ভবঘুরেকথা
মাওলানা রুমি

মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি

মাওলানা রুমি পিতা মাওলানা বাহাউদ্দিন ছিলেন তৎকালীন সময়ের সুলতানুল ওলামা (আলেম সমাজের রাজা)। রাস্তার সামান্য ফকির থেকে শুরু করে রাজ্যের প্রতাপশালী রাজা-মহারাজা পর্যন্ত তার পিতাকে সম্মান করতেন।

শুধু রাজা বাদশাহরা নয় বড় বড় কুতুব, গাউস, আউলিয়ারা মাওলানা রুমির পিতার পায়ের মোজা খোলার জন্য সদা ব্যাকুল থাকতেন। সেই মহান আলেম হযরত মাওলানা বাহাউদ্দিন (র) এর ঘরেই জন্মগ্রহণ করেন ইতিহাসের বিশ্ববিখ্যাত আলেম হজরত মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (র)।

………………….
জন্ম: ৬০৪ হিজরি ৬ই রবিউল আউয়াল খোরাসানের (বর্তমানে আফগানিস্থান ) বলখ রাজ্যে।
পর্দাগ্রহণ: ৬৭২ হিজরি সনের জুমাদাল ওখরা মাসের ৫ তারিখ রবিবার দিন।
পিতা: মাওলানা বাহাউদ্দিন (র)।
সমাধি: তুরুস্কের কনিয়া প্রদেশে।
পদবী: বিশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাওলানা, মারিফতের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
………………….

মাওলানা রুমি প্রাথমিক জীবনে সারাদিন হাদিস, তফসির ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থের কিতাব পাঠে সময় ব্যয় করতেন। সেসময় তার আশপাশে লক্ষ লক্ষ মুরিদান, আলেম, মুহাদ্দিস বসে থাকতেন শুধু তার মুখের একটু বাণী শোনার জন্য।

কিন্তু যখন তার বয়স চল্লিশ তখন শামস তাবরিজ নামের এক পাগল তার দিনের খাওয়া ও রাতের ঘুম হারাম করে ফেলেন। রুমি তখন সকল কিছু ফেলে খালি শামস তাবরিজের পিছনে পিছনে ঘুরতে শুরু করেন এবং শামস তাবরিজের কাছে নিজকে মুরিদ করার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন।

অনেক অনুরোধ-অনুনয়-বিনয়ের পর পরবর্তীতে শামস তাবরিজ তাকে মুরিদ করেন। মুরিদ করার পর ৪০ দিনের এক চিল্লায় নির্জনে তাকে মারিফতের জ্ঞান তার সিনায় ঢেলে দেন। এরপর মওলানা রুমি নীরব ও নিশ্চুপ হয়ে যান, খাওয়াদাওয়া ঘুম সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধু শামস তাবরিজের কথাই স্মরণ করতে থাকেন। মাওলানার পোশাক ছেড়ে দিয়ে সাধারণ ফকিরের পোশাক পরিধান করেন।

শামস তাবরিজের মত পাগলের ভেতর আল্লাহর নুরী জ্ঞানের বিশালভাণ্ডার দেখে মাওলানা রুমি বলে উঠলেন- “ওরে খোঁদার ভাব মিলে নাই মাওলানায়, কি দেখিয়া এত ফালফালায় শরীয়তের হুজুর ব্যাটায়।” শামস তাবরিজের ইশকের টানে মাওলানা রুমির এমন বেহাল দশা হয়ে যাওয়ায় তার ভক্ত মুরিদান এবং তার আপন পুত্র আলাওউদ্দিন শামস তাবরিজকে এই দুনিয়া থেকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র শুরু করেন।

আমিতো মহামিলনের মহাযাত্রার অভিযাত্রী। আমায় কবরে শোয়ালে ‘বিদায়’ জানাবে না, কবরতো ইহকাল-পরকালের মাঝে একটা পর্দা মাত্র অনন্ত আশীর্বাদের ফোয়ারা। তোমরা অবতরণ দেখেছ এবার চেয়ে দেখ আমার আরোহণ। চন্দ্র-সূর্যের অস্তগমন কি বিপজ্জনক? তোমাদের কাছে যেটা অস্তগমন, আসলে সেটাই উদয়ন।

এভাবে অনেক দিন গত হওয়ার পর শামস তাবরিজ ও মাওলানা রুমি একদিন জ্ঞানের আলোচনা করতে বসলে শামস তাবরিজ হঠাৎ করে বলে উঠেন, এখন আমাকে চিরবিদায় দাও হে রুমি! মৃত্যুর দূত আমাকে নিয়ে যাবার জন্য ইশারা দিয়ে ডাকছেন।”

এই কথা বলতে বলতে তিনি একটু সামনে এগুতেই মাওলানা রুমির আপন ছেলে আলাওউদ্দিন ও তার সঙ্গীরা বড় এক খঞ্জর দিয়ে শামস তাবরিজকে পিছন থেকে আঘাত করে। এতে শামস তাবরিজ এত জোরে চীৎকার করেন যে চীৎকার শুনে হত্যাকারিরা সঙ্গে সঙ্গে বেহুশ হয়ে মারা যান।

কিছুক্ষণ পর দেখা গেল সেই জায়গায় শামস তাবরিজের মৃত দেহ আর নাই শুধু পরে আছে ছোপ ছোপ লাল রক্ত, সেদিন মাওলানা রুমি নিজের ছেলের এই দুষ্কৃতি দেখে এতই মর্মাহত হন যে তিনি তার ছেলের জানাজাও পড়েন নি। পরবর্তীতে শামস তাবরিজের বিরহ বিচ্ছেদ ও ইশকে মাতোয়ারা হয়ে রচনা করেন দেওয়ানে শামস তাবরিজমসনবী শরিফ নামক বিশ্বনন্দিত জ্ঞানের কিতাব।

যা বিশ্বের দরবারে আজও সুপরিচিত হয়ে আছে। মাওলনা রুমি (র) এর পর শামস তাবরিজের প্রেমে নিজকে সমর্পণ করে অবশেষে তুরস্কেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। পৃথিবী থেকে চলে যাবার আগে তিনি তার মৃত্যু সম্পর্কে কিছু উক্তি করে গেছেন তা হল-

যেদিন আমি মরে যাব, আমার কফিন এগিয়ে যাবে সেদিন ভেবো না, আমার অন্তর এই ধরাধামে রয়ে গেছে! তোমরা অযথা অশ্রু বিসর্জন দিও না, হা-হুতাশ করো না ‘হায়রে লোকটা চলে গেল’ এই বলে বিলাপ করো না। আমার সমাধিকে অশ্রুজলে কর্দমাক্ত করে দিও না।

আমিতো মহামিলনের মহাযাত্রার অভিযাত্রী। আমায় কবরে শোয়ালে ‘বিদায়’ জানাবে না, কবরতো ইহকাল-পরকালের মাঝে একটা পর্দা মাত্র অনন্ত আশীর্বাদের ফোয়ারা। তোমরা অবতরণ দেখেছ এবার চেয়ে দেখ আমার আরোহণ। চন্দ্র-সূর্যের অস্তগমন কি বিপজ্জনক? তোমাদের কাছে যেটা অস্তগমন, আসলে সেটাই উদয়ন।

 

মাওলানা রুমির গুণাবলী

 

বিশ্ববিখ্যাত মসনবী শরিফ রচনা

মাওলানা রুমি শামস তাবরিজের দেওয়া তার সিনায় মারিফতের ফায়েজ কে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ২২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে রচনা করেন মসনবী শরিফ। যা সুবিশাল ৪০ হাজার লাইনের একটা মহাজ্ঞানের সমাহার। এই কিতাবকে বিশ্বের সকল সুফি, দরবেশরা মানুষের রচিত ২য় কুরআন বলে আখ্যায়িত করেছেন।

 

বিশ্ববিখ্যাত মাওলানা রুমি

মাওলানা রুমি তার মুর্শিদ শামস তাবরিজের সাথে সাক্ষাৎ করার পূর্বে ছিলেন একজন ধর্মভীরু পীর সাহেব। তিনি সারাদিন এতই কিতাব পড়াশুনা করতেন যে সে যেখানেই যেতেন সেখানেই ৭টি উট ভর্তি হাদিস, তাফসির, ফেকা ইত্যাদি ধর্মীয় কিতাব সাথে নিয়ে যেতেন। যাতে তার অধ্যায়ণে কোন প্রকার বিঘ্ন না ঘটে। এই কথা থেকে বোঝা যায় তিনি কত উঁচু পর্যায়ের আলেম ছিলেন।

 

মাওলানা রুমির স্তর

তার বিশ্ববিখ্যাত কিতাব মসনবীর প্রশংসায় বলেছেন যে, “কোরানের সমস্ত মগজ আমি রুমি চেটে খেয়ে ফেলেছি, শুধু তার হাড়গুলি রেখে দিয়েছি শরিয়তের অল্পবুদ্ধির আলেমরূপী কুকুরদের জন্য।” তার এই উক্তিতে বুঝতে আর বাকি থাকে না যে তিনি কোন পর্যায়ের আলেম।

 

বিভিন্ন মনীষীদের ভূয়সী প্রশংসা

রুমির সাহিত্যকর্ম অধ্যয়নের পর এতোকাল দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ইংরেজ সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মকে রীতিমতো পানসে বলে মনে হচ্ছে। তারা এখন রীতিমতো নিক্তি দিয়ে ওজন করছেন কার সাহিত্যকর্মের গভীরতা কতটা। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রিসার্স স্কলার এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিপ্রাপ্ত সামির আসাফ The Poet of the Poets শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছেন, গভীরতার মানদণ্ডে রুমির তুলনায় শেক্সপিয়রের মান হচ্ছে মাত্র ১০ ভাগের এক ভাগ।

পশ্চিমা সাহিত্যিকদের মান প্রসঙ্গে তিনি আরো লিখেছেন, ‘পাশ্চাত্যের গ্যাটে, চসার ও ইমারস পর্যন্ত রুমির প্রভাব প্রতিপত্তি উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এ কথা বলতে দ্বিধা নেই, রুমির সমকক্ষ যেমন গাজ্জালি, গালিব, জামি, সাদি, জিবরান, এমনকি কাজমি, দেহলভি বা জাউকের (Zauk) সাহিত্যকর্মের যে আধ্যাত্মিক গভীরতা লক্ষ করা যায় পশ্চিমা সাহিত্য তার ছিটেফোটাও নেই।

 

রুমি সম্পর্কে বিশিষ্ট অলিদের মন্তব্য

ছোট রুমি যখন বাবা বাহাউদ্দিনের সাথে দামেস্কে ভ্রমণে যাচ্ছিলেন, তখন বিখ্যাত আউলিয়া ইবনুল আরাবি (র) বাবার পিছনে ছোট রুমিকে হাঁটতে দেখে তার ভিতরে অপার জ্ঞানের সমুদ্র অনুমান করে বলেছিলেন, “আল্লাহর কি অপার মহিমা দেখো!!! জ্ঞানের সমুদ্র, জ্ঞানের নদীর পিছে পিছে হাঁটছে”।

শুধু তাই নয় বিশ্ব বরেণ্য আউলিয়া ফরিদউদ্দিন আত্তাব মাওলানা রুমিকে দেখে বলেছিল, “এই ছেলে বড় হয়ে আল্লাহ্ ইশকের সাগরের এমন সব রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হবে যে সারা দুনিয়া তা দেখে হতবাক হয়ে যাবে।”

 

রুমির মৃত্যুতে সকল ধর্মের মানুষের জানাজায় অংশগ্রহণ

মাওলানা রুমি যেদিন দুনিয়া ছেড়ে চলে যান, সেদিন তুরস্কের ইহুদি, নাসারা, খিরিস্তানসহ সকল ধর্মের মানুষ রুমির মৃতদেহের সামনে তাদের নিজ নিজ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা শুরু করে, শুধু তাই নয় একসাথে কাতার বন্দী হয়ে নামাজের জানাজা আদায় করেন।

 

সকল ধর্মের মানুষের মসনবি কিতাব পাঠ

হিন্দু(বৈষ্ণব মতালম্মবি), মুসলিম, ইহুদি, নাসারা, খিরিস্তান সকল ধর্মের মানুষ মাওলানা রুমির কিতাব নিজস্ব আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য পাঠ করে থাকেন। বিশ্বের সকল ভাষায় আজ মসনবি অনূদিত হয়েছে। এ যেন মাওলানান রুমির জন্য সারা বিশ্ব জয়ের এক বিজয় কাহিনী। অনেকে বলে থাকেন রুমির বইই সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনুদূত হয়েছে।

এক কথায় বলতে গেলে রুমির তুলনা রুমি নিজেই, তার তুলনা আর কোন মাওলানার সাথে দিলে সম্পূর্ণরূপে ভুল হবে। রুমি সেই নক্ষত্র যা আকাশে দিনের বেলাও স্তিমিত হয় না।

……………………….
আরো পড়ুন:
মাওলানা রুমির বাণী
রুমির মসনবী: অনুবাদের অপচেষ্টা

………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!