-মূর্শেদূল মেরাজ
রাত তিনটা… নেত্রকোণা শহরে নামিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে গেলো মহাখালি থেকে ছেড়ে আসা সৌদিয়া পরিবহনের বাসটা। বহু নাটকীয় ঘটনার পর নাস্তা সেরে সাড়ে পাঁচটায় একখানা সিএনজিতে ঠাসাঠাসি করে ছয়জনে ছুটলাম মোহনগঞ্জের দিকে। উদ্দেশ্য মোহনগঞ্জ থেকে হাওরে ভৈরব পর্যন্ত যাত্রা। সিএনজির পেছনে চারজন আর সামনে আমি আর শাহীন ভাই। আমাদের মাঝখানে অবশ্য ড্রাইভার সাহেব আছেন। তার বিচিত্র রিংটোন আমাদের এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে দেয়নি তিনি আমাদের মাঝেই আছেন।
নতুন জল ঢোকায় হাওরের পানি বেশ ঘোলা। তারপরও এর সৌন্দর্য ম্লান হয়নি এতোটুকু। আমরা ট্রলারের ছই-এর মধ্য বসে জানালা খুলে দেখছি জলের মাতম। বৃষ্টি একটু ধরে আসতে ছই থেকে বেড়িয়ে হাওর জলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলাম। কিন্তু বিধিবাম। এমন সুখ আমাদের সইবে কেন। বৃষ্টির সাথে বাতাসের তেজ অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পুনরায় ছই-এর মধ্যে নিয়ে গেলো।
পথে কয়েকদিনের বৃষ্টির ছাপ স্পষ্ট। চারপাশের উপচে পরা জল কোথাও কোথাও আঁকাবাঁকা সড়কটিকেও খেয়ে দিয়েছে। আকাশ কালো হয়ে আসা মেঘের বারতা ফরিদীভাইকে হতাশ করে তুলছে। ক্যামেরা-ল্যান্স কি ব্যাগবন্দিই থাকবে? এখনো মেঘলা আকাশে ঠিকঠাক মতো আলো ফোটেনি। এরই মাঝে বিভিন্ন বয়সী মানুষ বাড়ির উঠান, রাস্তার পাশে মাছ ধরতে বেড়িয়ে পরেছে টেটা-জাল-ছিপ নিয়ে। বেশ উৎসব উৎসব ভাব।
মহিলা-বৃদ্ধা এমনকি ছোট্ট ছোট্ট শিশুরাও ঘুম ঘুম চোখে মাছ ধরতে ব্যস্ত। অপরূপ এসব দৃশ্য আমাদের চোখে ম্লান হয়ে যাচ্ছে আকাশ কালো করে আসা মেঘমাল্লার বংশধরের আগ্রাসনে। এই আবহাওয়ায় হাওর ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবার কথা। এমন সময় শাহীন ভাই বললো ছোটবেলায় এমন কইরা আমি কত মাছ ধরছি। “ছোটবেলায় এমন কইরা আমি কত মাছ ধরছি” ছোট্ট এই কথাটি হঠাৎ করেই চিন্তায় একটা বড় নাড়া দিয়ে গেলো।
আমার মনে হতে লাগলো একদিন এই শিশুগুলিও এভাবেই আমাদের মতো করেই কোথাও যেতে যেতে হয়তো একই কথা বলবে… “ছোটবেলায় এমন কইরা আমি কত মাছ ধরছি”। শব্দগুলো মাথায় ঢুকে গেলো। “ছোটবেলায় এমন কইরা আমি কত মাছ ধরছি”। আসলে এই শিশুগুলি কি সত্যিই মাছ ধরছে? নাকি আমাদের শৈশবটা অভিনয় করে যাচ্ছে মাত্র? যদি তাই হয় তবে আমরা কার যৌবনটা অভিনয় করে যাচ্ছি?
