খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
খাজা ফুজাইল বিন আয়াজ যুবা বয়সে প্রেমিকার জন্য অর্থ যোগান দিতে বনে যেয়ে কুঁড়ে ঘর তৈরি কর বাস করতে শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি দস্যুবাহিনীর সর্দার রূপে আত্মপ্রকাশ করেন। পথিকদের মালামাল লুট করাই ছিল তার প্রধান কাজ। তার নাম শুনলে পথিকের পথচলা বন্ধ হয়ে যেত। পেশা দস্যুবৃত্তি হলেও তিনি দলবল নিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে আদায় করতে ন। নামাজে ইমামতি করতেন নিজেই।
খাজা ফুজাইর সম্পর্কে কথিত আছে, লুট করার সময় নামাজের সময় হয়ে গেলে তিনি পথিকদের গাছের সঙ্গে বেঁধে নামাজ আদায় শেষে তারপর লুট করতেন। লুট করা দ্রব্য দস্যু সদস্যদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতেন। সর্দার হয়েও তিনি কখনও অধিক গ্রহণ করতেন না।
একবার তার লোকজন এক গ্রামে লুট করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। কিন্তু হামলার পূর্বেই গ্রামবাসী খবর পেয়ে মূল্যবান সমস্ত কিছু নিয়ে নিরাপদ জায়গায় পালিয়ে যায়। তাদের মধ্যে এক যুবক নিজের স্বর্ণালংকার-অর্থ সবকিছু মাটিতে পুঁতে রাখতে বনের দিকে রওনা দিলো।
বনের ভিতর প্রবেশ করতেই সে একটি কুঁড়ে ঘর দেখতে পেল। যার ভেতরে বসা ইবাদতে নিমগ্ন এক দরবেশ। সে ভাবল মালামাল মাটির নিচে পুঁতে রাখার চেয়ে এ দরবেশের কাছে গচ্ছিত রাখা অনেক নিরাপদ। কুটিরে প্রবেশ করে নিজের ইচ্ছার কথা জানালে দরবেশ তাকে তার থলেটি ঘরের এক কোণে রেখে দিতে বললেন।
যুবক নিশ্চিন্তে তার সম্পদ তার কাছে গচ্ছিত রেখে চলে গেল। দস্যুদল গ্রাম লুট করার পর বনে ফিরে যেয়ে যখন লুন্ঠিত মালামাল ভাগ বাটোয়ারার কাজে ব্যস্ত। সে সময় যুবকটি তার গচ্ছিত মালামাল ফেরত নেওয়ার জন্য বনে প্রবেশ করে সেই কুঁড়ে ঘরের সম্মুখে পা রাখতেই চমকে উঠল। একি! কাদের কাছে সে তার মালামাল জমা রেখেছে? এরা তো তারাই যারা গ্রাম লুট করে এলো!
সে তাড়াতাড়ি নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে নেবার জন্য পা বাড়ালো। সাথে সাথে খাজা ফুজাইল তাকে ডাকল। যুবক ফিরে তাকাতেই তিনি বললেন, তোমার গচ্ছিত মালামাল নিয়ে যাও। সে দুরুদুরু বুকে এগিয়ে যেয়ে নিজের পুটলি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো এবং বলতে লাগল এও কি সম্ভব?
তিনি ডাকাত দলের সর্দার ছিলেন ঠিকই কিন্তু যার কাছে হতে যা লুট করতেন তাদের নাম ধাম সহ একটি তালিকা নিজের ডায়েরিতে লিখে রাখতেন।
খাজা ফুজাইল একদিন এক বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় ‘এখনও কি তোমার সংশোধনের সময় আসেনি?’ কোরআনের এই আয়াতটি শুনতে পেলেন। আয়াতটি শোনার সাথে সাথে তার মধ্যে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন দেখা দিল।
খাজা ফুজাইল নিরাশ না হয়ে বারবার তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। অবশেষে লোকটির মধ্যে ভাবান্তর দেখা দিল। সে বলল, দেখুন যেহেতু আমি কসম খেয়েছি আমার প্রাপ্য না পেলে আমি আপনাকে ক্ষমা করব না তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি আপনাকে পুনরায় বিশটি স্বর্ণমুদ্রা ধার দিচ্ছি। আপনি এটা ধার হিসেবে গ্রহণ করে আমাকে পূর্বের লুটে নেওয়া টাকা হিসেবে প্রদান করুন, তাহলে উভয় কুলই রক্ষা হবে।
তিনি হঠাৎ করে বলে উঠলেন, হ্যা! সময় হয়েছে, অবশ্যই হয়েছে। একথা বলতে বলতে তিনি যুগ শ্রেষ্ঠ অলিয়ে কামেল হযরত আবদুল ওয়াহিদ বিন যায়েদ রাদ্বিআল্লাহু আনহুর কাছে গেলেন এবং তাঁর হাতে হাত রেখে তওবা করলেন এবং বায়াত গ্রহণ করলেন।
এবার তাঁর ক্ষমা চাওয়ার পালা। তিনি যাদেরকে লুটেছেন তাদের নাম ঠিকানা ও মালামালের তালিকা বের করে প্রত্যেককে যার যার মাল ও অর্থ ফেরত দিয়ে মাফ চাইতে লাগলেন। তালিকার সর্বনিম্নে ছিল এক খ্রিস্টানের নাম এবং তার লুন্ঠিত দ্রব্য ছিল বিশটি স্বর্ণ্মুদ্রা।
কিন্তু খাজা ফুজাইলের কাছে অত অর্থ ছিল না যা দ্বারা সে ওই সে লোকটির অর্থ পরিশোধ করতে পারে। তাই ঠিকানা মত তিনি লোকটির বাড়িতে যেয়ে বললেন, আমি ফুজাইল ডাকাত। ডাকাতি ছেড়ে দিয়ে তওবা করেছি এবং যার যা মালামাল লুট করেছিলাম সবার কাছে থেকে মাফ নিয়েছি। এখন আপনার কাছে আসার কারণ হচ্ছে আমি আপনার কাছে হতে বিশটি স্বর্ণ্মুদ্রা লুট করেছিলাম।
কিন্তু এই মুহুর্তে আমার কাছে কোন অর্থ নেই। এখন যদি আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেন তাহলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধ করে দেবো। লোকটি বলল, আমার কাছে ক্ষমা নেই, আমি আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না। আপনি চলে যান।
কিন্তু খাজা ফুজাইল বারবার অনুনয় বিনয় করে বলতে লাগলেন, আপনি মাফ করলে আমার জীবনটা কালিমা মুক্ত হবে। সে বলল, যখন বিশটি স্বর্ণমুদ্রা দিতে পারবেন তখন ক্ষমা করে দেব। আমি প্রতিজ্ঞা করেছি, স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া আপনাকে ক্ষমা করতে পারব না।
খাজা ফুজাইল নিরাশ না হয়ে বারবার তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। অবশেষে লোকটির মধ্যে ভাবান্তর দেখা দিল। সে বলল, দেখুন যেহেতু আমি কসম খেয়েছি আমার প্রাপ্য না পেলে আমি আপনাকে ক্ষমা করব না তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমি আপনাকে পুনরায় বিশটি স্বর্ণমুদ্রা ধার দিচ্ছি। আপনি এটা ধার হিসেবে গ্রহণ করে আমাকে পূর্বের লুটে নেওয়া টাকা হিসেবে প্রদান করুন, তাহলে উভয় কুলই রক্ষা হবে।
খাজা ফুজাইল বিন আয়াজ রাদ্বিআল্লাহু আনহুর ওফাতের তারিখটি ছিল ২রা রবিউল আউয়াল ১৯৭ হিজরী। উম্মুল মু’মেনিন হজরত খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিআল্লাহু আনহা এর কবরের কাছেেই তাঁর দেহ দাফন করা হয়।
আপনিও ক্ষমা পেলেন, আমিও আমার পূর্বের মালামাল ফিরে পেলাম। এ বলে সে একটি কাপড়ের থলে তাঁর হাতে ধরিয়ে দিল এবং আবার ফেরত নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেলেন। আর একটু পরে ঐ লোকটি তার স্ত্রী পুত্র কন্যাসহ ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, আমরা আপনার হাতে ইসলাম গ্রহণ করব। আপনি আমাদের কালেমা পাঠ করান।
খাজা ফুজাইল বললেন, হঠাৎ এ পরিবর্তনের কারণ কী? সে বলল, আমরা আমাদের ধর্মগ্রন্থে দেখেছি যার তওবা আল্লাহ্র দরবারে কবুল হয় তার হাতে মাটি স্বর্ণ হয়ে যায়। এটাই পরীক্ষা করার জন্য কিছুক্ষণ পূর্বে আমি যে থলেটি আপনার হাতে দিয়েছিলাম তার মধ্যে ছিল মাটির চাকা ভর্তি।
কিন্তু সে থলেটি নিয়ে আমি যখন ভেতরে গেলাম তখন খুলে দেখলাম ভেতরের মাটি সব স্বর্ণ হয়ে গেছে। অতএব বুঝতে পারলাম যে আপনি স্রষ্টার একজন মনোনীত ও বন্ধু মানুষ। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সৃষ্টিকর্তার একজন বন্ধুর হাতে ইমান এনে জীবনের সমস্ত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করব।
তাঁর অফাত সম্বন্ধে বর্ণিত আছে যে তিনি মক্কায় বসবাস করতেন। এবং একদিন তিনি হালের (বিলীনতা) মধ্যে ছিলেন। এমন সময় এক ক্বারি সাহেব সুরা ফাতেহা পাঠ করছিলেন। তিনি তার সুললিত কণ্ঠের আওয়াজ শ্রবণ করে ঐ হালের মধ্যেই আল্লাহু আকবার বলে চিৎকার দিয়ে উঠলেন এবং জান জানের মালিকের হাতে তুলে দিলেন।
খাজা ফুজাইল বিন আয়াজ রাদ্বিআল্লাহু আনহুর ওফাতের তারিখটি ছিল ২রা রবিউল আউয়াল ১৯৭ হিজরী। উম্মুল মু’মেনিন হজরত খাদিজাতুল কুবরা রাদ্বিআল্লাহু আনহা এর কবরের কাছেেই তাঁর দেহ দাফন করা হয়।
………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ
…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই
হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্ বাবা
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ
বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার
উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি
বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন