রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
-মাবরুকা রাহমান
“যখন ব্রহ্মাণ্ডে ছিল না কিছুই
তখনো ছিলাম আমি,
যখন সব হয়েছে
তখনো আছি আমি।।
যখন থাকবে না কিছুই
তখনো থাকবো আমি।।”
-শামস তাবরিজি
যার সম্পর্কে দুনিয়াবাসী অনেকখানি জানে তাকে নিয়ে লেখা সহজ। যে রহস্য পুরুষ নিজেকে কেবল একজনের কাছেই উন্মোচিত করেছে আর মিলিয়ে গেছে পরেমশ্বের মাঝে। যার আধ্যাত্মিকতায় ডুবে গিয়ে, যার আত্মার সাথে একাত্ম হয়ে জালালউদ্দিন রুমির মত কবি সুফি সাধকের আধ্যাত্মিক বিকাশ। তাকে নিয়ে লেখা বেশ কঠিন।
রুমির লেখা পড়েছে আর ‘শামস এ তাবরিজি’-এর নাম শোনেন নি এমন লোক পাওয়া মুশকিল। রুমির সবচেয়ে বড় মহাকাব্য যাকে উৎসর্গ করে লেখা তিনি শামস তাবরিজি, জালালউদ্দিন রুমির ঐশী গুরু। বলা হয়, সত্যিকারের সাধকরা কখনো সমাজের কাছে ধরা দেন না।
তারা কেবল তাদের শিষ্যদের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন।
শামস তাবরিজি কতটা প্রজ্ঞাবান এবং কিভাবে পরিপূর্ণ ভাবে স্রষ্টার সাথে লীন হয়ে যেতে পেরেছেন; সেটা দেখা যায় তার শিষ্য রুমির লেখার ভেতর দিয়ে।
শামস তাবরিজি সম্পর্কে ইতিহাস বড্ড ধোঁয়াশা, বড্ড বেশি রহস্যময়। তাবরিজি এতোটাই অস্থির ছিলেন যে তাকে বলা হত ‘পারিন্দা’ বা ‘পাখি’।
কখনো কোথাও তিনি থিতু হন নি। কিভাবে কেটেছিল তার শৈশব? কিভাবে তার স্রষ্টার দিকে ধাবিত হওয়া? এসব সম্পর্কে শামস তাবরিজির লেখা আত্মজীবনী থেকে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায় ৷
তিনি তাবজিরি শহরে, ইরানে অনুমেয় ১১৮০ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেন।
শামস যখন খুব ছোট তখন থেকেই তিনি আর দশ জন বাচ্চার মত ছিলেন না। বলা হয়, তিনি ছোট বেলাতেই দৈব দৃষ্টি লাভ করেন। তার বাবার নাম ইমাম আলা আল-দ্বীন। ছেলের অদ্ভুত আচরণে তার বাবা মা তাকে নিয়ে চিন্তিত থাকতেন।
তাকে জিজ্ঞাস করতেন, ‘তুমি তো পাগল নও। তোমার কি হয়েছে?’
শামস কেবল বলতেন, ‘আমাদের অবস্থা হয়েছে সে মুরগির গল্পটার মত, যেখানে মুরগি কিছু হাঁসের ডিমে তা দিয়ে সেখান থেকে বাচ্চা ফোটায়। আর বাচ্চাগুলো যখন স্বচ্ছন্দে পানিতে নেমে যায়।
তখন মুরগি অবাক হয়ে ফিরে যায় নিজের আগের জায়গায়। কারণ সে সাঁতার জানে না। সে হাঁসদের এই পানিতে ভাসার আনন্দ আর প্রয়োজন কোনটাই বোঝে না।’
তার ব্যবহারে কখনো কখনো তার বাবা আহত হয়ে বলতেন, ‘তুমি যদি বন্ধুদের সাথে এমন আচরণ কর, তবে শত্রুদের সাথে তুমি কি কর?’
শামস তার বাবাকে ভীষণ ভয় পেতেন। তিনি জানতেন তার বাবা ভালো মানুষ। কিন্তু প্রেমিক নন। যে প্রেম কেবল সৃষ্টিকর্তার সাথে তার সৃষ্ট মানুষের মধ্যে হয়। তিনি মনে করতেন, হয়ত এরকম অদ্ভুত আচরণের জন্য তাকে শাসন করবেন তার বাবা।
শামস তার গোটা জীবনই কাটিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার প্রেমে পাগল হয়ে পথে পথে; জীবনকে সঙ্গী করে। ঘুরে বেড়িয়েছেন আর খুঁজেছেন এমন কাউকে যাকে তিনি দিয়ে যেতে পারবেন তার সমস্ত ভাবনা, উপলব্ধি অনুধাবন। যে হবে তার যথার্থ উত্তরসূরী।
কিন্তু তার বাবা শুধু অবাক হতেন, তার সামনে সংযত আচরণ করতেন।
বাল্যকাল থেকেই শামস তাবজিরির ধর্মের প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। যখনই কেউ ধর্মের কথা বলতেন তিন সেখানে উপস্থিত হয়ে তা শুনতেন। ধীরে ধীরে স্রষ্টার প্রেমে মশগুল শামস কৈশোরে তার ক্ষুধাবোধ হারায়।
বেশির ভাগ সময়ই তিনি খাবার গ্রহণে অনাগ্রহ প্রকাশ করতেন। তার মা তাকে বলতেন, কিছুটা খাবার হলেও খেতে। তিনি বলতেন, ‘আমার খাবারের প্রয়োজন নেই। আমি এতটা শক্তিশালী যে, আমি এখনই জানালা দিয়ে পাখি হয়ে উড়ে যেতে পারবো।’
আসলেই তিনি একটা পুরো জীবন পাখির মত উড়েই কাটিয়েছেন। স্বষ্টার প্রেমে মত্ত হয়ে উনি উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়িয়েছেন শহর থেকে শহরে। তার শুধু একটাই চাওয়া ছিল, একজন এমন শিষ্য যে তার পুরোটা গ্রহণ করতে পারবে।
যে বুঝবে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় প্রেম হলো স্রষ্টার জন্য প্রেমিক হওয়া। স্রষ্টা তার দেওয়ানার সে আকাঙ্খা পূরণ করেছেন। সৃষ্টিকর্তা অসীম দয়ালু, ভালোবাসায় পূর্ণ।
‘জীবনকে তোমার বিরুদ্ধে না রেখে বরং তোমার সঙ্গী করে নাও।’ -শামস তাবরিজি
শামস তার গোটা জীবনই কাটিয়েছেন সৃষ্টিকর্তার প্রেমে পাগল হয়ে পথে পথে; জীবনকে সঙ্গী করে। ঘুরে বেড়িয়েছেন আর খুঁজেছেন এমন কাউকে যাকে তিনি দিয়ে যেতে পারবেন তার সমস্ত ভাবনা, উপলব্ধি অনুধাবন। যে হবে তার যথার্থ উত্তরসূরী।
ভাবতেন, যে যাত্রা বাল্যকাল থেকে শুরু, সে যাত্রার শেষ যেন এমন কারো কাছে গিয়েই হয়। যার মাধ্যমে দুনিয়াবাসী জানবে তার সমস্ত বোধের কথা। তার সমস্ত উপলব্ধি। আর স্রষ্টার জন্য যে প্রেম, তা ছড়িয়ে দিবে সকল মানুষের মাঝে।
জীবিকার জন্য শামস কখনো শিক্ষকতা করেছেন। কখনওবা করেছেন দিনমজুরের কাজও। কখনও আবার হয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। শিক্ষক হিসেবে শামস বেশির ভাগ বাচ্চাদের কাছেই ছিলেন ভীতিকর। তিনি বাচ্চাদের সাথে রূঢ় ব্যবহার করতেন। সমস্ত মায়া মমতা ভেঙে দিয়ে আবার গড়ে উঠতে সুযোগ দিতেন।
তিনি যে অদ্ভুত ভালোবাসার সন্ধান পেয়েছিলেন কিংবা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেই ভাব স্বভাবতই বোঝার বা ধারণ করার মত মানুষ পাওয়াটা কঠিন ছিল।
তার জীবন মোটেও সহজ ছিল না। দিনে দিনে তিনি হয়ে উঠছিলেন অসামাজিক, খিটখিটে। সমাজের নিয়ম তাকে বাঁধতে পারত না।
পার্থিব জগত নিয়ে তার কখনো লোভ কাজ করেনি। তিনি স্রষ্টার ডাক নিজের ভেতর শুনতে পেয়েছিলেন। তিনি জানতেন সেটাই শ্রেষ্ঠ সুখবর। তিনি জানতেন মানুষ সোনার মুকুট পেলেও সুখী হয় না। কারণ তারা কখনো জানার চেষ্টাও করে না, সত্য কি?
