-মূর্শেদূল মেরাজ
হাওরের বড় বড় ঢেউ দেখা মিলছে এখনো। আজ খারাপ দিন তাই মাছ ধরা পরেনি। অনেকে যেতেই পারেনি। তাই আজ আর ঘাটে নৌকা ভিড়ছে না মাছ নিয়ে। তবে প্রতিদিন নাকি অগণিত নৌকা আসে মাছ নিয়ে। বিশাল বিশাল বরফের ট্র্যাঙ্কে সব মাছ চলে যায় ঢাকায় করে এই গ্রাম থেকে। তবুও মাছ ধরে যাদের সংসার চলে তাদের ঘরে তো আর বসে থাকলে চলবে কেন।
এই বৈরি আবহাওার মাঝেও দু-একটা মাছ নৌকা আসতে লাগলো অল্প-সল্প মাছ নিয়ে। সেখান থেকেই রাতে খাবারের জন্য কেনা হলো বিশাল সাইজের চিংড়ি। হাওরের চকচকে চিংড়ি দেখেই মুখে পানি চলে আসে।
উকিল মুন্সীকে নিয়ে আড্ডা… জানি না কিসের জন্য সকলে এই রৌদ্রউজ্জ্বল দিনে হাওর যাত্রা বিরতি দিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে বলে আমাকে গালাগালি না দিয়ে ক্রমে ক্রমেই মুগ্ধ হচ্ছে। সঙ্গে উল্টে পাল্টে আড্ডা চলছে জগতের তাবত বিষয়াদি নিয়ে।
অস্বাধারণ একটা গ্রাম গাগলাজোড়। আমরা ঘুড়ে ঘুড়ে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। জানলাম এই গ্রামের কোনো এক মেয়ের প্রেমে পরে গানও বেঁধেছিলেন উকিল মুন্সী। উকিল মুন্সীর গ্রামও দেখা যায় গাগলাজোড় থেকে। বাবু ভাই মহাখুশি মজিদ মস্টারকে পেয়ে। তিনি এইবার আমাকে ধন্যবাদ দিলেন ফিরে আসবার জন্য। না হলে এমন মানুষের সাথে পরিচয়ই হতো না।
মজিদ মাস্টার আমাদের বাবু মাস্টারকে আচ্ছাদিত করেছে। অন্যদিকে আস্তে আস্তে সকলের মন মেজাজ চাঙ্গা হয়ে উঠছে। গ্রামের সৌন্দর্য… মজিদ মাস্টারের আতিথেওতা… উকিল মুন্সীকে নিয়ে আড্ডা… জানি না কিসের জন্য সকলে এই রৌদ্রউজ্জ্বল দিনে হাওর যাত্রা বিরতি দিয়ে ফিরে আসতে হয়েছে বলে আমাকে গালাগালি না দিয়ে ক্রমে ক্রমেই মুগ্ধ হচ্ছে।
সঙ্গে উল্টে পাল্টে আড্ডা চলছে জগতের তাবত বিষয়াদি নিয়ে। এর ফাকে আমি উকিল মুন্সীর পুত্র ছাত্তারের শিষ্য মঞ্জিলকে খুঁজে বের করলাম রাতে গান শুনবো বলে। আটপৌরে মঞ্জিল এক ফাঁকে এসে আমাদের সাথে পরিচিত হয়ে চলে গেলো।
তারপরও তার গায়কীতে-কণ্ঠের কারুকাজে আমরা সকলে মুগ্ধ… গান পাগল মঞ্জিল এখনো সময় সুযোগ পেলেই গান গাইতে যান… মঞ্জিলকে দেখে আমরা ভাবতেই পরিনি এতোটা সম্মোহিত করতে পারবে সে আমাদের…
বড় বড় চিংড়ি দিয়ে রাতের মজাদার একটা ভোজ দিয়ে ফিরে দেখি মঞ্জিল ট্রলারে অপেক্ষা করছে আমাদের গান শোনাবে বলে। একটু রাত করে আমরা মঞ্জিলের গান শুনতে বসলাম ট্রলারের ভেতরে যাতে বাইরের বেশি মানুষ না চলে আসে। হারিকেনের আলোতে মঞ্জিল নিচু গলায় গান ধরলেন মন্দিরা হাতে। সে আরো যন্ত্রীদের নিয়ে আসতে চেয়েছিল।
কিন্তু আমাদের টাইট বাজেট বড় আয়োজন করা হলে শেষে বিপদে পরতে পারি। তাই মঞ্জিলকে একা নিয়েই বসেছি আমরা। একে একে মঞ্জিল উকিল মুন্সী, ছাত্তার, জঙবাহাদুরের গান শোনালেন আমাদের। শেষে রাস্তায় নেমে মঞ্জিল যখন গান গাইছিল “মান করে রাই কেন আছ একা ঘরে শুইয়া …পুরুষেরে পায়ে দিয়া বেরী থাক দূরে সরিয়া” তখন আমরা তাকে চক্র করে নাচছিলাম… সকল বিষাদ-বেদনা শেষ… ফিরে আসা… ফিরে চলা… কিছুই নয়… এইতো ভবের আনন্দ… এরজন্যই তো আমাদের ঘর ছাড়া…
শাহীন ভাই-এর ভাষায় এটাই এই ট্যুরের হানিমুন… আমরা নাচছি… গান গাইছি… রাত গড়িয়ে চলছে… ফরিদী ভাই ছবি তুলে চলছে… কখনো স্থির… কখনো চলমান… সকলে বলছে কাল যাতে আকাশ পরিস্কার হয়… আমরা যাতে সামনে এগিয়ে যেতে পারি… হাওরে পানি বাড়ছে… বাড়ছে পানির শব্দও… মজিদ মাস্টারের ভাটি বাংলা স্কুলের রাস্তার পাশের জলে আমাদের ট্রলারে হারিকেনের আলো জ্বলছে…
নৌকা দুলছে… আমরা দুলছি… অর্থ কষ্টের কারণে মঞ্জিল গানের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে পারেনি… সে এখন খেটে খাওয়া মানুষ… মুটের কাজ করেন… ভারি ভারি মাল বহন করেন… তারপরও তার গায়কীতে-কণ্ঠের কারুকাজে আমরা সকলে মুগ্ধ… গান পাগল মঞ্জিল এখনো সময় সুযোগ পেলেই গান গাইতে যান… মঞ্জিলকে দেখে আমরা ভাবতেই পরিনি এতোটা সম্মোহিত করতে পারবে সে আমাদের…
এতো কিছুর পরও সকলের ভাবনা একটাই কালকের দিনটা যেনো রৌদ্রজ্জ্বল হয় ; নৌপথ ধরে হাওরে আমাদের পারি দেয়ার কথা প্রায় ২৫০ কিলোমিটার… সেটা যেন সফল হয়… শাহীন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে দোয়া করে দিলো কাল যাই হোক মেরাজ ভাই যেন বলে এগিয়ে চলো সামনের দিকে… এগিয়ে চলো… আমরা নাচছি… জল নাচছে…
আমরা গাইছি… জল গাইছে… উকিল মুন্সী… শাহ্ আব্দুল করিম… সাত্তার… জঙবাহাদুরের গান ছাপিয়ে আবারো আমার মনে পরছে সেই লাইন… “ছোটবেলায় এমন কইরা আমি কত মাছ ধরছি”। আসলে এই শিশুগুলি কি সত্যিই মাছ ধরছে? নাকি আমাদের শৈশবটা অভিনয় করে যাচ্ছে মাত্র? যদি তাই হয় তবে আমরা কার যৌবনটা অভিনয় করে যাচ্ছি?
আমরা কে কার সময় কাটাচ্ছি? কে কার জীবন উপভোগ করছি? আমার জীবনটা তাহলে কে কাটাচ্ছে? কে কাটাচ্ছে আমার সময়কাল? আর কার সময়কাল কাটাচ্ছি আমি? নাহ্ এসব অহেতুক ভাবনা… নিজেকে বুঝ দেই। হাওরের বাতাসই আসলে সর্বনাশের মূল। হাওরের বাতাসেই এই বিভ্রান্তি। অন্যকিছু নয়।
(সমাপ্ত)
<<আফালে গাগলাজোড় : দুই ।। সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-এক>>
……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….
…………………
আরও পড়ুন-
আফালে গাগলাজোড় : এক
আফালে গাগলাজোড় : দুই
আফালে গাগলাজোড় : তিন
………………………..
আরও পড়ুন-
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব এক
ভবঘুরে খেরোখাতা: পর্ব দুই
মনোমোহনের পথে : প্রথম কিস্তি
মনোমোহনের পথে : দ্বিতীয় কিস্তি
মনোমোহনের পথে : তৃতীয় কিস্তি
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি এক
দয়াময় থেকে দয়ালের দরবারে : কিস্তি দুই
শাহান শাহ্’র দরবারে : পর্ব এক
শাহান শাহ্’র দরবারে – পর্ব দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : এক
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : দুই
লোকনাথ বাবার আশ্রম হয়ে মহারাজের আশ্রমে : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- এক
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি- দুই
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : তিন
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : চার
সীতাকুণ্ডের ঝড়ঝড়িতে গড়াগড়ি : পাঁচ
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- এক
নিরা গোঁসাইয়ের মতুয়া মহাসম্মেলন- দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- এক
সাঁইজির ধাম হয়ে পাককোলা- দুই
টকিমোল্লায় গানে আসর
ফর্সা হাজীতে আরেক দফা
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-এক
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-দুই
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-তিন
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-চার
সাঁইজির ধাম হয়ে নহির সাঁইজির হেমাশ্রমে-পাঁচ