-মূর্শেদূল মেরাজ
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
কথা ছিল সদরকোঠায় ফিরে যে যার মতো নিজ নিজ পথ ধরবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গ আর কাটে না কিছুতেই। নানা আড্ডা আয়োজনে খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা আর ঘুমের মধ্য দিয়ে গোটা দুয়েক দিন যে কি করে কেটে গেলো এখন তার হিসেব কষা দুষ্কর।
ঐদিকে মিঠুন দার ফিরতেই হবে। একদিন কাকডাকা ভোরে তিনি রামপালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। আমরা পরে রইলাম। সকলেই মতবল ভাজছে সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ পাহাড়ে যাবে। সুমন দাস আগে থেকেই যেতে আগ্রহী ছিল।
আর সেই আগ্রহে তেল মসলা দিয়ে বেশ উপাদেয় করে তুলেছে পাহাড়ের বাহারে যারা মত্ত্ব থাকে। সেই রাহাত আর ফয়েজ। আশিকের ছোটভাই সৌম্যও নাকি দলে আছে। শারীরিক কিছু সমস্যার কারণে আমি ঠিক চন্দ্রনাথে উঠতে পারবো কিনা তাতে আমি নিজেই সন্দিহান।
আমাকে ঘিরে সকলের যাত্রায় আবার ব্যাঘাত ঘটে কিনা। এই সব সাত-পাঁচ ভেবে এক সকালে সকলের অগোচরে সদরকোঠা ছেড়ে ঘরের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আর তারপর থেকেই শুরু হলো নতুন অত্যাচার। আমাকে নাকি জেতেই হবে সীতাকুণ্ড।
কি যে এক যন্ত্রণা। কি যে করি। যেতে স্বাদ যে আমার ষোল আনার উপর আর দুই আনা সেটা আমি নিজেও ভালো জানি। অন্যরাও জানে। কিন্তু আমি চন্দ্রনাথে উঠতে গিয়ে বিপত্তি বাঁধালে সকলের যন্ত্রণার কারণ হতে পারে।
যদিও আমাকে নানারূপ মন্ত্রণা দেয়া হচ্ছে। কোলে কাঁধে করে নেয়া হবে বলেও লোভনীয় সব অফার আসছে। আমি অবশ্য কান বন্ধ করে বসে আছি ঘরে। তারা প্রতিদিন নিত্যনতুন সব পরিকল্পনা করে। আর মধ্য রাতে সেসব জানায়।
আমি জানতে চাই না। তাও তারা জানায়। আর জ্বালায়। অবশ্য চন্দ্রনাথে গেলে ঝড়ঝড়িতে যাওয়া হবে। সেটাতে আমার বেশ উৎসাহ আছে। ফয়েজ-রাহাত-সিফাতের মুখে ঝড়ঝড়ির অনেক গল্প শুনেছি। ছবিও দেখেছি। তাই সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে আছে প্রবল।
শেষে ওরা সকলে মিলে ঠিকঠাক করলো ৩ তারিখ রাতে রওনা হবে। অর্থাৎ ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ খ্রিস্টাব্দ। রাহাতের বাবা আমাদের হাশেম কাকা একটা রিজার্ভেশন করে দিয়েছেন। সেই কামরায় সকলে যাবে। আর আমাকেও সাথে যেতে হবে।
দফায় দফায় ফোন আসতে শুরু করলো। অনেকেই চেষ্টা করলো বটে। আমি সকলকেই বুঝিয়ে সুজিয়ে ক্ষমা-ভিক্ষা করে নিলাম। কিন্তু শেষে আশিক ফোন দিয়ে মাকের্টিং-এর মারপ্যাঁচ আর চরম ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের ভেতর দিয়ে ঠিকই রাজি করিয়ে নিলো।
হুডি, কেডস, শুকনা খাবার, ফলফলাদি, বনস্পতি কিনে আমরা ফিরলাম। কয়েক মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছে বগি খুঁজে উঠে পরলাম। মাস্টার বললো, হায়রে রিজার্ভেশন কাদের নামে আর যাচ্ছে কারা। এইভাবে করলে কি চাকরি থাকবে?
ঠিক হলো দুই তারিখে উত্তরার সদরকোঠায় যাব। সেখান থেকে ৩ তারিখ রাতে সীতাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে রওনা। কি আর করা ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা হলাম।
সদরকোঠায় গিয়ে দেখি সকল রকম পরিকল্পনা হয়ে গেছে। প্রথমে যাওয়া হবে চন্দ্রনাথ। অর্থাৎ সকালে সীতাকুণ্ড নেমেই চন্দ্রনাথে রওনা। চন্দ্রনাথ-পাতালকালী ঘুরে নেমে এসে নিচে কোথাও অবস্থান করা হবে। তার পর দিন ঝড়ঝড়ি যাওয়া হবে।
সকল খসড়া পরিকল্পনা যখন প্রায় চূড়ান্তের পর্যায়ে তখন একটু ভেটো দিয়ে বললাম। প্রথমে চন্দ্রনাথের চূড়ায় না গিয়ে ঝড়ঝড়ি চলে যাই। সেখানে গড়াগড়ি করে বিশ্রাম নিয়ে ফেরার পথে চন্দ্রনাথে উঠি সেটা কেমন হয়। রাহাত এই বিষয়ে সবচেয়ে আগ্রহী।
সে আড়ালে আবডালে বলেছে, একবার যদি আমাদের ঝড়ঝড়িতে নিয়ে তুলতে পারে। তাহলে আমরা নাকি আর নামবোই না। সেখানেই কাটিয়ে দেবো পুরোটা সময়। সেই সৌন্দর্যকে এড়িয়ে নামা নাকি কষ্টকর হবে। তাই আমার সাথে তাল মেলানোর লোকের অভাব হলো না।
রাহাত ফয়েজ রাজি, সুমন দাসও রাজি, আউলিয়াও রাজি। আশিক রাজি তবে তার এক কথা চন্দ্রনাথ আর পাতালকালী উদ্দেশ্যে যাওয়া হচ্ছে সেটা যেন মিস না হয়। আমি অবশ্য চন্দ্রনাথ বা পাতালকালী নিয়ে খুব একটা ভাবছি না।
যদিও এই গ্রুপে দীর্ঘদিন ধরে পাতালকালী যাব যাব বলে রব আমিই প্রথম তুলেছিলাম। কিন্তু এখন আমার আর সেখানে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছেটা নেই। আমি ঝড়ঝড়িতে যাওয়ার জন্যই বেশি আগ্রহী। যাক শেষ পর্যন্ত তাই ধার্য হলো ৩ তারিখ রাতে রওনা হচ্ছি এয়ারপোর্ট স্টেশন থেকে।
প্রথমে যাব ঝড়ঝড়ি। ওহ্ ভালো কথা তো বলাই হয় নাই। আমি সদরকোঠায় যাওয়ার আগেই সকলে এক দফা কেনাকাটা সেরে নিয়েছে। বাসন্তি রঙে সকলে রেঙেছে। তাই আমি যাওয়ার পর আমাকেও আশিক নিয়ে চললো কেনাকাটায়।
হুডি, কেডস, শুকনা খাবার, ফলফলাদি, বনস্পতি কিনে আমরা ফিরলাম। কয়েক মিনিট আগে স্টেশনে পৌঁছে বগি খুঁজে উঠে পরলাম। মাস্টার বললো, হায়রে রিজার্ভেশন কাদের নামে আর যাচ্ছে কারা। এইভাবে করলে কি চাকরি থাকবে?
আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরলাম। মালপত্র কার ঘাড়ে কোনটা যাবে। তা এই বেলা ঠিকঠাক করে নিতে হবে। এমন সময় রেলের চার কর্মচারী ফাইনের খাতাপত্র নিয়ে দাপটে ভঙ্গিতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। যারা ট্রেন চলে যাওয়ার পরও স্টেশনে অপেক্ষা করে।
কামরায় চারজন যাওয়া যায় রাতে। তাই আশিক অতিরিক্ত আর তিন খানা স্ট্যান্ডিং টিকেট কিনে নিয়েছে। বিনা টিকেটে ভ্রমণ করা যাবে না। সে বিষয়ে আমরা সকলেই একমত। আমাদের কাছে ফয়েল+কম্বল পর্যাপ্ত আছে। সাথে নেয়া হয়েছে তিন খানা তাবু।
মজার বিষয় হলো আমাদের ঘুরে ফিরে সংখ্যায় সাত জনেই দাঁড়ায়। মিঠুন দা চলে গেলেও সৌম্য আসায় আবার আমরা সাত জনে পরিণত হয়েছি। কামরার ফ্লোরে ফয়েল বিছিয়ে, সীট আর বাঙ্কে মিলে সকলে আরাম করে বসে পরলাম।
যন্ত্রপাতি বের হলো। মানে ঐ বাদ্যযন্ত্র আর কি। শুরু হলো গান-বাজনার আয়োজন। রাহাত গান ধরলো অঞ্জন দত্তের ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। এক এক করে চলতে লাগলো গান-আড্ডা খাওয়া দাওয়া। ঐ দিকে চলতে লাগলো ট্রেন ঝম ঝমাঝম ঝম।
সীতাকুণ্ড স্টেশন থেকে এতো সব ব্যাগপত্র, কম্বলের বস্তা, ফয়েলের বাহারি আয়োজন, তাবু সমস্ত কিছু নিয়ে নামতে না নামতেই এই ভোর ভোর পরিবেশেও কিছু উৎসাহী মানুষ এগিয়ে এলো তারা। জাতে চায় আমরা কোথায় থেকে এসেছি? কোথায় যাব?
এই প্রশ্নটা বরাবরই বেশ বিব্রতকর। কোথা থেকে আসছি। কোথায় যাব। সেটা কি আমরা কেউ নির্দিষ্ট করে জানি? নাকি বলতে পারি?? কিন্তু উৎসহী লোকজন তা বুঝতে পারে না। চায়ও না।
আমরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পরলাম। মালপত্র কার ঘাড়ে কোনটা যাবে। তা এই বেলা ঠিকঠাক করে নিতে হবে। এমন সময় রেলের চার কর্মচারী ফাইনের খাতাপত্র নিয়ে দাপটে ভঙ্গিতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। যারা ট্রেন চলে যাওয়ার পরও স্টেশনে অপেক্ষা করে।
ট্রেন লোকজন ধরেই নেয় তাদের পকেটে টিকেট নেই। কিন্তু যখন আমাদের রির্জাভেশন আর টিকেট তারা দেখতে পেলো। তীব্র মনকষ্ট নিয়ে ফিরে গেলো। এমন করে এক একটা টিকেট আর রির্জাভেশনের কাগজটা পরতে লাগলো।
যেন এই জিনিস জীবনের প্রথম দেখছে তারা। সকাল সকাল বাড়তি উপার্জনটা হাত ফসকে গেলো বলে তাদের মনটা যে বেশ খারাপ হলো সে বিষয়টা আমরা সকলেই বুঝে ফেলেছি। তাদের চেহারার ফ্যাকাসে ভাব দেখে।
আমরা দুইজনই কেবল চা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো আধঘণ্টা জুড়ে এমাথা ওমাথা চোষে ফেললেও চায়ের দেখা মিললো না। এই বাজারে নাকি শুধু চায়ের কোনো দোকান নেই। আর যে গোটা দুয়েক আছে তাও এখনো খুলে উঠতে পারে নি।
স্টেশনের পাশের ছোট্ট হোটেলখানায় নাস্তার পর্ব সেরে হাঁটা দিলাম। গন্তব্য সীতাকুণ্ড বাজার। সেখানে একদল যাবে বাজার করতে। আরেকদল ব্যাগপত্র নিয়ে অপেক্ষা করবে। যথারীতি বাজারের দলে রাহাত-ফয়েজ-আউলিয়া আর সৌম্য।
আর অপর দলে আমি, সুমন আর আশিক। সুমন অবশ্য তার ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয় পরলো যথারীতি। একবার কানে ফোন উঠলে সুমন নির্দিধায় ঘণ্টা দুয়েক বা তিনেক কাটিয়ে দিতে পারে। বিষয়টা যে আশপাশের মানুষের জন্য বিরক্তিকর হয়ে উঠে বিষয়টায় সে গা করে না।
সামাজিক ব্যবহারের নূন্যতম এটিকেট হলো- তোমার আশপাশে যারা আছে তোমার সাথে। তাদের অধিক গুরুত্ব দেয়া। দূরে যারা আছে তাদের সাথে সময় করে। অন্য কারো বিরক্তির কারণ না হয় সেভাবে ম্যানেজ করে নেয়া। নইলে উপস্থিত মানুষকে অবহেলা করা হয়।
আর অবহেলা হলো প্রেমের বিপরীত। প্রেমিক অপমান সইতে পারে অবহেলা সইতে পারে না। অবহেলায় প্রেমের গতিপথ পাল্টে যায়।
ফোনে ব্যস্ত সুমন দাস বাউলকে ব্যাগপত্রের সামনে রেখে আমি আর আশিক বেড়িয়ে পরলাম এক কাপ গরম গরম চিনি ছাড়া রঙ চা পানের উদ্দেশ্যে। তখনো ঠিকঠাক মতো সকালটা হয়ে উঠতে পারেনি। বেশিভাগ দোকানই বন্ধ।
মাত্র গুটি গুটি করে ভাড়া খাটা গাড়িগুলো রাস্তায় জায়গা নিতে শুরু করেছে। একটা দুইটা করে দোকান খুলছে। শিক্ষার্থীরা ঘুম থেকে উঠে ফিটফাট হয়ে কোচিং-এ যাচ্ছে দলে দলে। এই দিকের কোচিং সেন্টারগুলো সম্ভবত করোনার নির্দেশনা মানছে না। কেউ কেউ বাজার করতে বের হয়েছে এরই মধ্যে।
আমরা দুইজনই কেবল চা খুঁজে বেড়াচ্ছি। আশ্চর্যের বিষয় হলো আধঘণ্টা জুড়ে এমাথা ওমাথা চোষে ফেললেও চায়ের দেখা মিললো না। এই বাজারে নাকি শুধু চায়ের কোনো দোকান নেই। আর যে গোটা দুয়েক আছে তাও এখনো খুলে উঠতে পারে নি।
(চলবে…)
<<লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন ।। সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই>>
………………………..
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