ভবঘুরেকথা
খাজা গরিবে নেওয়াজ মঈনুদ্দীন চিশতী

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী

মহান রাব্বুল আলামিন যুগে যুগে মানুষের পথ প্রদর্শন ও সর্বাঙ্গীণ কল্যাণের নিমিত্তে অসংখ্য নবী ও রাসুল পৃথিবীর বুকে প্রেরণ করেছেন। হযরত আদম (আ) থেকে আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) পর্যন্ত একজনের পর একজন নবী ও রাসুলের আগমনের হক সিলসিলা জারি থাকে। নবী-রাসুলগণের ধারবাহিকতা সমাপ্ত হবার পর আরম্ভ হয় বেলায়তের সিলসিলা।

ঠিক তেমনিভাবে পাক-বঙ্গ-ভারত তথা উপমহাদেশে হেদায়তের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন খোরাসানের (বর্তমান আফগানিস্তান) অন্তর্গত সঞ্জর নামক গ্রামে এক আল্লাহর ওলীর আগমন ঘটে। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে যার নাম লিপিবদ্ধ রয়েছে তিনি হলেন আতায়ে রাসুল সুলতানুল হিন্দ গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমেরী সঞ্জরী (রহ) ।

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ১১৩৮ ইংরেজিতে (৫৩৭ হিজরী) মধ্য এশিয়ায় খোরাসানের অন্তর্গত সিস্তান রাজ্যের সানজার নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ খাজা গিয়াস উদ্দীন, মাতার নাম সৈয়দা উম্মুল ওয়ারা মাহেনুর। পিতার দিকে তিনি শেরে খোদা হযরত আলী এবং মাতার দিকে তিনি খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমা জোহরার বংশধর।

মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে বাবা মা উভয়কেই হারান। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী পিতার সান্নিধ্যে প্রাথমিক দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেন। এছাড়া তিনি প্রখ্যাত হাদিসবেত্তা ইমামুল হারামাইন হযরত আবুল মা’আলীর নিকট শরীয়তের বিভিন্ন সূাতিসূক্ষ্ম বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করেন।

কিন্তু খাজা সাহেবের বেলায়েতের কাছে তাদের কোন কৌশলই ফলপ্রসূ হয়নি। বরং তার অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। তিনি আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে অতি অল্প সময়ে এতদঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন সফলভাবে। তার নূরাণী চেহারা, রূহানী তাওয়াজ্জু এবং অলৌকিক ক্ষমতা দেখে অসংখ্য মানুষ ঈমানী সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন

সমরকন্দের প্রখ্যাত আলেম হযরত শরফুদ্দীন ও বোখারার প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত হুসামুদ্দীনর নিকট দীর্ঘ পাঁচ বছর অধ্যয়ন করে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার কৃতিত্বপূর্ণ পূর্ণতা অর্জন করেন।

খাজা মঈনুদ্দিন ছিলেন এক মহান মুবাল্লিগ এবং তাসাউফের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র। যাঁর প্রচেষ্টার ফসল হল ভারতবর্ষে ইসলামের সূর্যের উদয় এবং উদয়ের ফলান্তে এদেশের মানুষ ইসলামের শান্তি লাভ করে। শরিয়ত-মারেফতের আলোতে উদ্ভাসিত হয়ে সত্যিকারের পথ ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ প্রাপ্তি হয়।

তাঁর প্রতিষ্ঠিত তরিকাকে বলা হয় ‘চিশতীয়া তরিকা’। চিশতীয়া তরিকার আদি মুর্শিদ হলেন আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)। আল্লাহর রাসুলের আধ্যাত্মিক শিক্ষা হযরত আলী হয়ে হাসান-আল-বসরীর মাধ্যমে অধীনস্ত সিলসিলায় বয়ে এনেছেন। সিনা-ব-সিনায় চলে আসা এই তালিম হযরত ওসমান হার’নীও লাভ করেন। এই তালিমগুলো লিপিবদ্ধ ছিল না। খাজা মঈনুদ্দিন সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে লিপিবদ্ধ করেন।

খাজা মঈনুদ্দিন আল্লাহর রাসুলের নির্দেশেই আজমিরে শুভাগমন করেন। ভারতবর্ষে চলছিল তখন অত্যাচারী শাসকদের শাসন। তিনি ভারতে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেন। তার হেদায়েতে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। ফলে সেখানকার রাজারা স্বীয় রাজ্য হারানোর ভয়ে মঈনুদ্দীন চিশতী ও তার অনুসারীদের উপর নানারকম অত্যাচার করতে চেষ্টা করে।

কিন্তু খাজা সাহেবের বেলায়েতের কাছে তাদের কোন কৌশলই ফলপ্রসূ হয়নি। বরং তার অনুসারীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়তেই থাকে। তিনি আধ্যাত্মিক ক্ষমতাবলে অতি অল্প সময়ে এতদঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন সফলভাবে। তার নূরাণী চেহারা, রূহানী তাওয়াজ্জু এবং অলৌকিক ক্ষমতা দেখে অসংখ্য মানুষ ঈমানী সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর জীবন ছিল অসংখ্য কারামাতে ভরপুর। একবার হল তিনি সাতজন অগ্নি উপাসকের একটি দলকে অগ্নিকুন্ডের পাশে পূজারত অবস্থায় দেখেন, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হন। অগ্নি উপাসকগণ হযরতের নূরাণী চেহারা দেখামাত্র তার সান্নিধ্যে আসে। মঈনুদ্দিন চিশতী তাদের অগ্নিপুজার উপকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা বলেন-

‘হুজুর আমরা নরকের আগুন হতে রক্ষা পাবার জন্য, এর পুজা করে আসছি।’

তাদের জবাব শুনে তিনি বলেন, ‘ওহে বোকার দল। খোদার আদেশ ব্যতীত আগুনের কোনরূপ কর্মশক্তি নাই। যে প্রভুর আদেশে আগুন কর্মক্ষম, তার উপাসনা না করে কেন তার সৃষ্টির উপাসনায় মত্ত রয়েছ?’

আগুনের পূজারিগণ খাজা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘তাহলে আগুন কি আপনার ক্ষতি সাধন করতে পারে না?’ উত্তরে খাজা সাহেব বললেন, ‘মঈনুদ্দীনের কথা রাখ, খোদার হুকুম ব্যতীত তার পায়ের জুতারও কোনরূপ ক্ষতিসাধন করতে পারবে না।’ এ কথা বলার সাথে সাথে খাজা বাবা নিজের জুতা জোড়া অগ্নিকুন্ডে ফেলে দিলেন।

কিছুক্ষণ পর সবাই দেখল যে খাজা সাহেবের জুতা জোড়া বহাল রয়েছে আগুনে স্পর্শ করেনি। উক্ত আগুনের পূজারিগণ খাজা সাহেবের অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে গভীর আস্থার সাথে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং বহুদিন পর্যন্ত তারা খাজা সাহেবের কাছে অবস্থান করেন।

মঈনুদ্দীন চিশতী ৬৩৩ হিজরীর ৫ রজব দিবাগত রাত অর্থাৎ ৬ রজব সুবহে সাদেকের সময় ৯৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। তার বড় সাহেবজাদা হযরত খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী তার নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন একজন বড় মাপের ওলীয়ে কামেল।

এরকম ওলীয়ে কামেলের ব্যপারে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করছেন, মনে রেখো যারা আল্লাহর (ওলি) বন্ধু, তাদের না কোন ভয় ভীতি আছে, না তারা চিন্তিত হবে। যারা আল্লাহর প্রতি ইমান এনেছে এবং ভয় করতে রয়েছে। তাদের জন্য সুসংবাদ পার্থিব জীবনে ও পরকালীন জীবনে। আল্লাহর কথার কখনো হের-ফের হয় না। এটাই হল মহা সফলতা।

………………………………………..
(সুরা ইউনুছ: ৬২-৬৪)

………………….
পুন:প্রচারে বিনীত : নূর মোহাম্মদ

…………………….
আপনার গুরুবাড়ির সাধুসঙ্গ, আখড়া, আশ্রম, দরবার শরীফ, অসাম্প্রদায়িক ওরশের তথ্য প্রদান করে এই দিনপঞ্জিকে আরো সমৃদ্ধ করুন- voboghurekotha@gmail.com

……………………………….
ভাববাদ-আধ্যাত্মবাদ-সাধুগুরু নিয়ে লিখুন ভবঘুরেকথা.কম-এ
লেখা পাঠিয়ে দিন- voboghurekotha@gmail.com
……………………………….

………………………………….
আরও পড়ুন-
হযরত শাহ্জালাল
নাসির উদ্দিন সিপাহসালার
বাবা খানজাহান আলী
শাহ মখদুম রূপোশ: এক
শাহ মখদুম রূপোশ: দুই

হযরত ছৈয়দ শাহ্ আলী বোগদাদী
হযরত কেল্লা শাহ্‌ বাবা

মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: এক
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: দুই
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: তিন
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: চার
মনসুর হাল্লাজ ফকির সে তো: পাঁচ

বড় পীর আবদুল কাদের জিলানী
হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী
সুলতানুল হিন্দ খাজা গরীবে নেওয়াজ
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-১
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-২
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৩
দিল্লীর নিজামউদ্দিন আউলিয়া-৪
খাজা নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কাশফের নিদর্শন

মুজাদ্দিদে আলফে সানী: এক
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: দুই
মুজাদ্দিদে আলফে সানী: তিন

শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: এক
শেখ বাহাউদ্দীন নকশবন্দী: দুই

ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: এক
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: দুই
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: তিন
ইমাম গাজ্জালী : জীবন ও দর্শন :: চার
সালমান আল-ফারেসী: এক
সালমান আল-ফারেসী: দুই
সালমান আল-ফারেসী: তিন
সালমান আল-ফারেসী: চার

উয়াইস করনি পাগল: এক
উয়াইস করনি পাগল: দুই
উয়াইস করনি পাগল: তিন
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-১
রহস্যাবৃত শামস তাবরিজি: পর্ব-২
মাওলানা শ্রেষ্ঠ জালালউদ্দিন রুমি
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : এক
আত্তারের সাধনার সপ্ত স্তর : দুই
সুফিবাদের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ইবনে আল আরাবী
হযরত বাবা হাজী আলী
খাজা ফুজাইল : ডাকাত থেকে ওলী
সাধক বায়জিদ বোস্তামী
মরমী বুল্লেশাহ্
সারমাদ কাশানি

বাংলাদেশের প্রথম ইসলাম প্রচারক শাহ্ সুলতান
শাহানশাহ রাহাত আলী শাহ
বাবা সিরাজ শাহ্
বাবা হায়দার শাহ্
মদন পাগলার মোরতবা
মোখলেছ শাহর কারামতি
বাবা জাহাঙ্গীর

সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব এক
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব দুই
সৈয়দ আহমদ উল্লাহ মাইজভাণ্ডারী : পর্ব তিন

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!