তিনি বলতেন-
‘আমি কি আত্মিক, নাকি বস্তুগত, নাকি শারীরিক ভালোবাসার দিকে মন দিবো? এসব প্রশ্ন করতে যেও না। বৈষম্য তো কেবল বৈষম্যেরই জন্ম দেয়। ভালোবাসার জন্য এসব নানান রকম নাম, বিভাজন অথবা সংজ্ঞার প্রয়োজন নেই।
হয় তুমি ভালোবাসার মাঝেই আছ, একদম কেন্দ্রে। নতুবা এই পরিসীমার বাইরে তুমি আছ, এই দূরত্বের হাহাকার বুকে নিয়ে।’
জীবিকার জন্য শামস কখনো শিক্ষকতা করেছেন। কখনওবা করেছেন দিনমজুরের কাজও। কখনও আবার হয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ বিক্রেতা। শিক্ষক হিসেবে শামস বেশির ভাগ বাচ্চাদের কাছেই ছিলেন ভীতিকর। তিনি বাচ্চাদের সাথে রূঢ় ব্যবহার করতেন। সমস্ত মায়া মমতা ভেঙে দিয়ে আবার গড়ে উঠতে সুযোগ দিতেন।
যেন এক তাল মাটিকে গড়েপিঠে ভাস্কর্যে পরিণত করা। অল্প কয়েকজন বাচ্চাই তার ভেতরের কোমল রূপটা চিনতে পারত। যেমন, তার আত্মজীবনী মাকালাত বইয়ে একটা বাচ্চার কথা উল্লেখ আছে। যে সারাক্ষণ শামসের সাথে লেগে থাকতার আর বিড়বিড় করে বলতো-
‘আমি সারাবেলা তোমার দরজায় পড়ে থাকি, ধুলোবালির মত, অন্যরা আসে যায় বাতাসের মত।’
এই বাচ্চাটা আঠার বছর বয়সে মারা যায়। হয়ত সে স্রষ্টার প্রিয় হয়ে উঠেছিল শামসকে নিগূঢ় ভাবে ভালোবেসে।
শামস ভাবতেন-
‘বুদ্ধি মানুষকে নিয়ে যায় শেষ কিনারায়। কিন্তু মানুষকে বুদ্ধি কখনোই ঘরে নিয়ে যায় না। সেখানে বুদ্ধি এক পর্দা, হৃদয় এক পর্দা, গুপ্ত হৃদয় সেও এক পর্দা।’
তার ভক্তকুল বলেন, শামস তাবজিরি সেই গুপ্ত হৃদয়ে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন।
খোদাও তাকে এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জগতে এমন একজন আছে, যে শামসের সবটুকু ধারণ করার যোগ্যতা রাখে। যে প্রেমে মশগুল হবে এবং আধ্যাত্মিকতা, সুফিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বিশ্ব দরবারে।
অনার্থক চতুরতা, ধন-জ্ঞানের বড়াই করা ছিল তার অপছন্দ। তিনি জ্ঞানী, দরবেশদের সাথে সময় কাটাতেন। কিন্তু কখনো নিজের জ্ঞান প্রদর্শন করতেন না। এ সময় তার মনে হলো, অনেক দরবেশই আদতে ভণ্ড। তখন তিনি বিচারকদের সাথে সময় কাটাতে লাগলেন।
তানবীহ সহ অন্যান্য অসংখ্য বই তিনি পড়েছেন। তাও এক বার নয়, অসংখ্যবার।
তিনি একজন বিচারকও ছিলেন বটে। কিন্তু তার প্রিয় ছিল কল্পনার রাজ্য। তার বক্তব্য ছিল, বুদ্ধিমান লোকের সাহচার্যের চেয়েও, যৌবনের চেয়েও মধুর হচ্ছে ‘কল্পনা’।
তিনি সেখানে মিশে যেতে পারতেন তার স্রষ্টার মাঝে। একজন প্রেমিকের কাছে সব চেয়ে মূল্যবান তো তার প্রেমটুকুই।
শামস বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন। কিন্তু কোথাও স্থায়ী হন নি। তিনি ক্রমাগত স্রষ্টার কাছাকাছি গিয়েছেন। নিজেকে পরমাত্মার মাঝে বিলীন করে দিয়ে খুঁজে চলেছিলেন এমন একজন শিষ্যকে। যে শিষ্য তার গুরুকেও ছাড়িয়ে যাবে সাধনায়। ছাড়িয়ে যাবে নামে, আর বুদ হয়ে রবে খোদার প্রেমে।
খোদাও তাকে এমনটাই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জগতে এমন একজন আছে, যে শামসের সবটুকু ধারণ করার যোগ্যতা রাখে। যে প্রেমে মশগুল হবে এবং আধ্যাত্মিকতা, সুফিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাবে বিশ্ব দরবারে।
(চলবে…)
………………….
আরো পড়ুন:
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
………………….
আরো পড়ুন:
শামস তাবরিজির বাণী: এক
শামস তাবরিজির বাণী: দুই
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই
হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্ বাবা
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ
বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার
উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি
বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন
3 Comments