আমরা কে কার সময় কাটাচ্ছি? কে কার জীবন উপভোগ করছি? আমার জীবনটা তাহলে কে কাটাচ্ছে? কে কাটাচ্ছে আমার সময়কাল? আর কার সময়কাল কাটাচ্ছি আমি? সিএনজি ছুটে চলছে সর্পিল রাস্তা ধরে। কিন্তু মাথায় একটাই চিন্তা আমার সময়টা তবে কে কাটাচ্ছে? কে? কে? নাহ্ এসব অহেতুক ভাবনা… নিজেকে বুঝ দেই। হাওরের বাতাসই আসলে সর্বনাশের মূল। হাওরের বাতাসেই এই বিভ্রান্তি। অন্যকিছু নয়।
সিএনজি ছেড়ে অটো চেপে যখন মোহনগঞ্জের ঘাটে পৌঁছালাম তখন বৃষ্টির সকল প্রস্তুতি শেষ মেঘমাল্লার দলের। শাহীন ভাই ছাড়া ঘাটের সকলেই বলছে এ বৃষ্টি থামবার নয়। ঘাটের সবচেয়ে ভালো ট্রলারটা নিয়ে অবশ্য মোজাম্মেল মাঝি প্রস্তুত। এরই ফাঁকে আমরা যখন চা পানে ব্যস্ত তখন স্থানীয়রা দোকানের টিভি দেখা বাদ দিয়ে আমাদের ট্রলার ডুবে গেলে আমরা কি করবো তা নিয়ে আলোচনা জুড়ে দিলো নিজেদের মধ্যে।
এই সময় উত্তাল হাওরে বেড়াতে যাওয়া যে বোকামী তাই তারা বলতে চাইছে। তবে আমাদের কান্ডারী শাহীন ভাই নির্বিকার। ট্যুর প্ল্যান এগিয়ে চলছে তুমুল জোড়ে। আমাদের ট্রলার যখন যাত্রা শুরু করলো প্রথম স্টপিজ ইটনার উদ্দেশ্যে তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে বেশ জোরেসোরে। নতুন জল ঢোকায় হাওরের পানি বেশ ঘোলা। তারপরও এর সৌন্দর্য ম্লান হয়নি এতোটুকু। আমরা ট্রলারের ছই-এর মধ্য বসে জানালা খুলে দেখছি জলের মাতম।
বৃষ্টি একটু ধরে আসতে ছই থেকে বেড়িয়ে হাওর জলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গেলাম। কিন্তু বিধিবাম। এমন সুখ আমাদের সইবে কেন। বৃষ্টির সাথে বাতাসের তেজ অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের পুনরায় ছই-এর মধ্যে নিয়ে গেলো।
আমার স্বপ্নের শহর… আমার ঘর… আমার বিছানা…। আমার ছাদে উড়ে আসা সাহসী কবুতরটার কথা মনে পরলো হঠাৎ করেই… সে ভয় পায় না… আমার হাত থেকে সাহস করে খাবার নিতে পারে। না আর নয় জলে… একবার ডাঙায় যেতে পারলে হয়। এমনটা ভাবতে ভাবতেই ঘণ্টা দুয়েক পার… সিদ্ধান্ত হলো আধ ঘণ্টা এগিয়ে একটা বাজার পাওয়া যাবে সেখানে যাবো…
ট্রলার ঝুটছে যত ঢেউ বাড়ছে তত। প্রচন্ড দুলতে শুরু করলো ট্রলার। একেই আফাল বলে কিনা কে যানে ; তবে শরীফ ততক্ষণে লাইফ জ্যাকেট পরে নিয়েছে। ফরিদী ভাই ল্যান্স পাল্টাচ্ছেন। পর্যাপ্ত আলো পাওয়া যাচ্ছে না ছবি তুলবার। শাহীন ভাই ঘুমাবার জায়গা খুঁজছে। বাবু ভাই ঢেউ দেখছে। বৃষ্টি বেড়েই চলেছে, সেই সাথে ঢেউ। আমি দু হাতে ছইয়ের কাঠ ধরে বসে আছি। তখনো ভাবছি আসলেই কি আমি আমার সময় কাটাচ্ছি?
নাকি অন্য কারো সময়ের অভিনয় করে যাচ্ছি মাত্র? তাহলে আমার সময় কাটাচ্ছে কে? কে? ঢেউ বেড়েই চলছে। এই ঢেউ-এ নৌকা টিকতে পারবে কিনা বুঝে উঠতে পারছি না। হাওর পাগলা হয়ে গেছে। একসময় আর না পেরে মাঝিরা কোনো এক গ্রামের পাশে নোঙ্গর করলো। ততক্ষণে সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। ঘণ্টা দুয়েক বৃষ্টি কমার অপেক্ষায় নাম না জানা এক গ্রামের পাশে ট্রলারের ছইয়ের ভেতরে আমরা জড়োসড়ো।
সবাই বেশ আনন্দে আছে। শুধু সাঁতার না জানা আমি এই অকূল পাথারে বসে বসে ভাবছি এই জলে আর নয় ; একবার ডাঙ্গায় যেতে পারলে সোজা ফিরে যেতে হবে যান্ত্রিকতার শহর ঢাকায়। আমার স্বপ্নের শহর… আমার ঘর… আমার বিছানা…। আমার ছাদে উড়ে আসা সাহসী কবুতরটার কথা মনে পরলো হঠাৎ করেই… সে ভয় পায় না… আমার হাত থেকে সাহস করে খাবার নিতে পারে। না আর নয় জলে… একবার ডাঙায় যেতে পারলে হয়।
এমনটা ভাবতে ভাবতেই ঘণ্টা দুয়েক পার… সিদ্ধান্ত হলো আধ ঘণ্টা এগিয়ে একটা বাজার পাওয়া যাবে সেখানে যাবো… দুপুরের খাওয়ার আয়োজন হবে ওখানেই। কিছুটা কমে আসা বৃষ্টির মধ্যেই ট্রলারের মেশিন স্ট্যার্ট নিলো, এগিয়ে চললাম লিপসা বাজারের দিকে। আশপাশে কোনো ট্রলার বা মাছ ধরা নৌকারও দেখা মিলছে না এখন আর। সকলেই নিরাপদ দূরত্বে ডাঙ্গার দিকে চলে গেছে। ঢেউ তার তেজ দেখিয়েই চলছে। লিপসা বাজারে যখন পৌঁছাতে পৌঁছাতে বৃষ্টি কিছুটা কমে আসলো।
(চলবে…)
<<ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক ।।আফালে গাগলাজোড় : দুই>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………
আরও পড়ুন-
আফালে গাগলাজোড় : এক
আফালে গাগলাজোড় : দুই
আফালে গাগলাজোড় : তিন
………………………..
আরও পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