি ভাষায় তিনি গান ও কবিতা লিখতেন। তাকে কাওয়ালীর জনকও বলা হয়।
ভক্তদের কাছ তিনি পরিচিত ‘তুত-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারতের তোতা পাখি’ হিসেবে। আমির খসরু একই সঙ্গে তুর্কি, ইরানি এবং ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী ছিলেন।
জানা যায়, আমির খসরু যুবক বয়সে নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরবারে হাজির হন। ভেতরে প্রবেশ না করে হুজরার বাইরে বসে রইলেন। কেউ তাঁর প্রতি দৃষ্টিপাত করলো না। শেষে তিনি একটা কাগজে দুই লাইন কবিতা লিখে ভেতরে পাঠান।
কবিতার সারমর্ম –
‘তুমি তো এমন এক বাদশাহ, যার মহলে কবুতর এসে বসলেও বাজপাখিতে পরিণত হয়। একজন অসহায় দরজায় আছে, সে কি ভেতরে আসবে? না বিফল হয়ে ফিরে যাবে?’
কিছুক্ষণের মধ্যেই কাগজের অপর পৃষ্ঠায় লিখিত জবাব আসল-
‘প্রার্থী যদি দিব্যজ্ঞানের আকাংখী হয় তবে তার পক্ষে ভেতরে চলে আসাই উচিত। হয়ত সে আমাদের সমব্যথী ও সাধনসঙ্গীতে পরিণত হতে পারে। আর যদি মূর্খ ও নাদন হয়ে থাকে তবে যে পথে সে এসেছে সে পথে ফিরে যাওয়াই তার পক্ষে শ্রেয়।’
এরপর আমির খসরু হযরত নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার এমন অন্তরঙ্গ ও সমব্যথীতে পরিণত হলেন যে, মৃত্যুর পরও তারা একজন হতে আর একজন পৃথক হননি। উভয়েই পাশাপাশি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার ওফাত
৩ এপ্রিল ১৩২৫ খ্রিস্টাব্দের সকালে দেহত্যাগ করে নিজামউদ্দিন আউলিয়া। মৃত্যুর আগে শিষ্যদের নির্দেশ দিয়ে যান, আমির খসরুকে যেন তাঁর কবরের পাশে দাফন করা হয়।
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় প্রতিবছর ১৭ রবিউস সানি তার ওরস পালিত হয়। আর ১৮ শাওয়াল আমির খসরুর ওরশ পালিত হয়। জানা যায়, তার সমাধিতে ফিরোজ শাহ তুঘলক সমাধিসৌধ নির্মাণ করলেও পরে তা অবলুপ্ত হয়।
মুর্শিদের মৃত্যুর পর তার সমাধির পাশে বসে বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে ছয় মাস পর আমির খসরুও মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরেন। তাকে তার পীরের মুর্শিদের পায়ের কাছে সমাহিত করা হয়। তার পাশেই আছে আরেক উর্দু কবি মীর্জা গালিবের সমাধি।
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগায় প্রতিবছর ১৭ রবিউস সানি তার ওরস পালিত হয়। আর ১৮ শাওয়াল আমির খসরুর ওরশ পালিত হয়। জানা যায়, তার সমাধিতে ফিরোজ শাহ তুঘলক সমাধিসৌধ নির্মাণ করলেও পরে তা অবলুপ্ত হয়।
পরবর্তী ১৫৬২-৬৩ সালে ফরিদ খান নামক জনৈক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী পূর্ববর্তী সৌধের অনুরূপ সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন যা এখনো বর্তমান।
চারটি বই লেখেন নিজামউদ্দিন- ‘ফাওয়াদ আল ফুয়াদ’, ‘ফাসাল ফুয়াদ’, ‘রাহাত আল মুহাব্বিন’ এবং ‘সৈয়দ আল আউলিয়া’।
নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সাজরাগত ইতিহাস পীরগত বংশানুক্রম-
- হজরত মুহাম্মদ (স)।
- মওলা আলী ইবনে আবু তালিব।
- সৈয়দ হোসাইন ইবনে আলী।
- সৈয়দ জয়নুল আবেদিন ইবনে হোসাইন।
- ইমাম সৈয়দ মুহাম্মদ আল বাকির।
- ইমাম সৈয়দ জাফর আল সাদেক।
- ইমাম সৈয়দ মুসা কাজেম।
- সৈয়দ আলী আল রিদা।
- সৈয়দ মুহাম্মদ আল তকি।
- সৈয়দ আলী আল নকি।
- সৈয়দ জাফর বুখারী।
- সৈয়দ আলী আজগর বুখারী।
- সৈয়দ আবি আব্দুল্লাহ বুখারী।
- সৈয়দ আহমদ বুখারী।
- সৈয়দ আলী বুখারী।
- সৈয়দ হোসাইন বুখারী।
- সৈয়দ আব্দুল্লাহ বুখারী।
- সৈয়দ আলী (ডেনিয়েল হিসেবে পরিচিত)।
- সৈয়দ আহমদ বাদায়ুনি।
- সৈয়দ নিজামউদ্দিন আউলিয়া।
(চলবে…)
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪>>
……………………………
আরো পড়ুন:
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
…………………………..
টিকা
খলিফা: খলিফা হচ্ছে একজন শিষ্য যাকে বায়াত গ্রহণ করার অনুমতি দেয়া হয় এবং স্বীয় মুর্শিদ বা পীরের বংশানুক্রমকে বিস্তার করার দায়িত্ব দেয়া হয়।
…………
তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়াসমূহ
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই
হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্ বাবা
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ
বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার
উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি
বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন