ভবঘুরেকথা
ইমাম গাজ্জালী

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন

হজ্ব পালন ও দেশ ভ্রমণ

মদীনা শরীফ থেকে তিনি মক্কা শরীফ যেয়ে তিনি হজ্ব পালন করেন। এখানেও তিনি ধীর্ঘকাল অবস্থান করেন। মক্কা মদীনায় অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন দেশের বহু বুজুর্গের সাথে সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনা করেন। এরপর সেখান থেকে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আলেকজান্দ্রিয়া যান। সেখানে কিছুকাল থাকার পর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

ফেরার পথে তিনি আবার মক্কা-মদীনা যিয়ারত করেন। বাগদাদ থেকে বের হয়ে দীর্ঘ দশ এগার বছর তিনি বহু বন-জঙ্গল, জনপথ ও মরুপ্রান্তর পরিভ্রমণ করেন। বলাই বাহুল্য সেসময় যাতায়াতের জন্য বাহন পশু ব্যতীত অন্য কোন উপায় ছিল না। কিন্তু এত কষ্টকর ভ্রমণেও তার ইবাদত-বন্দেগী ও রিয়াযত-মোঝাহাদায় কোন প্রকার ত্রুটি বিচ্যুতি হয়নি। ফলে তার অন্তরাত্মা নির্মল ও পবিত্র হয়ে পরে। এবং দিব্যজ্ঞানের পথে সমস্ত পর্দা একেবারে অপসারিত হয়ে পরে।

 

পুনরায় মাদ্রাসা নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান

ইমাম গাজ্জালী উপলব্ধি করেন সমগ্র দুনিয়া ধর্মের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে এবং মুসলমানরা ধর্ম-কর্মে দিন দিন শিথিল হয়ে পরছে। জড়বাদী দর্শন-বিজ্ঞানের ঝড়ঝঞ্জার সংঘাতে ধর্মের সূত্র ছিন্নভিন্ন হয়ে পরছে। এজন্য নির্জনবাস ত্যগ করে ধর্মপ্রচারে আত্মনিয়োগে মন দেন।

বাগদাদ অধিপতি সুলতান মালেক শাহের পুত্র সুলতান সালজানর সালজুকীর প্রধানমন্ত্রী ফখরুল মুলক (ভুতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী নিজামুল মুলকের জৈষ্ঠপুত্র) এ সময় আবার ইমাম গাজ্জালীকে মাদ্রাসা নিযামিয়ার অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। তার বন্ধুবান্ধবরাও তাকে ইসলামী শিক্ষা প্রসারে আত্মনিয়োগ করার অনুরোধ জানাতে থাকে। স্বপ্নযোগেও বহু পবিত্র আত্মার পরামর্শও আসতে থাকে।

দেশে ফেরার পর হিজরি ৪৯৯ সনে যিলকাদ মাসে পুনরায় তিনি মাদ্রাসা নিযামিয়ায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। তিনি অতি উৎসাহের সাথে এ কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।

 

মাদ্রাসা নিযামিয়া ত্যাগ

হিজরী ৫০০ সনে মহররম মাসে প্রধানমন্ত্রী ফখরুল মুলক এক গুপ্তঘাতকের হাতে নিহত হন। এই হৃদয়বিদারক ঘটনার কিছুদিন পরই ইমাম গাজ্জালী মাদ্রাসা নিযামিয়া ত্যাগ করে নিজ বাসভবনের কাছে একটি খানকা প্রতিষ্ঠা করে ইলমীদ্বীনের শিক্ষার্থী ও আল্লাহর পথের পথিকদেরকে শিক্ষা দিতে থাকেন। বাকি জীবন তিনি এই স্থানে এই কাজেই নিয়োজিত ছিলেন।

 

হিংসার কোপে গাজ্জালী

মাদ্রাসা নিযামিয়ার অধ্যক্ষপদ পুন:গ্রহণের জন্য বাগদাদাধিপতি সুলতান সানজার সুলজুকী গাজ্জালীকে বারবার অনুরোধ করতে থাকেন। কিন্তু এতে তিনি রাজী হননি। এই সুযোগে হিংসাপরায়ন কিছু লোক তার বিরুদ্ধে সুলতানকে উত্তেজিত করার প্রয়াস পায়। সুলতান হানাফী মাযহাবালম্বী ছিলেন। তারা তার কাছে অভিযোগ করেন, ‘মন্‌খুল’ কিতাবে ইমাম গাজ্জালী হযরত আবূ হানীফাক(র)-কে তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন।

এতে গাজ্জালীর প্রতি সুলতানের আসন্তোষের উদ্রেক হয়। রাজ দরবারে হাজির হওয়ার জন্য ইমাম গাজ্জালীকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে মোতাবেক তিনি দরবারে উপস্থিত হলে সুলতান দণ্ডায়মান হয়ে তাকে আলিঙ্গন করেন এবং সিংহাসনে বসান।

ইমাম আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা সত্য না। তার সম্বন্ধে আমার সেই বিশ্বাসই বলবৎ আছে, যা আমি ‘ইয়াহয়েউল উলূম’ কিতাবে প্রকাশ করেছি। তাকে আমি ফিকাহশাস্ত্র যুগস্রষ্টা ইমাম বলেই স্বীকার করি। এতে তার সম্পর্কে সুলতানের ধারণা সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

 

অধ্যক্ষ পদ পুন:গ্রহণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান

মাদ্রাসা নিযামিয়া সুনাম পুনরুদ্ধারের জন্য আমীর-উমরাহ ও রাজপুরুষরা নানা উপায়ে ইমাম গাজ্জালীকে এর অধ্যক্ষ পদে পুন:নিয়োগ করার চেষ্টা করতে থাকেন। সালজুকী সুলতান এবং খলিফার দরবার থেকেও তার কাছে বারবার অনুরোধপত্র আসতে থাকে।

 

অসম্মতি কারণ হিসেবে গাজ্জালী উল্লেখ করেন-

১. তুস নগরে বর্তমানে আমার কাছে দেড়শত ছাত্র অধ্যয়নরত আছে। আমি বাগদাদে চলে গেলে তাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া দু:সাধ্য হবে।
২. পূর্বে আমার কোন সন্তান ছিল না। কিন্তু এখন আল্লাহ তাআলা কয়েকটি সন্তান দান করেছেন। তাদেরকে ছেড়ে বাগদাদে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
৩. মাকামে খলিলে প্রতিজ্ঞা করেছি যে, ভবিষ্যতে আর কোন বিতর্কে জড়াবো না। কিন্তু বাগদাদে এ থেকে বিরত থাকার উপায় নেই।
৪. খলিফার সন্মানার্থে তার দরবারে উপস্থিত থেকে হবে। আমার এটা বরদাস্ত হবে না।
৫. রাজ দরবার থেকে কোন বেতন বা বৃত্তি গ্রহণ করব না বলে প্রতিজ্ঞা করেছি। বাগদাদে আমার কোন সম্পত্তি নেই। তাই কিভাবে আমি বাগদাদে অবস্থান করবো?

মোটকথা সকল অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি অধ্যক্ষ পদ গ্রহণে আর সন্মত হননি। জীবনের অবশিষ্ট সময় তিনি তুস নগরে অবস্থান করে গ্রন্থ রচনায় মগ্ন থাকেন। জ্ঞানের আলো বিতরনের উদ্দেশ্যেই ইমাম গাজ্জালীর এ পৃথিবীতে আবির্ভাব। বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারে তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা নিঃসন্ধেহে অতুলনীয়। এ মনীষী মাত্র ৫৫ বছর জীবিত ছিলেন।

শৈশব ও পাঠ্য জীবন বাদ দিলে মাত্র ৩৪/৩৫ বছর কর্মজীবনে তিনি প্রায় চার শত অমূল্য গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে ”ইয়াকুতুততাবলিক” নামক তাফসীর ৫০ খণ্ডে বিভক্ত এবং ”ইয়াহইয়উল উলুমুদ্দীন” বিরাট চার খণ্ডে সমাপ্ত। প্রত্যেকটি খণ্ডও আবার দশটি পৃথক বিভক্ত। ১০/১১ বছর তিনি দেশ পর্যটন ও নির্জনবাসে অতিবাহিত করেন।

তারপরও অধ্যাপনা, অধ্যয়ন, ধ্যান-সাধনা ও ইবাদত বন্দাগীতেও কিছু সময় ব্যয় হতো। তার দরবারে শিক্ষার্থী ও দীক্ষা প্রার্থীদের সংখ্যা কোন দিনই দেড়শত’র কম হত না। তাছারাও দূরদূরান্ত থেকে নানা জটিল বিষয়ে ফতোয়ার জন্য অনেক লোক তার দরবারে আগমন করত এবং ওয়াজনসিহত ও বিতর্কসভাও তাকে করতে হত।

এতেও তার কম সময় ব্যয় হত না। এত কর্মব্যস্ততার মধ্যেও এত গুলি গ্রন্থ রচনা করে তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। আল্লামা নববী বলেন, ইমাম গাজ্জালীর সম্পূর্ণ আয়ুষ্কাল ও তার রচিত গ্রন্থাবলীর হিসাব আন্তে আমি গড় করে দেখেছি, তিনি গড়ে প্রত্যেকদিন ১৬ পৃষ্ঠা লিখেছেন।

দর্শন, তর্ক, ইলমে কালাম, ধর্মতত্ব, মনস্তত্ত্ব, স্বভাব-বিজ্ঞান, নীতি-বিজ্ঞান, আধ্যাত্মিক তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেন। তার রচিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে নিম্নলিখিতগুলি বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।

(চলবে…)

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার>>

……………………………..
আরো পড়ুন: 
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
……………………………..

………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!